ভূমিকা

অভিজিৎ রায়ের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ঘটেছিলো অনেক দেরীতে। তাঁকে আমি মূলত বইয়ের লেখক হিসাবেই জানতাম। অন্তত প্রথমদিকে তাঁর বইয়ের পাঠক যতটা ছিলাম, ব্লগের ততটা নিয়মিত পাঠক ছিলাম না। ব্লগের নিয়মিত পাঠক হয়ে উঠি তাঁর বই পাঠের পরেই। আমি আসলে ব্লগ জগতের সঙ্গে খুব একটা যুক্ত ছিলাম না। খুব নির্বাচিত কয়েকজন লেখকের লেখা মাঝে মধ্যে পড়া হতো। অভিজিৎ রায় তাঁদের একজন। তিনি আমাদের দেশের প্রথাগত বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক বিজ্ঞান লেখকদের মতো ছিলেন না। এমন কি তিনি আমাদের লেখালেখির আরেকটা গোত্র, বইমেলা কেন্দ্রিক লেখকও ছিলেন না। এই বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়তো পুনরাবৃত্তি করা হবে অনেকের কাছে, কিন্তু অভিজিৎ কেনো স্বতন্ত্র ঘরানার লেখক ছিলেন তা বোঝার জন্যে এই প্রসঙ্গগুলো জরুরী। অভিজিৎ কখনও কখনও নিজেকে বিজ্ঞান লেখক বলেছেন বটে, কিন্তু তাঁকে শুধু বিজ্ঞান লেখক বললে বরং তা হবে তাঁর লেখক পরিচয়ের দারুন খন্ডিত পরিচিতি। আবার লেখক অভিজিৎ রায়কে পরিচিত করতে অনেকেই লেখেন “নাস্তিক ব্লগার” হিসাবে, অনেকেই তাকে পরিচিত করতে চান “মিলিট্যান্ট এথিস্ট” হিসাবে। ব্যক্তিগত পরিসরের কথা আমার জানার সুযোগ ছিলোনা, কিন্তু ফর্মাল বা আনুষ্ঠানিক পরিচয় হিসাবে লেখক অভিজিৎ নিজেকে একজন “মিলিট্যান্ট এথিস্ট” দাবী করতেন কিনা, পরিচিত করতেন কিনা আমার জানা নেই। কিন্তু যারা অভিজিৎকে শত্রুজ্ঞান করেন, তারাতো বটেই অভিজিৎ এর গুণগ্রাহী পাঠকদেরও কেউ কেউ মনে করেন তিনি একজন “মিলিট্যান্ট এথিস্ট” ছিলেন, তাঁর পরিচিতি তাঁর নাস্তিকতার জন্যে, ধর্মের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্যে। হয়তো ব্যক্তি পর্যায়ে অভিজিৎ নিজেকে তাই মনে করতেন (আমার জানা নেই, অভিজিৎ এর কাছের বন্ধুরা ভালো বলতে পারবেন)। কিন্তু অভিজিৎ এর লেখালেখি এতো অদ্ভুত রকমের বিচিত্র যে লেখক অভিজিৎ রায়কে একজন “নাস্তিক ব্লগার” বা “মিলিট্যান্ট এথিস্ট” লেখক হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেয়াটা কঠিন হয়ে ওঠে। শুধু কঠিনই নয় এটা অবিচার এবং মাঝে মধ্যে আমার মনে হয় এটা এক ধরনের ষড়যন্ত্রও বটে। অভিজিৎকে খন্ডিত ও সংকীর্ণ করে রাখার একটা বাজে ষড়যন্ত্র। সম্ভবত এর উৎপত্তি অভিজিৎকে যারা শত্রুজ্ঞান করেন তাদের মহল থেকেই (বন্ধু মহল থেকেও কি? জানিনা।)।

বিজ্ঞান কি জ্ঞানার্জনের জন্যে? নাকি দুনিয়াকে দেখার ও বদলে দেয়ার জন্যে?

একথা সত্যি, অভিজিৎ এর লেখালেখির একটা বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে বিজ্ঞান, বিজ্ঞানের পদ্ধতি, বিজ্ঞানের ইতিহাস ইত্যাদি। তাঁর কয়েকটি পুস্তকের পাতায় পাতায় রয়েছে আধুনিক বিজ্ঞানের জটিল সব তত্ত্ব, তথ্য ও উপাত্তের উপস্থাপন ও ব্যাখ্যা। বিজ্ঞান, বিশেষত বিজ্ঞানের অগ্রসর তত্ত্ব, তথ্য ও বিশ্লেষণ নিয়ে লেখালেখি বাংলা ভাষায় অপ্রতুল। বাংলাদেশে প্রচলিত অর্থে আমরা যাদের বিজ্ঞান লেখক হিসাবে জানি, তাদের একটা বড়ো অংশ হচ্ছে “বিজ্ঞানীদের জীবনী” ভিত্তিক বা “শত বিজ্ঞানীর আবিষ্কার” কেন্দ্রিক লেখালেখিতে ব্যস্ত। খুব স্পষ্টভাবেই, অভিজিৎ সেই ঘরানার বিজ্ঞান লেখক ছিলেন না। অভিজিৎ বিজ্ঞানের তথ্য দেবার জন্যে লিখতেন না, লিখতেন বিজ্ঞান মনস্কতা গড়ে তোলার জন্যে, যে বিজ্ঞান মনস্কতা মানুষকে শুধু বিজ্ঞানে “আগ্রহী” করে স্কুলের ভালো ছাত্র বানায় না, বরং জীবন সম্পর্কে প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গিকে পাল্টে দেয়। যে বিজ্ঞানমনস্কতা শুধু বিজ্ঞানেই থেমে থাকেনা, প্রতিদিনের জীবনের সাথে যুক্ত হতে শেখায়, জীবনের বিভিন্ন প্রপঞ্চ নিয়ে প্রশ্ন করতে শেখায়। আমাদের দেশের যে সকল লেখক বিজ্ঞানের কিছু আবিষ্কারের তথ্যে ভরপুর পুস্তক লেখেন বা লিখতেন, আমি তাদের ভূমিকাকে বা তাদের কাজকে খাটো করছিনা, আমি কেবল বলছি, অভিজিৎ রায়ের বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখি ছিলো প্রচলিত জনপ্রিয় ধারার বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখির সম্পূর্ণ উল্টো ধারার। কেনো উল্টো ধারার সেটা ব্যাখ্যা করছি খানিক পরেই, তাঁর আগে আসুন “বিজ্ঞান” নিয়ে অভিজিৎ রায়ের মতামতটিকে দেখে নেই। বলাই বাহূল্য, এই মতামতটিও আমি জেনেছি, অভিজিৎ রায়ের পুস্তকের লেখকের কথা অংশ থেকে।

“বিজ্ঞানের অবদান কি কেবল বড় বড় যন্ত্রপাতি বানিয়ে মানুষের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য বয়ে আনা? আমাদের স্কুল কলেজে যেভাবে বিজ্ঞান পড়ানো হয় তাতে এমন মনে হওয়া স্বাভাবিক। ব্যাপারটা আসলে তা নয়। বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে মানুষ বড় বড় যন্ত্রপাতি বানায় বটে; তবে সেগুলো স্রেফ প্রযুক্তিবিদ্যা আর প্রোকৌশল বিদ্যার আওতাধীন। বিজ্ঞানলব্ধ জ্ঞানের অভিযোজন মাত্র। আসলে বিজ্ঞানের একটি মহান কাজ হচ্ছে প্রকৃতিকে বোঝা, প্রাকৃতিক ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা খুঁজে বের করা। বিজ্ঞানের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য এখানেই”।
(আলো হাতে চলিয়াছে আধারের যাত্রী, অভিজিৎ রায়)

উপরের এই মন্তব্যটি হয়তো খুব সংক্ষিপ্ত একটি মতামত। কিন্তু এই মতামতটিই আসলে অভিজিৎকে ভিন্ন ঘরানার বিজ্ঞান লেখক হিসাবে আলাদা করে দিয়েছে। অভিজিৎ বিজ্ঞান আর বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে আলাদা করে দেখতেন। তিনি জানতেন, বিজ্ঞানের এমন আহামরি কোনও দায় নেই যে গরমের দিনে আরো জোরে ঘোরে এমন পাখা বানিয়ে আমাদের শরীরকে ঠান্ডা রাখার ব্যবস্থা করার। সেটা বরং কিছু পাটোয়ারী ব্যবসায়ী বিজ্ঞানের কিছু প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে কিছু টাকা পয়সা কামিয়ে নেয়। বিজ্ঞানের দায়িত্ব হচ্ছে কেনো বাতাস শরীরে লাগলে ঠান্ডা লাগে, কিম্বা আসলে “বাতাস” কি আর কেনই বা বাতাস শীতল কিম্বা গরম হয়ে ওঠে সেই সকল মৌলিক কারণ ব্যাখ্যা করা। অর্থাৎ বিজ্ঞানের প্রকৃত কাজ হচ্ছে প্রকৃতির নিয়মকে ব্যাখ্যা করা। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, বিজ্ঞান যদি প্রকৃতির নিয়মগুলোকে একে একে ব্যাখ্যা করে দেয় তাহলে সবচাইতে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে পড়েন কে? সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে পড়েন – ঈশ্বর – আল্লাহ্‌ – ভগবান বলে যে সকল কল্পিত চরিত্র আমাদের হাড়ে মজ্জায় মিশে আছে তারা। সবচাইতে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে পড়েন মুহাম্মদ কিম্বা যীশুর মতো পাটোয়ারী ধর্মীয় নেতারা, মানুষের অজ্ঞানতাকে ভর করে যারা মানুষকে আফিম খাইয়ে রাখেন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। এখানেই অভিজিৎ এর সাথে আরো দশজন বিজ্ঞান লেখকের তফাৎ। অভিজিৎ বিজ্ঞান নিয়ে লেখেন মানুষের মাঝে গভীরভাবে গেঁড়ে বসা বিশ্বাসের অন্ধকার দূর করার জন্যে। তিনি বিজ্ঞান নিয়ে লেখেন দুনিয়ার ইতিহাস ব্যাখ্যা করার জন্যে। মানুষ যখন দুনিয়ার ইতিহাস জানেন, তখন ইসরাফীল সাহেবের শিঙ্গার গল্প পানসে হয়ে যায়। তাই তাঁর বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখির উদ্দেশ্য প্রথাগত অর্থে “জ্ঞানার্জন” নয়। বরং তাঁর লেখালেখির মূল উদ্দেশ্য মানুষকে আলোকিত হয়ে উঠতে সাহায্য করা। কেনা জানেন, কোনো বস্তু আমাদের চোখে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে যখন বস্তুটির উপরে আলো পতিত হয়, চোখের উপরে নয়। তাই অভিজিৎ-এর লেখালেখি বস্তুকে আলোকিত করে, যেনো আমরা তা দেখতে পাই। তাই অভিজিৎকে আমি নেহায়েত একজন বিজ্ঞান লেখক বলিনা। আমি অভিজিৎ রায়কে বলি আলো হাতে চলা সেই ভদ্রলোক, যিনি নিজে পথ চিনে নিচ্ছেন, বাকীদেরও বলছেন পথ চিনে নেবার জন্যে। অভিজিৎ আমার কাছে বিজ্ঞান লেখকের চাইতেও বড় কেউ।

অভিজিৎ রায়ঃ নতুন লেখকের আত্মীয়

অভিজিৎ রায়ের সাথে আমার খানিকটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠার সময়েই তিনি ধর্মীয় মৌলবাদীদের (? শুধু কি ধর্মীয় মৌলবাদ? রাষ্ট্রও কি ছিলো সেই হত্যাকারীদের দলে? জানিনা।) হাতে নিহত হলেন। এটা নিয়ে আমার তীব্র খেদ আছে, দুঃখবোধ আছে, লজ্জাবোধ আছে। আমার মনে হয়, হয়তো আরো আগেই তাঁর সাথে ব্যক্তিগতভাবে সংযুক্ত হতে পারতাম। কিন্তু, আবার মাঝে মাঝে মনে হয়, লেখকের সাথে বরং ব্যক্তিগত যোগাযোগ না থাকাই ভালো, তাতে লেখকের “লেখক” আত্মার সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেটা অনেক জরুরী। অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর পরে আমি তাঁর এককভাবে ও যৌথভাবে লেখা বেশ কয়েকটি পুস্তক আবারো পড়েছি। অভিজিৎ হত্যাকান্ডের পার হয়ে যাওয়া গত কয়েক বছরে আমি প্রায়শই টের পেয়েছি, ব্যক্তি অভিজিৎ রায়ের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কের চাইতে লেখক অভিজিৎ রায়ের সাথে আমার সম্পর্কটা অনেক বেশী গভীর। গত কয়েকবছরে আমি সামান্য কিছু লেখালেখির চেষ্টা করেছি আর তাই লেখক অভিজিৎ রায়কে আমি বোধ করি, অনুভব করি, মাঝেমধ্যেই। আজকের এই লেখাটি লেখক অভিজিৎ রায়কে নিয়ে, ব্যক্তি অভিজিৎ রায়কে নিয়ে নয়। তাই, আমি চেষ্টা করবো ব্যক্তি অভিজিৎ রায়ের প্রতি আমার নিজের ব্যক্তিগত আবেগকে সংযত রেখে লেখাটিকে এগিয়ে নেবার জন্যে।


অভিজিৎ রায়ের লেখালেখি

অভিজিৎ ভালোবাসা নিয়ে নিজের অনুভবের কথা লিখেছেন। অন্যের ভালোবাসা নিয়েও লিখেছেন। অভিজিৎ লিখেছেন ভালাবাসা ও যৌনতা নিয়ে “সংখ্যালঘু” সমকামী মানুষদের বঞ্চনার কথা নিয়ে। আবার এই অভিজিৎই লিখেছেন অবিশ্বাসের দর্শন যেখানে বিজ্ঞানকে ব্যাখ্যা করেছেন মানুষের জীবন পাথেয় হিসাবে। অভিজিৎ পলেমিক্যাল লেখা লিখেছেন ধর্ম ও ভাইরাসের তুলনা দিয়ে। লিখেছেন মার্কসবাদের বৈজ্ঞানিকতার দাবীর বিরুদ্ধে। রংধনুর সাত রঙের মতো বিস্তৃত ছিলো অভিজিতের লেখালেখির বিষয়বস্তু। এই সকল লেখালেখির ভেতর থেকে অভিজিৎকে কোনো একটি বিশেষ বিষয়ের লেখক বলাটা কি সত্যিই সংকীর্ণ ধারণা নয়? তাই এই লেখায় অভিজিৎ রায়ের লেখালেখির কিছু মূল প্রবনতার উল্লেখ করতে চাই, যার প্রতিটিই আমার কাছে মনে হয়েছে, যেকোনো লেখকের জন্যে শিক্ষনীয়, ব্যক্তিগতভাবে আমি শিখেছি (তা নিজের লেখায় ব্যবহার করতে পারি কিনা, তা পুরোপুরি জানিনা।)।

এবার আসুন, অভিজিতের লেখালেখির আঙ্গিক ও ধরণ নিয়ে কিছু কথা বলি। আমি সহ আমাদের অনেকেরই দারুণ কিছু শেখার আছে অভিজিৎ এর লেখালেখির আঙ্গিক ও ধরণ থেকে। অভিজিতের প্রথম পুস্তকটির (আলো হাতে চলিয়াছে আধারের যাত্রী, অংকুর প্রকাশনী) প্রকাশক ঘটনাচক্রে আমার পারিবারিক আত্মীয়। অভিজিৎ রায় সম্পর্কে কোনো কিছু জানার আগেই আমি কেবলই বাজারের আরো দশটি পুস্তকের মতো করেই পড়েছিলাম “আলো হাতে চলিয়াছে আধারের যাত্রী” পুস্তকটি। বইটি পড়া শুরু করার আগেই ভিন্ন একটি বিষয় ভেবে বিস্মিত হয়েছিলাম। তাহলো, রবীন্দ্রনাথের গানের একটি লাইন কি করে একটি বিজ্ঞান বিষয়ক পুস্তকের শিরোনাম হতে পারে, সেটা ভেবে। নামকরণটি অভিজিৎ নিজে করেছেন কিনা জানিনা, কিন্তু যেকথা আগে লিখলাম যে “শত বিজ্ঞানীর আবিষ্কার” ধরণের বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায় নন, এটা তাঁর প্রথম পুস্তকের শিরোনাম থেকেই তিনি জানান দিয়েছিলেন। বইটির প্রথম পড়ার স্মৃতি বলতে এইটুকুই। কয়েকবছর পরে বইটি আবার পড়েছি এবং আমার বলতে দ্বিধা নেই, ব্যক্তিগতভাবে বিজ্ঞানের একটি বিষয়ে (চিকিৎসা বিজ্ঞান) পড়াশুনা করেও আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম বিজ্ঞানের বেশ কিছু জটিল বিষয়ে অভিজিৎ রায়ের উপস্থাপনায়। আমি সেই পুস্তকটিকে আমার নিজের জন্যে একটি দারুণ প্রয়োজনীয় পুস্তক হিসাবে পেয়েছিলাম। পুস্তকের নামকরণে অভিজিতের সৃজনশীলতা দারুণ, যদিও অনেকের কাছেই হয়তো বিষয়টি খুব জরুরী কিছু নয়।

“জলবৎ তরলং” এর যাদুকর অভিজিৎ রায়

পুস্তকের লেখায় কিম্বা ব্লগের লেখায় উভয় ক্ষেত্রেই দেখেছি, লেখক অভিজিতের সবচাইতে বড় দক্ষতাটি ছিলো, তাঁর লেখার শুরু থেকেই তিনি পাঠককে যুক্ত করে নিতে চাইতেন। ইংরাজিতে যাকে বলে “readers engagement”, তিনি সেটা পারতেনও বটে। এই রকমের বেশ কিছু নমুনা আমি তাঁর লেখায় দেখেছি এবং আমি নিজে একজন কাটখোট্টা লেখক হিসাবে লজ্জিত হয়েছি। ধরা যাক, তাঁর প্রথম পুস্তক “আলো হাতে চলিয়াছে আধারের যাত্রী”র শুরুটা করেছেন বিজ্ঞানী নিউটনের মাথার উপরে আপেল পতনের সেই বহুল শ্রুত “গল্পটি” দিয়ে। সেই লেখাটি যখন পড়ছিলাম তাঁর কয়েকবছর আগে আমি ডাক্তারি পাশ করে পেশাগত কাজ করছি। প্রচলিত অর্থে আমাকে একজন “বিজ্ঞানমনস্ক” মানুষ বলা যেতেই পারে। কিন্তু আমিও ধাক্কা খেয়েছিলাম, নিউটনের এই বহুল প্রচলিত “গল্প”টি যে কেবলই গালগল্প সেটা পড়ার পরে। বিষয়টি আমি জানতাম কিন্তু এটা দিয়ে একটা সিরিয়াস পুস্তকের শুরু হতে পারে? আমি টের পেয়েছিলাম সেই শুরুটাই আমাকে আগ্রহী করে তুলেছিলো পুরো বইটা পড়ে শেষ করার জন্যে। এই রসাত্মক শুরু, পাঠক হিসাবে আমাকে আশ্বত্ব করেছিলো যে এই বইটি পড়ার জন্যে আমাকে উচ্চতর ক্যালকুলাস এর ছাত্র হতে হবেনা। এমনকি একই পুস্তকে অভিজিৎ যখন নিউটনের তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা আর তাকে উত্তোরণ ঘটানোর জন্যে আইন্সটাইনের সুত্রের অবদান ব্যাখ্যা করছিলেন, তখন তিনি উল্লেখ করছেন এভাবে –

“আইন্সটাইনের এই থিওরী আলোচনা করবার জন্যে গনিতের যে জ্ঞান থাকার দরকার হয় তা একেবারেই প্রাথমিক স্তরের। স্কুল কলেজে যারা বীজগণিত পড়ছে তারাও বুঝতে পারবে অংকগুলো। কিন্তু অংক গুলো থেকে যে সিদ্ধান্তগুলো (Mass increase, length contraction and Time dilation) বেরিয়ে আসে তা সত্যিই আশ্চর্যজনক”।
(আলো হাতে চলিয়াছে আধারের যাত্রী, অভিজিৎ রায়)

এরপরে তিনি খুব সহজ ব্যাখ্যা করেন Mass increase, length contraction আর Time dilation কিভাবে ঘটে আর আর এই সকল প্রপঞ্চের চুড়ান্ত ফলাফল বা সিদ্ধান্ত হচ্ছে “কোনও পদার্থই আলোর সমান গতিবেগ অর্জন করতে পারবেনা আর সেই থেকেই মহাবিশ্বের গতিসীমা নির্ধারিত হয় আলোর গতিবেগ দিয়ে”।

যখন কেউ কোনো একটি বিষয় খুব ভালো করে ব্যাখ্যা করতে পারেন না, তখন আসলে প্রথম যে প্রশ্নটি করা উচিৎ তা হচ্ছে, আদৌ কি তিনি নিজেই সেই বিষয়টি খুব ভালো করে বোঝেন? এটা হচ্ছে অভিজিতের লেখালেখির দ্বিতীয় দক্ষতার দিক। বিজ্ঞানের যে বিষয়গুলোকে তিনি হাজির করতেন সেই বিষয়গুলোর আদ্যপান্ত ছিলো তাঁর নখদর্পণে, তাঁর প্রমাণ পাবেন তাঁর প্রথম পুস্তক “আলো হাতে চলিয়াছে” তে কিম্বা “অবিশ্বাসের দর্শন”, “বিশ্বাসের ভাইরাস” পুস্তকগুলোতে। যে সকল পুস্তকে বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলো হাজির করেছেন, প্রায় সকল ক্ষেত্রেই তিনি ব্যবহার করেছেন অসংখ্য উদাহরণের, উপমার। ডপলার ইফেক্ট বোঝানোর জন্যে ট্রেনের হুইসেল এর উদাহরণ (“আলো হাতে চলিয়াছে”- অভিজিৎ রায়) কিম্বা ড্রেক এর সমীকরণ বোঝানোর জন্যে স্কুলের ছাত্রদের মাঝে কতজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী হতে পারে তাঁর সম্ভাবনার উদাহরণ (“মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে” – অভিজিৎ রায় ও ফরিদ আহমেদ) দিয়ে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, আমার মতো গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানভীতু পাঠকও দারুণভাবে সংযুক্ত হয়েছিলাম সেই বর্ণনাগুলোর সাথে। লেখা দিয়ে যারা পাঠকের মননে – মস্তিষ্কে পরিবর্তন আনতে চান, তাদের জন্যে এটা একটা দারুণ অনুসরনীয় দিক। অভিজিৎ রায়ের প্রতিটি পুস্তকে এক ধরণের “চুম্বক” শক্তির মূল কারণ হচ্ছে বিষয়ের মেজাজ অনুযায়ী তিনি জানতেন কিভাবে পাঠককে যুক্ত করতে হয়।

জনপ্রিয় হতে চেয়েছিলেন অভিজিৎ?

প্রিন্টিং প্রযুক্তির সুলভ হয়ে ওঠা আর অভ্র’র ইউজারফ্রেন্ডলি বাংলা ফন্ট আসার পর আমরা দেখেছি, লেখক হয়ে ওঠাটা একটু সচ্ছল বাঙালীর এক ধরনের প্রিয় শখে পরিনত হয়েছে। দারুণ অগভীর সব লেখালেখি দুই মলাটের মাঝে বাধাই করে মানুষ হয়ে উঠছেন লেখক। তাদের পুস্তক “বেস্ট সেলার”ও হচ্ছে, একের পর এক সংস্করণ হচ্ছে। বইয়ের বাজার যখন এই রকমের স্থুল লেখকে ভরে উঠতে শুরু করেছে, সেই সময় অভিজিৎ রায় তাঁর লেখালেখিতে আরেক ধরণের বৈচিত্র্য আনলেন, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো’র উপরে একটি বই লিখে। বলাই বাহুল্য, আমি পুস্তকটি পাঠ করার আগে, একটু ভ্রু কুঁচকেছিলাম, ভেবেছিলাম … হুমম ! অভিজিৎ রায়ের কি দরকার ছিলো এতো বিচিত্র সব বিষয় নিয়ে একই সময়ে লেখার? তিনি কি জনপ্রিয়তার প্রথাগত পথে একটু হেঁটে আসতে চাচ্ছেন? কিন্তু এবারো অভিজিৎ রায় আমাকে অবাক করেছেন। ঢাকা থেকে নূরনবী দুলালের পাঠানো বইয়ের চালানে যখন “ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোঃ এক রবি-বিদেশীনির খোঁজে” পুস্তকটি আসলো, আমি বিস্ময় নিয়ে পড়লাম। বইটির শিরোনামে আমি ভেবেছিলাম হয়তো রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে বহুল চর্চিত “প্রেম – ভালোবাসা” ইত্যাদি নিয়ে আরেকটি নতুন বই হবে। কিন্তু অভিজিৎ তাঁর স্বভাবসুলভ ঢঙে দারুণ গভীর গবেষণা উপস্থাপন করেছেন পুস্তকটিতে। পুস্তকটিতে কেবল ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো একজন উপলক্ষ্য মাত্র, তাঁকে উপলক্ষ্য করে অভিজিৎ রায় বিস্তৃত করেছেন রবীন্দ্রনাথের শিল্প ভাবনা, নারী ভাবনা’র মতো জটিল বিষয়গুলোকে। সেখানে এসেছে বেগম রোকেয়ার সাথে তুলনামূলক আলোচনা। সেখানে তিনি তুলে এনেছেন রোকেয়াকে নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ের নারীবাদী বিতর্কগুলোকে। তিনি উল্লেখ করেছেন কেতকী কুশারী ডাইসন কিম্বা আকিমুন রহমানের মতো নারীবাদী একাডেমিক লেখকদের লেখালেখিকে। শুধুমাত্র একটি বইয়ের সংখ্যা বাড়ানোর জন্যে লেখালেখি করাটা “অভিজিৎ বিরুদ্ধ” বিষয়। তাইতো যাকিছুই লিখেছেন সেখানেই চিন্তার গভীরতা, সমকালীন গবেষণাগুলোকে সংযুক্ত করা আর সর্বোপরি ইতিহাসনিষ্ঠার অদ্ভুত সমন্বয় দেখতে পাই আমরা লেখক অভিজিতের লেখালেখিতে। যারা আমার কথায় আশ্বস্ত নন, তাঁরা অভিজিতের ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ও রবীন্দ্রনাথের উপরে লেখা পুস্তকটি পড়ে দেখতে পারেন। লেখকের নিজের পাঠের “গভীরতা” হচ্ছে লেখালেখি করার জন্যে একটি দারুণ জরুরী বিষয়। পাঠের গভীরতা ছিলো অভিজিৎ রায়ের একটি সহজাত বৈশিষ্ট্য যা ক্রমশই বিরল হয়ে উঠছে আমাদের মাঝে। আমার জন্যে এটাও এক দারুণ শেখার বিষয়।

সমালোচনামূলক লেখায় অভিজিৎ রায়ের কাছ থেকে শেখা

যেহেতু অভিজিৎ রায় শিশুতোষ বিজ্ঞানের লেখক ছিলেন না এবং তাঁর বিজ্ঞানের লেখালেখির একটা বৃহত্তর লক্ষ্য ছিলো ধর্মান্ধতা দূর করা, বিজ্ঞান মনস্কতা গড়ে তোলা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রচার করা, তাই অভিজিৎকে প্রায়শই ব্যাপক বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়েছে নানান মহলের থেকে। অভিজিতের বিরোধিতা করেছেন ইসলামপন্থী মৌলবাদী লেখকেরা, বিজ্ঞানের বিষয়ে পড়াশুনা করা কথিত ইসলামী বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে পেয়েছেন বিরোধিতা এমন কি প্রগতিশীল, বামপন্থী বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষদের কাছ থেকেও কখনো কখনো বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে অভিজিৎ রায়কে। এই ধরণের বুদ্ধিবৃত্তিক বিরোধিতা সব সময়ই কাম্য ও একটি স্বাভাবিক বিষয়। সভ্যতা এগিয়ে যায় এইভাবে জ্ঞানের ও চিন্তার মিথস্ক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই। এক অর্থে, আমার ধারণা অভিজিৎ রায় বিষয়টিকে উপভোগ করতেন। কিন্তু এই চিন্তার মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নেবার জন্যে তাকে প্রচুর লেখালেখি করতে হয়েছে। বিতর্কমূলক লেখালেখি, ইংরাজিতে যাকে আমরা সহজ করে বলি “পলেমিক্যাল রাইটিং” বা সমালোচনামূলক লেখালেখি। সমালোচনামূলক লেখালেখি কঠিন কাজ। এর কয়েকটি কারণ রয়েছে। সমালোচনামূলক লেখার লেখককে খুব সহনশীল, সচেতন ও সৎ হতে হয়। সমালোচনামূলক লেখালেখি হচ্ছে সভ্যতাকে এগিয়ে নেবার একটা বড় মাধ্যম, যেখানে নিজের মতামতকে প্রকাশ করতে হয় অন্যের মতামতকে খন্ডন করেই। তাই সমালোচনামূলক লেখার সাথে আমাদের প্রচলিত অনলাইন গালাগালভরা লেখালেখির তফাৎ আছে। সমালোচনামূলক লেখালেখিতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অর্জন করতে হয় এবং তা লেখার মাঝে নিশ্চিত করতে হয়। এই বিষয়গুলো হচ্ছেঃ

১ – প্রথমত, সমালোচনামূলক লেখালেখি করার জন্যে, যার সমালোচনা করা হচ্ছে, তাঁর লেখাটিকে খুব ভালো করে পড়তে হয়।

২ – সমালোচনাটিকে বিরুদ্ধ মতের লেখকের ব্যক্তির সমালোচনার চাইতে চিন্তার সমালোচনা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে হয়। আর এ জন্যে সবার আগে নিজেকে ব্যক্তিগত মূল্যবিচার বা জাজমেন্ট থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হয়। পলেমিক্যাল লেখালেখিতে নিজেকে বিচারক নয়, বরং বাদী বা বিবাদী পক্ষের উকিল ভাবতে হয়।

৩ – সমালোচনা মূলক লেখালেখির জন্যে সবার আগে নির্মোহ ভাবে অপরপক্ষের মতামতকে “হুবুহু” তুলে ধরতে হয়। ভিন্ন চিন্তাটিকে সেই প্রতিপক্ষ লেখক যেভাবে লিখেছেন বা বলেছেন ঠিক সেভাবেই উল্লেখ করতে হয়। এটাকে বলা হয় Proper representation বা যথাযথ উপস্থাপন।

৪ – এমন কি যদি হুবুহু উল্লেখ করা নাও যায়, যদি নিজের বয়ানে লিখতে হয়, তাহলে সেই বয়ানটিতেও থাকতে হয় দারুন ভাবে সত্যনিষ্ঠ, ইতিহাসনিষ্ঠ।

অভিজিৎ রায়ের লেখা সমালোচনামূলক ব্লগ বা প্রবন্ধগুলো যারা পড়েছেন, তাঁরা পলেমিক্যাল লেখালেখির মূলনীতির এক দারুণ উদাহরণ দেখতে পাবেন। মুক্তমনায় প্রকাশিত অভিজিৎ রায়ের একটি দীর্ঘ প্রবন্ধের কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রবন্ধটির সাথে আমার ব্যক্তিগত দ্বিমত রয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই, কিন্তু এই প্রবন্ধটি পলেমিক্যাল লেখার একটা ধ্রুপদী উদাহরণ হতে পারে। অভিজিৎ রায় এই লেখাটিতে মার্ক্সবাদ, কমিউনিস্ট দেশগুলোর রাজনীতি ও নেতৃত্বকে অত্যন্ত নিষ্ঠুর ভাবে সমালোচনা করেছেন। লেখাটি তিনি লিখেছিলেন শংকর রায় বলে একজন লেখকের লেখা একটি প্রবন্ধের সমালোচনা হিসাবে। দেখুন লেখাটি কিভাবে শুরু করেছিলেন অভিজিৎ রায় –

“মুক্তমনায় সম্প্রতি প্রকাশিত শঙ্কর রায়ের অত্যন্ত সুলিখিত ‘মার্ক্সবাদ, বিজ্ঞান ও ধর্ম’ শীর্ষক লেখাটি পড়বার থেকেই এ নিয়ে কিছু লিখবার তাগিদ বোধ করছি। কার্ল মার্ক্স উনবিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী দার্শনিক, রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ এবং সমাজ বিশেষজ্ঞ। শ্রেণীহীন শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়েছিল একসময় বিশ্বের বহু মুক্তিকামী মানুষকে। ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সুস্থ আলোচনা আজো তাই প্রাসঙ্গিক। লেখাটি মিঃ রায় মুক্তমনার সাম্প্রতিক সংকলন গ্রন্থ ‘বিজ্ঞান ও ধর্ম : সংঘাত নাকি সমন্বয়?’-এ অন্তর্ভুক্তির জন্য প্রদান করেছেন। এ প্রবন্ধটি বইয়ে আলাদা উপযোগ তৈরী করবে নিঃসন্দেহে”।লিংক

এই অংশটুকু ছিলো অভিজিৎ রায়ের লেখাটির প্রথম প্যারাগ্রাফ। লক্ষ্য করে দেখুন তিনি লেখক শংকর রায় বিষয়ে কি লিখেছেন, আর ইতিহাসে কার্ল মার্ক্সের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কি লিখছেন। ভেবে দেখুন তো যে দীর্ঘ লেখাটিতে তিনি মার্ক্সবাদকে সমালোচনা করেছেন, মার্ক্সবাদীদের সমালোচনা করেছেন, সেই লেখাটির প্রথম প্যারাগ্রাফ যদি হয় এই রকমের একটি বয়ান, তাহলে পাঠক হিসাবে লেখাটি কি মার্ক্সবাদীদেরকে সংযুক্ত করবে? নাকি বিতাড়িত করবে? এই প্যারাগ্রাফের বদলে যদি অভিজিৎ রায় “বামাতি”দের একগাদা গালাগাল দিয়ে শুরু করতেন, তাহলে কি লেখাটি তার অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে পারতো? পলেমিক্যাল লেখালেখির প্রথম সূত্র হচ্ছে – ভিন্ন পক্ষের লেখক যদি শত্রুর মতোও হয়, তবুও তাঁর চিন্তাকে আক্রমণ করতে গিয়ে যেনো সেই ব্যক্তিকে আক্রমন করে ফেলা না হয়। এই দীর্ঘ লেখাটিতে তিনি কার্ল মার্ক্সের চিন্তার উল্লেখ করেছেন, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁর নিজের বয়ানেই উল্লেখ করেছেন। মার্কসবাদের একজন আগ্রহী পাঠক হিসাবে আমি দেখেছি, মার্ক্সের চিন্তাকে উল্লেখ করবার যায়গায় অভিজিৎ বিকৃতির আশ্রয় নেননি। সমাজবিজ্ঞানের একটি ধারা হিসাবে মার্ক্সের চিন্তা যে সকল প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে গত একশো বছরে, তাঁর কিছু উল্লেখযোগ্য আলোচনা করেছেন অভিজিৎ এই লেখায়, কিন্তু কোথাও মার্কস বা মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকদের প্রতি ব্যক্তি আক্রমণ বা তাদের চিন্তার প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করেননি। এটাই হচ্ছে পল্যমিক্যাল বা সমালোচনামূলক লেখার মূলনীতি।

আরেকটি লেখার উল্লেখ না করলেই নয়। ধর্ম এবং বিশ্বাস হচ্ছে এক ধরণের ভাইরাস। এরা ভাইরাসের মতো করেই মানুষের মননে – মস্তিষ্কে কাজ করে। অভিজিৎ রায় এ বিষয়ে একটি বইও লেখেন। ধর্ম কেনো ভাইরাস আর কেনো নয়, এই রকমের একটি বিতর্কে আমিও জড়িয়ে পড়েছিলাম একদা। আমাদেরই সহ-ব্লগার বন্ধু, পারভেজ আলম অভিজিৎ রায়কে “সালাফী সেকুলার” ঘোষণা করে একটি সমালোচনামূলক ব্লগ লেখেন। সেই ব্লগের বোঝাপড়া নিয়ে আমার মৌলিক দ্বিমত থাকায়, আমি পারভেজ আলমের লেখার সমালোচনা করে একাধিক ব্লগ লিখি। এক পর্যায়ে অভিজিৎ রায় নিজেও একটি দীর্ঘ ব্লগ লেখেন একই প্রসঙ্গে, যেখানে তিনি পারভেজ আলমের লেখার সমালোচনা করেছিলেন। দেখুন, ব্যক্তি পারভেজ সম্পর্কে তিনি লেখাটির শুরুতেই লি বলে নিচ্ছেন –

“প্রথমোক্ত দলভুক্তদের নিয়ে আমার নতুন করে বলার কিছু নেই। কারণ তারা যুক্তি মানেন না, জবাব দিতে চান অস্ত্রে কিংবা সহি উপায়ে কল্লা ফেলে দিয়ে। তারা মনেই করেন ধর্ম এবং ধর্মপ্রচারকদের বিন্দুমাত্র সমালোচনা কেউ করলে তাকে মেরে ফেলার স্বর্গীয় অধিকার তাদের আছে। তারা যদিও বাস করছেন আধুনিক একবিংশ শতকে, কিন্তু দেখে মনে হয় নিজেদের বিবেক, বুদ্ধি এবং মনন জিম্মি রেখে এসেছেন সেই সপ্তম শতকে। এদের নিয়ে কিছু লেখার কোন অর্থ হয় না। কারণ জিহাদ এবং কতলের বাইরে তারা চিন্তা করতেই অক্ষম। দ্বিতীয় দলভুক্তরা অবশ্য সেরকম নন। তারা নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের পক্ষেই কথা বলেন। সমাজ রাজনীতি এবং মানুষ নিয়ে তারা সংবেদনশীল। ব্লগে পত্র-পত্রিকায় মননশীল লেখা লেখেন। কাজেই তাদের বক্তব্যের আলাদা গুরুত্ব আছে আমার কাছে। পারভেজ আলম এমনি একজন মননশীল লেখক। ব্লগে লেখা ছাড়াও ‘মুসলিম জ্ঞানতত্ত্ব’ নিয়ে এবং ‘শাহবাগের রাষ্ট্রপ্রকল্প’ বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ দুটো বই আছে তার। আমি উদ্যোগী হয়ে বইদুটো সংগ্রহ করেছি, পড়েছি, অন্যদেরও উৎসাহিত করেছি একসময়। ভদ্রলোক আরজ আলী মাতুব্বর পাঠাগার আন্দোলনের সাথেও যুক্ত। এমন একজনের লেখা নিঃসন্দেহে বাড়তি মনোযোগ দাবী করে”।লিংক

আমি সমালোচনামূলক লেখালেখি করেছি। আমি জানি পলেমিক্যাল লেখায় আমার সীমাবদ্ধতার কথা। তাই অভিজিৎ রায়ের লেখা থেকে আমি শিখি, শেখার চেষ্টা করি, কিভাবে সমালোচনামূলক লেখার কৌশলগুলো রপ্ত করা যায়। নিজের বিরুদ্ধ মতের মানুষের প্রতি এমন নির্বিকারচিত্ত লেখক আমি খুব বেশী দেখিনি। অন্যের লেখার সমালোচনা করার জন্যে এইরকমের নির্বিকার ও নৈর্ব্যক্তিক হতে হয়। আমি তা পারিনা সব সময়, অভিজিৎ রায়ের কাছ থেকে শিখি, শেখার চেষ্টা করি।

ফোকাস, ফোকাস আর ফোকাস !

লেখক অভিজিৎ রায়ের পুস্তক যখন বাংলাদেশের বইয়ের অনলাইন দোকান রকমারি ডট কম ঘোষণা দিয়েই নামিয়ে দিলো, বিক্রি বন্ধ করে দিলো, তখন আমরা অনেকেই এর প্রতিবাদ করেছি। অনলাইনে – অফলাইনে আমাদের বন্ধুদের অনেকেই বেশ কিছুদিন ধরে প্রতিবাদ করেছি। এই প্রতিবাদে ইসলামী মৌলবাদীরা ছিলো বই ব্যবসায়ী রকমারীর পক্ষে। রকমারীর পক্ষে অনলাইনে প্রায় একাই লড়ে গেছেন অধুনা ডানপন্থীদের অনলাইন বুদ্ধিবৃত্তির সিপাহসালার জনাব পিনাকী ভট্টাচার্য। আমাদের সমাজ এখন হাজারো পিনাকীতে ভরপুর, তাই আমি অভিজিৎ রায়কে ব্যক্তিগত ভাবে কয়েকবার বলেছিলাম, আপনি কিছু লিখুন, আপনি কিছু লিখুন। তিনি বেশ কয়েকদিন পরে, আমাকে ব্যাখ্যা করেছিলেন, অনলাইনের ডানপন্থীদের প্রতিদিনের “ক্যাচাল – প্যাচাল” এর জবাব দেবার মতো যথেষ্ট সময় তাঁর নেই। তিনি বলেছিলেন – নিজের কাজ, বাসার কাজ, পড়াশুনা, লেখালেখি করে যেটুকু সময় পাওয়া যায়, সেই সময়টুকু তিনি এভাবে স্থুল বিতর্ক করে নষ্ট করতে চান না। পরে একই রকমের ব্যাখ্য দিয়ে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তাঁর অবস্থান ব্যাখ্যা করেছিলেন। এটা হচ্ছে লেখক অভিজিৎ রায়ের আরেকটি শক্তির দিক। মনঃসংযোগ বা “ফোকাস”। বাংলাদেশ হচ্ছে ৯৫% মুসলমানের দেশ। সেই দেশে জন্মে – বড় হয়ে, ইসলাম আর মুসলমানদের পক্ষে না থাকাটা এক ধরণের “অপরাধ” কিম্বা “বোকামী”। সেই “অপরাধ” আর “বোকামী” যারা করেছেন, তাঁদেরকে সারা বছর দারুণ রকমের “ফোকাসড” থাকতে হয়। লক্ষ পিনাকীদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে “ফোকাসড” না থাকার মানেই হচ্ছে ইতিহাসে হারিয়ে যাওয়া। অভিজিৎ ইতিহাসে হারিয়ে যাননি, যাবেন না, তাঁর কারণ তাঁর “ফোকাস” বা মনঃসংযোগ। পিনাকীদের অব্যাহত বিরোধিতা অভিজিৎকে কয়েক মিনিটের জন্যেও বিচ্যুত করতে পারেনি। অভিজিৎ রায়ের লেখালেখিই তার প্রমাণ। লেখালেখি যারা করেন, তাদের জন্যে অভিজিতের কাছ থেকে আরেকটা বিরাট শিক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে মনঃসংযোগ বা “ফোকাস”। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিশ্চিতভাবেই ব্যর্থ এই মনঃসংযোগ এর বিষয়টিতে। আজও আমি অভিজিৎ রায়ের সেই ব্যাখ্যাকে মাঝে মাঝে মনে করি আর ব্যর্থ চেষ্টা করি মনসংযোগের।

শেষ কথা

যে বছর গ্যালিলিও মারা গেলেন সে বছরই নিউটনের জন্ম হয়েছিলো(মতান্তরে পরের বছর)। বিজ্ঞানের ইতিহাসের পরম্পরা রক্ষিত হয়েছিলো এভাবেই। গ্যালিলিও ও নিউটনের জীবনী পড়েছেন যারা তারা জানেন, দুজনেই পদার্থবিজ্ঞান ও গনিতের ইতিহাসে দুই ধ্রুবতারা কিন্তু নিউটন গ্যালিলিওর চাইতে অনেক বেশী সতর্ক ছিলেন, কৌশলী ছিলেন। বাঙালীর একটা জ্যোতির্ময়তার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্যে অভিজিৎ এর আরো চল্লিশ বছর বেঁচে থাকা দরকার ছিলো। দুর্ভাগ্য আমাদের। ধর্ম, ধর্মান্ধ ঘাতক আর তাদের প্রতিষ্ঠানসমূহ অভিজিৎকে বাঁচতে দেয়নি। কিন্তু কে জানে, হয়তো আরো অনেক অভিজিৎ জন্ম নিয়েছে ইতিমধ্যেই যারা রক্ষা করবে অভিজিৎ এর ঐতিহাসিক পরম্পরা, যারা অভিজিতের চাইতে আরো অনেক বেশী কৌশলী, অনেক বেশী লক্ষ্যভেদী। লড়াইটা দীর্ঘমেয়াদী। এই লড়াইয়ে জেতার জন্যে অভিজিৎ রায় হচ্ছেন আমাদের দিক দেখানো এক “মুডি” ধ্রুবতারা।

আমাদের বিরুদ্ধে আছে রাষ্ট্র, গোয়েন্দা সংস্থা, জলপাই পোশাকধারীরা আর তাদের প্রিয় ধর্ম, ৯৫% মানুষের ধর্ম ইসলাম আর আছে ইসলামের ধামাধরা অনলাইন সেবকেরা। আমাদের যুদ্ধটা এখন আরো অনেক দীর্ঘ, নিঃসঙ্গ। এই লড়াইয়ে আপনাকে মিস করি প্রিয় অভিজিৎ রায়, আর প্রতিদিনই খুঁজে ফিরি, কিভাবে আপনার হত্যার বদলা নেয়া যায়। চাপাতি তো হাতে ধরতে পারবোনা, তাই আপনার হত্যার চরম বদলা নেয়ার জন্যে লিখে যাই এখনও। লেখা ছাড়া আর কিইবা আছে আমাদের?

(পূনশ্চঃ অভিজিৎ রায়ের কাছ থেকে আমাদের শেখার যে বিষয়গুলো উল্লেখ করলাম, তা আমাদের সকলের জন্যেই। কোনোভাবেই এর অর্থ এই নয় যে আমি ব্যক্তিগতভাবে অন্যদের উপদেশ দিচ্ছি এই সকল বিষয় শেখার জন্যে। আমি তাঁর কাছ থেকে শিখেছি। আশা করি, সচেতন পাঠক বিষয়টি বুঝবেন। )