লিখেছেন: ডাঃ দেব মজুমদার

 

 

দিগন্তে সূর্যের শেষ লালচে রেখাটাও মিলিয়ে গিয়ে আঁধার নেমে এলো দ্রুত পায়ে, তবু খোলা বারান্দায় একাই বসে রইল রিদ্যম। ভেতরের পুঞ্জিভূত কষ্টগুলো ছুরির ছোট ছোট আঘাত হেনে যাচ্ছিল মনে, বসে বসে সেই আঘাতের যন্তনাময় সুখ উপভোগ করছিল সে। আজকাল এভাবেই দিনগুলো কাটে রিদ্যমের।

 

রাজশ্রীর সঙ্গে রিদ্যমের বন্ধুত্ব অনেক দিনের, তা প্রায় দেড় বছরের কাছাকাছি হবে। মেডিকেল কলেজের কষ্টদায়ক দিনগুলো শুরুর কিছু পরেই একই ব্যাচের এই মেয়েটির সঙ্গে তার পরিচয়। সে চুপচাপ ধরণের, শান্ত স্বভাবের মেয়ে; তার গায়ের রঙ শ্যাম বর্ণা হলেও চেহারা মোটামুটি ভালোর দিকেই; চোখগুলো যেন নিপুন হাতে আঁকা, আর হাসিটিও বড় মনকাড়া। পড়াশুনার ব্যাপারে ওর থেকে অনেক সাহায্য পেয়েছে রিদ্যম, মন খুলে দু’জনে আড্ডাও দিয়েছে কত! আসলে রাজশ্রী এমন, যাকে সব বলা যায়, সে যেন সব কিছু গ্রহণ করার জন্যেই বসে আছে। ওর মন যেন বৃষ্টিস্নাত আকাশের মতই নির্মল।

 

প্রথম বছরটি খুব ভালোভাবেই কেটে গিয়েছিল, তবে গোলমালের শুরু এর পরেই। রিদ্যম খেয়াল করে, রাজশ্রীকে না দেখলে, ওর সঙ্গে কথা না বললে ভালোলাগে না একদম, কোন ছেলের সঙ্গে সে মিশলেও বিরক্ত লাগে খুব; আর প্রায় সবসময়ই রাজশ্রী তার মাথার ভেতর ঘোরাফেরা করে। রিদ্যম বুঝতে পারে সে আসলে রাজশ্রীকে ভালোবেসে ফেলেছে। আর বোঝা মাত্রই, নিজের সে অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করার জন্যে ছুটে যায় ওর কাছে।

 

রিদ্যম বুঝতে পারেনা ভুলটা কোথায় ছিল। রাজশ্রী আর সে খুব ভালো বন্ধু, সে যদি রাজশ্রীকে ভালোবেসে ফেলেই তবে অন্যায়টা হয় কোথায়! বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাসা হওয়াটাই কী উত্তম নয়? কিন্তু রাজশ্রী স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, রিদ্যমকে নিয়ে তার প্রেম বা বিয়ে করা কিংবা ভালোবাসার কোন অনুভূতি কখনোই ছিলনা, আর যতদূর ধারণা, পরবর্তীতেও জন্মাবে না। জীবনসঙ্গীর ব্যাপারে তার নিজস্ব পছন্দ সম্পূর্ণ ভিন্ন। আর বন্ধুত্বের সম্পর্কে প্রেমের প্রস্তাব নিয়ে এসে রিদ্যম বড়সড় ভুলই করেছে, এখন তাদের বন্ধুত্বেও এর ফলে ভাটা নেমে আসবে।

 

রিদ্যমের মনে হয় রাজশ্রী হয়তো শেষ কথাগুলো ঠিকই বলেছে। কিন্তু তার ভালোবাসা যত গভীরে শেকড় ছড়িয়েছে, সেখান থেকে উপড়ানোর ক্ষমতা তার আদৌ হবে কিনা সেটাই জানা নেই। আর যতদিন সেটা না হচ্ছে, কী করে পারবে সে রাজশ্রীর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে?

 

মানব প্রজাতির একজন সদস্য (সাধারণত পুরুষ) বিপরীত লিঙ্গের আরেকজন সদস্যের সাথে ‘শুধুই বন্ধু’ থাকতে পারেনা

 

দু’জন বিষমকামী নারী ও পুরুষের মাঝে যৌনতাহীন ঘনিষ্ঠতা বা বন্ধুত্ব (অর্থাৎ প্লেটোনিক ভালোবাসা) কি আদৌ সম্ভব? সাহিত্যের পাতায়, চলচ্চিত্রে, কিংবা আমাদের চারপাশে বিপরীত লিঙ্গের মাঝে গড়ে ওঠা বন্ধুত্ব দেখে স্বাভাবিক নিয়মেই আমরা ভাবতে পারি- হ্যা, সম্ভব। হয়তো আমরা লক্ষ্য করেছি, একই পাড়ায়, স্কুল-কলেজে, কিংবা কর্মক্ষেত্রে পরিচিত হওয়া নারী-পুরুষদের মাঝে নন-রোমান্টিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরী হতে, কখনো বা সে সম্পর্ক তাদের বিয়ের পরেও টিকে ছিল অনেকদিন। জীবন পথে পরিচয় হওয়া কারো সঙ্গে কথা বলে যদি ভাল লাগে, তার সঙ্গে কাটানো সময় যদি আমি উপভোগ করি, তবে কেন সে আমার বন্ধু হতে পারবে না? লিঙ্গভেদ নিশ্চয়ই কোন কারণ হওয়ার কথা নয়, তাই না? কিন্তু বাস্তবতা এবং এর অন্তর্নিহিত সত্য ততটা সরল নয় যতটা আমরা ভাবি। আমরা হয়তো তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে পারি, কিন্তু সেটা হয় খাঁড়া কোন খাঁদের কিনারা ঘেঁষে হাঁটার মতন, রোমান্টিক অনুভূতিরা এসে পা দু’টো টলিয়ে দেবে যেকোন মুহূর্তে।  উল্লেখ্য যে, ‘নারী-পুরুষের মধ্যকার বন্ধুত্ব’ প্রসঙ্গটি অতীব আধুনিক সময়ের একটি ঘটনা, বিংশ শতাব্দীর পূর্বে এর অস্তিত্ব তেমনভাবে টের পাওয়া যাবে না।

 

‘‘Between men and women there is no friendship possible. There is passion, enmity, worship, love, but no friendship.’’ Oscar Wilde

 

সাম্প্রতিক সময়ে হওয়া একটি গবেষণায়(১) দেখা গেছে, নারী ও পুরুষ পারস্পরিক বন্ধুত্বকে কী দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করে তাতে যথেষ্ট ভিন্নতা রয়েছে। প্রথমতঃ পুরুষ তার মেয়ে বন্ধুর প্রতি যতটা আকর্ষণ অনুভব করে, মেয়েটি কিন্তু তার প্রতি তেমনটা করবে না। দ্বিতীয়তঃ পুরুষ ধরে নেয়, সে নিজে যতটা আকর্ষণ অনুভব করছে, মেয়েটির মনেও তেমন অনুভূতিই রয়েছে; অর্থাৎ বিপরীত লিঙ্গের প্রতি পুরুষের মনে যদি রোমান্টিক আবহ তৈরী হয়, সে ভাবে, ঘটনাটি দু’জনের মনেই ঘটছে। কিন্তু মেয়েদের বেলায় হয় সম্পূর্ণ উলটো; পুরুষ বন্ধুর প্রতি তারা ততটা আকর্ষণ বোধ তো করেই না, বরং মনে করে যে, তার বন্ধুটিও একই মনোভাব ধারণ করে। পারস্পরিক আকর্ষণ নিয়ে দু’জন ব্যক্তির মাঝে এই যে ভুল দৃষ্টিভঙ্গির কথা জানলাম, এ থেকেই বলা যায়, নারীর তুলনায় পুরুষের বেলায়, বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে নন-রোমান্টিক সম্পর্ক বজায় রাখা যথেষ্ট কঠিন একটি কাজ। বন্ধুত্বে মেয়েরা অধিকাংশ সময় প্লেটোনিক সম্পর্ক বজায় রাখতে পারলেও, পুরুষেরা এসব সম্পর্কের মাঝে ভবিষ্যৎ প্রেম বা রোমান্টিক সম্পর্কের লুপ্ত সম্ভাবনা দেখতে পায়। আর তাই, বান্ধবীকে ভালোবেসে ফেলার ঘটনা পুরুষের দ্বারাই ঘটে বেশী। তবে সচেতনভাবে প্রায় সবাই বন্ধুর সঙ্গে প্রেম হওয়াকে নেতিবাচক বিবেচনা করে, অবশ্য মনোভাবটি নারীদের তুলনায় পুরুষে কিছুটা দুর্বল।

 

আমরা বন্ধুত্ব তৈরী করি কাদের সঙ্গে? অবশ্যই যাকে আমার ভালো লাগবে; আর এই ভালোলাগাই শেষ অব্দি কারণ হতে পারে ভালোবাসার। শারীরিক বা মানসিক যে সকল বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় আমরা প্রেমে পড়ি বা বিয়ে করি (অর্থাৎ যৌনসঙ্গী নির্বাচন করি), সেই একই বৈশিষ্ট্য জন্ম দেয় বন্ধুত্বের। পারস্পরিক দিক থেকে সন্তুষ্ট দু’জন বন্ধুর মাঝে অনেকগুলো বৈশিষ্ট্যে মিল খুঁজে পাওয়া যাবে; তাছাড়া আমরা তাদেরই পছন্দ করি, যারা আমাদেরই মতো (অ্যাসরটেটিভ মেটিং)। ফলে বন্ধুত্ব বাঁক নিতে পারে প্রেমে, তবে যেটা আগেই বলেছি, ঘটনাটি পুরুষের বেলাতেই ঘটে সচরাচর।

 

লুসি হান্ট’এর নেতৃত্বে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল মনস্তত্ত্ববিদ ১৬৭ জন রোমান্টিক সম্পর্কে আবদ্ধ নারী-পুরুষের ওপর একটি পরীক্ষা চালান। ঐ সকল যুগল প্রেমে আবদ্ধ হওয়ার পূর্বে কতদিন যাবৎ পরস্পরের বন্ধু ছিল জেনে এবং তাদের শারীরিক আকর্ষণীয়তা কেমন সেটা অন্যদের দ্বারা যাচাই করে তাঁরা দু’টোর ভেতর সমন্বয় করেন, এবং আশ্চর্যজনক ফলাফল লক্ষ্য করেন।

 

শারীরিক সৌন্দর্যের দিক দিয়ে কোন যুগলে যত বেশী অমিল থাকে (যেমন, আকর্ষণীয় পুরুষের সঙ্গে অনাকর্ষণীয় নারী), রোমান্টিক সম্পর্কে যাওয়ার পূর্বে তারা তত দীর্ঘদিন পরস্পরকে জানতো, পরস্পরের বন্ধু ছিল। অন্যদিকে, যে সকল যুগলের মাঝে শারীরিক সৌন্দর্যে মিল দেখা যায় (যেমন, আকর্ষণীয় পুরুষের সঙ্গে আকর্ষণীয় নারী, অথবা উল্টোটা), রোমান্টিক সম্পর্কে যাওয়ার পূর্বে খুবই অল্প দিন যাবৎ তারা পরস্পরের বন্ধু ছিল। অর্থাৎ যখন নারী ও পুরুষের আকর্ষণীয়তার মাত্রা একই পর্যায়ে থাকে, তারা সহজেই, অল্প সময়েই পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে প্রেমে জড়ায়। আর যাদের সৌন্দর্যে যথেষ্ট পার্থক্য দেখা যায়, পার্থক্যের মাত্রা বুঝে সম্পর্কিত হওয়ার সময়ও বেশী লাগে। এভাবে নারী-পুরুষের মধ্যকার দীর্ঘ দিনের বন্ধুত্ব অ্যাসরটেটিভ মেটিং অনুযায়ী আমাদের যে আকর্ষণ তাতে প্রভাব ফেলে- আর এমন ক্ষেত্রে, আকৃষ্ট হতে খুব বেশী চাহিদার প্রয়োজন পড়ে না, অর্থাৎ অমিলযুক্ত ব্যক্তিরাও প্রেমে আবদ্ধ হয়।

 

সহজ কথায়, নারী-পুরুষের বন্ধুত্বের মাঝে প্রেমের আবির্ভাব হওয়া, কিংবা কোন একজনের প্রতি অন্যের দুর্বল হয়ে পড়া, এসব কিছুই নির্ভর করে তাদের বাহ্যিক সৌন্দর্যের মাত্রা বুঝে।

 

বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে কারো মনে অন্যের প্রতি জন্ম নেওয়া সুতীব্র অনুভূতি বা বন্ধুত্বের বাইরেও বাড়তি কিছুর আকাঙ্ক্ষা করাকেই পাশ্চাত্য ভাষায় বলে ‘ফ্রেন্ড জোন’ (friend zone)। এমন অবস্থাতে মেয়ে বন্ধুর প্রতি মনে আসে রোমান্টিক প্রেমানুভূতি, কিংবা ছেলেটি আকৃষ্ট হতে পারে শারীরিকভাবে, জাগতে পারে বন্ধুর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের কামনা। পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে, এমনো হতে পারে যে, তারা পরস্পর ইতিমধ্যে শারীরিক সম্পর্কে আবদ্ধ, যদিও বন্ধু, আর এধরণের সম্পর্ককে বলে ‘ফ্রেন্ডস উইথ বেনিফিটস’। এমন সম্পর্কেও মেয়ে বন্ধুটি চাইতে পারে শারীরিক চাহিদার থেকেও বাড়তি কিছু- আর তা হলো, ছেলেটির থেকে ‘দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক গঠনের প্রতিশ্রুতি’, অর্থাৎ ঘুরেফিরে সেই রোমান্টিক সম্পর্কেই জড়িয়ে যাওয়া; এবং শেষ অব্দি অনেকে যায়ও। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফ্রেন্ড জোনে থাকা ব্যক্তির অবস্থা অন্যজনের কাছে থাকে অজ্ঞাত। একজন বন্ধুত্বের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকতে পারলেও অন্যজনের মনের চাহিদা বেড়ে যায় অনেকখানি, যা মেটে না, ফলে মনে তৈরী হয় হতাশা। একদিকে না পাওয়ার ব্যাথা, অন্যদিকে পেতে চাওয়ার ফলে বন্ধুত্ব হারানোর ভয়- এই দ্বৈত দ্বন্দে আমাদের জীবনে আসে অস্থিরতা, ব্যাহত করে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ। আর এমন অবস্থা থেকে মুক্তি কে না চায়? কারো কারো ‘শুধুই বন্ধুত্বে’ সীমাবদ্ধ থাকতে পারার কারণ সঙ্গী নির্বাচন বিষয়ক তার চাহিদাগুলোর ভিন্নতা। যে ধরণের মানুষ সে তার জীবনে চায় বন্ধুটি তেমন নয় বলেই জন্মেনি কোন রোমান্টিক আকর্ষণ, কিংবা কোন কামনা। ফলে তার মাঝে আছে শুধু প্রেমহীন, কামনাহীন এক বন্ধুত্বের সম্পর্ক- যার সংস্পর্শে থাকতে, কথা বলতে হয়তো ভালোলাগে, তবে এর বেশী কিছু নয়। ফ্রেন্ড জোনে থাকা ব্যক্তিটির আকর্ষণ তাই একপক্ষীয়। দু’জনের ক্ষেত্রেই যখন চাহিদাগুলোয় ভিন্নতা থাকবে, তখনই কেবল সম্ভব হয় দীর্ঘমেয়াদি নারী-পুরুষের বন্ধুত্ব বজায় রাখা; তবে সে এক বিরল ঘটনা।

বিবর্তনগত দৃষ্টিকোণ থেকে, নারী-পুরুষের ‘শুধুই বন্ধু’ থাকতে না পারার কারণঃ

বয়ঃসন্ধির পর একজন বালক যখন পুরুষ হয়ে ওঠে, শুক্রাশয় (testis) দু’টো থেকে ক্ষরণ হওয়া টেস্টোস্টেরন তার মনস্তত্ত্বকে প্রজননক্ষম নারীর প্রতি প্রলুব্ধ করায়, উপযুক্ত নারী দেখলে তার প্রতি কামনার জন্ম দেয় (যদি না মানসিকভাবে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকে)। পুরুষের মনোগত এই আচরণকে যৌনাকর্ষণ বলাই শ্রেয়, যেটাকে একধরণের রিফ্লেক্সও বলা যায়। সঙ্গী নির্বাচনে পুরুষ চোখের ওপর নির্ভরর্শীল, বাহ্যিকভাবে কোন মেয়েকে ভালোলাগলেই তার প্রতি কামোত্তেজিত হতে পারে পুরুষ। পরিণত মেয়ে দেখলে প্রথমেই তাদের মাথায় খেলে ‘মেয়েটির সঙ্গে সঙ্গম ঘটানো যায় কিনা’, যার অর্থঃ মেয়েটির মাঝে ব্যক্তির পছন্দসই বৈশিষ্ট্যগুলো আছে কিনা, যাতে করে তাকে বিছানায় তোলা যায়। চাহিদা অনুযায়ী মিললেই মস্তিষ্কের কিছু অঞ্চল উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে, সে মনে মনে তাকে চুম্বন করে, তার নগ্ন শরীর জাপটে ধরে আদর করে- মনের অলিগলিতে এই পুরো ব্যাপারটি ঘটে যায় কিছু মুহূর্তের ব্যবধানে। নারীর সুন্দর মুখ, বড়সড় স্তন বা নিতম্ব তাকে আরো বেশী উদ্দীপনা যোগায়। পুরুষের এই চিন্তা আদিমতম, জৈবিক, এবং স্বতঃস্ফূর্ত- যার সরল উদ্দেশ্য বংশবৃদ্ধি, উৎকৃষ্ট উত্তরাধিকার রেখে যাওয়ার অবচেতন তাড়না।

 

চিন্তাটি সবার মাঝেই যে প্রকট তা অবশ্য নয়, কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটা কাজ করে অবচেতন পর্যায়ে। সামাজিক, শিক্ষাগত মূল্যবোধ ও ধর্মীয় নীতি-শাসন দিয়ে অনেক সময়ে মনের এই আদিমতম দিকটির ওপর প্রলেপ তৈরী করা হয়তো সম্ভব, কিন্তু সব সময়ই কি? কখনো কোন মেয়েকে দেখে পুরুষ তাকে নিয়ে যৌনতার স্বপ্ন দেখেনি এটা অসম্ভব ঘটনা, প্রকৃতপক্ষে এ কাজটি সে প্রতিদিনই করে থাকে, এবং সেটাকে অস্বাভাবিক বলার সুযোগ নেই। মনে রাখা প্রয়োজন যে আমাদের মস্তিষ্ক এভাবেই প্রোগ্রাম করা, কোন নীতিবোধ মেনে আমরা বিবর্তিত হইনি।

 

এই রিফ্লেক্স পুরুষে প্রবল এবং প্রায় বাছবিচারহীন হলেও, মেয়েদের বেলায় কালেভদ্রে এমনটা দেখা যায়; কারণ তারা সহজেই এধরণের চিন্তাকে কাটিয়ে উঠতে পারে, এবং পুরুষের অন্য সকল বিষয় সম্পর্কে উৎসাহী হতে পারে। বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, পুরুষের শুক্রাণু তৈরি হয় অসংখ্য, অবিরত (সেকেন্ডে ১৫০০’র অধিক), তাই সস্তা, ফলে তারা চায়ও যত সংখ্যক নারীতে পারা যায় সেগুলোর বিস্তার ঘটাতে- এতেই আসে তাদের প্রজননগত সাফল্য। কিন্তু মেয়েদের ডিম্বাণু দামী, কারণ তারা অল্প কিছু ডিমের ফলিকল নিয়ে জন্মায় (মাত্র ৪০০টা), যেগুলোই প্রতি মাসে একটি একটি করে পরিণত হয়ে নিষিক্ত হওয়ার অপেক্ষা করে। তাছাড়া গর্ভাধানে মেয়েদেরকে শারীরিক ও মানসিকভাবে যে আত্মত্যাগ সেটাও কম বিবেচ্য নয়, সাথে আছে প্রসব মুহূর্তে মৃত্যুর সমূহ সম্ভাবনা। এসব কারণ বিবেচনায়, পুরুষ যত সহজে ভাবনাহীনভাবে নারীর যোনীপথে তার শুক্রাণু নিক্ষেপ করতে পারে, নারী তত সহজে যে সে ব্যক্তির শুক্রাণু দিয়ে তার মূল্যবান ডিম্বাণু নিষিক্ত করতে চায়না। এটাই মূলত কারণ- কেন পুরুষের মাথায় অবিরাম যৌন চিন্তা আসে (বিশেষ করে হাতে যখন কোন কাজ নেই), এবং কেন মেয়েরা তাৎক্ষনিক যৌনচিন্তা মুক্ত থাকতে পারে। মেয়েরা বরং পুরুষের সঙ্গে প্রাথমিক অবস্থায় স্বাভাবিক সম্পর্ক (আমরা যেটাকে বন্ধুত্ব বলতে পারি) গড়তেই আগ্রহ বোধ করে, কারণ এতে করে পুরুষটির যোগ্যতা তথা উপযুক্ততা (পেশা, শিক্ষা, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য) যাচাই করার যথেষ্ট সময় ও সুযোগ মেলে। তাছাড়া অন্য যেকোন সামাজিক সম্পর্কের মতই, শুধুমাত্র প্রয়োজনের তাগিদেও (কাজে সাহায্য পাওয়া, মনের কথা বলা, একাকীত্ব কাটান) তারা পুরুষবন্ধু খোঁজে। কিন্তু পুরুষের নিকট এই বন্ধুত্ব, এই ঘনিষ্ঠতার ভুল বার্তা পৌঁছুতে পারে, এবং সেক্ষেত্রে পুরুষটি যদি নারীকে প্রেম প্রস্তাব পাঠায়, কিংবা যৌন ইঙ্গিত করে তবে অবাক হওয়ার কিছু নেই। পুরুষের নিকট প্রজননক্ষম সকল নারীই ‘যৌন উপকরণ’ (sex object), এমনকি বন্ধুত্বের আবরণেও, যার সাথে জীবনের কোন না কোন সময় সুযোগ আসতে পারে সঙ্গম ঘটানোর, নয়তো প্রেম হওয়ার (যার চূড়ান্ত পরিণতি ঐ সঙ্গমকার্যই); অবচেতন মনে পুরুষ সেই সময়েরই কামনা করে।

 

আদিম গুহা জীবনে, মেয়েরা খুবই অল্প বয়সে তাদের যৌন জীবনে প্রবেশ করতো, চলে যেতো কোন পুরুষের আলিঙ্গনে। শুরু থেকেই নারীর ওপর চলেছে পুরুষের আধিপত্য, ছিল যৌন অধিকার বিষয়ক সচেতনতা- নিজের অধিকারে থাকা নারীটির অন্য পুরুষের সঙ্গলাভ কিংবা যৌনতায় অংশ নেওয়া ছিল নিষিদ্ধ(২)। এমতাবস্থায়, নিজ বংশের বাইরের কোন পরিণত পুরুষের সঙ্গে যৌনতাহীন ঘনিষ্ঠতা বা সহায়তাকেন্দ্রিক বন্ধুত্ব গড়ে তোলা কোন নারীর জন্য একটু অস্বাভাবিকই বলা চলে। তাছাড়া যৌন-সম্পর্কহীন নারী-পুরুষের বন্ধুত্বের তেমন কোন মূল্যও বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পাওয়া যাবেনা।

 

ডেভিড বাস ও এপ্রিল ব্লেস্ক, টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন মনস্তত্ত্ববিদ, প্রায় ২৩১ জন অংশগ্রহণকারী নারী ও পুরুষের ওপর বিপরীতলিঙ্গ বন্ধুত্ব বিষয়ক একটি গবেষণা পরিচালনা করেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল এটা জানা যে, পুরুষ ও নারী এমন বন্ধুত্ব থেকে পাওয়া কোন্‌ কোন্‌ দিককে লাভজনক মনে করে। তাঁরা দেখেন, পুরুষ তার বান্ধবীর সাথে সঙ্গমে (sexual act) অংশ নেওয়াকে (মেয়েটির প্রতি যদি রোমান্টিক আকর্ষণ নাও থাকে) বা তার সঙ্গে রোমান্টিক সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়াকে সবথেকে লাভজনক ভাবে; অন্যদিকে, নারী তার পুরুষ বন্ধুর থেকে চায় সুরক্ষা*। এছাড়া, নারী ও পুরুষ উভয়ই ‘উপযুক্ত সঙ্গী কিভাবে আকৃষ্ট করা যায়’ একে অন্যের থেকে সে তথ্য সংগ্রহকে মনে করে লাভজনক।

 

*নারী বরাবরই ‘সুরক্ষা পাওয়া’কে (হিংস্র জন্তু বা কামুক পুরুষ থেকে) অনেকবেশী গুরুত্ব দেয়। তবে এটা অনিশ্চিত যে তারা এটাকে সঙ্গীর উপযুক্ততা বিচারে ব্যবহার করে কিনা। তবে দেখা গেছে, যেসকল পুরুষ নারীদের সুরক্ষার দায়িত্ব বহন করে তারা সহজেই ঐসব নারীর থেকে যৌন-প্রবেশাধিকার পেয়ে যায়। যেমন, বেবুনদের মাঝে এমন একটি ব্যাপার লক্ষ্য করা গেছে; যেসকল নারী বেবুন কোন পুরুষের থেকে সুরক্ষা ও খাদ্যের ভাগ পায় তার সঙ্গে সে বিশেষ ধরণের বন্ধুত্ব বজায় রাখে, এবং মাঝে মাঝে তাকে সঙ্গমে অংশ নেওয়ার অনুমতি দেয়।

 

পরস্পরকে দীর্ঘদিন যাবৎ চেনাজানার ফলে, কিংবা বন্ধুত্ব থেকে যে ভালোবাসার জন্ম, যে প্রেমময় সম্পর্কের উৎপত্তি, সেটাই প্রকৃত অর্থে উত্তম যাত্রা। বন্ধুত্বের ফলে একে অপরকে ভালো রকম উপলব্দি করা সম্ভবপর হয়, তৈরী হয় পরস্পরকে দীর্ঘ জীবনের জন্য গ্রহণের মানসিকতা। দাম্পত্য জীবনে সফলভাবে এগিয়ে যেতে স্বামী-স্ত্রীর ভেতরকার বন্ধুত্ব অমূল্য উপাদানতুল্য। বন্ধুত্বের গুরুত্বপূর্ণ এক উপকরণই হচ্ছে পারস্পরিক আকর্ষণ (প্রকৃতপক্ষে যৌনাকর্ষণ), ফলে কিছু কদমের অগ্রসরই বয়ে আনতে পারে ভালোবাসার। কিন্তু প্রকৃত সমস্যা আসে তখনই যখন কেউ একজন ‘ফ্রেন্ড জোনে’ আটকে যায়, এবং অন্যজন তার ‘শুধুই বন্ধুত্বে’ দাঁড়িয়ে থাকে। সমলিঙ্গ বন্ধুত্ব কিংবা রোমান্টিক সম্পর্ক থেকে বিপরীতলিঙ্গ বন্ধুত্ব তাই অনেক বেশী জটিলতা সম্পন্ন। তাছাড়া একজনের রোমান্টিক সম্পর্কের মাঝে বিপরীতলিঙ্গ বন্ধুর উপস্থিতি তার সঙ্গী বা সঙ্গিনীর মনে ঈর্ষারও জন্ম দেয়, বয়ে আনে বাড়তি জটিলতা।

 

……………………………………………………………

 

লেখাটি ‘রোদেলা প্রকাশনী’র ব্যানারে প্রকাশিত আমার প্রথম বই ‘ত্রয়ঃ আকর্ষণ, ভালোবাসা ও যৌনতা (খণ্ড-১)’ থেকে নেওয়া একটি অধ্যায়। বইটি প্রকাশিত হলো বইমেলা ২০১৮ তে।

 

 


……………………………………………………………

 

 

রেফারেন্সঃ

(১)  Bleske-Rechek et al. 2012

(২)  Wilson and Daly, 1995

……………………………………………………………

 

ডাঃ দেব মজুমদার