অপ্রিয় সত্য বলতে নেই, লিখতে নেই।

লতিফ সিদ্দিকী মন্ত্রীত্ব হারিয়েছেন অপ্রিয় সত্য কথনের জন্য। প্রাণে বেঁচে গেছেন – কারণ তিনি সরকার দলের লোক। বিপদে পড়ে বুঝে গেছেন – অপ্রিয় কিছু বলতে নেই।

আব্দুল গাফফার চৌধুরীও বিপদে পড়েছিলেন। তিনি সরকারী দলের একনিষ্ঠ সেবক। তাই বেঁচে গেছেন। বিপদে পড়ে বুঝে গেছেন – অপ্রিয় কিছু বলতে নেই।

আরজ আলী মাতুব্বর লিখেছেন, “সত্যের সন্ধানে”। জীবদ্দশায় লুকিয়ে থেকেছেন – অপ্রিয় সত্য লিখতে নেই।

ডঃ হুমায়ুন আজাদের মাথায় চাপাতির কোপ পড়েছিলো – অপ্রিয় সত্য লিখতে নেই।

দাউদ হায়দার জন্মভূমির নাগরিক অধিকার হারিয়েছেন। দেশ ছেড়ে বেঁচে আছেন – অপ্রিয় সত্য লিখতে নেই।

তসলিমা নাসরিনও নাগরিক অধিকার হারিয়েছেন। দেশ ছেড়ে বেঁচে আছেন – অপ্রিয় সত্য লিখতে নেই। তিনি ভয়কে জয় করেছেন। তাঁর লেখায় কোন কাঁপুনি নেই, জড়তা নেই। জয়তু তসলিমা।

রাজিব হায়দার চাপাতির আঘাতে খুন – অপ্রিয় সত্য লিখতে নেই, বলতে নেই।
নিলয় চক্রবর্তী খুন – অপ্রিয় সত্য লিখতে নেই, বলতে নেই।
ওয়াশিকুর রহমান বাবুও খুন – অপ্রিয় সত্য লিখতে নেই, বলতে নেই।
অনন্ত বিজয় দাসও খুন – অপ্রিয় সত্য লিখতে নেই, বলতে নেই।
ডঃ অভিজিৎ রায়ও খুন – অপ্রিয় সত্য লিখতে নেই, বলতে নেই।

আসিফ মহিউদ্দিন, রাজীব হায়দার, সানিয়ুর রহমান, শফিউল ইসলাম, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাস, নিলয় চক্রবর্তী, ফয়সল আরেফিন দীপন, তুতুল প্রভৃতিদের খুন করে আর কতদিন মিথ্যাকে টিকিয়ে রাখতে পারবে ধর্মীয় প্রতিবন্দী টেরোরিষ্টদের দল? চাপাতির ভয় দেখিয়ে আর কতকাল পৃথিবীকে সমতল বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে? মাথার উপরে আমাদের আকাশকে খুটার উপর লটকিয়ে রাখা যাবে? সূর্য কতকাল সন্ধ্যাবেলায় ঘোলা পানিতে ডুব সাঁতার কাটবে?

ডঃ অভিজিৎ রায় পিএইচডি করেছেন Biomedical Engineering এ, পেশায় Software Engineer. পৃথিবীর মানব প্রজাতির জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে যত প্রযুক্তির উদ্ভব হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে, তার সব কিছুই ইঞ্জিনীয়ারদের জন্য। ইঞ্জিনীয়ারদের এটাই পেশা। পেশাগত ভাবে ইঞ্জিনীয়ারদের বিজ্ঞানী হতে হয়। বিজ্ঞান গবেষক হতে হয়। অভিজিৎ রায় শুধু মাত্র নিজ পেশায় নিমজ্জিত থাকেন নি। তিনি মৌলিক বিজ্ঞান নিয়েও গবেষনা করতেন। বিজ্ঞান-ভাবনা ছিলো তার অন্তরের জিনিষ। সেজন্যই তিনি ছিলেন মুক্তমনা, যুক্তিবাদী মানুষ। গড়ে তুলেছিলেন “মুক্তমনা” প্ল্যাটফরম। সতত ছুটেছেন বিজ্ঞানের প্রান্তিক আবিষ্কারের পেছনে। এসব সংঘবদ্ধ করে বাংলায় প্রবন্ধ লিখতেন, বই লিখতেন। তাঁর সমস্ত লেখাই বিজ্ঞানের প্রান্তিক গবেষনা নিয়ে। আমার মত হাজার মানুষ এসব পড়ার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে থাকতো।

প্রচলিত সমস্ত ধর্মই চতুর মানুষদের সৃষ্টি। তারা অতিশয় চালাক এবং ধুরন্ধর ছিলেন। নিজের ধ্যান-ধারণা দিয়ে সাধারণ মানুষের মস্তিস্কে আবেশ সৃষ্টি করে প্রভাব বিস্তার করতেন। প্রভাবকে মজবুত করার নিমিত্তে অনেক চতুর এবং ধুরন্ধর লোকেরা অলীক ঈশ্বরের নামে এসব প্রচার করতেন। ধুরন্ধরদেরও চিন্তা-ভাবনায় সীমাবদ্ধতা থাকে, ভুল থাকে। তখন ধরা না পড়লেও বিজ্ঞান এক সময় ভুলটা ধরিয়ে দেয়। যদি একটি মাত্র (মাত্র একটিই যথেষ্ট) ভুল ধরা পড়ে, তাহলেই প্রমাণ হয় তথাকথিত সৃষ্টিকর্তা বলতে কিছু নেই। সবটাই চতুরদের বানানো।

আদমকে দিয়ে মানুষের ইতিহাস শুরু হয়নি। হিন্দুদের মনু পৃথিবীর প্রথম মানুষ নয়। রাফিদা আহমেদ বন্যা চার্লস ডারউইনের বির্বতনবাদ নিয়ে বই লিখেছেন বাংলাভাষায়। অভিজিৎ রায় নিজেও অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন। আরজ আলী মাতুব্বরও বিবর্তন নিয়ে লিখেছেন সুললিত ভাষায়। এসব আদম আর মনু নিয়ে সৃষ্ট কল্প-কাহিনীকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়।

পৃথিবীই মহাবিশ্বের সব কথা নয়। ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে আমাদের এই মহাবিশ্বের শুরু। মহাবিশ্বের কোটি কোটি সূর্যের মধ্যে আমাদের ছোট সৌরজগতের কেন্দ্রে যে সূর্যটি আছে তার নিকট আমাদের এই পৃথিবীটা একটা তেজপাতাও নয়। আর মহাবিশ্বের কাছে পৃথিবী একটা বালুকনার কোটি কোটি ভাগেরও ধারে কাছে নয়। আমাদের এই পৃথিবীটা থাকলো কি না থাকলো তার খবর আমাদের সূর্যটাই টের পাবে না। সূর্য কেনো, আমাদের প্রতিবেশী গ্রহ যে বুধ (Venus), সেটারও কিছু যাবে আসবে না। মানুষ তো অতি তুচ্ছ জিনিষ – মানুষের জন্মই শুরু হয় রাসায়নিক প্রক্রিয়া দিয়ে। মানুষের বুদ্ধিমত্তা, প্রতিবন্দী দশা, বাড়ন, স্থিতাবস্থা, পরিশেষে জীবনাবসান, সবই প্রতি মুহুর্তে কোটি কোটি রাসায়নিক প্রক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফসল। এসব ক্রিয়া-বিক্রিয়া শেষ, আমাদেরও সমাপ্তি। দেহ পড়ে থাকে, জীবনের জন্য রাসায়নিক ক্রিয়া বন্ধ হলে পচন ক্রিয়া শুরু হয়। একটা জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। পূনর্জীবন বা হাশরের বিচার মিথ্যা ছাড়া আর কিছু নয়।

অভিজিৎ সেটাই সবাইকে বুঝাতে চেষ্টা করেছেন। মিথ্যা ধর্ম এবং মিথ্যা ঈশ্বর-বিশ্বাস বাদ দিয়ে মুক্তমনা এবং যুক্তিবাদী হয়ে বিশ্বমানবতার ডাক দিয়ে গেছেন। তিনি কতটা সফল হয়েছেন? আর কেউ না পারলেও ইসলামী সন্ত্রাসবাদীরা তার সফলতার সঠিক মূল্যায়ন করেছে। কারণ অভিজিতের লেখা তাদের বিশ্বাসে ভাংগন ধরিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে এখন অগনিত নিরীশ্বরবাদীর সৃষ্টি হচ্ছে। এদের অনেকেই চাপাতির ভয়ে সাবধানে থাকছে। যত সময় যাবে এদের সংখ্যা বেড়েই যাবে কারণ অনুপস্থিত অভিজিৎ বেশী শক্তিশালী। অভিজিতরা নেই, কিন্তু এদের লেখার মৃত্যু নেই। নতুন প্রজন্ম অবশ্যই যুক্তি এবং মুক্তমন দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করবে, কী অপরাধে এদেরকে খুন করা হয়েছে। এরা তো কাউকে খুন করেনি। এদের শক্তি শুধুই এদের মেধা এবং বুদ্ধিমত্তা। মানুষের মেধার সাথে চাপাতির লড়াই। ছিঃ, পশুরাও এটা করে না।

একটা জিনিষ অবশ্য মনে রাখতে হবে, অভিজিৎ কখনও কারো ধর্ম বিশ্বাসের অনুভূতিতে আঘাতে দেননি। তিনি বলেছেন,কোনরকম কুসংস্কারে নিমজ্জিত না থেকে নিজেদের মেধা, জ্ঞান, এবং বিবেচনা বোধ দিয়ে সব কিছু বুঝার চেষ্টা করুন। তাঁর অগনিত লেখায় তিনি একথাটাই বলেছেন। বিশ্বাসীরাও তাঁর সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা করতে এগিয়ে এসেছেন। তিনি সবিনয়ে প্রত্যেকের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। এ ব্যাপারে মুক্তমনায় তাঁর সাথে কারো ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে এমন দাবি কেউ করতে পারবে না।

সত্য কথনে Giordano Bruno কে পুড়িয়ে হত্য করা হয়েছিলো। Bruno কে খুন করে কি সূর্য দ্বারা পৃথিবী প্রদক্ষিনের ভ্রান্ত ধারণাকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে? অভিজিতদের প্রাণ নাশ করে ধর্মীয় প্রতিবন্দিদের কোনো লাভ হয়নি। বরং নতুন প্রজন্মকে সত্য সন্ধানে বেশী বেশী আগ্রহী করা হয়েছে।

অভিজিতদের মৃত্যু দিবস বলে কোন কিছু নেই। ওদের মৃত্যু নেই, অবিস্মরণীয়। ওরা প্রত্যেকে একেক জন Bruno. আমার মস্তিস্ক কোষে একটা জায়গায় অভিজিতের স্থায়ী নিবাস। আমার কাছে তিনি সদাজাগ্রত। স্কুল সময় থেকে আমার মধ্যে যুক্তিবাদী
মন নিয়ে যে দুর্বল চিত্তটি গড়ে উঠেছিলো, তা অভিজিৎ রায়ই শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। আমি এখন দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করি – ভুতের যেমন অস্তিত্ব নেই, ধুরন্ধরদের দ্বারা সৃষ্ট সৃষ্টিকর্তাদেরও কোন অস্তিত্ব নেই। ইহকাল সত্য, পরকাল মিথ্যা। পরকালে শাস্তির ভয় মতলবাজ ধুরন্ধরদের সৃষ্টি।

“আলো হাতে আঁধারের অভিযাত্রী” অভিজিতের পেছনে ছুটে চলছি।

মহাবিশ্বই সত্য। রাতের অন্ধকার আকাশে মহাবিশ্বের দিকে তাকিয়ে থাকি। লক্ষ কোটি সূর্য, লক্ষ কোটি সৌরজগত। তারই মাঝে আমাদের সৌরজগতটি বড়ই নগন্য। এই নগন্য সৌরজগতের নগন্য একটি গ্রহে বসবাস আমাদের। পরকাল আছে ভাবি, নরক আছে ভেবে ভয় পাই, স্বর্গ আছে ভেবে মানুষ খুন করি। ছিঃ