(৭)

ধর্ম বিশেষত প্রচলিত ধর্ম নিয়ে আগ্রহ আছে। তাই সাগ্রহে প্রায় সব প্রচলিত ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাসীদের দূর থেকে বুঝতে চেষ্টা করি। সে চেষ্টা যে সব সময় সুখকর হয় তা নয় বরং আশাহত শুধু নয়, বেদনাহত হতেই হয় বেশীর ভাগ সময়।

তবুও ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাস নিয়ে লিখতে চেষ্টা করি। সে লেখালেখি গবেষণালব্ধ কিছু নয়। বরং আশেপাশের ধর্মবিশ্বাসীদের বিশ্বাস ও ভড়ং দেখে এবং নিজের সাধারণ ও সহজ বুদ্ধি দিয়ে যা বুঝি সেটাই বোঝাতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করি। জানি অধিকাংশই ক্ষেত্রেই তা উলুবনে মুক্তো ছড়ানো হয় । আবার কখনো কখনো সে উলুবন থেকে উত্থিত উল্লুকের কাঁটায় ক্ষতবিক্ষতও হই। তবুও লিখি-লেখার চেষ্টা করি। কারণ, আমি এমন কোনো কেউকেটা নই যে ক্ষমতার দাপটে কিংবা জনপ্রিয়তার মোহাবিষ্টে মোহিত করে সমাজে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন করে ফেলবো। তাই আমার অবস্থা সেই দূর্বল ভদ্রলোকের চিটাগাং থিওরি বা মোরগের একমাত্র বাঁচার তত্ত্বের মতো।

এক ভদ্রলোকের সাইকেল চুরি গেছে। প্রবল হুঙ্কারে তিনি পাড়া মাতিয়ে তুলে বলছেন,“ আমি মাত্র এক ঘন্টা দেখবো। সাইকেল না পেল চিটাগাং যা করেছিলাম তাই করবো। আমাকে তো চোরে এখনও চেনেনি”। পরে দেখা গেল ভদ্রলোকের দাপট দেখে চোর ভয়ে সাইকেল ফেলে পালিয়ে গেছে। আশেপাশের মানুষজন জিজ্ঞেস করলেন, “ভাই, একটু শুনতে পারি,চিটাগাং কী করেছিলেন?”

ভদ্রলোক বললেন, “দেখেন ভাই, আমি নিরীহ মানুষ। সে বার চিটাগাং আমার সাইকেল হারিয়ে গেল। অনেক অপেক্ষার পরেও যখন সাইকেল পেলাম না , তখন চলে এলাম সাইকেল ছাড়াই”।

বনে শিয়ালের আক্রমন হলো। পশু-পাখিরা যে যার মতো ছুটে পালাল। যারা জীবিত ছিল পরে এসে যার যার পলায়ণের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিল। মোরগের কাছে জিজ্ঞেস করতেই মোরগ বললো,” আমি তোমাদের মতো এতো উপায় জানি না, জানি শুধু গাছে ওঠা। তাই আমি যা জানি, সেটাই করেছি”।

আমার অবস্থাও সেই দূর্বল ভদ্রলোক ও মোরগের মতো। যেটুকু লেখালেখি জানি, তা দিয়েই নিজের বুঝটুকু বোঝাতে চাই। কে বুঝলো আর কে বুঝলো-না, সে দিকে তাকাবার ইচ্ছে কিংবা সময় কোনোটাই নেই।

(৮)

তবুও বিশ্বাস করি বা না-করি, প্রত্যেকের জীবনেই প্রচলিত ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাসীদের আঁচ এসে লাগে ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছায়। কারণ, সমাজ বিবর্তণে প্রচলিত ধর্মকে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই ব্যবহার করা হয়েছে। কেউ স্ব-স্ব ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে আবার অনেকেই নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থের কারণেও। এক সময় ছিল যখন দূরের কোনো প্রভাবশালী ধর্মবিশ্বাসের আঁচ অন্যপ্রান্তে পৌঁছুতে অনেক সময় নিতো। তখন বিশ্বাসের সাথে বিশ্বাসের কিংবা ধর্মের সাথে ধর্মের যে সংঘাত বা দ্বন্ধ তার প্রভাব পড়তে পড়তে অনেক বছর বা যুগ গড়িয়ে যেতো। কিন্তু এখন আর সেটা নেই, পৃথিবীর একপ্রান্তের দাবানলের তাপ নিমিষেই ছড়িয়ে পড়ে অন্যপ্রান্তে।

তাই এখন প্রায় প্রতিটি প্রচলিত ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাসীরা একে অন্যের শুভ-অশুভের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েছে। এতে অসুবিধে যেমন আছে, সুবিধেও তেমনি। শুধুই বিশ্বাস দিয়ে কোনো ক্ষতিকর ও যুগের সাথে সাংঘর্ষিক ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করা সহজেই আর সম্ভব হচ্ছে না এবং হবেও না। নিজের ধর্মবিশ্বাসকে যখনই ঘর থেকে বাইরে বের করার চেষ্টা হবে, তখনি সে বিশ্বাস প্রশ্ন ও মূল্যায়ণের মুখোমুখী হবে। তাকে টিকিয়ে রাখতে হবে যুগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই।

তাই ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপে এবং অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে খ্রিস্টান ধর্মকে আন্দোলনের মুখে পড়তে হয়েছে। হিন্দু ধর্মকে বেদ পরবর্তী সময়ে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে অনেক সংস্কার ও পরিবর্তন করতে হয়েছে। এমনকি এই ঊনবিংশ শতাব্দীতেও বাংলায় হিন্দু ধর্ম অনেক মনীষীদের দ্বারা সংস্কারের চেষ্টা হয়েছে।

কেননা, প্রত্যেক ধর্মের ধর্মসংস্কারকগন হয়ত চেষ্টা করেছিলেন ধর্ম বিশ্বাসকে কিছু অর্থহীন সংস্কার,যুক্তিহীন নিয়মনীতির বাতাবরণ, ইচ্ছে বা লোভ পূরণের ভরসা এবং না-দেখা এক শক্তিমানকে বশ করে নিজের স্বার্থ –সিদ্ধির উপায় থেকে বের করে আনতে। কিন্তু কাজের কাজ বিশেষ কিছু কি হয়েছে? এখনো দেখি ধর্ম পালন মানেই হয় জাগতিক বিষয়-সম্পদ লাভ ও বৃদ্ধির ইতর লোভ, নয়তো বা মৃত্যুর পরে না-দেখা এক জগতে নিজের ইন্দ্রীয় সুখ ও তৃপ্তির আকাঙ্ক্ষা।

(৯)

অথচ এই বংগদেশে মাত্র কিছু দিন আগেও রামমোহন রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ সবাই হিন্দু ধর্মকে এক ভিন্ন ধারায় ও স্রোতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিলেন। হিন্দু ধর্মে কিছু যে সংস্কার হয়নি , সেটা বলা যাবে না। কিন্তু এ কথা বলাই যায়, বিষয়লিপ্সার ইতর লোভ থেকে বুদ্ধিবৃত্তিরচর্চায় ধর্মকে উন্নীত করার যে চেষ্টা ঊনবিংশ শতাব্দীতে হয়েছিল, তার সবিশেষ কার্যকারীতা এখনো সমাজে বিরল। কিন্তু ব্রাহ্ম সমাজের সংস্কার প্রচেষ্টা সফল না হলেও তার রেশ যে হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামিতে আঘাত করেনি একথা বলা যাবে না।

ঠিক এরকম চেষ্টাই করেছিলেন প্রোটেস্টান্ট ধর্মবিশ্বাসীদের পক্ষে লুথার,ক্যালভিন সহ নানা ধর্মসংস্কারকগন। ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসীদের, এমনকি ইভাঞ্জেলিস্ট ও এংলিক্যানদের পক্ষেও ষোড়শ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে এক সংস্কারের জোয়ার এসেছিল। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, আজ যতটুকু সহনশীলতা ও যুগের সাথে তালমিলিয়ে চলার চেষ্টা এই সব ধর্মবিশ্বাসীদের, সে সবের শুরু ওই সময়েই।

এ কথা নিঃসন্দেহে ও নিঃসংঙ্কোচে বলাই যায়, সময়ের সাথে মানুষ বদলায় এমনকি বদলায় প্রকৃতিও। অথচ প্রাচীনকালে প্রচলিত এক বিশ্বাস বা মতবাদ বদলাবে না, সেটা শুধু যুক্তিহীন মূঢ় ধারণাই নয়, এক প্রকার গোয়ার্তুমিও বটে। এই একবিংশ শতাব্দীতে অনেকেই সে মূঢ় সংস্কার ও গোঁড়ামির বেড়াজালেই আবদ্ধ হয়ে নিজেকে তো বটেই অন্যের জীবনকেও বিপন্ন ও বিপদসঙ্কুল করে তুলছে।

যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই যে, প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের মাধ্যমেই অনেকে জীবন যাপনের মহত্ত্ব , ত্যাগ – প্রত্যয় এবং এমনকি নিজেকে বিকশিত করার উপায় খোঁজার চেষ্টা করে থাকেন। অথচ আমাদের চারপাশে লক্ষ্য করলে যা প্রত্যক্ষ করা যায়, তা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এখন ধর্মাচারণ বা ধর্ম-পালনের উদ্দেশ্য ইহলৌকিক এবং তথাকথিত পারলৌকিক লোভ-লালসার প্রার্থণা ছাড়া অন্য কিছু নয়!

ধর্মাবতার বা ঈশ্বর যদি হোন নিস্পাপ ও নির্লোভ এক মহাশক্তির প্রতিভূ,ধার্মিকেরা তবে সেই নির্স্পাপ ও শক্তিশালী ঈশ্বরের কাছে নিজেকে না নিয়ে বরং নিজেদের পঙ্কিল স্বার্থের কাছেই ঈশ্বরকে নামিয়ে এনে ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও শক্তিমত্ত্বাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলছেন। এতে ঈশ্বরের অসারতাই প্রমানিত হচ্ছে- যা অবশ্যই ঈশ্বর বিশ্বাসের সাথে দ্বান্দিক।