-আরজ আলী(জুনয়ির)

ক্ষুদ্র জ্ঞানে যা বুঝি, ধর্মের মূল উপাদান চারটি। যথাক্রমে- ১) ধর্মপ্রবর্তক, ২) ঈশ্বর, ৩) শয়তান এবং ৪) ঐশ্বী বাণী (গ্রন্থ)। ধর্মে বিশ্বাসী হতে হলে এ চারটি মূল উপাদানে সম্পূর্ণ ও প্রশ্নহীন বিশ্বাসী হলেই চলবে না, আমৃত্যু এবং অবশ্য-অবশ্যই হিমালয়ের ন্যায় অটল এবং গর্বিত থাকতে হবে। একবিন্দু দ্বিধা কিংবা সংশয় থাকলে স্বর্গপ্রাপ্তির আশা শেষ। যদিও সন্দেহ-সংশয়, যুক্তিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা, অজানাকে জানার দুর্দমনীয় বাসনা… না থাকলে সত্য জানা সম্ভব না, ধর্মে যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। জানি, তিন নম্বর (শয়তান) ছাড়া অন্য উপাদানগুলো নিয়ে ধার্মিকরা প্রশ্ন তুলবে না। তিন নম্বর নিয়ে উঠবে- “শয়তান কীভাবে ধর্মের উপাদন হলো?” মূলত শয়তান ছাড়া ঈশ্বর এবং ধর্ম দুটোই অসম্পূর্ণ, বরং এরা একে অপরের পরিপূরক। যেমন, শয়তান মানুষকে মন্দ কাজে প্ররোচিত করে, তা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ ঈশ্বরকে ডাকে। ধর্মসৃষ্টিকারীরা হয়তো ভেবেছিলো, শয়তানের ভয়ে মানুষ ঈশ্বর এবং তাদেরকে বেশি বেশি ডাকবে! এজন্যই শয়তানকে তাদের খুব বেশি প্রয়োজন। না হলে শয়তান সৃষ্টি করতোই না। অতএব ঈশ্বর আছে, তাই শয়তানও আছে কিংবা শয়তান আছে, তাই ঈশ্বরও আছে। সেহেতু ঈশ্বর এবং শয়তান দুটোই ধর্মের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। কারণ (ধর্মানুসারে), এ দুটোই মানুষের উপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা রাখে এবং প্রকৃতির উপর প্রভাব খাটানো ছাড়াও মানুষ দিয়ে নিজেদের ইচ্ছামত যা খুশি করতে বা করাতে পারে। আবার, দু’জনেই মানুষকে নিজেদের বাধ্য রাখতে লোভ দেখায়। ঈশ্বর দেখায় স্বর্গের, শয়তান দেখায়- ধন-সম্পদ, নারী, বাড়ি, গাড়ি, ক্ষমতা, দুর্নীতি, লুটপাট… (ধর্মানুসারে নরকের)। মানুষকে লোভে ফেলতে ঈশ্বর ও শয়তানের যেন নিরন্তর যুদ্ধ চলছেই (ভালো বা খারাপ), এ থেকে মানুষের মুক্তির পথ দেখি না! জানি না, বিদ্বানগণ দেখতে বা জানতে পারছেন কিনা! এব্যাপারে ঈশ্বর ও শয়তানের ক্ষমতা প্রায় সমান সমান। যদিও ঈশ্বর এবং শয়তান দুটোই অদৃশ্য ও মারাত্মক ভাইরাস! একইসঙ্গে এ দুটো মানুষের হার্ডডিস্কের (মস্তিষ্কের) প্রচণ্ড ক্ষতি করছে!

যদিও ভালো কিংবা মন্দ, কোনটার জন্যই লোভ দেখানো অন্যায়। যেমন, ভালো ফলপ্রাপ্তির জন্য লোভ দেখানো হলেও কেউ যখন বারবার অকৃতকার্য হয়, তখন ভালোর জন্য লোভেও কাজ হয় না। উদাহরণস্বরূপ, চুরি করা মহাপাপ (নিঃসন্দেহে ভালো কথা)। কিংবা পাপ করলে স্বর্গলাভ হবে না। ধর্ম স্বর্গের লোভ দেখিয়ে চুরি বন্ধ করতে চেয়েছে। কিন্তু হায়! ধর্মের দেখানো লোভেই যদি চুরি বন্ধ হতো, তাহলে স্বর্গের কী প্রয়োজন ছিলো? পুরো পৃথিবীটাই তো স্বর্গ হয়ে যেতো। ভাগ্যিস পাপের ভয়ে বাঙালি চুরি বন্ধ রাখেনি, রাখলে লক্ষ লক্ষ নিরাপত্তা রক্ষি এবং তাদের পরিবারদের ভাতে মরতে হতো! যাহোক- চালাক, ধনী, পুঁজিবাদি, ক্ষমতাধর… চোরদের কথা নয়। বলছি, অতি দরিদ্ররা যখন দিনের পর দিন না খেয়ে থাকে এবং বাধ্য হয়ে চুরি করে, তখনও কিন্তু স্বর্গলোভে কাজ হয় না। তেমনি কোনো জাতি যখন ধন-সম্পদ ও ক্ষমতার লোভে মত্ত থাকে, তখন ধর্মের তথা স্বর্গের লোভে তা বন্ধ করা সম্পূর্ণ অসম্ভব এবং লোকদেখানো। তাছাড়া ধনাসক্তি, ক্ষমতাসক্তি… এসবের ফলাফল নগদ বা তাৎক্ষণিক আর স্বর্গের ফলাফল সম্পূর্ণটাই বাকি এবং অদৃশ্য ও অনিশ্চিত। অতএব, অদৃশ্য লোভের কারণে মানুষ কেনো নিশ্চিত প্রাপ্য ছেড়ে দেবে? যার প্রমাণ বাংলাদেশের মানুষ, এরা যেমন প্রায় শতভাগ ধার্মিক তথা স্বর্গলোভে মত্ত, তেমনি প্রায় শতভাগই দুর্নীতিপরায়ন অর্থাৎ নগদ প্রাপ্তির নেশায় মত্ত। ধন-সম্পদ ও ক্ষমতার লোভ যেমনি মারাত্মক/ভয়ানক হয়ে ওঠে, ঠিক তেমনি ধর্মের লোভগুলোও কখনো কখনো মারাত্মক/ভয়ানক আকার ধারণ করে। ফলে ঈশ্বরের নামে যেমন ধর্মসন্ত্রাস হচ্ছে, শয়তানের নামেও (প্ররোচনায়ও) হচ্ছে। অর্থাৎ শয়তানের হুকুমে যেমন কেউ সন্ত্রাসী হয়, ঈশ্বরের হুকুমেও হয়। পরিপূরক হলেও, এরা একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বিও বটে। যদিও ধর্মানুসারে শয়তান মানুষকে দিয়ে শুধু খারাপ কাজই করায়, ঈশ্বর ভালো কাজ করায়! তথাপিও বহু খারাপ বা মানবতাবিরোধি কাজ আছে, যাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঈশ্বরেরও নির্দেশ থাকে। তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন- শয়তান যদি ঈশ্বরের অনুসারীদের দিয়ে খারাপ কাজ করাতে পারে, তাহলে শয়তান কী ঈশ্বরের চাইতেও শক্তিশালী? অথবা ঈশ্বর যা চায়, এর বিপরীত কাজ শয়তান দ্বারা সাধিত হলে ঈশ্বরের সর্বশ্রেষ্ঠত্ব থাকে কীভাবে?

যদিও ধর্মের একান্ত আবশ্যকীয় চরিত্র হলো- ধর্মসৃষ্টিকারী(রা)। তারাই শয়তান ও ঈশ্বরদের ধর্মের একান্ত ও অপরিহার্য অংশীদার বানিয়ে নিজেরা হয়েছে- সর্বাধিনায়ক। কারণ, ধর্মপ্রবর্তক ছাড়া কোনো ধর্ম আছে কী-না, জানা নেই। তাছাড়া ঈশ্বরের নামের সাথে, তাদের নাম স্মরণ করাও বাধ্যতামূলক। তবে জানি না, ধর্মসৃষ্টিকারীরা শয়তানবিহীন ধর্ম সৃষ্টি করেনি কেনো? শয়তান ছাড়া কেবল ঈশ্বর থাকলে এমন কী এমন ক্ষতি হতো? তাছাড়া ধর্মের এতো শত্রুই বা কেনো? এতো শত্রু নিয়ে কীভাবে ধর্ম অস্থির না হয়ে পারে? কারণ প্রতিটি ধর্মই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে অন্য ধর্মগুলোকে শত্রু মনে করে এবং ধর্মানুসারীদের প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে শিক্ষা দেয়। শত্রু নিধনের জন্য সদা প্রস্তুত থাকতে নিরন্তর প্রচারণা ও পরামর্শ দেয়। শত্রুর সাথে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত থাকতেও পরামর্শ দেয়। ফলে স্ব-স্ব ধর্মশত্রু নিধনের জন্যই সৃষ্টি হচ্ছে নিত্য-নতুন ধর্মদানব কিংবা মহাদানব।

তাহলে কী ধর্মসৃষ্টিকারীদের নিজেদের এবং নিজেদের সৃষ্ট ঈশ্বরদের ক্ষমতার উপর পূর্ণ আস্থা নেই? থাকলে- ক্ষমতাময়, সর্বশক্তিমান, সর্বশ্রেষ্ঠ… হয়েও মানব জাতিকে শাসন করতে এবং ভয় দেখাতে শয়তানের সাহায্য নিতে হচ্ছে কেনো? ধর্মানুসারে জগত ও জীব সৃষ্টি যদি সত্য ধরে নেই, বলতেই হয়- ধর্মসৃষ্টিকারীদের নিজেদের এবং ঈশ্বরদের কারো ক্ষমতার উপরই যেমন আস্থা নেই, তেমনি শুভবুদ্ধিও নেই। সুবুদ্ধি থাকলে অন্তত শয়তান সৃষ্টি করতো না। কেননা, ঈশ্বর সুবুদ্ধির কিংবা মঙ্গলময় এবং শয়তান কুবুদ্ধি বা অমঙ্গলের। অথচ যে মঙ্গলময়, সে নিশ্চয়ই অমঙ্গলকারীকে স্থান দেবে না। হয়তো ঈশ্বর শয়তানের কাছে পরাজিত হয়ে, ক্ষমতা ভাগাভাগি করেছে বা আপোষ করেছে! ফলে পৃথিবীতে কখনো শয়তানের, কখনো ঈশ্বরের রাজত্ব চলছে! নাকি ধর্মসৃষ্টিকারী কিংবা ঈশ্বর জেনেশুনে ও ইচ্ছা করেই শত্রু (শয়তান) সৃষ্টি করেছে, যেন নিজেদের দোষ শয়তানের উপর চাপাতে পারে? কারণ ধর্মানুসারে, ঈশ্বরের কথিত মঙ্গলজনক কাজ, শয়তানের অমঙ্গলজনক কাজের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত এবং বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। প্রকৃত পরোপকারী বা মঙ্গলময় কখনো শত্রু সৃষ্টি করবে না, ভুল করে করলেও চিরস্থায়ীভাবে জীবিত রাখবে না, যে/যারা কিনা তার সৃষ্টির ক্ষতি করে! তাহলে শয়তান সৃষ্টি কি, ধর্মসৃষ্টিকারীদের ইচ্ছাকৃত এবং মারাত্মক ভুল! যার খেসারত দিচ্ছে মানুষ।

তথাপিও, শয়তানকে মুক্ত রেখে অবিশ্বাসীদের জন্য নিশ্চিত নরক বানিয়েছে ধর্মসৃষ্টিকারীরা! বুঝলাম, কিন্তু অবিশ্বাসীরা কী শয়তানের চাইতেও বেশি ক্ষতিকর? তা না হলে- শয়তানকে মুক্ত রেখে অবিশ্বাসীদের নরকে পাঠানোর হুকুম এবং খুনের নির্দেশ কেনো? ধর্মসৃষ্টিকারী এবং ঈশ্বরেরা যদি খুনী হয়, এর চেয়ে বড় লজ্জার আর কী আছে? শয়তানকে ভয় না করে অবিশ্বাসীদের এতো ভয়ই বা কেনো? শয়তানদের জন্য নরক নয় কেনো? মন্দ কাজ বা নিষিদ্ধ খাবার খেলে যদি মানুষের শাস্তি হয়, তাহলে- যে/যারা মানুষকে মন্দ কাজে প্ররোচিত করে, তাদের শাস্তি হবে না কোন যুক্তিতে? সুতরাং, ঈশ্বর সর্বশক্তিমান, দয়াময়, ন্যায় বিচারক ইত্যাদি উপাধির মর্যাদা কোথায়? সব মানুষের শ্রেষ্ঠ মানুষ- ধর্মসৃষ্টিকারীদের মর্যাদাই বা থাকে কীভাবে? কারণ তারা চাইলেই তো কেউই মন্দ কাজ করতে পারে না এবং অবিশ্বাসী/নাস্তিকরাও জন্ম নিতে পারে না। তাহলে? অবিশ্বাসীরা না থাকলে তো তাদের রাজত্ব আরো নিষ্কন্টক হতো- নয় কী? আর শয়তান না থাকলে তো পুরোপুরি নিরাপদে ও নিশ্চিন্তেই থাকতে পারতো। অথচ এক শয়তানই তাদের ঘুম হারাম করে চলেছে (যা আবার চিরস্থায়ী)! যাহোক, হয়তো অবিশ্বাসীদের ব্যাপারে ধর্মসৃষ্টিকারীদের জ্ঞানের অভাব আছে। তারা নাস্তিকদের ধ্বংস চাইলেও, নাস্তিকরা চায় তারা যেন নিজেদের ভুল শোধরায় এবং স্বীকার করে! কারণ ভুল স্বীকারের মধ্যে গৌরব আছে! অস্বীকার করা মানেই বহু ভুলের জন্ম দেয়া, যা তারা চিরকালই অত্যন্ত লজ্জাহীভাবে করেই চলেছে। কারণ তারা যেমন শয়তান সৃষ্টি করে নিজেদের এবং মানবজাতির মহাসর্বনাশ করছে, তেমনি অবিশ্বাসী জন্ম দিয়েও ঝঞ্জাট পোহাচ্ছে। এরূপ দ্বিচারিতার অর্থ কী? আবার অবিশ্বাসী হত্যার হুকুম দিয়েছে, শয়তানকে নয়, বরং ওগুলোকে হৃষ্টপুষ্ট রাখার চিরস্থায়ী ব্যবস্থা! আর এসব বিধান অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে ধার্মিকরা (যদিও সবাই নয়), যাতে রাষ্ট্র ও সমাজের সমর্থন ষ্পষ্ট। যা মারাত্মক অন্যায়। এজন্য ধর্মসৃষ্টিকারী এবং ঈশ্বরেরা নরহত্যার দায়ে দোষী। অতএব, এসব তাদের সর্বশ্রেষ্ঠত্বের লক্ষণ নয় বরং কাপুরুষতার লক্ষণ। তারা এতোই কাপুরুষ যে, অবিশ্বাসীদের সামান্যতম সমালোচনাও সহ্য হয় না, যুক্তি মানবেই না। সুতরাং যুক্তি ও ভুল স্বীকারে অবিশ্বাসীরা তাদের চেয়ে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ। মূলত এবিষয়ে ধর্মসৃষ্টিকারী এবং ঈশ্বরেরা সর্বশ্রেষ্ঠ স্বৈরাচার।

যাহোক, কতোজন ধার্মিকের মধ্যে আমরা নম্রতা ও শুচিতা দেখতে পাই? কতোজন আছেন, যারা শুচিশুভ্র চিত্তের? ঘরের ও শরীরের ময়লা বারবার পরিষ্কার করলেই শুচিশুভ্র হওয়া যায় না। ধর্মকর্মে বসার পূর্বে গোসল কিংবা হাতমুখ ধুয়ে ধর্মকর্ম করলেই শুচি হয়ে গেলাম… এমন দৃঢ় বিশ্বাস বোকামি ছাড়া কিছু নয়। যা বর্তমানের ধার্মিকদের মধ্যে খুবই স্পষ্ট।

যেমন কবিগুরু বলেছেন, “…পাওয়া এক জিনিস, আর সেই পাওয়া ব্যাপারটাকে বিশ্লেষণ করিয়া জানা আর এক জিনিস।” মানুষ যেমন ধর্ম, ধর্মবতার ও ঈশ্বরদের পায় বংশপরম্পরায়, মোটেও জানার মাধ্যমে নয়। পেয়েই খুশি, জানার চেষ্টা নেই, সংশয় নেই, প্রশ্ন নেই; আছে শুধু দাম্ভিকতা, গোড়ামি, পুলক, উম্মাদনা… ইত্যাদি। বিশ্লেষণ করে সত্যাসত্য খোঁজার প্রয়োজন মনে করে না। ফলে ধর্মকর্ম যেভাবে চলে, ঘুষ-দুর্নীতিও সমান তালে চলে। এর বহু উদাহরণ দেয়া যায়। যেমন, পকেটে ঘুষের টাকা নিয়ে ধর্মালয়ে যেতে দেখেছি, ফিরে এসে আবার ঘুষের টাকা পকেটে পুরতে দেখেছি। অনর্গল মিথ্যা এবং ঘুরিয়ে-প্যাচিয়ে কথা বলার মানুষে সমাজ পূর্ণ। এরা ঠিক সময়মত ধর্মকর্ম করছে, অথচ ঘুষ-দুর্নীতিও সমানতালে চালাচ্ছে। এরা ধর্মের একবিন্দু-বিসর্গও ভুল করে না। তারপরেও সমাজ ও রাষ্ট্রের দৃষ্টিতেও এরাই ভালো মানুষ, কারণ এরা ধার্মিক এবং ধর্মের জন্য প্রচুর খরচও করে! তাই মনে হয়, ভদ্রভাবে লুটেপুটে খাবার ও সম্মান বজায় রাখার প্রধান অস্ত্রটির নাম- ধর্ম।

জানি না, রাষ্ট্র ধার্মিক হলে মানুষের উপকার কী? হয়তো নিজেরা ধার্মিক, তাই রাষ্ট্রকেও ধার্মিক বানাতে ও রাখতে হবে! সম্ভবত, রাষ্ট্র ধার্মিক হলে- দুর্নীতিবাজ জাতির বদনাম না ঘুচলেও, আত্মগরিমা, অহংকার, মর্যাদা… ইত্যাদি বাড়ে! এবিষয়ে বিদ্বানরাই ভালো বলতে পারবেন! তবে এটা বুঝি, তখন রাষ্ট্রধর্মের প্রতি রাষ্ট্রের বেশকিছু দায়িত্ব বেড়ে যায়। প্রধান দায়িত্ব- স্বধর্মের নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা বা সুরক্ষাসহ সর্বোচ্চ সম্মানিত স্থানে রাখা। ফলে মানুষ যেমন ধর্মমাতাল, তেমনি রাষ্ট্রও ধর্মমাতাল হয়। এ রাষ্ট্রগুলো তখন স্বধর্ম রক্ষায় যতোটা আগ্রাসী, মানবাধিকার রক্ষায় ততোটা অনাগ্রহী (যা এদেশসহ বহু দেশেই বিধর্মী নির্যাতন, বিতাড়ন, জমি/বাড়ি দখল, ধর্ষণ, লুটপাটে… প্রমাণিত)। এছাড়াও পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রায় সর্বত্রই ধর্ম ঢুকিয়ে বিধর্মীদের তা শুনতে/জানতে বাধ্য করে। রাষ্ট্র তার ধর্মের প্রতি একপেশে সমর্থন, প্রয়োজনে কঠিন আইন প্রয়োগ করে, যাতে বিধর্মী/নাস্তিকরা কোণঠাসা হতে বাধ্য। ফলে সংখ্যাগুরু সমপ্রদায়ের অশিক্ষিত, শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী, পণ্ডিত… পর্যন্ত প্রায় সকলেই অন্যরকম এক অনুভূতিতে মত্ত থাকে, যার নাম দেয়া যেতে পারে- ধর্মোম্মাদনা বা ধর্মমাতাল। কথিত এ উম্মাদনায় সামান্যতম আঘাত লাগলেই উগ্রতা হিমালয় ছাড়িয়ে যায়। আর যদি বিশেষ কেউ (ধর্মব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, সমাজপতি…) তা উষ্কে দেয় তাহলে তো কথাই নেই, প্রলয়ংকারী তান্ডব শুরু হয় পুরো রাষ্ট্র জুড়ে (যার অজস্র ছোট-বড় প্রমাণ আছে এবং যা চলমান)। বেশি বড় রকমের অপবাদ কিংবা আঘাত লাগলে, তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে অন্যান্য স্বধর্মী রাষ্ট্র্রগুলোতেও। দুঃখের বিষয়, মানবানুভূতিতে এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আঘাত লাগলেও কিন্তু এরা উম্মাদ কেনো, বেশিরভাগই সাধারণ প্রতিবাদটুকুও করে না। তথাপিও রাষ্ট্র ও সমাজ ওইসব পুরানো বিশ্বাসকেই বাঁচিয়ে রাখতে মরিয়া। কারণ শুধুমাত্র ধর্মজীবিরাই নয়, বরং রাষ্ট্র ও সমাজের নেতারা ধর্মের কাছ থেকে যেসব বৈধ-অবৈধ এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সুযোগ-সুবিধা পায়, তা অন্য কোনো কিছু থেকে পায় না। যদিও ধর্মরাষ্ট্রের নাগরিকরা নীতি-নৈতিকতায় পৃথিবীর সবচাইতে বেশি সৎ তথা সুনাগরিক হওয়ার কথা! কিন্তু ধর্মরাষ্ট্রগুলোতে এর ১% সুফলও কী দেখতে পাই? নাকি উল্টা কিছু দেখতে পাই?

অথচ অতি অল্পসংখ্যক যারা ধর্ম বিশ্বাস করে না, ধর্মরাষ্ট্রের বিরোধিতা করে, কুসংষ্কারের প্রতিবাদ করে… তারাই বরং ছলেছুতায় আক্রান্ত হয়। যেহেতু ধর্মের দোহাই দিয়ে আক্রমণ করার চেয়ে মারাত্মক আক্রমণ আর যে হতেই পারে না। কারণ ধর্মের আক্রমণের কাছে পরমাণু বোমাও পরাজিত হতে বাধ্য হবে। অথচ যারা ধর্ম মানে, তারা চরম থেকে চরমতর দুর্নীতি করলেও সাচ্ছন্দ্যে ও বিলাসী জীবনযাপন করছে। এর কারণ, ধার্মিক এবং ধর্মরাষ্ট্রগুলোর মূল শক্তি বহু পুরানো কিছু বিভ্রান্তে ভরা পুস্তক, যা সঠিকভাবে পড়লে গোমড় ফাঁস হওয়ার কথা কিন্তু প্রায় সকলেই তা না পড়েই পবিত্র ও মহান মানছেন! মূলত মতলবাজ ও দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিরাই নিজেদের দুর্বলতা, চাতুরি, নানাবিধ অপরাধ ঢাকতে ধর্মকে সুরক্ষিত রাখে, বিশেষ করে এর উগ্রতা (কথিত ধর্মানুভূতি) কাজে লাগায়। ফলে দেশ যেভাবে ধর্মালয়ে ভরে উঠছে, যেভাবে ধার্মিকদের সংখ্যা বাড়ছে, সেইহারে সৎ লোক বা সততা বাড়ছে না বরং কমছে! তাহলে কী ধর্ম সৎ মানুষ বানাতে ব্যর্থ? কারণ ধর্মানুসারে ধার্মিকতা বাড়লে সততাও বাড়ার কথা, কিন্তু বাস্তব কী সেকথা বলে?

তবে বুঝি না, মানুষ কেনো ধর্ম রক্ষার জন্য এতো নৃশংস্য হয়? কারণ দেখা যাচ্ছে, ধর্মদানবরা হত্যাযজ্ঞের ধরণ পাল্টিয়ে নৃশংস্য থেকে নৃশংস্যতর হচ্ছে এবং বিরামহীনভাবে দানবীয়তা ঘটিয়েই চলেছে। অন্যদিকে প্রতিটি হত্যাযজ্ঞের পর জ্ঞানীগুণিরা ধর্মরক্ষার জন্য উঠেপড়ে লাগে। একই সুরে একই গান গায়- হত্যাকারীদের সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই, এরা খাঁটি ধামির্ক নয়, এরা প্রকৃত ধর্ম জানে না, ধর্মে এসব নেই, ধর্ম এসব বলে না…! প্রশ্ন- তাহলে ধর্মে আছেটা কী? বলেই বা কী? খাঁটি ধার্মিকই বা কী? যুগযুগ ধরে একই প্যাঁচাল না পেড়ে, যুক্তিসহকারে ব্যাখ্যা করে বলুন তো, কথিত পবিত্র(!) শাস্ত্রের কোন কোন আদেশ-নির্দেশ ধর্মদানবরা লংঘন করছে এবং আপনারা কথিত খাঁটি ধার্মিকেরা কী কী পালন করে খাঁটি(!) ধার্মিক হয়েছেন? জানি না, মহাসত্য(!) ধর্ম পালন করে কীভাবে একজন খাঁটি ধার্মিক হয়, আর একজন খাঁটি দানব হয়! আপনার উভয়পক্ষ (ধর্মজঙ্গি ও কথিত খাঁটি ধার্মিক) কী একই ধর্মপুস্তক, একই ঈশ্বর, একই ধর্মপ্রবর্তকের অনুসারী নন? তাহলে কেনো ধর্মের বাণী ও নিয়ম-কানুনগুলো নিয়ে একমত হতে পারছেন না? যা মহাসত্য(!) তা কেনো সার্বজননীন বা সর্বত্র একই কর্মকাণ্ডে বিশ্বাসী নয়? কেনো একটি সুনির্দিষ্ট মত মেনে চলতে পারছেন না? অর্থাৎ কেউ কারোটা নিয়ে সমালোচনা করবে না, দাঙ্গা বাধাবে না, কেউ কাউকে মারার জন্য চাপাতি হাতে ঘুমাতে যাবে না, কোনো গোষ্ঠি, অন্য গোষ্ঠিকে অতর্কিতে আক্রমণ করবে না (যদিও এগুলো ঐতিহাসিক সত্য এবং ধর্ম সমর্থিত), ধর্মযুদ্ধগুলো পাঠ্যপুস্তকের কিংবা ধর্মশিক্ষার অংশ হবে না (কারণ যুদ্ধ যে কারণেই হোক, তা মঙ্গলজনক নয়)…। অর্থাৎ যে ধর্মমত হবে অত্যন্ত মানবিক ও সকলের কাছে সমানভাবে প্রিয়। বিধর্মীদের ধর্মের সাথে একমত হওয়ার কথা বলছি না, কেবলমাত্র স্বধর্মীদের মধ্যে এই কাজটি করতে পারবেন কী? চ্যালেঞ্জ দিলাম, কোনোদিনও পারবেন না। যদি পারেন, পিতা-মাতার দিব্যি রইলো, অবশ্যই ধর্মদানবদের তরবারির নিচে মাথা পেতে দেবো। পারবেন না কারণ- যে বিশ্বাস সত্য নয়, তার ফলাফলও সত্য-সুন্দর হতেই পারে না এবং তাতে হাজার হাজার বিভ্রান্তিকর ব্যবস্থা, প্রথা, ব্যাখ্যা, বিতর্ক তথা কুসংস্কার থাকে; যা নিয়ে কোনো বিশ্বনেতা কিংবা কথিত মহামানব অথবা কথিত বিশ্বসেরা ধর্মগুরুরাও একমত হতে পারেনি এবং ভবিষ্যতেও সম্ভব না। অতএব ধর্মগুলো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত দানব ও মহাদানব সৃষ্টির পথও কখনোই বন্ধ হবে না।

যদিও যুদ্ধ-দাঙ্গা পৃথিবীর জঘন্যতম কাজ অথচ এ নিয়েই ধর্মগুলো যখন গর্বিত হয়, মহিমা-গৌরব করে, উৎসাহ দেয়; তখন নিশ্চয়ই এর আদেশদাতাগণের (ধর্মপ্রবর্তক ও ঈশ্বর) ধৈর্য-সহ্য ও ক্ষমতার বিষয়গুলো পরিষ্কার। কোনো তারা কথিত ‘ন্যায়’ প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধের বিকল্প খুঁজে পায়নি? এতো বিশাল ক্ষমতাধর, সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বমহান ধর্মপ্রবর্তক ও ঈশ্বরদের কিনা অস্ত্র ধরতে হয়েছে, বানর পিটিয়ে মানুষ করার জন্য? অর্থাৎ মানুষদের বিধর্ম থেকে স্বধর্মে আনতে এবং পাপমুক্ত রাখতে অস্ত্র হাতে যুদ্ধে নামতে হচ্ছে কিংবা শাস্তির ভয় দেখাতে হচ্ছে! এর চেয়ে লজ্জার, অপমানের, অসহায়েত্বর, কাপুরুষতার… আর কী হতে পারে? সুতরাং ঈশ্বর ও ধর্মনির্মাতা এবং বর্তমানের ধর্মজীবি, যারা ধর্ম রক্ষার উছিলায় যুদ্ধ-দাঙ্গা বাঁধায়, সমর্থন করে, ধর্মযুদ্ধের ইতিহাস পড়ে গর্বিত হয়, প্রশংসা করে, প্রচার করে… এরা সকলেই মানবতাবিরোধি অপরাধে দোষী! না হলে- কেনো নয়? অথচ মানবাধিকার এবং রাষ্ট্রের আইনে যুদ্ধবাজ খুনিরা অপরাধী হলেও, ধর্মযুদ্ধ-দাঙ্গা সৃষ্টিকারীরা (ঈশ্বর-ধর্মপ্রবর্তক) নিরাপরাধ কীভাবে? কেউ তাদের বিচার চাওয়া দূরে থাক, বরং প্রশংসা করে। যদিও যুদ্ধ মানেই খুন করা, নয় খুন হওয়া। তাই যারা যুদ্ধ করে (সৈনিক) তাদের চেয়ে আদেশদানকারীরাই জঘন্যতম অন্যায়কারী তথা পাপী। কারণ, যাদের দেখে মানুষ অনুপ্রাণিত হয়, তারাই যদি যুদ্ধাংদেহী হয়, যুদ্ধের আদেশ-নির্দেশ দেয়, তাহলে মানুষের দোষ কী? রাজপ্রাসাদে মহাবিলাসী জীবন-যাপনে অভ্যস্ত রাজা (বর্তমানের শাসকরা), যারা যুদ্ধের হুমকি দেয় ও বাঁধায় তারাও একই রকমের পাপী। কারণ ধর্মযুদ্ধকারীরা যুদ্ধে জয়ী হলে যেমন ঈশ্বরের প্রশংসা করে, তেমনি যুদ্ধবাজ রাজনৈতিক নেতারাও জয়ী হলে ঈশ্বরদের ধন্যবাদ দেয়, আর জীবিতদের কথিত বীর উপাধি দিয়ে গর্বিত করে! কিন্তু যুদ্ধ মানেই বহু খুন ও বহু কান্না। অথচ এ খুনে কারো মনেই কোনো পাববোধ হয় না, কেনো? কারণ সব ধর্মেই তো নরহত্যা মহাপাপ! তাহলে? যুদ্ধে কী শুধু কথিত শত্রু হত্যা করা হয়, নাকি সাধারণ মানুষই বেশি হত্যা করা হয়? তর্ক এড়াতে ধরে নিলাম- যুদ্ধে শুধু শত্রু (বয়ষ্ক যোদ্ধা) খুন করার আদেশ-নির্দেশ রয়েছে, কিন্তু তা তো নয়, এতে বরং বেশিরভাগই নিরাপরাধ শিশু ও নারী খুন হচ্ছে। বছরের পর বছর ঘরবাড়ি ছেড়ে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহায় সাধারণ মানুষই। অতএব, কথিত ন্যায়ের যুদ্ধ বলে কিছু নেই, যুদ্ধ মানেই মহা অন্যায়, মহাপাপ। হোক তা কথিত ধর্মের জন্য বা রাষ্ট্রের জন্য। বিশেষ করে ধর্মযুদ্ধকে যারা ‘ন্যায়ের যুদ্ধ’ বলেন, তারা নিকৃষ্টতম মনমানসিকতার অধিকারী তথা ইতর প্রবৃত্তির। অতএব, নরহত্যার জন্য যুদ্ধবাজ শাসক যেমন দোষী, তেমনি যুদ্ধবাজ ঈশ্বর এবং ধর্মসৃষ্টিকারীরাও দোষী। মানুষের পাপমুক্তি ও অন্যায়ের কথা এরা যতোই বলুক, নিজেদেরই পাপবোধ নেই। তা না হলে- কথিত মঙ্গলময়, দয়াময়, শান্তিময়, প্রেমময়… ঈশ্বর ও ধর্মসৃষ্টিকারীই কখনোই, কোনো অবস্থাতেই যুদ্ধের আদেশ দিতো না।

তাছাড়া, ঐতিহাসিক বহু যুদ্ধ-দাঙ্গার কাহিনী পড়ে মনে হয়, এসব ধর্মের অপরিহার্য অঙ্গ; যা নিয়ে ধর্মপ্রতর্ক এবং অনুসারীদের গর্বের সীমা-পরিসীমা নেই। কী চমৎকার! এক ধর্ম, অন্য ধর্মের সাথে যুদ্ধ করে রাজ্য জয় করেছে, সব পুরুষ খুন করেছে, তাদের গরু-ছাগল, ধন-সম্পদ এমনকি নারী ও শিশু লুটে নিয়ে ভাগবণ্টন করে নিয়েছে… স্বধর্ম অর্থাৎ খাঁটি ধর্ম, সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম, মহাধর্ম… প্রতিষ্ঠা করেছে (যা এখনো চলমান)! কী করে যে এমন যুদ্ধ-দাঙ্গার ইতিহাস মহান ও গৌরবের হলো, সুখপাঠ্য হলো, শিক্ষার অন্যতম বিষয় হলো- একদমই বোধগম্য নয়। ফলশ্রুতিতে, ধর্মে-ধর্মে প্রকাশ্যে যে ঐক্য তা সাময়িক এবং লোকদেখানো কিন্তু যুদ্ধ, বিবাদ, সংঘর্ষ, লুটপাট, ধর্ষণ, সামপ্রদায়িকতা, ঘৃণা… চিরস্থায়ী (ঐতিহাসিক বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে)। আবার এসব যুদ্ধের কাহিনী পড়েই অনেকে ডিগ্রি লাভ করে। আগেও বলেছি, যুদ্ধ কখনোই মঙ্গল বয়ে আনে না, যুদ্ধ মানেই রক্তপাত, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ…। অথচ দেবতা থেকে শুরু করে বিশেষ বিশেষ ধর্মের প্রায় প্রতিটি ঈশ্বর এবং ধর্মপ্রবর্তকই যুদ্ধের নির্দেশদাতা অথবা সমর্থক। অর্থাৎ তারা মুখে যা-ই বলুক, যুদ্ধ করে শান্তি আনায় বিশ্বাসী, শান্তির পথে শান্তি আনায় বিশ্বাসী নয়। অনেক দেবতা ও ধর্মপ্রবর্তক শুধু হুকুম দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, নিজেরাও সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে। ঈশ্বরেরাও কথিত স্বর্গদূত পাঠিয়ে সাহায্য করেছে! যা ধার্মিকরা অত্যন্ত গৌরবের বিষয় বলে গর্ব করেন, প্রশ্নহীনভাবে বিশ্বাসই শুধু নয়, বুক ফুলিয়ে প্রচারও করেন। অতএব, ধর্মযুদ্ধের ইতিহাস তথা যুদ্ধ বিজয়ের কাহিনী নিয়ে ধার্মিকরা যেভাবে গর্বিত, এতে মনে হয়- যুদ্ধ যেন ধর্মরক্ষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। যেন যুদ্ধ করেই ধর্ম রক্ষা ও বিস্তার ঘটানো সম্ভব (যা চলমান), অন্য কোনো উপায় তাদের হাতে নেই! এটাই যদি সত্য হয়, তাহলে- এরা কীসের সর্বশক্তিমান ও সর্বশ্রেষ্ঠ?

ফলে ধার্মিকদের দৃঢ় বিশ্বাস, দেবতা ও ধর্মপ্রবর্তকরা যেহেতু যুদ্ধ করেছে, সেহেতু তাদেরকেও এরকম একটি নৃশংস্যতম, মানবতাবিরোধি প্রথার সমর্থন ও প্রশংসা করতে হবে এবং ধর্মের ব্যাপারে সদাই যুদ্ধাংদেহী থাকতে হবে, নতুবা ঈশ্বর আশির্বাদ করবে না, ধার্মিক থাকা যাবে না… ইত্যাদি। সুতরাং এক ধর্মের অনুসারীরা যখন অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে কীভাবে, কখন, কোথায়, কতো অল্প সৈনিক নিয়ে ঐতিহাসিক যুদ্ধ জয়ের কাহিনী শোনায়, টিটকারী মারে… তখন পুনরায় নতুন করে যুদ্ধ-দাঙ্গা লেগে যাওয়ার শতভাগ সম্ভবনা থাকে। কেননা মানুষের মন থেকে অনেক পুরানো ক্ষত (দুঃখ-ব্যাথা…) চিরতরে বিলীন হতে পারে কিন্তু ধর্মের ক্ষত কখনোই শুকায় না, মৃত্যু পর্যন্ত জ্বলন্ত থাকে। অথচ ধর্মজীবিদের অন্যতম প্রধান কাজ হলো- ওইসব যুদ্ধ-দাঙ্গার ঘটনাগুলো বারবার এবং গর্বভরে শ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত হিসেবে জনগণকে জানান দেয়া। অর্থাৎ শত-সহস্র বছরের পুরানো যুদ্ধ-দাঙ্গার কাহিনী শুনিয়ে সাধারণ মানুষদের স্বধর্ম রক্ষায় উজ্জিবীত রাখা। শুধু তাই-ই নয়, ধর্মপুস্তকেও এর গৌরবগাঁথা রয়েছে, যা পড়ে বহু মানুষই মনে মনে যুদ্ধ-দাঙ্গার জন্য তৈরি থাকতে কিংবা দানবও হতে পারে। এর ফলে যখন-তখন যেকোনো সময় সামপ্রদায়িকতার বিস্ফোরণ অতি সহজ (যা নির্ভুল, প্রামাণিত ও চিরস্থায়ী সত্য)। ক্ষুদ্র জ্ঞানে বুঝি, এর থেকে মুক্তি পেতে হলে, কথিত ‘পবিত্র যুদ্ধের’(!) সব ইতিহাস ধর্মপুস্তক ও পাঠ্যপুস্তক থেকে সম্পূর্ণরূপে মুছে ফেলতে হবে এবং ধর্মজীবিরা কখনোই এসব প্রচার করতে পারবে না অর্থাৎ বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে এসব শেখানো সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করতে হবে।

যদিও উচ্চশিক্ষিত রাষ্ট্রনায়ক থেকে বিদ্বানগণ এবং ধর্মজীবিসহ সাধারণ জ্ঞানীরা প্রায়ই বলেন, সন্তান যেন জঙ্গি না হয় সেজন্য পিতামাতাকে সতর্ক থাকতে হবে। কিন্তু তারা একথা বলেন না যে, ধর্মের মধ্যে যেসব কুসংস্কার ও বিভ্রান্তি এবং যুদ্ধ-দাঙ্গার ইতিহাস রয়েছে, যেসব দৃষ্টান্ত অতি গৌরবের সাথে সন্তানকে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ ও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হোক। ধর্মপুস্তক সংশোধনসহ যাবতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও এসব নিষিদ্ধ করা হোক! কারণ ওখানেই সন্তান জঙ্গি হবার সর্বোত্তম শিক্ষা রয়েছে। তারা বলেন না, ধর্মের মধ্যে শয়তান রয়েছে (যে/যারা মানুষকে বিপথে চালায়), সেই শতয়ানকে ধর্ম থেকে বহিষ্কার করা হোক! অর্থাৎ ঈশ্বরের কথিত পবিত্র(!) বাণীগুলোও সংশেধন করা হোক। যেসব তথাকথিত ঐশ্বী বাণী শুনে এক ধর্মালম্বীরা অন্য ধর্মালম্বীদের অধার্মিক ভাবে, ছোট ভাবে, হীন কিংবা জঘন্য ভাবে, ঘৃণা করে, শত্রু ভাবে… ধর্ম থেকে ওইসব বাক্য/শব্দ সম্পূর্ণরূপে মুছে ফেলা হোক! না হলে, সন্তানকে আপনি যতো ভালো শিক্ষাই দিন, যতো ভালো স্কুল-কলেজে পাঠান, চোখে-চোখে রাখেন… এক সময় না এক সময় তাকে ছেড়ে দিতে হবে। তারা যখন স্বাধীনভাবে সমাজে মিশবে, তখন যে পরিবেশ ও পরিস্থিতির শিকার হবে না, এমন গ্যারান্টি কোথায়? কারণ যে সমাজে সব শিক্ষার মূল শিক্ষা- ধর্ম, যে সমাজে শিশু বয়স থেকে ধার্মিক বানানো হয় এবং আজীবন ধার্মিক রাখা হয়, সেই সমাজে সন্তানকে চোখে-চোখে রাখলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমনটা আশা করা আর উম্মাদের সঙ্গে থাকা সমান। তবে ধর্মশিক্ষার পরিবর্তন না করে, সন্তানকে চোখে-চোখে রেখে জঙ্গি হবার সম্ভাবনা কমানো কিংবা দমানো গেলেও নির্মূল করা কিংবা সুন্দর মনমানসিকতার সন্তান তথা জাতি গঠন করা অসম্ভব। কারণ বীজ এবং শিকড় থেকে গেলে চারা তো গজাবেই।

যাহোক, নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপাতে হলে- কাউকে তো লাগবেই। হয়তো তাই ধর্মসৃষ্টিকারীরা শয়তান বানিয়ে সব দোষ ওটার ঘাড়ে চিরস্থায় এবং চিরদিনের জন্য চাপিয়ে দিয়েছে। যেমন শয়তান রোগ-শোক ছড়ায়, যুদ্ধ বাধায়, ঝড়-বন্যা, দুর্ভিক্ষ, মহামারী… ইত্যাদি সৃষ্টি করে। অথচ এটাও বিশ্বাস করা হয়, ঈশ্বর না চাইলে শয়তান কিছুই করতে পারে না! তাহলে কী শয়তান যখন মানুষের বিরুদ্ধে এসব করে, তখন ঈশ্বর নাকে ঘি মেখে ঘুমায়? নাকি শয়তান ও ঈশ্বরের সাথে বোঝাপড়া হয়েছে, তুই যখন কাজ করবি আমি বাধা দেবো না, আমি যখন করবো তুই বাধা দিবি না…! কী চমৎকার বোঝাপড়া তাই না? অন্যদিকে, ঈশ্বরেরা যেমন নিজেদের দোষ চাপানোর জন্য শয়তান সৃষ্টি করেছে, মানুষও তেমনি স্বধর্মের দোষ, অন্য ধর্মের উপর চাপিয়ে নিজেরটা জায়েজ করছে। উদাহরণস্বরূপ, এক ধর্মের কুসংস্কার প্রশ্নে অন্য ধর্মের তুলনা টেনে বলা হয়- অন্য ধর্মে দাসত্ববাদ আছে, যুদ্ধ-দাঙ্গা আছে, বিভক্তি-বিভ্রান্তি-বিতর্ক আছে, নারী ও সংখ্যালঘু নির্যাতন আছে, ভুল ব্যাখ্যা, কুসংস্কার রয়েছে… তাহলে শুধু আমারটার সমালোচনা হচ্ছে কেনো? অন্যগুলোকে ধরা হচ্ছে না কেনো? ওগুলো দোষের না হলে, আমারটা দোষের নয়… ইত্যাদি। প্রশ্ন হলো- অন্য ধর্মে যা আছে, তা যদি আপনার ধর্মে থাকে, তাহলে আপনারটা সর্বোত্তম হলো কীভাবে? যেহেতু ধর্মে-ধর্মে মতোবিরোধ চিরস্থায়ী, অখণ্ডণীয়, অলঙ্ঘনীয়… তবু তা মানবজাতির জন্য মঙ্গলজনক কিংবা শান্তির হলো- কীভাবে?

জানি না, পরকালে সুখে থাকার জন্য ধর্ম পালন, নাকি এ পৃথিবীতে ভালো মানুষ হওয়ার জন্য ধর্ম পালন, কোনটা হওয়া উচিত? তবে এটা জানি, ধর্মজঙ্গি দমন নয়, এর কারখানা তথা ধর্ম দমন করলেই তা নির্মূল হবে, এর আগে নয়। কিন্তু তা হবার নয় কারণ, ধূর্ত ধর্মপ্রবর্তকদের কল্পিত ধর্ম শোষকদের (রাজনীতিবিদদের) প্রধান হাতিয়ার। মূলত শোষিত জনগণকে অধীনে রাখতে এর আধ্যাত্মিক মন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা অসামান্য।