লিখেছেন: ক খ গ বৃত্তবন্দী

আমাদের পাড়ার নজরুল নয়, কাজী নজরুল ইসলাম। আজকাল তার লিখার প্রতি খুব আগ্রহ জন্মাচ্ছে কেন জানিনা। তিনি যে কতটা বাস্তবমুখী তার প্রমাণ আর বলা বাহুল্য। আমাদের চারপাশ, আমদের দেশ, আমাদের সমাজ কতটুকু বদলালো, কতটুকু সামনে অগ্রসর হলো তাহার প্রতি তীক্ষ্ণ নজরদারি করিলেই ইহার চাক্ষুষ প্রমান পাওয়া যাবে। আমরা আজও তালাকের ফতোয়া খুঁজি কোরান হাদিস চষে। কাঠমোল্লাদের অঙ্গুলী নির্দেশে আজো হাজারো সন্ত্রাসবাদ, সবই ধর্মগ্রন্থের মিথ্যা বাহানা মাত্র। ধর্মগ্রন্থ নিয়ে নজরুল লিখেছেন- পূজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল মূর্খরা সব শোন/ মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোন।

যে গ্রন্থ মানুষের রচিত সেই ধর্মগ্রন্থের সমালোচনা করলে আজও আমাদের কণ্ঠ রোধ করে দিতে, হাতের কলম কেড়ে নিতে ধেয়ে আসে মূর্খ ধার্মিকেরা। আজও দেশের কবি সাহিত্যিকেরা হয় খুন, হয় নির্বাসিত। যে দিন থেকে ধর্মগ্রন্থ দুনিয়ায় এসেছে, সে দিন থেকে জগতের মানুষ তার মনুষ্যত্ব পরিচয় ভুলে গিয়ে বিভক্ত হয়ে গেছে বহু ধারায়, বহু জাতিতে বহু পরিচয়ে। ধর্মগ্রন্থ মানুষের কাছে মানুষকে কীভাবে পরিচয় করিয়ে দেয় নজরুল বলছেন-

‘একদিন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল আমার, হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে। গুরুদেব বললেন: দেখ যে ন্যাজ বাইরের, তাকে কাটা যায়, কিন্তু ভিতরের ন্যাজকে কাটবে কে?… যে প্রশ্ন করছিলাম এই যে ভেতরের ন্যাজ, এর উদ্ভব কোথায়? আমার মনে হয় টিকিতে ও দাড়িতে। টিকিপুর ও দাড়ি-স্থানই বুঝি এর আদি জন্মভূমি।

এতোদিন পরেও কি আমরা মানুষকে মানুষ রূপে জানতে শিখেছি? আজও কি আমরা ক্রস, টিকি-দাড়িতে মানুষের পরিচয় খুঁজিনা? নজরুল মানুষেরই মাঝে খুঁজে পেয়েছিলেন মানুষের পরিচয়, লিখেছেন-

গাহি সাম্যের গান-গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্‌লিম-ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান!

কে তুমি?- পার্সী? জৈন? ইহুদী? সাঁওতাল, ভীল, গারো?
কন্‌ফুসিয়াস্‌? চার্বাক চেলা? ব’লে যাও, বলো আরো!
বন্ধু, যা-খুশি হও,
পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা-খুশি পুঁথি ও কেতাববও,

কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক-
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেবপ’ড়ে যাও, য্তসখ-
কিন্তু, কেন এ পন্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন এ দর কষাকষি? -পথে ফুটে তাজা ফুল।

মোল্লাতন্ত্রের উৎপীড়ন, নির্যাতন থেকে মানুষকে বাঁচাতে নতুন প্রজন্মকে মাশাল হাতে আলোর ফুল্কানি ছড়িয়ে অন্ধকার দূর করতে হবে।

আমাদের সমাজের কল্যাণকামী যে সব মৌলানা সাহেবান খাল কাটিয়া বেনোজল আনিয়াছিলেন, তাঁহারা যদি ভবিষ্যৎদর্শী হইতেন, তাহা হইলে দেখিতে পাইতেন বেনোজলের সাথে সাথে ঘরের পুকুরের জলও সব বাহির হইয়া গিয়াছে। উপরন্তু সেই খাল বাহিয়া কুসংস্কারের অজস্র কুমির আসিয়া ভিড় করিয়াছে। মৌলানা মৌলবী সাহেবকে সওয়া যায়, মোল্লা ও চক্ষুকর্ণবুজিয়া সহিতে পারি, কিন্তু কাঠমোল্লার অত্যাচার অসহ্য হইয়া উঠিয়াছে। ইহাদের ফতুয়া-ভরা ফতোয়া। বিবি তালাক ও কুফরির ফতোয়া তো ইহাদের জাম্বিল হাতড়াইলে দুই দশ গন্ডা পাওয়া যাইবে। এই ফতুয়াধারীফতোয়াবাজদের হাত হইতে গরীবদের বাঁচাইতে যদি কেহ পারে তো সে তরুণ।

খাল কেটে আপন ঘরে যারা কুমির এনেছিলেন সেই সকল ফতুয়াধারী ফতোয়াবাজদের বিরুদ্ধে নজরুল সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন-

এই ঘরো যুদ্ধ ভাইয়ের সহিত, আত্মীয়ের সহিত যুদ্ধই সর্বাপেক্ষা বেদনাদায়ক। তবু উপায় নাই। যত বড় আত্মীয়ই হোক, তাহার যক্ষ্মা বা কুষ্ঠ হইলে তাহাকে অন্যত্র না সরাইয়া উপায় নাই। যে হাত বাঘে চিবাইয়া খাইয়াছে তাহাকে কাটিয়া ফেলিয়া দেওয়া ছাড়া প্রাণ রক্ষার উপায় নাই।

আমরা বড় স্বার্থপর হয়ে গেছি। সমাজকে কুষ্ঠরোগীদের হাতে ছেড়ে দিয়ে আমরা শুধু নিজের প্রাণ বা নিজেকে বাঁচাতে সমাজ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে চলেছি। এই কুমিরদের আমরা সরাতে পারি নাই বা সরাবার চেষ্টা করি নাই, তাই তারা মাঝে মাঝেনুরজাহানদের মাটিতে পুঁতে হত্যা করে, সাতক্ষিরায় আগুন জ্বালিয়ে তাদের উপস্থিতি জানা।

পশু সাজবার মানুষের একি ‘আদিম’ দুরন্ত ইচ্ছা!- ন্যাজ গজাল না বলে তারা টিকি দাড়ি জন্মিয়ে যেন সান্তনা পেল। ……হিন্দুত্ব মুসলমানত্ব দুই সওয়া যায়, কিন্তু তাদের টিকিত্বদাড়িত্ব অসহ্য, কেননা ঐ দুটোই মারামারি বাধায়। টিকিত্ব হিন্দুত্ব নয়, ওটা হয়ত পন্ডিত্ব। তেমনি দাড়িও ইসলামত্ব নয়, ওটা মোল্লাত্ব। এই দুই “ত্ব” মার্কা চুলের গোছা নিয়েই আজ যত চুলাচুলি!……….. মানুষ আজ পশুতে পরিণত হয়েছে, তাদের চিরন্তন আত্মীয়তা ভুলেছে। পশুর ন্যাজগজিয়েছেওদের মাথার ওপর, ওদের সারা মুখে। ওরা মারছে লুংগিকে, মারছে নেংগোটিকে; মারছে টিকিকে, দাড়িকে! বাইরের চিহ্ন নিয়ে এই মূর্খদের মারামারির কি অবসান নেই?

মোল্লাতন্ত্র আমাদের নারী সমাজকে গৃহবন্দী করে রেখেছে যুগযুগ ধরে। অবরোধবাসিনী নারীরা ভুলেই গেছেন তারাও যে মানুষ। অবরোধ প্রথাকে শ্বাসরোধ বলে উল্লেখ করে নজরুল বলেন-

আমাদের পথে মোল্লারা যদি হন বিন্ধ্যাচল, তাহা হইলে অবরোধ প্রথা হইতেছে হিমাচল। আমাদের দুয়ারের সামনের এই ছেঁড়া চট যে কবে উঠিবে খোদা জানেন। আমাদের বাংলাদেশের স্বল্পশিক্ষিতমুসলমানদের যে অবরোধ, তাহাকে অবরোধ বলিলে অন্যায় হইবে, তাহাকে একেবারে শ্বাসরোধ বলা যাইতে পারে। এই জুজুবুড়ির বালাই শুধু পুরুষদের নয়, মেয়েদেরও যেভাবে পাইয়া বসিয়াছে, তাহাতে ইহাকে তাড়াইতে বহু সরিষা-পোড়া ও ধোঁয়ার দরকার হইবে। আমাদের অধিকাংশ শিক্ষিত বা অর্ধ-শিক্ষিত লোকই চাকুরে, কাজেই খরচের সঙ্গে জমার তাল সামলাইয়া চলিতে পারে না। অথচ ইহাদের পর্দার ফখর সর্বাপেক্ষা বেশি। আর ইহাদের বাড়িতে শতকরা আশিজন মেয়ে যক্ষ্মায় ভুগিয়া মরিতেছে। আলো-বায়ুর অভাবে। এই সব যক্ষ্মারোগগ্রস্ত জননীর পেটে স্বাস্থ্য-সুন্দর প্রতিভাদীপ্ত বীর সন্তান জন্মগ্রহণ করিবে কেমন করিয়া! ফাঁসির কয়েদিরও এইসব হতভাগিনীদের অপেক্ষা অধিক স্বাধীনতা আছে। আমাদের কন্যা-জায়া-জননীদের শুধু অবরোধের অন্ধকারে রাখিয়াই ক্ষান্ত হই নাই, অশিক্ষার গভীরতর কূপে ফেলিয়া হতভাগিনীদের চির-বন্দিনী করিয়া রাখিয়াছি। আমাদের শত শত বর্ষের এই অত্যাচারে ইহাদের দেহ-মন এমনি পঙ্গু হইয়া গিয়াছে যে, ছাড়িয়া দিলে ইহারাই সর্বপ্রথম বাহিরে আসিতে আপত্তি করিবে। ইহাদের কি দুঃখ, কিসের যে অভাব তাহা চিন্তা করিবার শক্তি পর্যন্ত ইহাদের উঠিয়া গিয়াছে।