হজরত শাহজালাল এখন বাংলাদেশের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তাঁর নামে দেশের সবচেয়ে বড় বিমানবন্দরটির এবং একটি ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে’র নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়া  ছাত্রাবাস স্কুল কলেজ রাস্তা ইত্যাদি অসংখ্য প্রতিষ্টান ও স্থাপনার নামের সাথেও শাহজালাল নামটি শোভা পেতে দেখা যায়। সেসাথে ব্যক্তিগত ব্যবসায় প্রতিষ্টানতো আছেই। নামকরণের দিক দিয়ে হয়তো বঙ্গবন্ধুর পরেই তাঁর অবস্থান। এছাড়া জাতীয় বা বিভিন্ন আঞ্চলিক নির্বাচনে তাঁর ভূমিকা এখন প্রশ্নাতীত এবং অপরিহার্য। আমাদের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের দুই নেত্রীই আবার পির সাহেবের দারুণ ভক্ত। দুজনই উত্তরাধিকারসূত্রে দুই রাজনৈতিক দলের নিউক্লিয়াস হিসেবে পর্যায়ক্রমে দেশ শাসন করে জাতিকে ধন্য করছেন। যাদের উত্তরাধিকার নিয়ে তারা ক্ষমতার শীর্ষবিন্দুতে অবস্থান করছেন সেই দুই প্রয়াত নেতার প্রতি তাদের ভক্তি-শ্রদ্ধার কোনো কমতি নেই। ক্ষুদ্র বা বৃহৎ দিবসে গুরুত্বপূর্ণ বা লঘু মেজাজের অনুষ্টানের সূচনাপর্বেও তারা প্রয়াত নেতাদ্বয়ের মাজারে বা প্রতিকৃতিতে পুষ্ফস্তবক অর্পণ করতে  কখনো অবহেলা করেননা। কিন্তু নির্বাচন ঘনিয়ে আসলেই তাদের এই নিত্যকর্মে কিছুটা ব্যত্যয় দেখা দেয়। তখন তারা পিতা বা স্বামীর ইমেজের প্রতি তাদের চিরাচরিত  আস্থাটুকু আর ধরে রাখতে পারেননা। তারা তখন তড়িঘড়ি করে সপারিষদ ছুটে যান শাহজালালের মাজারে। দুই নেত্রীর মাঝে রিতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় কার আগে কে গিয়ে পিরের দোয়া আগাম বুকড করে নেবেন।এসব বিবেচনায় শাহজালাল আমাদের সবচেয়ে  জনগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। এমন একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে যেরকম গবেষণা হওয়ার প্রয়োজন ছিল তা কিন্তু একেবারেই হচ্ছেনা। শাহজালাল নামটি এখনও রূপকথার এক নায়কের পর্যায়েই রয়ে গেছে। সুতরাং এখনই প্রয়োজন শাহজালালকে মিথের ধূম্রজাল থেকে মুক্ত করে একজন মানুষ হিসেবে তাঁর মূল্যায়ন করা। কেননা যে বিদেশী পর্যটকটি বাংলাদেশে পা দেয়ার আগেই আমাদের এয়ারপোর্টের কল্যাণে সবার আগে শাহজালাল নামটির সাথে পরিচিত হয়ে যায় সেই ভিনদেশীর শাহজালাল নিয়ে কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক। শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যার নামে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাথে তার সম্পর্ক বা অবদান কতটুকু ? আমাদের দুই নেত্রীর অতিরিক্ত মাজার আসক্তি দেখে একজন অনুসন্ধিৎসু মানুষ হিসেবে আমার মনেও প্রশ্ন জাগে নারীনেত্রীগণ যার উপর এত আস্থা রাখেন স্বয়ং তিনি নারীর উপর কতটা আস্থাশীল বা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন? অথবা আদৌ ছিলেন কি না ? এই প্রশ্নের জবাব  খুঁজতে গিয়ে শাহজালালের প্রচলিত জীবন কাহিনী থেকে যে তথ্যগুলি পেয়েছি তা মোটেই সুখকর নয়। আমাদের নেত্রীদের জন্যতো তা ভয়াবহ তথ্য কেননা শাহজালালের মাজারে তাঁর কথিত অলৌকিকতা যদি ফসিল আকারেও অস্থিত্বশীল থাকে তবে তার প্রভাবে দুজনের বাসনা নিষ্ফলতো হবেই এমনকি হিতে মহা বিপরীত ফল হওয়ারই সম্ভাবনা বেশী।

এবার আসা যাক হজরত শাহজালাল এবং নারী প্রসঙ্গে। উপমহাদেশের পির-ফকিরদের জীবনকাহিনী অলৌকিকতার মোড়কে এতটাই আচ্ছাদিত যে এর থেকে সত্য বের করে আনা খুবই দুরূহ। হজরত শাহজালালও এর ব্যতিক্রম নন। ঢাকা নিবাসী জনৈক নাসির উদ্দিন হায়দর প্রনীত ফারসী ভাষায় লিখিত ‘সুহেলী ই এমন’ নামে তাঁর একটি জীবনকাহিনী আছে বাংলায় তা ‘তোয়ারিখে জালালী’ নামে অনূদিত হয়েছে। সুহেলী ই এমন’ এর লেখক যে দুটি সূত্র থেকে তথ্যাদি সংগ্রহ করেছিলেন সেগুলি সম্ভবতঃ ভক্ত খাদেমদের কাছ থেকে সংগৃহিত ছিল এজন্য একে ইতিহাস ও কল্পকাহিনীর মাঝামাঝি কিছু বলা যেতে পারে। একে ফেনায়িত দুধের সাথে তুলনা করা যায়। তলানীর দুধ্টুকু পেতে হলে নির্মোহ এবং সাহসিকতার সাথে ফেনাকে ফেলে দিতে হবে। সাহসিকতা বলছি কারণ আমরা দুধ থেকে তার ফেনাতেই বেশী আসক্ত তাই ফেনা ছেকে ফেলতে গেলে চারদিক থেকে হৈহৈ পড়ে যাবে। সে যাই হোক তাঁর এ জীবনী গ্রন্থে শাহজালালের সাথে নারী সম্পর্কিত তিনটি তথ্য পাওয়া যায়।

এক

শাহজালাল ভারত বর্ষে আগমনের পর দিল্লীতে অবস্থানরত পির নিজামুদ্দিন তাঁর এক শিষ্য মারফত খবর পান  আরব থেকে এক পির এসেছেন খুব অদ্ভুত তার চাল-চলন। তিনি  নারীসঙ্গ বিবর্জিত। দৃষ্টিপথে যাতে ভুলেও কখনো কোনো নারীর ছায়া না পড়ে এজন্য চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে পথ চলেন। তিনি আবাসগৃহে এক বালককে সাথে রাখেন এবং তাকে প্রানাধিক প্রেমাস্পদের ন্যায় বিবেচনা করেন। নিজামুদ্দিন পির বিষয়ে সন্দীহান হন। শাহজালাল নিজামুদ্দিনের সন্দেহ দূর করার জন্য একটি কৌটাতে জ্বলন্ত অঙ্গার এবং কিছু তুলা পাশাপাশি রেখে নিজামুদ্দিনের কাছে পাঠান। জ্বলন্ত অঙ্গারের পাশে অক্ষত তুলা দেখে নিজামুদ্দিনের সন্দেহ দূরীভুত হয়।

দুই

সিলেটে তাঁর উপসনালয়ের উত্তর দিকে এক পুকুর ছিল। একদিন উপাসনালয়ে বসেই সেদিকে তাকিয়ে এক অদ্ভুত সুন্দর প্রাণী দেখে তিনি চমকে ওঠেন কিন্তু যখনই তিনি বুঝতে পারেন প্রাণীটি আসলে একটি নারী সাথে সাথেই তিনি ভীষণ অনুতপ্ত হয়ে পড়েন। তিনি পুকুরটিকে তাৎক্ষণিক ভরাট হয়ে যাওয়ার জন্য অভিসম্পাত করেন এবং বাস্তবেও তাই হয়। নারীটিও অকুস্থানে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।

তিন

শাহজালালের সঙ্গী-সাথিদের প্রায় সবাই ছিলেন পশ্চিম থেকে আগত। শীতের মওসুমে সিলেটের কনকনে শীতল হাওয়ায় সাগরেদ্গণ কাতর হয়ে বাবাকে গিয়ে ধরেন কিছু একটা করার জন্য। শাহজালালাল সিলেটের তৎকালীন শাসক সিকান্দর শাহ মতান্তরে সিকান্দর গাজীকে বললেন- এ বছর বড় কনকনে ঠান্ডা পড়েছে। শীতে কাবু হয়ে পড়েছি। কিছু একটা ব্যবস্থা কর। সিকান্দর শাহ বুঝলেন পিরসাহেব বুঝি শীত নিবারণীর কথা বলে মূলতঃ রমনী-সঙ্গের কথা ইঙ্গিত করেছেন। তিনি অনেক অনুসন্ধান করে এক অপরূপা সুন্দরী নারী সংগ্রহ করে শিবিকাযোগে শাহজালালের কাছে পাঠান। চিরকালের নারীবিবর্জিত ফকির এতে অতিশয় ক্ষুব্দ হন। ঘটনাক্রমে সেদিনই সিকান্দর শাহ সুরমা নদী পাড় হতে গিয়ে নৌকা ডুবে মৃত্যুমুখে পতিত হন। সিকান্দর শাহর লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেদিন চমৎকার আবহাওয়া ছিল। ঝড়-তোফান ছিলনা সুরমা নদীতে নৌকাডুবির মতো উত্থাল ঢেউ ছিলনা।

এই তিনটি ঘটনার সাথেই নারী সম্পৃক্ততা এবং পির-আউলিয়াদের জীবনের সাথে প্রায় অবিচ্ছেদ্য অনুসঙ্গ ‘কেরামতি’র সংশ্লিষ্টতা আছে। প্রথমেই কেরামতির ব্যাপারেই আলোকপাত করা যাক। ইতিহাসে গাল-গল্প তথা কেরামতি বুজরুকির কোনো স্থান নেই তাই আমাদিগকে তিনটি ঘটনাকেই বস্তুনিষ্টভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে।

প্রথম ঘটনার কথাই ধরা যাক। শাহজালাল শয়নকক্ষে বালক নিয়ে থাকতেন এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই কেননা এটা কোনো বিধর্মী রটনাকারীর বর্ণনা নয়। তবে শাহজালালের আত্নপক্ষ সমর্থনের যে গল্প ফাঁদা হয়েছে তা ভক্ত মুরিদ খাদিমদের রচনা বলেই মনে হয়। প্রকৃত সত্য হয়তো এমন হতে পারে  শাহজালাল যুক্তি এবং প্রমানাদি দিয়ে নিজামুদ্দিনকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেনযে বালক সাথে রাখলেও তাতে কোনোরূপ কুপ্রবৃত্তি নেই। নিতান্তই পাই-ফরমাশের জন্য একটি বালককে সঙ্গে রাখা। যদিও প্রশ্ন উঠতে পারে এতসব পূর্নবয়স্ক খাদেম থাকতে বালক-সেবকের কেন প্রয়োজন হলো? তাছাড়া বালক কেন সেবা করবে? বালকইতো বয়স্কজনদের কাছ থেকে সেবা ডিজার্ভ করে। যাই হোক পির নিজামুদ্দিন শাহজালালের কথায় বা যুক্তিতে বিশ্বাস করেছিলেন এবং তাঁকে একজোড়া কবুতর উপহার দিয়েছিলেন।

দ্বিতীয় গল্পটি আরও বেশী বিষ্ময়কর। তিনি স্নানরত একজন মহিলাকে দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে কামনা করলেন মহিলাটি অদৃশ্য হয়ে যাক পুকুরটি ভরাট হয়ে যাক অমনি তা হয়ে গেল। এই গল্প আল্লাহ কর্তৃক পৃথিবী সৃষ্টির কাহিনীকেই মনে করিয়ে দেয়। আল্লাহ ‘কুন ফাইয়াকুন’ বললেন অমনি সব গড়গড় করে হয়ে গেল। আল্লাহ নাহয় সর্বশক্তিমান সেহেতু নিছক মনস্কামনা থেকেই যা ইচ্ছে তা বানিয়ে নিতে পারেন কিন্তু শাহজালালতো সেই পর্যায়ের ক্ষমতাশালী নন বরং এদিক বিবেচনায় ইসলামের দৃষ্টিতে তা শিরক বলেই বিবেচিত হওয়ার কথা। আর ইতিহাসও এইসব গালগল্পকে প্রমাণ ছাড়া গ্রহণ করবেনা। আসল সত্য  হতে পারে এ রকম- যে নারীকে না দেখার জন্য সারাজীবন তিনি চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে পথ চলেছেন এবং সফলকামও হয়েছেন অথচ বাঘের ঘরে ঘোগের বাসার মতো নিজ সাধনস্থলে বসেই যখন সেই নাপাক প্রাণী দর্শন করে ক্রোধ ও অনুশোচনায় হাহাকার করে ওঠেন তখন বাবার ক্রোধ প্রশমনের জন্য ভক্ত খাদেমরাই উত্তেজিত হয়ে সেই মহিলাকে তাৎক্ষণিক হত্যা করে ঘটনাস্থলেই মাটিচাপা দিয়ে দেয়। উন্মত্ত খাদেমরা পরে পুকুরটিকেও গাছপালা লতাগুল্ম আবর্জনা ফেলে ব্যবহারের অনুপযোগি করে ফেলে যাতে ভবিষ্যতে অনুরূপ ঘটনা আর সংঘটিত না হয়। অব্যবহারের ফলে পুকুরটি কালক্রমে ভরাট হয়ে যায় সেসাথে একটি হত্যাকান্ডও অলৌকিকতার চাদরে চিরকালের জন্য ঢাকা পড়ে যায়।

তৃতীয় ঘটনাকে একটি কাকতালীয় দুর্ঘটনা বলা যেত কিন্তু কাহিনীর সাথে যখন চমৎকার আবহাওয়ার কথা বলা হয় সুরমা নদীকে ঢেউহীন শান্ত সুবোধ বলা হয় তখন মনে হয় এর পেছনেও খাদেমদের হাত থাকতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে হজরত শাহজালাল মুখ-ঢাকা শান্ত নিরীহ ফকির হলেও তাঁর সঙ্গীগণ ছিলেন বিপরীত চরিত্রের। তারা ছিলেন একটি দখলদার বাহিনীর সহযোদ্ধা। পরবর্তিতে শাহজালাল এদের অনেককে ছোট ছোট ভাগ করে বিভিন্ন অঞ্চলে অভিযানে প্রেরণ করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে তরফ বিজয়ের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এক রকমের বিনাযুদ্ধে সিলেট বিজয়ের মূল রূপকার ছিলেন শাহজালালের সঙ্গী-সাথিরা, একথা বললে মনে হয় অত্যুক্তি হবেনা। কারণ শাজালালকে ভিত্তি করে তারা এমনসব কাহিনীর জন্ম দেন যা শুনে যাদুবিদ্যায় বিশ্বাসী রাজা গোবিন্দের মনোবল একেবারেই ভেঙ্গে গিয়েছিল। তার সৈন্যবাহিনীর নিক্ষিপ্ত অগ্নিবাণ পিরের যাদুতে বুমেরাং হয়ে ফিরে এসে নিজেদেরকেই বিদ্ধ করে, তিনি একে একে প্রতিটি নদীর পারাপার বন্ধ করে দেন আর সেই পির জায়নামাজ বিছিয়ে তা অবলীলায় পার হয়ে যান এইসব রটনা তার মনোবলকে ভেঙ্গে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল অথচ গোবিন্দ শাহজালালের পূর্বে সাহসিকতার সাথে মুসলমানদের বেশ কটি আক্রমন প্রতিহত করে তার ক্ষুদ্র রাজ্যটিকে আগলে রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন। শাহজালালের কেরামতিতে সিলেট বিজয় হয়েছে এই ধারণা থেকেই সম্ভবতঃ সিলেটের শাসককে খাদেমগণ সামান্যই তোয়াক্কা করতেন। শাহজালাল ছিলেন তাদের আধ্যাত্বিক গুরু এবং তাঁর স্থান ছিল সবার উপরে। সেই শক্তিমান মুর্শিদকে সিলেটের তৎকালীন শাসক সিকান্দর শাহ কর্তৃক নারী উপঢৌকনের ঘটনাকে স্বাভাবিকভাবেই তাদের কাছে চরম ধৃষ্টতা বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক। হয়তো এমনও হতে পারে সেই খাদেমরাই মাছ-শিকারে আসক্ত এবং সাঁতার না জানা সিকান্দর শাহকে প্রলুব্ধ করে নৌকায় তুলে মাঝ-নদীতে তা ডুবিয়ে তাকে হত্যা করেছিলেন। যদিও এটা অনুমান মাত্র তবে সিকান্দর শাহর লাশ খুঁজে না পাওয়া এই সন্দেহকে আরো জোরালো করে। তিনি খুব সাধারণ মানুষ ছিলেননা একটি অঞ্চলের প্রশাসক ছিলেন। সুতরাং সুরমা নদী তন্ন তন্ন করে তার লাশ খোঁজা হয়েছে এটা আমরা ধরে নিতে পারি। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো তার লাশ কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি অথবা নদীর ভাটিতে তার লাশ ভেসেও ওঠেনি। এ থেকে হত্যা করে তার লাশ গুম করে ফেলার আশংকাটি শক্ত একটা ভিত পেয়ে যায়।

এই তিনটি ঘটনা যেভাবেই ঘটে থাকুকনা কেন এর মূল তাৎপর্য অভিন্ন আর তা হলো হজরত শাহজালাল কেবল নারীসঙ্গ বিবর্জিতই ছিলেননা ছিলেন প্রচন্ড নারী-বিদ্বেষীও। নারীকে তিনি কল্পিত শয়তানের চেয়েও ঘৃণ্য জীব বলে বিশ্বাস করতেন যার ছায়া মাড়ানোও ভয়ানক পাপের। নারী নিয়ে তিনি যে নেতিবাচক ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বড় হয়েছিলেন  আমৃত্যু সেই ভ্রান্তিকেই বহন করে চলেছিলেন। একজন পুরুষ মানুষ জীবনের দুই পর্বে নারীর দুই ইউনিক স্বত্তাকে দর্শন করে। প্রথমত শৈশবে দ্বিতীয়বার যৌবনে। শৈশবে নারীর যে প্রবল স্নেহের সাক্ষাৎ আমরা মায়ের কাছ থেকে লাভ করি তারতো কোনো তুলনাই চলেনা। যৌবনে প্রিয়তমা নারীর ললিত লোভন লীলায় আমরা সবাই কমবেশী হাবুডুবু খাই। কিন্তু  প্রথমা রমনীর অর্থাৎ মায়ের স্নেহ ভালবাসার দৌরাত্ন্য এতই প্রবল যে একশ বছরের একজন বুড়োও জীবনের অন্তিম পর্বে যখন ঘন ঘন হ্যালোসিনেশনের শিকার হয় তখনও তার স্মৃতিতে সেই মায়ের মুখটিই ঘুরে ফিরে আসে। শাহজালালের দুর্ভাগ্য জন্মের মাত্র তিন মাস বয়সে তিনি মাতৃহীন হন। কিছুদিনের মাঝে জন্মদাতা পিতাও কাফেরদের সাথে ধর্মযুদ্ধে প্রাণ হারান ফলে মমতাহীন এক নিষ্টুর পরিবেশে তাকে বড় হতে হয়। তিনি যে মাতুল দ্বারা লালিত-পালিত হন তিনিও সম্ভবতঃ সংসার-বিরাগী ফকির ছিলেন। মামা সংসারী হলে ভাগিনা অবশ্যই তার স্ত্রী-কন্যার সান্নিধ্য পেতেন তাতে করে তাঁর মনোজগতে নারী সম্পর্কে নেতিবাচক কোনো ধারণার জন্ম হবার সুযোগ থাকতনা। মামা সংসার-বিরাগী ছিলেন বলেই শিষ্যকে একেবারে শিশু অবস্থা থেকেই সংসারের প্রতি অনাসক্ত হবার মন্ত্রদান করে গিয়েছেন। শিখিয়েছেন ঈশ্বর বা আল্লাহকে পেতে হলে সংসার করা চলবেনা। নারীর দিকে ফিরে তাকানো যাবেনা। নারী হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অপশক্তি যা ইশ্বর প্রাপ্তির পথে অন্যতম অন্তরায়। বর্তমান সময়েও আমরা একদল মানুষকে বলতে শুনি নারী হলো দোজখের পৈঠা বা সিঁড়ি। এরা তেঁতুলের মতো, দেখলেই জিহবায় জল আসে। তাই এই লোভনীয় অপশক্তিকে বস্ত্রের অশোভন ব্যাগে বন্দি করে রাখতে হবে যাতে সাধুপুরুষের দৃষ্টিতে পড়ে তার স্বর্গের পথে দুর্লঙ্গ দেয়াল তুলে না দাঁড়ায়। শাহজালালের সাথে বর্তমান সময়ের কপট নারীবিদ্বেষীদের পার্থক্য হলো মুখে এরা যতই নারী নিয়ে অকথা কুকথা বলুকনা কেন নারীকে যতই অপয়া নাপাক এবং শয়তানের দোসর ভাবুকনা কেন নারীর প্রতি এই ভন্ডদের আসক্তির কথা সর্বজনবিদিত। এরা এক নারীতে সন্তুষ্ট নয় বহু নারীতে আসক্ত থাকে। ঘরে একাধিক নারী রেখে ভোগ করে। পক্ষান্তরে শাহজালাল যা বিশ্বাস করেছিলেন তা আমৃত্যু অতি নিষ্টার সাথে পালনও করে গেছেন এ দিক  বিবেচনায় বলা যায় তিনি আর যাই হোক ভন্ড ছিলেননা। তিনি চিরকুমার বা মজররদ থেকেই জীবনলীলা সাঙ্গ করে গেছেন।