লিখেছেন: ফাহিম আহমেদ

আমাদের মাঝে এমন বহু মানুষ আছে যারা সবকিছুতেই ষড়যন্ত্রের গন্ধ পান। অনেকেই বিশ্বাস করেন মানুষ কখনো চাঁদে যায়নি, AIDS একটি মনুষ্য সৃষ্ট রোগ, কম্পিউটারের এন্টিভাইরাস প্রস্তুতকারী কোম্পানীগুলোই ভাইরাস তৈরি করে, প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যু কোন দুর্ঘটনা নয় ইত্যাদি। এ ধরণের ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সত্যতা যাচাই, অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করা মাঝে মাঝে খুবই কঠিন। কিন্তু দিনশেষে আমরা সবাই জানি যে এগুলো কেবলই অনুমান। কিন্তু যখন এ ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলোর কোন একটি সত্য হয়ে যায় তখন আমাদের সবার পক্ষে তা সমানভাবে মেনে নেয়া সহজ নয়। Shadow World: Inside the Global Arms Trade গ্রন্থে দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনীতিবিদ Andrew Feinstein বিশ্ব অস্ত্র বাণিজ্যের এমন একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সত্যতা দেখিয়েছেন। তিনি এ বইয়ে বিভিন্ন তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে অনেক বিশেষজ্ঞের সন্দেহকে সত্য প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে বিশ্বের অস্ত্র বাণিজ্য কেবল সামরিক অফিসার কিংবা অস্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকদের পকেট ভরে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাজনীতিবিদরাও এর সাথে জড়িত থেকে হত্যা, ধ্বংস ও সহিংসতায় সমান অবদান রাখছেন।

সিডনিভিত্তিক থিংক ট্যাংক Institute for Economics and Peace বিভিন্ন দেশের দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ভিত্তিতে প্রকাশ করে Global Peace Index নামক বাৎসরিক তালিকা। ২০১৭ সালে প্রকাশিত এ তালিকার শীর্ষ চারটি দেশ হলো আইসল্যান্ড, পর্তুগাল, অস্ট্রিয়া ও ডেনমার্ক। সবচেয়ে নিচের তিনটি দেশ হলো সিরিয়া, আফগানিস্তান ও ইরাক। Global Peace Index এর ১৬৩টি দেশের তালিকায় মাত্র ১০টি দেশ বর্তমানে সকল প্রকার দ্বন্দ্ব-সংঘাত থেকে মুক্ত। এ প্রতিবেদন থেকে সহজেই অনুমান করা যায় বর্তমান বিশ্ব একটি যুদ্ধের সম্মুখে দাঁড়িয়ে। Stockholm International Peace Research Institute (Sipri) এর মতে ২০১০ সালে বিশ্বের শীর্ষ ১০০টি অস্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় ছিল ৪০০ বিলিয়ন ডলারের অধিক। বর্তমান বিশ্বের প্রধান দুই অস্ত্র বিক্রেতা মার্কিন-যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন হলো বিশ্বের শীর্ষ তিনটি অস্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক। এগুলো হলো- Lockhead Martin (যুক্তরাষ্ট্র), BAE Systems (ব্রিটেন) ও Boeing (যুক্তরাষ্ট্র)। Shadow World বইয়ে Feinstein বলেন, “অস্ত্র বাণিজ্যের মাধ্যমে বর্তমান বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ দুর্নীতি হয়ে থাকে। যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত যারা নেন, বহুক্ষেত্রে তারাই এর থেকে সবচেয়ে বেশী লাভবান হন।”

যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত দেশপ্রেমের পরিবর্তে অর্থনীতি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে বহু আগে থেকেই। এর একটি উদাহরণ হলো Dick Cheney যিনি ২০০১-২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইরাক হামলার অন্যতম হোতা Dick Cheney এ যুদ্ধের সময় তার তেল কোম্পানি Halliburton এর মাধ্যমে ৩৯ বিলিয়ন ডলার আয় করেন। গনতন্ত্র ও মানবতার নামে যুক্তরাষ্ট্রের এ হামলার পরিণাম ইরাকসহ বর্তমান বিশ্ব এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে। ২০১০ সাল থেকে ব্রিটেন তাদের Human Rights Watchlist এ থাকা ৩০টি দেশের মধ্যে ২২টির কাছে অস্ত্র বিক্রয় করেছে। বিভিন্ন সময়ে ব্রিটেনের অস্ত্র ক্রেতার তালিকায় আছে ইরান, আফগানিস্তানের তালেবান ও ইরাক সরকার। যেখানে যুদ্ধ আছে সেখানে আছে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা। ২০১৫ সালের মার্চ থেকে ইয়েমেনে সৌদি-আরব সমর্থিত বাহিনীর সাথে বিদ্রোহীদের চলা গৃহযুদ্ধে সৌদি বোমা পড়েছে জানাযার নামাজ ও বিয়ের অনুষ্ঠানে। সেখানে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ কলেরা। ৭০ লক্ষ ইয়েমেনবাসী তীব্র খাদ্য ও পানির সংকটে ভুগছে। সৌদি বাহিনীর এ হামলা International Humanitarian Law ভঙ্গ করলেও ব্রিটিশ সরকার এ সময়ে সৌদি আরবের সাথে ৩ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তি করেছে।

ব্রিটেন ও সৌদি আরবের অস্ত্র লেনদেনের একটি ঐতিহাসিক অতীত আছে। ১৯৬০ সাল থেকে ব্রিটেনের অস্রের অন্যতম ক্রেতা হলো সৌদি আরব। এ দুই দেশের মধ্যকার সবচেয়ে বড় ও বিতর্কিত অস্ত্র চুক্তিটি হলো ১৯৮৫ সালের Al-Yamama চুক্তি। এ চুক্তির অর্থনৈতিক গুরুত্ব এতই বেশি ছিল যে তত্কালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার এর দরকষাকষিতে সরাসরি যোগ দেন। বাদশাহ ফাহাদের সাথে তার বৈঠকের মাধ্যমে ফ্রান্সকে হটিয়ে এ চুক্তির অভ্যন্তরীণ অস্ত্র সরবরাহের কন্ট্রাক্টটি ব্রিটেনের BAE Systems লাভ করে। Al Yamama ছিল বিশ্বের অন্যতম বড় অস্ত্র চুক্তি যা BAE Systems পরবর্তী ২০ বছর ব্রিটেনের জন্য ২০ বিলিয়ন ডলার রাজস্ব আনে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী এ চুক্তির জন্য সৌদি রাজ কর্মকর্তা ও মধ্য-সত্তভোগীদের ৬ বিলিয়ন ডলার ঘুষ দিতে হয়। এসব তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পরও দুই দেশে কাউকে আইনের আওতায় আনা অথবা জবাবদিহি করতে হয়নি। বিশ্বের অস্ত্র ব্যবসা অর্থ, দুর্নীতি, প্রতারণা ও হত্যার এক অসম প্রতিযোগিতা। সামান্য কিছু মানুষের জন্য ব্যাপক সম্পদ নিয়ে এলেও কোটি কোটি মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে এ প্রতিযোগিতা। ধ্বংসের ফেরিওয়ালাদের এ অর্থনীতি গণতন্ত্রকে সংকুচিত করে, দুর্বল রাষ্ট্রকে ভঙ্গুর করে ও জাতীয় নিরাপত্তাকে কটাক্ষ করে এগিয়ে চলছে নিজস্ব গতিতে।