উৎসর্গপত্র

অভিজিৎ রায়ের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। ঠিক তিন বছর আগে এরকম এক রাতে আচমকা তাঁর মৃত্যু সংবাদ পেয়েছিলাম। বইমেলা থেকে ফেরার পথে অসম্ভব প্রতিভাবান এই মানুষটা খুন হয়ে গেল। প্রকাশ্যে, জনসম্মুখে; অথর্ব পুলিশ প্রহরার আশেপাশে। এখন আমরা সেই অভিজিৎ রায়ের রক্তের উপর দিয়ে বইমেলায় যাই। বই কিনি। যে বইমেলায় অভিজিৎ রায় লেখেনা, অনন্ত বিজয় দাস লেখে না, দীপন আসে না, শুদ্ধস্বর থাকে না; মুক্তবুদ্ধির কোনো বই ধর্মীয় উসকানির জেরে প্রবেশ করতে পারে না। মানুষের মতো বইকেও পুলিশের নজরদারির মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করতে হয়, এবং আরো অন্যান্য। সম্ভবত ‘দু হাজার পাঁচ থেকে ‘দু হাজার ষোল সাল পর্যন্ত মুক্তমনায় লেখা বিভিন্ন প্রবন্ধের সংকলন প্রকাশিত হতো বইমেলায়। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম সেই বইগুলোর জন্যে। এখন বইমেলা কোনো আগ্রহের জায়গা নয়। বাজারের ফর্দের মতো কোরে একটা কাগজে বই আর স্টলের নাম লিখে নিয়ে যাই। বই কিনি, রুদ্ধশ্বাসে বের হয়ে আসি। ওই প্রাঙ্গণ,- যেখানে হুমায়ুন আজাদের রক্তাক্ত শরীর, অভিজিৎ রায়ের লাশ, বন্যা আহমেদের নিঃশব্দ আর্তনাদ এখনো ভেসে আসে;- তা স্বস্তির হতে পারে কি? জানিনা এই বৌদ্ধিক-বন্ধ্যত্ব দূর করার জন্য আর কোনো দেবদূত আমাদের মাঝে আসবে কিনা। হয়ত আসবে। প্রত্যাশা করি আসার। কারণ অভিজিৎ এখনো মরেনি; তাঁর লেখাগুলো বেঁচে আছে, তাঁর চিন্তা বেঁচে আছে। বেঁচে আছে তাঁর আত্মার দর্শন। অভিজিৎ-এর অনুসন্ধান পদ্ধতি, পাঠ্যবলয়কে আশ্রয় করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ এখনো আছে আমাদের।

‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’, বইটি যখন প্রথমবার দেখি, বুঝতে পারিনি এটি হতে পারে কোনো বিজ্ঞানের বই। রবীন্দ্রনাথের সর্বপরিচিত এই গানটি একটা বিজ্ঞানভিত্তিক বইয়ের নাম! যেখানে বিস্তৃত হয়েছে আপেক্ষিকতা, স্ট্রিং থিওরি, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মতো মর্ডানফিজিক্সের বিষয়গুলো। সেই স্কুল-কলেজে পড়ার সময়ে বিজ্ঞানের প্রতি যে এক গভীর ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল, তার জন্যে আমি বাংলাদেশের অনেক প্রবীণ লেখকের অগ্রেভাগে অভিজিৎ রায়কে রাখতে চাই। বিজ্ঞানের মধ্যে সাহিত্যের রস আর ধর্মের সাথে এর বিরোধের যে অসামান্য সমন্বয়, তার হাতেখড়ি অভিজিৎ রায়ের ‘মুক্তমনা’ ব্লগের মাধ্যমেই হয়েছিল আমার। আমি ঋণী, ঐ আঁধারের যাত্রীজোত্যির্ময়ের কাছে। যদিও আমি ক্ষুদ্র,- এই ঋণশোধে তাই খুব মামুলি একটা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ‘দু বছর আগে; প্রতিবছর ছাব্বিশ ফেব্রুয়ারি আমি অভিজিৎ রায়কে উৎসর্গ করে একটা লেখা লিখব। গতবছর ‘টাও মেনিফেস্টো’ নিয়ে লিখেছিলাম। আজ তাঁকে উৎসর্গ করলাম আরেকটি লেখা-

১.
বিজ্ঞানের চিরায়ত দু’টি শাখা, ‘বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান’ (Evolutionary Biology) এবং ‘বৌদ্ধিক মনোবিজ্ঞানের’ (Cognitive Psychology) একত্রিতরূপ ‘বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান’ (Evolutionary Psychology); যা প্রাচীন সমাজব্যবস্থা থেকে শুরু করে বর্তমান সভ্যতার বিভিন্ন উপকরণকে বিবর্তন এবং মনোবিজ্ঞানের আলোকে ব্যাখ্যা করে। ধর্ষণ, খুন, হিংসা প্রভৃতি প্রাণিগত বৈশিষ্ট্যকে পূর্বে সমাজ ও মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা হলেও, বর্তমানে এগুলো জীববিজ্ঞানের নির্মোহ দৃষ্টিতে আলোচনার দাবি রাখে। এই নিবন্ধে মূলত ‘ধর্ষণ’ নিয়ে আলোচনা করা হবে। ধর্ষণকে বায়োলজিক্যালি ব্যাখ্যা করার পূর্বে এটা স্মরণে রাখা জরুরি যে, ‘ধর্ষণ’-এর মতো জঘন্য অপরাধকে যদিও বা জেনেটিক্যালি ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়, তার অর্থ এই নয় যে, একজন অপরাধী এই বলে পার পেয়ে যাবে যে,- সে জেনেটিক্যালি নিয়ন্ত্রিত এবং সেজন্যেই এই অপরাধ তার দ্বারা সংঘটিত হয়েছে! মূলত আমরা ব্যাখ্যা করতে চাই, বর্তমান সমাজে ধর্ষণ আদৌ জেনেটিক্যালি নিয়ন্ত্রিত কি-না ?

২.
প্রাণির বিবর্তনের জন্যে ‘অভিযোজন’ একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। সৃষ্টির শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত, প্রত্যেক জীবই সবসময় চেষ্টা করে তার চারপাশের পরিবেশের সাথে নিজেকে উপযোগি করে তুলতে। যাতে ঐ পরিবেশের ম্যাক্সিমাম সুযোগ সুবিধা সে ভোগ করতে পারে। পরিবেশের বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজেকে ঠিক মতো মানিয়ে নিয়ে সুষ্ঠুভাবে বেঁচে থাকা এবং বংশবৃদ্ধি করার জন্য জীবের নানান রকমের পরিবর্তন ঘটে; —এই পরিবর্তন গঠনগত হতে পারে, শারীরবৃত্তীয় হতে পারে কিংবা আচরণগত হতে পারে । এর ফলে জীব যে বৈশিষ্ট্য অর্জন করে তা পরের প্রজন্মেও সঞ্চারিত হয় । এভাবে প্রত্যেক প্রজন্মে নতুন কিছু বৈশিষ্ট্য অর্জনের মাধ্যমে এক সময় সরল জীব থেকে নতুন জটিল জীবের উদ্ভব ঘটে, অর্থাৎ জৈববিবর্তন ঘটে । যে সমস্ত পরিবর্তন জৈববিবর্তনে সাহায্য করে তাদেরকেই অভিযোজন )Adaptation) বলা হয়। এখন প্রশ্ন হলো, ধর্ষণ কি মনুষ্য সমাজের একটি অভিযোজিত বৈশিষ্ট্য ? আর যদি, অভিযোজিত বৈশিষ্ট্যই হয়, তবে এর সার্থকতা কী ?

ধর্ষণ, মানবসমাজের অভিযোজনীয় বৈশিষ্ট্য কি-না, তা ব্যাখ্যা করার পূর্বে আমরা অন্যান্য প্রাণিদের মধ্যে এর যৌক্তিকতা বিচার করতে পারি। মানুষ,- অন্যান্য প্রাণি থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। মানুষ জীবজগতেরই একটা অংশমাত্র। কুকুর, শিম্পাঞ্জী, হাতি, গরিলা যেমন আলাদা-আলাদা প্রজাতি, মানুষও তেমন। তবে প্রজাতিভিত্তিক প্রাণিকুলের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন: জোনাকি পোকা জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়ায় তার শরীরে আলো জ্বালাতে পারে এবং এই আলো তাদের যৌনমিলন ও শিকারে সাহায্য করে। জোনাকির এই বৈশিষ্ট্যকে আমরা জৈববৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করি। অথচ মানুষের এমন কোনো বৈশিষ্ট্যকে ব্যাখ্যা করার সময় আমরা জীববিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে কেবল সামাজিক অবস্থাগুলো বিবেচনা করি। সমাজবিজ্ঞানের প্রচলিত যে ধ্যানধারণা, তা মানুষকে অন্যান্য প্রাণি থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা করে দেখার পক্ষপাতি। বিশেষত মানুষের বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডকে শুধুমাত্র সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে বিবেচনা না করে জীববিজ্ঞানের নিরিখে দেখার প্রয়াস বেশিরভাগ সমাজবিজ্ঞানীর মধ্যেই নেই। প্রফেসর লী এলিস, একজন আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী, প্রভূত এই সমস্যাটিকে ‘বায়োফোবিয়া (Biophobia)’ বলে চিহ্নিত করেন। মানুষ অন্য প্রাণি থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু, জীববিজ্ঞান এখানে অচল,- এই ধারণাকে এখন পাল্টাতে হবে।

প্রাণিজগতে ধর্ষণের অনেক উদাহরণ রয়েছে। স্তন্যপায়ী, পাখি, পতঙ্গ, মাছ ইত্যাদি স্পেসিসের মধ্যে এই আচরণ লক্ষ্য করা যায়। প্রথমে আর্থোপোডা পর্বের একটা পতঙ্গকে দিয়ে শুরু করা যাক। ওয়াটার স্ট্রাইডার (Water Strider), পানির উপরিতলে ঘুরে বেড়ানো একটা পতঙ্গ। বিভিন্ন পুকুর, জলাশয়ে পানির উপর দিয়ে এদেরকে হেঁটে বেড়াতে দেখা যায়। ফিমেল স্ট্রাইডারের শরীরে যৌনাঙ্গকে রক্ষা করার জন্যে একটা আবরণ থাকে। মেল স্ট্রাইডার তাই সেক্সের ক্ষেত্রে একটা কৌশল অবলম্বন করে। ফিমেলকে সে জোরপূর্বক ধরে রেখে পা দিয়ে পানিতে আঘাত করতে থাকে। এতে পানিতে তরঙ্গের সৃষ্টি হয়। যা অন্যান্য পোকা, মাছকে আকৃষ্ট করে। ফিমেল স্ট্রাইডারের তখন উভয় সংকট ! হয় মাছের খাদ্য হতে হবে, নয়ত মেল স্ট্রাইডারের কাছে নতি স্বীকার করতে হবে। স্বভাবতই সে যখন নত হয়, মেল পতঙ্গটি তখন পানিতে ভাইব্রেশন বন্ধ করে। এভাবে ক্ষুদ্র প্রজাতির এই প্রাণিদের মধ্যে একটা বলপূর্বক যৌনমিলন ঘটে। নিচের ভিডিওতে এটা দেখা যাবে-

সাধারণত অমেরুদণ্ডী প্রাণিতে এধরণের ঘটনা বেশি ঘটতে দেখা যায়। জীববিজ্ঞানে একে ‘ট্রমাটিক ইনসেমিনেশন’ বলা হয়। অর্থাৎ শুক্রাণুকে নারীদেহে প্রবৃষ্ট করানোর সময় এমন কোনো পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া, যাতে নারীর শরীর অন্তত এমন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যেন আর কোনো পুরুষের শুক্রাণুর জন্য সে রিসেপ্টিভ না থাকে। এই ঘটনা অমেরুদন্ডী প্রাণিদেহে পাওয়ার কারণ হল, অমেরুদণ্ডী প্রাণিদের মুক্ত-সংবহন তন্ত্র রয়েছে এবং সমস্ত অর্গ্যানই হিমোলিম্ফ দিয়ে পরিবহণ পায়। তাই কোনভাবে ওভারিতে নয়, বডি ক্যাভিটিতে শুক্রাণু জমা করতে পারলে ওভারিতে তা পৌঁছে যায়। এবং নারীও আঘাত পায়, যাতে দ্বিতীয় পুরুষ তার কাছে আর চট করে যেতে চায় না। এই পদ্ধতি বিবর্তনের লড়াই-এ জিতেছে, সেটি প্রমাণিত, কারণ নারীরও বেশ কিছু অভিযোজন (রেজিস্টিভ অর্গান, যেগুলো পরে আলোচনা করা হবে) দেখা যায়, নিজেকে ট্রমাটিক ইনসেমিনেশন থেকে বাঁচানোর জন্য।

কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে: বেড বাগ, পুরুষ নারীদেহের পেট ফুটো করে শুক্রাণু ত্যাগ করে। একধরনের বিটল, তার রয়েছে পুরুষাঙ্গে প্রচুর কাঁটা। কেউ কেউ কায়টিন ভাঙ্গতে পারে এমন এনজাইম দিয়ে নারী সঙ্গীর দেহে ফুটো করে। একধরনের মাকড়সা পেটে ফুটো করার পর ওভারিও ফুটো করে তার মধ্যে স্পার্ম ডিপোজিট করে। ওয়াটার স্ট্রাইডার বিটলরা যদি কোনো নারী সঙ্গমে রাজি না হয়, তবে তার দিকে শিকারী প্রাণীদের টেনে আনে, যেটা একটু আগেই দেখা হলো। Sea Otters, বাংলায় যাকে আমরা ভোঁদর বা উদ্বিড়াল বলে থাকি। স্তন্যপায়ী এই প্রজাতির মধ্যেও ফোর্সফুল কপুলেশন দেখা যায়। ভোঁদড়ের প্রতিদিন প্রচুর খাদ্যের প্রয়োজন হয়। দেশের গড় ওজনের শতকরা ২৫ ভাগ খাদ্য তাদের একদিনে লাগে। যখন এই খাদ্যের সংকট দেখা দেয়, তখন পুরুষ ভোঁদর অন্য পরিবারের বাচ্চা ভোঁদরকে আটকে রাখে এবং তার মায়ের কাছে খাদ্যের বিনিময়ে মুক্তি দাবি করে। যদি মা ব্যর্থ হয়, তাহলে এই বাচ্চা ভোঁদরগুলোর উপর চলে অত্যাচার। কম বয়স্ক ফিমেল ভোঁদরকে পানির মধ্যে মুখ চুরিয়ে রেখে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ধর্ষণ করা হয়। অনেকসময় এক অঞ্চলের ভোঁদর আরেক অঞ্চলে এসে আক্রমণ করে, জায়গা দখল করার জন্যে। যদি তারা জয়ী হয়, তখন ঐ অঞ্চলের ফিমেলদেরকে রেখে অন্যান্যকে দূরবর্তী এলাকায় স্থানান্তর করতে হয়। পরাজয়ের কারণে উন্মত্ত দলের জেষ্ঠ্যরা এসময় কমবয়স্ক ভোঁদরদের উপর শারীরিক নির্যাতন চালায়, ধর্ষণ-হত্যা করে। ভিডিওতে দেখা যেতে পারে-

ডলফিন (Bottlenose Dolphin) আমাদের পরিচিত একটা প্রাণি। প্রধানত স্তন্যপায়ী প্রাণিদের মধ্যে মানুষের পরেই অনেকক্ষেত্রে এদেরকে স্থান দেওয়া হয়। ডলফিন প্রজাতিতে যৌন-আক্রমণ বেশ তীব্র। মেল ডলফিন সাধারণত একটা দলের মধ্যে থেকে ফিমেলকে আলাদা করে। যদি কাউকে না পায়, তাহলে দলের সবচেয়ে ছোট মেল ডলফিনকে তখন যৌনাকাঙ্ক্ষা (কিছু স্তন্যপায়ী শুধুমাত্র বংশবৃদ্ধির জন্যে সেক্স করে, এমন নয়। কামনা থেকেও সেক্স করে, যাকে ‘sex for pleasure’ বলা হয়। পরবর্তীতে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।) মেটাবার কাজে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া কোনো একটা দলের ফিমেল ডলফিনদেরকে আলাদাভাবে সুরক্ষা দেওয়া হয়, যাতে বাইরের কেউ এসে তাদের ভোগ করতে না পারে।

পাখিদের মধ্যেও বলপ্রয়োগে যৌনমিলন স্বাভাবিক ঘটনা। আফ্রিকায় অনেকটা মাছরাঙার মতো এক প্রজাতির পাখি, যারা মূলত মৌমাছি খায়, তাদের গোত্রে এধরণের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যদিও এরা দলবন্ধভাবে থাকে, অর্থাৎ এক নীড়ে পুরুষ এবং স্ত্রী বসবাস করে, কিন্তু কোনো কারণে স্ত্রী পাখিটি যদি একা বাসা ছেড়ে কোথাও যায়, তাহলে তার উপর অন্য পুরুষ পাখিরা আক্রমণ করে। এক থেকে বারোটা পুরুষ পাখি দ্বারা একটা স্ত্রী পাখি আক্রান্ত হতে পারে। আক্রমণ করা পুরুষ পাখিরা সবসময়ই সঙ্গীযুক্ত হয়। অর্থাৎ জোড়া নেই, এমন পুরুষ পাখি সাধারণত এ কাজ করে না। তাই অনেকক্ষেত্রে নীড় থেকে উড়ে যাওয়ার সময় স্ত্রী পাখিরা উচ্চস্বরে শিস দেয়। যাতে তার সঙ্গী বুঝতে পারে, তার প্রহরা প্রয়োজন। এরকম অন্যান্য অনেক প্রজাতির মধ্যে জোরপূর্বক জৈবমিলন একটা প্রাকৃতিক ঘটনা। বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস (Mallard duck), বাঁদুড় (Brown Bat), ওরাংওটাং, শিম্পাঞ্জি- তাদের গোত্রে ফোর্সফুল কপুলেশনের খোঁজ পাওয়া যায়। ওরাংওটাং, শিম্পাঞ্জি এবং মানুষের বর্গ যেহেতু একই (প্রাইমেট), তাই এই দলভাগের মধ্যে যৌনচর্চাকে আলাদাভাবে ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।
প্রাইমেট বর্গের মধ্যে যৌন নিপীড়নকে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করলে হয়-

“Any use of force or threatened use of force by a male against a female that functions to increase that male’s mating access to the female, or that functions to decrease the probability that she will mate with another male, or both.”

এই সংজ্ঞাটা কার্যকর হবে সেইক্ষেত্রে, যদি একটা পুরুষজীব অপর এক নারীর উপর তার যৌন-আক্রমণের ফলে সফল প্রজনন হার বৃদ্ধি করতে পারে এবং অন্য পুরুষের জন্যে এই হার কমাতে পারে। বোস্টন ইউনিভার্সিটির নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক চেরিল নট দীর্ঘদিন ওরাংওটাং এর উপর গবেষণা করে তাদের যৌনজীবন নিয়ে চমৎকার কিছু তথ্য পেয়েছেন। মানবসমাজে যেমন ধর্ষণের ক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক অবস্থান একটা গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক অনুষঙ্গ, তেমন ওরাংওটাংদের ক্ষেত্রেও। যেসব পুরুষ ওরাংওটাং সেক্সুয়ালি ম্যাচিউর। অর্থাৎ দলে উচ্চশ্রেণির, তাদের গালে দাঁড়ির মতো কিছু জিনিস থাকে। যেগুলো ওদের ম্যাচুরিটির লক্ষণ। তুলনামূলক বিচারে কম ম্যাচিউর পুরুষের চেয়ে এরা ধর্ষণে বেশি সফল। এখানে সফল বলতে প্রজননগতভাবে বেশি কার্যকরীতা বুঝানো হচ্ছে। ধর্ষণ, ওরাং মিলনে একটি দরকারী কম্পোনেন্ট। নট দেখিয়েছেন, অতিরিক্ত শারীরিক আঘাত ও জোর করে করা সঙ্গম, যেটা পরিণত ওরাং করে থাকে, নারী ওরাংকে স্বভাবতই রেজিস্ট করতে প্রভাবিত করে, কিন্তু প্রজননগতভাবে এই রকম সঙ্গম বেশি সফল। অন্যদিকে ছোট ওরাংরা যদিও বেশি সময় ধরে এক একটি ফিমেল গ্রুপে সঙ্গম করে, তারা প্রজননগতভাবে খুব সফল নয়। সেটা হয়ত তাদের কম টেস্টস্টেরণ এর কারণে। কিন্তু এরা শারীরিক আঘাতও খুবই কম করে, পরিণত পুরুষের তুলনায়, নারী ওরাং কম বাধা দেয়। কিন্তু যথেষ্ট উত্তেজিত হয়না। অন্যদিকে শিম্পাঞ্জি পুরুষ যে শুধু ধর্ষণ করে তাই নয়, রুগ্ন ও বলহীন পুরুষ শিম্পাঞ্জিকে যে নারী পছন্দ করে তাকে বেদম পিটিয়ে তবেই ধর্ষণ করে। কিন্তু, তা সত্ত্বেও নারী মাঝে মধ্যেই খানিকটা নিম্নগোত্রীয় শিম্পাঞ্জিকে বেছে নেয়। এই কারণে নট বলেছেন , ওরাং ফোর্সফুল কপুলেশন করে না বলে- বলা ভালো যে তারা “resisted mating” করে। এবং এই মিলনে রেজিস্ট্যান্স ও কো-অপারেশন নারী ওরাং এর দিক থেকে প্রায় সমান সমান। ধর্ষণ ও সম্মতি সমানুপাতিক, এবং তার পরিমাণ একটা ন্যুনতম স্কেলে পৌঁছনোর আগে প্রজননগতভাবে মিলন সফল নয়।

এতক্ষণ আমরা বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে ধর্ষণের উদাহরণ দেখলাম। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রাণিদের মধ্যে এই ধর্ষণের কোনো উপযোগিতা আছে কি? কারণ, আমরা উপরে সংজ্ঞায়ন করে এসেছি যে, প্রাণি প্রকৃতিতে সেভাবেই অভিযোজিত হয়, যাতে তার বেনিফিট সর্বোচ্চ হয়। তাহলে ধর্ষণ কি আদৌ প্রাণিজগতে কোনো বেনিফিট দিচ্ছে ? এর উত্তর বিশ্লেষণের জন্যে যে উপাত্ত দরকার, তা আমরা উপরের উদাহরণগুলো থেকে নেবো। প্রথমেই আমরা দেখতে পাই, যেসব প্রাণি বেশিরভাগ সময় পেনিট্রেটিভ সেক্সে অংশ নেয়, তাদের মধ্যে ধর্ষণপ্রবণতা বেশি। এর মূল উদ্দেশ্য হলো, বেশি পরিমাণে বংশবৃদ্ধি করা। কিন্তু পুরুষের বহুগামিতার উদাহরণই বেশি কেন ? কারণ, জীববিজ্ঞানে (Embryology বিভাগ) দেখা যায়, পুরুষের শুক্রাণু এবং নারীর ডিম্বাণুর মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। যে পার্থক্যের দিকে সবচেয়ে গভীর মনযোগ দেওয়া প্রয়োজন, সেটা হল- একজন এডাল্ট পুরুষের দৈনিক গড়ে ২৯০ মিলিয়ন শুক্রাণু উৎপন্ন হয়। পঞ্চাশ বছরের বেশি বয়স্কদের এর চেয়ে কম, ১৩০ মিলিয়ন। প্রকৃতপক্ষে একজন সুস্থ পুরুষ প্রতি সেকেন্ডে ১৫০০ শুক্রাণু কোষ উৎপন্ন করে! এবং তার জীবদ্দশায় এই শুক্রাণুর সংখ্যা প্রায় ৫০০ বিলিয়ন। অন্যদিকে, একজন নারী একটি ঋতুচক্রে (গড়ে ২৮ দিন পরপর) একটিমাত্র ডিম্বাণু উৎপন্ন করে। স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়, শুক্রাণুর সংখ্যা যেহেতু বেশি, তাই এর সহজাত প্রবণতা হলো যত বেশি সম্ভব প্রতিলিপি সৃষ্টি করা। অন্যদিকে, ডিম্বাণুর উৎপাদন হার যেহেতু কম (একজন পুরুষ, একবার নিঃসরণে যে পরিমাণ শুক্রাণু নির্গমন করে, নারী তার পূর্ণজীবনে তার চেয়ে কম ডিম্বাণু উৎপন্ন করে), তাই নারীরা সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রচন্ড সাবধানী থাকে। যেন একটি উৎকৃষ্ট পুরুষের শুক্রাণুর মাধ্যমেই তার বংশধর তৈরি হয়। এখানে উৎকৃষ্ট পুরুষ বলতে শারীরিক দিক থেকে শক্তিশালী এমন নয় সবক্ষেত্রে। উপরে বলা হয়েছে, নারী শিম্পাঞ্জি সঙ্গমের জন্যে অনেকক্ষেত্রে দুর্বল পুরুষকে বেছে নেয়। এর কারণ পারিবারিক বন্ধনের ব্যাপারেও নারীকে সতর্ক থাকতে হয়। সন্তান জন্মদানের পর, তার লালনপালন, খাদ্য চাহিদাপূরণ এবং নিরাপত্তাদানের জন্যে একজন নীতিশিষ্ট পুরুষের প্রয়োজন হয়। ফলে খানিকটা নিম্নগোত্রীয় পুরুষ হলে, তার পক্ষে বহুগামিতার সুযোগ কম। এবং সে নিজ সন্তানের প্রতি অন্যদের চেয়ে বেশি বিশ্বস্ত থাকবে। ফলে, পুরুষ এবং নারী, এই দুই ভিন্ন সত্ত্বার জন্যে বহুগামিতা ভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়। পুরুষ স্বভাবত বহুগামিতা এবং সেক্স এগ্রেশনের পক্ষে, অন্যদিকে নারী এর বিপক্ষে। তবে কিছুক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের বহুগামিতাকে নিজেদের স্বার্থে (ফিমেল হারেম) ব্যবহার করে। তাহলে, এইসকল যুক্তির ভিত্তিতে আমরা এটা বলতে পারি যে, ধর্ষণ বা জোরপূর্বক সঙ্গম আসলে প্রাণিদের মধ্যে তেমন কোনো বেনিফিট দেয় না। বরং একই স্পেসিসের মধ্যে কনফ্লিক্ট তৈরি করে। এখানে নতুন একটা প্রশ্ন চলে আসে, তা হল- এই দ্বন্দ্বের ফলাফল আসলে কী?

এই দ্বন্দ্বের ফলাফল আসলে দুইদিকে হতে পারে। প্রথমত, এই যৌন বিরোধিতা পুরুষ এবং নারীকে দুইটি আলাদা সত্ত্বা হিসেবে বিবর্তিত হতে সাহায্য করে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ; বলা যায় প্রাণিবৈচিত্রতার মূল উপাদান। বিবর্তনবিদ্যায় বলা হয়, একই স্পেসিস-এর নারী এবং পুরুষ প্রাণির আলাদাভাবে বিবর্তিত হওয়ার মূল কারণ সেক্সুয়াল কনফ্লিক্ট। অর্থাৎ কোনো একটি কৌশল , যা পুরুষকে এনে দিচ্ছে তার অপটিমাল ফিটনেস, বিবর্তনের আঘাত ও ঝড়-ঝাপটা সহ্য করে নিজেকে পরবর্তী প্রজন্মে নিয়ে যাওয়ার কাঙ্খিত উপকরণ। সেই স্ট্র্যাটেজি কাজ করছে নারীর সারভাইভ্যাল রেশিও এবং তার জীবনবিস্তার কমিয়ে আনতে। উল্টোদিকে , নারীর অভিযোজন যথাসম্ভব বাধা দিচ্ছে এই কৌশলগুলোকে এবং নারী লড়ে যাচ্ছে মনোগ্যামাস মিলন এবং ফ্রিডম অফ চয়েস ব্যবহার করার জন্য। একটা স্পেসিস বিবর্তিত হচ্ছে একটা ইউনিট হিসাবে নয়, দুটো কাউন্টার একটিং ইউনিট হিসাবে। এবং দুটো কাউন্টার-একটিং জিনের সেট, যেগুলো আমাদের এনে দেয় বাহ্যিক গুণাবলীসমূহ, তারা স্পেসিসের বিবর্তনে কো-ইভলভ করছে, প্রত্যেক মেটিং-এ এবং তা থেকে উদ্ভূত সন্তানে একটা সেট অন্যটাকে ডমিনেট করার চেষ্টা করছে জেনেটিক্যালি। ফলে ক্রমাগত নারী এবং পুরুষ- দুইটি আলাদা জৈবিক বৈশিষ্ট্য বহনকারী জীব হয়ে উঠছে। এখন সেক্সুয়াল কনফ্লিক্টের অন্যদিকে প্রবেশ করি। যেহেতু ফোর্সফুল কপুলেশন প্রাণিজগতের জন্য বায়োলজিক্যালি পজিটিভ কিছু নয়, তার যৌক্তিকতা আমরা উপরেই দেখলাম, তাহলে প্রাণিদের মধ্যে অবশ্যই এর জন্য কিছু রেজিস্টিভ উপকরণ থাকা যৌক্তিক। অর্থাৎ এমন কিছু অর্গান প্রাণিদের (বিশেষত ফিমেল) মধ্যে বিবর্তনের ধারায় তৈরি হওয়া সম্ভব, যা কিনা ফোর্সফুল কপুলেশনকে প্রতিহত করতে পারে। এর উদাহরণগুলো আমরা পর্যায়ক্রমে দেখব-

উদাহরণ- ১, ম্যালার্ড হাঁস। হাঁস গোত্রের এক-তৃতীয়াংশ মিলন ফোর্সড। সবচাইতে লম্বা পুরুষাঙ্গ দেখা যায় এদের মধ্যে, পুরোপুরি ইরেক্টেড অবস্থায় তার নিজের দৈর্ঘ্যের সমান, যা কিনা আবার কর্ক-স্ক্রু এর মত প্যাঁচানো-ব্যালিস্টিক পেনিস। প্রথমে একটি বাসা বেঁধে পুরুষ ও নারী একটি দম্পতি তৈরী করে। নারী হাঁস গর্ভবতী হওয়ার পর পুরুষেরা দল বেঁধে অন্যান্য সঙ্গীহীন কিংবা দুর্বল সঙ্গীযুক্ত নারী হাঁসেদেরও আক্রমণ করে এবং চালায় গণধর্ষণ। এদের আচরণ সেক্সুয়াল প্রিডেটরদের মতোই। এই শিকারীদের হাত থেকে বাঁচতে, আশ্চর্যজনক ভাবে নারী হাঁসেদের যোনিও হয় কর্ক-স্ক্রু এর মত, ঠিকঠাক প্যাঁচে ঘুরে বসলে তবেই সঙ্গম হওয়া সম্ভব। এদিকে এই দীর্ঘ যোনিপথে প্রিডেটরদের বোকা বানাতে রয়েছে ফলস গহ্বর, যেসব পথ আদৌ ওভারিতে লিড করেনা, উল্টো দিকের প্যাঁচ! এইভাবে নারী হাঁস নিজেকে রক্ষা করে, একই সঙ্গে নিজের সেক্সুয়াল চয়েস কেও ঠিক রাখে। মনে রাখা প্রয়োজন এই জটিল মেকানিজম একদিনে তৈরী হয়নি। এটা হতে ম্যালার্ড হাঁসকে দীর্ঘ বিবর্তনের পথ অতিক্রম করতে হয়েছে।

উদাহরণ- ২, ড্রসোফিলা। একপ্রকার মাছি। বাংলায় যাকে ‘ডাসা মাছি’ বলা হয়। সাধারণত পাকা ফলের আশেপাশে এদের ঘুরতে দেখা যায়। পৃথিবীতে অধীত যেকোন জীবসত্ত্বার মাঝে এই গণের পুরুষদের শুক্রাণু কোষ সবচাইতে দীর্ঘ; যেমন ড্রসোফিলা বাইফারকা (D. bifurca) নামের প্রজাতির পুরুষদের প্রায় ৫৮ মিলিমিটার (২.৩ ইঞ্চি) দীর্ঘ শুক্রাণু রয়েছে। এসব শুক্রাণু কোষ মূলত লেজ, যা স্ত্রীদের কাছে পাকানো কুণ্ডলীর মতো নিষ্কৃত করা হয়। ড্রসোফিলা বাইফারকা ছাড়াও ড্রসোফিলা গনের অন্যান্য সদস্যরাও অপেক্ষাকৃত বৃহৎ আকৃতির শুক্রাণু কোষ তৈরী করে। ড্রসোফিলা মেলানোগেস্টারের শুক্রাণু কোষ মোটামুটি ১.৮ মিলিমিটার দীর্ঘ হবার পরও এটি মানুষের শুক্রাণু কোষের চাইতে ৩৫ গুণ লম্বা! ড্রসোফিলা মেলানোগেস্টার প্রজাতিদলের বেশ কয়েকটি প্রজাতির মধ্যে ‘ট্রমাটিক ইনসেমিনেসনের’ মাধ্যমে মিলন সংঘটিত হয়। ড্রসোফিলার সেমিনাল ফ্লুইডে থাকে প্রায় ৮০ টি এক্সেসরি গ্ল্যান্ড প্রোটিন। যৌন মিলনের পর এই প্রোটিনের কাজ হলো স্ত্রী ড্রসোফিলাকে যৌন উত্তেজনা রহিত করা। দেখা গেছে যে এর মধ্যে দু একটি প্রোটিন বেশি তৈরী হলে, পুরুষ ড্রসোফিলার লাইফ স্প্যান কমে যায় , অর্থাৎ সেক্সুয়াল আধিপত্য কিছুটা দাম দাবি করেই। উল্টো দিকে কয়েকটিকে নক আউট করলে কমে যৌন পারফরম্যান্স।

উদাহরণ- ৩, বিভিন্ন প্রাণীতে দেখা যায় ভ্যাজিনাল প্লাগ বা মেটিং প্লাগ। যেগুলো সেক্সুয়াল একাধিপত্যের নজির। মৌমাছি কিংবা কাঠবেড়ালিতে মেটিং প্লাগ তৈরী হয় সেমিনাল ফ্লুইড থেকে। যেটা কিনা নারীর যৌনদ্বার বন্ধ করে দেয়, ১২ থেকে ৪৮ ঘন্টার মত। নিষ্ক্রিয় পুরুষ প্রহরা বলা যেতে পারে, এতে অতিরিক্ত বল প্রয়োগের বা নিজে উপস্থিত থেকে প্রহরা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। পুরুষ প্রাণিটি তখন অন্য নারীর খোঁজে যেতে পারে।

স্ত্রী প্রাণির এইসকল এনাটমিগত বৈশিষ্ট্য তৈরির জন্যে প্রচুর এনার্জি ক্ষয় হয়েছে। নতুন জিন এবং মেটাবলিজম তৈরির পিছনে প্রকৃতিকে দিতে হয়েছে দীর্ঘ সময়। যাকে বিবর্তনের ভাষায় ‘কস্ট অফ অ্যাডাপ্টেশন’ বলা হয়। মনে রাখা প্রয়োজন যে, প্রকৃতির এই শক্তিক্ষয়ের পিছনে একটা নিগূড় উদ্দেশ্য অবশ্যই আছে। এমনি এমনি কোনো কারণ ছাড়া এসব কিছু হয় না। যদি নারী প্রজাতিতে এরকম রেজিস্টিভ কোনো ফাংশন তৈরি না হতো, তাহলে যৌন অবদমনের কারণে যেকোনো একটা প্রজাতির(জেন্ডার) ক্রমশ বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। প্রকৃতি নারী এবং পুরুষ- উভয় সত্ত্বাকেই তাই প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। ফলে প্রাণিজগতের মধ্যে ‘ধর্ষণ’ শুধুমাত্র একটি সামাজিক ক্রিয়া(অপরাধমূলক অবশ্যই) নয়, জৈববিবর্তনের দীর্ঘপথ জুড়ে এর ইতিহাস লেখা রয়েছে। প্রাণিদের মধ্যে যদি শুধুমাত্র স্বাভাবিক যৌনমিলন ঘটত, তাহলে উপরে বর্ণিত বিশেষ অঙ্গগুলোর কোনো অস্তিত্ব থাকত না। বিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্ট এইসব অঙ্গ এবং কৌশল পুরুষ প্রাণির যৌনচাহিদার পক্ষে। অর্থাৎ ‘নির্বাচিত’(Natural selection)। অন্যদিকে নারীদের শরীরে যে বিভিন্ন প্রতিরোধমূলক অঙ্গ তৈরি হয়েছে, এটিও একটি প্রাকৃতিক নির্বাচন। সুতরাং, সবশেষে এটা বলা আবশ্যক যে, প্রাণিকুলের মধ্যে ‘ধর্ষণ’-কে জৈববিবর্তনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা যায়।
[এই পর্বের সমাপ্তি]

আগামী পর্বগুলোতে যা থাকবে-
১। পুরুষ এবং নারীর যৌনবিবর্তন।
২। মানবসমাজে (নারী এবং পুরুষপ্রধান সমাজে, আলাদাভাবে) নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে যৌনাচার।
৩। মানবসমাজে ধর্ষণের জন্য জৈববিবর্তনের ব্যাখ্যা এবং বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের ব্যাখ্যা।
৪। ধর্ষণ বিষয়ক কিছু কেস স্টাডি।

তথ্যসূত্র:
১। Evolution, Gender, and Rape- edited by Cheryl Brown Travis
২। Journal of Cold Case Review- Kenneth L. Mains
৩। Book Review: A Natural History of Rape: Biological Bases of Sexual Coercion by Susan Hansen
৪। The evolutionary biology of rape by Randy Thornhill / Craig T. Palmer
৫। http://www.guruchandali.com ref: sosen (I’ve directly cited some lines from this blog, So, Special thanks to SOSEN)
৬। Why Do Men Rape? An Evolutionary Psychological Perspective by William F. McKibbin, Todd K. Shackelford, Aaron T. Goetz, and Valerie G. Starratt
৭। A Natural History of Rape: Biological Bases of Sexual Coercion by Randy Thornhill, Craig T. Palmer
৮। ভালোবাসা কারে কয়- অভিজিৎ রায়
৯। https://en.wikipedia.org

লেখক: মুহম্মদ মাজ্‌হারুল ইসলাম।
৩য় বর্ষ, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ,
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।