ভূমিকা

কোনও সন্দেহ নেই শব্দটি বিতর্কিত, স্পর্শকাতর এবং অযথাযথ ব্যবহারের শিকার। মুসলমানেরা এই শব্দ বা ধারণাটিকে ব্যবহার করেছেন অবিবেচকের মতো, যথেচ্ছ ভাবে। তেমনি পশ্চিমা, ডানপন্থী মানুষেরা এমন কি মানবতাবাদী দাবী করা নব-নাস্তিকতাবাদী একটিভিস্টরাও এই ধারণাটির ব্যবহার করেছেন যথেচ্ছ ভাবে। নব-নাস্তিকেরা বলার চেষ্টা করেছেন সমাজে যে “ইসলামোফোবিয়া”র সৃষ্টি হয়েছে এটা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া, সারা দুনিয়াতে ইসলামিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী গুলোর যে আতংকজনক তৎপরতা, তার ফলশ্রুতি হিসাবে পশ্চিমা জনগোষ্ঠীতে এই ধরণের প্রতিক্রিয়া খুবই স্বাভাবিক। আবার মুসলমান নাগরিকেরা কিম্বা ইউরোপে মুসলিম সংগঠনসমূহ তাদের সকল বঞ্চনাকেই “ইসলামোফোবিয়া” বলে চিহ্নিত করেতে চেয়েছেন যা হয়তো সকল ক্ষেত্রেই সঠিক নয়। সিরিয়াস গবেষকদের মাঝে বিরোধ আছে এই শব্দটির উপযুক্ততা নিয়ে। তাদের মাঝে মতবিরোধ আছে এই ধরণের বিদ্বেষ মূলক আচরণের পরিমান নিয়ে। কিন্তু একটি বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই, সেটা হচ্ছে মুসলমান জনগোষ্ঠীর দিকে তাক করা ঘৃণা, শারীরিক আক্রমন, ঘৃণাসূচক ভাষা, বাক্যের ব্যবহার ইত্যাদির উপস্থিতি এবং তার হার বৃদ্ধি নিয়ে। মুসলিম এবং অমুসলিম উভয় পক্ষের গবেষক, সমাজ বিশ্লেষক কিম্বা রাজনীতি ভাষ্যকারদের মাঝে ইসলামোফোবিয়া বা মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা ও সংস্কারাচ্ছন্ন আচরণের সাম্প্রতিক বৃদ্ধি বিষয়ে কোনও মতবিরোধ নেই। ইউরোপ, আমেরিকার গবেষকেরা স্বীকার করেছেন গত তিন দশকে পশ্চিমা দেশগুলোতে মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যদের প্রতি ঘৃণা ও সাংস্কৃতিক বর্ণবাদের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।

সাম্প্রতিক সময়ে “ইসলামোফোবিয়া” বিষয়ক আমার দুই একটি মন্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার বন্ধুদের কাছ থেকে বেশ আগ্রহউদ্দীপক কিছু মতামত পেয়েছি যা আমাকে এই লেখাটি লিখতে প্রেরণা দিয়েছে। আমি সমাজবিজ্ঞানী নই কিন্তু সমাজ বিজ্ঞানের বিভিন্ন আলোচনা আমাকে দারুন ভাবে টানে। “ইসলামোফোবিয়া” ধারণাটি নিয়ে আমার আগ্রহের প্রধান কারণ সম্ভবত সেটাই। এ সম্পর্কে সামান্য কিছু পড়াশুনার প্রেক্ষিতে আমার মনে হয়েছে, এই ধারণাটি নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে, বিশেষত ইউরোপে যে ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্ক চলছে গত তিন দশক ধরে, তার ছিটেফোঁটাও হয়নি আমাদের বাংলা ভাষায়। মুসলিমদের মাঝেতো নয়ই, এমন কি মুক্তচিন্তক দাবী করা মানুষদের মাঝেও তাই “ইসলামোফোবিয়া” শব্দটির বোঝাপড়াগুলো দারুন ভাবে প্রাথমিক, খানিকটা বিভ্রান্তিমূলক ও অপ্রতিনিধিত্তশীল। এই লেখাটির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এই বিষয়টি নিয়ে বাংলা ভাষায় একটি গঠনমূলক আলোচনা শুরু করা।

এই বিষয়ে পক্ষে বিপক্ষে বেশ কিছু ভালো গবেষণা হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। এই সকল গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন নামকরা জার্নালে এবং এঁদের কেউ কেউ তাদের গবেষণার ফলাফলকে পুস্তক আকারেও প্রকাশ করেছেন। এই সকল প্রকাশনা গুলোর মাঝে প্রবল আক্রমণাত্মক, পারস্পরিক দোষারোপ করে প্রকাশনা আছে আবার নিরেট একাডেমিক, গঠনমূলক ধারার প্রকাশনাও আছে। আমি চেষ্টা করেছি, এই লেখাটি তৈরীতে, পদ্ধতিগত ভাবে করা গবেষণা প্রকাশনা গুলোর সাহায্য নিতে এবং রাজনৈতিক ভাবে বায়াসড প্রকাশনাগুলোকে এড়িয়ে চলতে। পক্ষে বিপক্ষে উভয় ধরণের লেখালেখিকে পড়ার চেষ্টা করেছি, বোঝার চেষ্টা করেছি।

বলাই বাহূল্য “ইসলামোফোবিয়া” এই শব্দটি যে প্রতিষ্ঠানটি সবচাইতে বেশী প্রচার করেছে ও বিখ্যাত করেছে, তারাও স্বীকার করেন এই শব্দটি “পারফেক্ট” বা একদম “যুতসই” শব্দ নয়। কিন্তু যে ঘটনা বা সামাজিক প্রপঞ্চ (Social Phenomenon) গুলোকে এই শব্দটি ব্যাখ্যা করে তার জন্যে শব্দটি যথেষ্ট বলে মনে করেন এঁরা। এই লেখাটিতে, আমি চেষ্টা করবো “ইসলামোফোবিয়া” শব্দটিকে তার ঐতিহাসিক ও সাম্প্রতিক প্রেক্ষিত থেকে তুলে ধরার জন্যে। চেষ্টা করবো “ইসলামোফোবিয়া” ধারণাটি নিয়ে একজন নাস্তিক ও মানবতাবাদী মানুষ হিসাবে আমার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার ।

তার আগে আসুন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে কিছু মন্তব্য দেখে নেই এই প্রসঙ্গেঃ

মন্তব্য – ১
“একজন আমাকে বলেছেন, তিনি একটি শপিং মল এ প্রথমে একটি সম্পূর্ণ আবৃত ( চশমার জন্য চোখও দেখা যাচ্ছে না ) বোরকা পরিহত নারীকে দেখে এবং কিছুক্ষনের মধ্যেই আরবী পোষাক পরিহিত কয়েকটি দাড়িওয়ালা ব্যক্তিকে একসাথে হাঁটতে দেখে দ্রুত ওই মল ত্যাগ করেছেন । (সম্ভাব্য বোমা হামলার ভয়ে) । আপনার বিবেচনায় ওই ব্যক্তি কি ইসলামোফোবিক? মানুষ দেখে উনার মধ্যে ভয় কাজ করেছে । মল এ দাঁড়িয়ে থেকে সত্যি বোমা ফাটে কিনা দেখাটা কি উচিত হতো? আমার তো তাকে বুদ্ধিমান মনে হয়েছে” ।

“একটি শপিং মল, একটি বা দুটি মুখঢাকা নারী আর কয়েকটি তালেবানি চেহারার লোককে একসাথে দেখলে লোকটি আবারও ভয় পাবে, বারবার ভয় পাবে এতে সন্দেহ নেই । ক্রনিক ব্যাপার হবে সেটা । কিন্তু মানসিক রোগ হবে কি? সেই একই ব্যক্তি তো আক্রান্ত বলাও কি সুবিচার হবে? সাধারন চেহারা পোষাকের মুসলিম নারী পুরুষকে দেখে ভয় পান না । বন্ধু বলে জড়িয়েও ধরতে পারেন । একসাথে মল-এও যেতেপারেন । লোকটাকে ফোবিয়ায় আক্রান্ত বলা যাবে কি”?

মন্তব্য – ২
“ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু বললেই তাকে ইসলামোফোব বলা হচ্ছে , সেই সংগে ত্যানাবাজী করা হচ্ছে যে যৌক্তিক সমালোচনা না করে যা ইচ্ছা বলা হচ্ছে। কেউ অযৌক্তিক সমালোচনা করলে পারলে তাকে যুক্তি দিয়ে বলুন কিন্তু ইসলামোফোব বলে মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করবেন না”।

মন্তব্য – ৩
“রাজনৈতিক ইসলাম নিজে অতীতমুখী, সর্বাত্মকবাদী, ‘ইসলামো-ফ্যাসিস্ট’ রাষ্ট্রের ধারনা লালন করে বলেই তার বিরোধীদের ‘ইসলামোফোবিক’ বলে আখ্যায়িত করে। এটি একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত শব্দ, যা মৌলবাদ সচেতনভাবে তৈরি করে এবং ব্যবহার করে। এমনই অপর একটি শব্দ, যা হিন্দু মৌলবাদ ব্যবহার করে, সেটি হল ‘লাভ জিহাদ’।

মুক্তচিন্তার সংগ্রামে লিপ্ত মানুষেরা যত বেশী এই শব্দগুলো ব্যবহার করবে, ততই এইসব উদ্দেশ্যমুলক শব্দগুলো বৈধতা পাবে। তাই সচেতনভাবেই এইসব শব্দের ব্যবহার বন্ধ করা বাঞ্ছনীয়”।

মন্তব্য – ৪
“ইসলামোফোবিয়া” শব্দটা ইসলামিস্টদের বহুল ব্যবহৃত একটি টার্ম। এই শব্দটাকে এরা এতদিন ধরে ব্র্যান্ডিং করছে তাদের অপকর্মের সমালোচনাকে প্রতিহত করার ঢাল হিসাবে। সেই একই দায়িত্ব এখন কাঁধে তুলে নিয়েছেন এতদিন আমরা যাদের সমমনা মনে করেছি তাঁরা। অতি মানবতাবাদী আমাদের এই বন্ধুগণ রাজনৈতিক ইসলামের সমালোচনাকে ইদানিং ইসলামফোবিয়া বলে যখন মনে করে তখন একটু কষ্ট লাগে”।

এই চারটি মন্তব্য যারা করেছেন, তাঁরা সকলেই প্রগতিশীল, অগ্রসর চিন্তার মানুষ। বলাই বাহূল্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কোনও মন্তব্য নিশ্চিত ভাবেই সেই মানুষটির চিন্তার সম্পূর্ণ প্রতিফলন নয়। অনেক সময়েই এই সকল মন্তব্যগুলো খুব তড়িৎ প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ, সুচিন্তিত মতামত নাও হতে পারে। তাই এই মন্তব্যগুলোকে কেবল তাঁদের তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া বলেই ধরে নিচ্ছি এবং নামহীন হিসাবে উল্লেখ করছি। তারপরেও, এই মন্তব্যগুলো থেকে “ইসলামোফোবিয়া” সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়াটা খানিকটা বোঝা যায়। একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে – “ইসলামোফোবিয়া” কি ব্যক্তির ইসলামভিতী বা মুসলিমভীতি? যেভাবে প্রথম মন্তব্যটিতে প্রকাশ করা হয়েছে, তালিবানী পোশাকে কাউকে দেখে যদি কোনও একজন মানুষ বোমা আতংকে ভোগেন তাকে কি “ইসলামোফোবিক” বলা হবে? সোজা উত্তর হচ্ছে, সমাজবিজ্ঞানের চত্বরে “ইসলামোফোবিয়া” বলে যে ধারণাটির আলোচনা – বিতর্ক চলছে, তার অর্থ এই ধরনের ব্যক্তিগত আতংকের বিষয় নয়। দুনিয়ার যেকোনো কিছু দেখে একজন ব্যক্তি সুখ – দুঃখ – আনন্দ – বেদনা – হর্ষ – আতংক বোধ করতে পারেন এমন কি তা প্রকাশও করতে পারেন। অর্থাৎ কোনও একটা ভীতিকর কিছু দেখে কেউ যদি সিদ্ধান্ত নেন “শপিং মল” ত্যাগ করার, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত স্বাধীন অধিকার, এর সাথে আলোচ্য “ইসলামোফোবিয়া” ধারণাটির সম্পর্ক একদমই নেই তা বলা যাবেনা, তবে সম্পর্কটি দূরতম। কিন্তু উল্লেখযোগ্য হচ্ছে – একজন অগ্রসর চিন্তার মানুষ কেনো এই বহুল আলোচিত শব্দটি বা ধারণাটি নিয়ে এই রকমের প্রাথমিক ও বিভ্রান্তিকর ধারণা নিয়ে বসে আছেন? এর কারণ আছে। এই ধরনের বিভ্রান্তিকর ধারণার জন্ম দিচ্ছেন আমাদের মুক্তচিন্তক দাবীদার লেখকদেরই কেউ কেউ, তাঁদের লেখালেখির মধ্য দিয়ে। একটি উদাহরণ এখানে দিচ্ছি –

“মনে করেন আপনি বিমানে করে যাচ্ছেন। আপনার পাশে বা পিছনে এক টুপি দাড়ি পাগরি পরা মুসলমান সুরমা চোখে তসবি জপছে আর মাঝে মাঝে মৃদু স্বরে আল্লাহো আকবর বলছে… আপনি ভীত হলেন আপনার সহযাত্রীর উদ্দেশ্য নিয়ে। সে কি বোমা মারবে নাকি ছিনতাই করবে বিমান এই আশংকায় আপনি তটস্থ থাকলেন।… মোটা দাগে এটাই ইসলামফোবিয়া। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওই রকম ধার্মীক মুসলমান যাত্রী বিমানে বোমা দিয়ে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করবে না তবে বিগত বিশ বছরের যত ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ তার সবই কোন না কোন ধর্মীয় মুসলমানের হাতেই। ঢাকার রমনাতে যে বছর বোমা ফুটল, এরপর থেকে টুপি দাড়িওয়ালা মাদ্রাসার ছাত্র কিসিমের কেউ মেলায়, এক্সিবিশনে, জনসভায় এসে দাঁড়ালে মানুষ চোরা চোখে চাইত। নিরাপত্তা গেইটে এই লেবাসের লোকজনকে বেশি করে তল্লাসি চালাতো। এখনো খোলা কোন জায়গায় গানের অনুষ্ঠানের আশেপাশে হুজুর লেবাসের লোকজনকে মানুষ আলাদা দৃষ্টিতে দেখে। এটাই হচ্ছে ইসলামফোবিয়া”।

“বাইরের দেশের কথা বাদ দেন, ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশে আপনি কোন রেলস্টেশনে কি বিমানবন্দরে চিৎকার করে নারায়ে তাগবির আল্লাহো আকবর বলেই জোড়ে একটা দৌড় লাগান ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে, দেখবেন আশেপাশের মানুষ ভয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে। এই ইসলামফোবিয়া নেচারাল। এর পিছনে ইসলাম এবং মুসলমানরাই দায়ী”।
(হিন্দু নাস্তিক্য বিতর্ক, সুষুপ্ত পাঠক, লিংক)

সুষুপ্ত পাঠক আমাদের বাংলা ভাষাভাষী ব্লগ চত্বরে একটি উল্লেখযোগ্য নাম। মুক্তচিন্তক দাবীদার এই লেখক নিরন্তর ভাবে লিখে চলেছেন, ধর্মীয় মৌলবাদ এর বিরুদ্ধে, ইসলামী সন্ত্রাসবাদ এবং বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক ইসলামের ভয়াবহ উত্থানের নানান দিক নিয়ে তিনি আমাদের আলোকিত করে চলেছেন। শুধু মুক্তমনা পাঠকদের মাঝেই নন, তিনি বিরাট সাধারণ পাঠকের মাঝেও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার সংগ্রাম সুষুপ্ত পাঠকের কাছে ঋণী। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি হচ্ছে, “ইসলামোফোবিয়া” বিষয়ে সুষুপ্ত পাঠকের যে ধারণা তিনি এখানে প্রকাশ করেছে, তা ভয়াবহ রকম প্রাথমিক, বিভ্রান্তিকর, অযথাযথ ও বালখিল্য। এবং আমাদের উদাহরনের প্রথম মন্তব্যটি লক্ষ্য করে দেখুন, তা আসলে ইসলামোফোবিয়া বিষয়ে সুষুপ্ত পাঠকের চিন্তারই একটা সহজ সরল প্রকাশ।

“ইসলামোফোবিয়া” সঠিক না বেঠিক, উচিৎ বা অনুচিত, বাস্তব না অবাস্তব, ভালো না মন্দ, মহান নাকি খল এই সকল কিছু নিয়েই বিতর্ক করা যেতে পারে। কিন্তু প্রথম বিষয়টি পরিস্কার করে নেয়া দরকার, “ইসলামোফোবিয়া” শব্দটি দিয়ে যে সামাজিক প্রপঞ্চ (Social phenomenon) গুলোকে বোঝানো হয়ে থাকে, তা সুষুপ্ত পাঠকের এই ধরনের ব্যাখা থেকে যথেষ্ট জটিল এবং দূরের। সুষুপ্ত পাঠকের “ইসলামোফোবিয়া” বিষয়ক বোঝাপড়ায় সরলীকরণ আছে, কিন্তু তিনি যে বিষয়টিকে বোঝেননা তা নয়, তিনি বোঝেন, তার লক্ষণ তাঁর লেখায় আছে। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো এই লেখাতেই।

সুষুপ্ত পাঠক ও আরো অনেক মুক্তচিন্তক বন্ধুদের সাথে আমার চলমান বিতর্কের একটি প্রধান বিষয় হচ্ছে, সামাজিক প্রপঞ্চ গুলোকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে অনেক তরুন পাঠকদের মতো এই সকল সিজনড ব্লগার বন্ধুদেরো রয়েছে অতি সরলীকৃত পদ্ধতি (Oversimplified approach)। এই লেখার বিষয়টি অর্থাৎ “ইসলামোফোবিয়া” নিয়েও তাইই ঘটেছে।

বরং পরবর্তী তিনটি মন্তব্যের প্রতিটিতেই কিছু কিছু বাস্তবতার উল্লেখ আছে। যেমন ধরুন, দ্বিতীয় মন্তব্যে একজন বন্ধু লিখেছেন –

“ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু বললেই তাকে ইসলামোফোব বলা হচ্ছে , সেই সংগে ত্যানাবাজী করা হচ্ছে যে যৌক্তিক সমালোচনা না করে যা ইচ্ছা বলা হচ্ছে”।

এটা বাস্তব। পশ্চিমা বিশ্ব এবং বিশেষত ইউরোপের বাস্তবতায়, মুসলমান সমাজের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ, ইসলাম সম্পর্কে সমালোচনা এমন কি অত্যন্ত গঠনমূলক সমালোচনাকেও “ইসলামোফোবিক” বলে উল্লেখ করছেন। মুসলিম মোল্লাতন্ত্র ইসলামের সমালোচনা বন্ধ করার জন্যেও এই শব্দটিকে ব্যবহার করছেন। এই বিষয়েও আলোচনা উল্লেখ করবো এই লেখায়।

তৃতীয় মন্তব্যটি শুরুই হয়েছে একটি বিশেষ শব্দ “রাজনৈতিক ইসলাম” দিয়ে। সমগ্র পশ্চিমা বিশ্বে “রাজনৈতিক ইসলাম”কে একটি সাম্প্রতিক ধারণা বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়, যার সাথে রয়েছে বিশ্বব্যাপী আঞ্চলিক ও ভু-রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল। “ইসলামোফোবিয়া”র আলোচনায় তাই রাজনৈতিক ইসলামই অধিক প্রাসঙ্গিক, ইসলামের চাইতে। যদিও, ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি, রাজনৈতিক ইসলাম আসলে ইসলামেরই এক বর্ধিত সংস্করণ।

শেষ দুটি মন্তব্যের মূল বক্তব্য হচ্ছে “ইসলামোফোবিয়া” হচ্ছে ইসলামিস্টদের আবিষ্কার এবং এটা একটা চতুর উদ্দেশ্য প্রনোদিত শব্দ, যা আসলে ইসলামিস্টদের উদ্দেশ্যকেই সেবা করে। অন্তত ঐতিহাসিক তথ্য আমাদেরকে বলেনা যে এই শব্দটি ইসলামিস্টদের আবিষ্কার এমন কি পশ্চিমের বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনায়, একাডেমিক লেখালেখি – গবেষণায় এই বিষয় নিয়ে যে বিপুল পরিমানে লেখালেখি রয়েছে তার প্রায় অধিকাংশই পশ্চিমা ও অমুসলিম মানুষদের হাতেই গড়ে উঠেছে। তবে “ইসলামোফোবিয়া” শব্দটি কাদের উদ্দেশ্য সাধন করে সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। এটা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।

এবারে মূল আলোচনায় প্রবেশ করি।


ইসলামোফোবিয়াঃ ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত

বিনয়ের সাথে বলি, যারা বলেন “ইসলামোফোবিয়া” শব্দটি ইসলামিস্টদের আবিষ্কার তাঁরা ভুল বলেন। তাঁদের এই তথ্য বা উপসংহার ইতিহাসনিষ্ঠ নয়। অন্তত সমাজবিজ্ঞানের লিখিত ইতিহাস বলছে ভিন্ন কিছু। লিখিত ইতিহাস বলছে – শব্দটির উৎস হিসাবে খুঁজে পাওয়া যায় একটি ফরাসী শব্দ “Islamophobie” যার আক্ষরিক অর্থ করা যেতে পারে ইসলাম সম্পর্কে মন্দ মানসিকতা বা ইসলাম বিষয়ে শত্রুভাবাপন্ন। এই অর্থে, আজকের “ইসলামোফোবিয়া” শব্দটির সাথে ধারণাটির এর অর্থগত ও ব্যবহারিক পার্থক্য আছে, যা নীচের ব্যাখ্যায় পরিস্কার হবে বলে আশা করছি।

ফরাসী উপনিবেশিক শাসক জনাব Alain Quellien কে মনে করা হয় প্রথম ব্যক্তি যিনি একটি লিখিত দলিলে এই শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলে। মূলত ফরাসী উপনিবেশিক শাসকদের একটি আমলাতান্ত্রিক দলিলে তিনি এই ধারণাটির ব্যাখ্যা করেন (The Muslim Policy in West Africa, 1910)। পশ্চিম আফ্রিকায় ফরাসী কলোনিগুলোতে যে সকল উপনিবেশিক প্রশাসকরা কাজ করতেন, মুসলিম জনগোষ্ঠী সম্পর্কে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গীকে বোঝানোর জন্যেই তিনি এই শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। খৃস্টানদের তুলনায় মুসলিমদের শাসন করা সহজ, এর কারণ হিসাবে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন, ধর্ম হিসাবে ইসলাম খ্রিস্টান ধর্মের চাইতে সহজ এবং জটিলতাবিহীন। পিছিয়ে থাকা মুসলমান জনগোষ্ঠী উপনিবেশিক শাসকদের জন্যে খৃস্টানদের চাইতে অধিক সহজে শাসনযোগ্য (easy to rule) । তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন,কেনো মুসলিম জনগোষ্ঠীতে ইউরোপীয় কলোনি বিস্তার সহজতর। সেজন্যেই তিনি অন্যান্য উপনিবেশিক শাসকদের আহ্বান করেছিলেন মুসলমানদের আদিম, বর্বর, ভয়াবহ ইত্যাদি “ইসলামোফোবিক” ধারণা থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে।

আরেকজন উপনিবেশিক প্রশাসক Maurice Delafosse, প্রায় একই সময়ে “ইসলামোফোবিয়া” শব্দটি ব্যাখ্যা করেনা। তিনিও একই ভাবে বলেছিলেন, উপনিবেশিক প্রশাসনের ভেতরে মুসলিমদের প্রতি ঘৃণাবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো এবং প্রশাসন নীতিগত ভাবেই মুসলমানদের প্রতি ঘৃণাবাচক দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করতেন, যাকে তিনি মনে করেছিলেন অপ্রয়োজনীয় এবং ফরাসী কলোনি বিস্তারের জন্যে প্রতিবন্ধক। তিনি লিখেছিলেন, ইসলামোফোবিয়া তাই ফরাসী সরকার তথা উপনিবেশিক শাসকদের উদ্দেশ্য সাধন করেনা (Does not serve the purpose of west)।

পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালে প্যালেস্টাইনী বংশোদ্ভূত আমেরিকান লেখক এডওয়ার্ড সাঈদ এই শব্দটি ব্যবহার করেন তাঁর লেখায়। সম্ভবত তিনিই প্রথম একাডেমিক জার্নাল এ এই শব্দটি ব্যবহার করেন। এডওয়ার্ড সাঈদ কে নিয়েও ব্যাপক বিতর্ক আছে আমাদের মুক্তচিন্তক ও নাস্তিক বন্ধুদের মাঝে। জন্মগত ভাবে এডওয়ার্ড সাঈদ একজন আরব খৃস্টান, তিনি জন্মেছিলেন প্যালেস্টাইনে কিন্তু সারাজীবন কাটিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তাঁর পিতা একজন আমেরিকান সৈনিক, আমেরিকার হয়ে যুদ্ধ করেছেন। সাঈদ পড়াশুনা করেছেন স্ট্যানফোরড বিশ্ববিদ্যালয়ে। ব্যক্তিগত রাজনৈতিক ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে তিনি ছিলেন একজন বামপন্থী চিন্তা প্রভাবিত মানুষ। আন্তোনীয় গ্রামশি, মিশেল ফুকো কিম্বা পোষ্ট মডারনিস্ট তাত্ত্বিক থিওডোর আডোরনো’র বুদ্ধিবৃত্তিক প্রভাবের কারণে, এডওয়ার্ড সাঈদ ছিলেন পশ্চিমের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির তীব্র সমালোচক। অর্থাৎ সকল অর্থেই তিনি একজন আমেরিকান অথবা কোনও অর্থেই তাঁকে “ইসলামিস্ট” বলার সুযোগ নেই। সুতরাং এই অর্থেও উপসংহার টানা যায়না যে “ইসলামোফোবিয়া” শব্দটি ইসলামিস্ট দের আবিষ্কার বা বানানো।

উৎপত্তির দিক থেকে একমাত্র মুসলিম সংশ্লিষ্টতা পাওয়া ১৯১৮ সালের সময় কালে একজন ফরাসী পেইন্টার বা চিত্রকর Etienne Dinet যিনি পরবর্তীতে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন, তাঁর কাছ থেকে। তিনি ও তার আলজেরিয়ান সহকর্মী দুজনে মিলে মুহাম্মদের জীবনী অনুবাদ করেন যেখানে তিনি ফরাসী ভাষায় ইসলামোফবিয়ার সমার্থক একটি শব্দ ব্যবহার করেন, যার শাব্দিক অর্থ ইসলামকে ইচ্ছাকৃত ভাবে নীচু করে দেখানো।

এই হচ্ছে নিরেট ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত থেকে দেখলে ইসলামোফোবিয়া শব্দটির ইতিহাস। যদিও শব্দটির উৎস নিয়ে এই ইতিহাস এখন আর খুব একটা প্রাসঙ্গিক নয়। কেননা, এই প্রাথমিক লেখকেরা ঠিক যে অর্থে বা যে ধারনাকে প্রকাশ করার জন্যে এই বিশেষ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন, ইসলামোফোবিয়া শব্দটির বর্তমান অর্থ আরো অনেক বেশী বিস্তৃত এবং সেই অর্থে রাজনৈতিক ভাবে অনেক খানিই ভিন্ন। সুতরাং শব্দটির সাম্প্রতিক ইতিহাসটিই বেশী প্রাসংগিক আর সেজন্যে আমাদের কে শব্দটিকে বিশ্লেষণ করতে হবে সাম্প্রতিক ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত থেকে।

“রানিমেইড ট্রাস্ট” – “ইসলামোফোবিয়া” শব্দটির পুনর্জন্ম যার হাত ধরে।

উপরে উল্লেখিত এই সকল উৎসই আসলে আধুনিক কালে বা সাম্প্রতিক সময়ে “ইসলামোফোবিয়া” বলতে আমরা যা বুঝি তাঁর সাথে আক্ষরিক অর্থে সংশ্লিষ্ট নয়। বরং বর্তমান সময়ের “ইসলামোফোবিয়া” ধারণাটিকে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে পরিচিত করে তোলে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠান “রানিমেইড ট্রাস্ট”। রানিমেইড ট্রাস্ট যুক্তরাজ্যের প্রথম সারির একটি থিংক ট্যাংক, যারা বর্ণবাদ বিরোধী গবেষণা করে থাকে এবং সরকার ও পাবলিক প্রতিষ্ঠান গুলোকে তাঁদের নীতি প্রনয়নের ক্ষেত্রে সাহায্য করে থাকে। যে সকল পাঠকের আগ্রহ আছে, তাঁরা এই প্রতিষ্ঠানটির ওয়েব সাইট ঘুরে দেখতে পারেন (রানিমেইড ট্রাস্ট )। যুক্তরাজ্যের এই মূল ধারার থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠানটিকে আর যাই বলা হোক না কেনো অন্তত ইসলামী বা মুসলিমদের প্রতিষ্ঠান বলার কোনও সুযোগ নেই। ১৯৯৬ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি আঠারো সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিশন গঠন করে যার প্রধান ছিলেন অধ্যাপক গরডন কনওয়ে। এই আঠারো সদস্যের কমিটিতে ধর্মীয় পরিচয়ের দিক থেকে মুসলিম, খৃস্টান, হিন্দু, শিখ এবং ইহুদী সকলেই ছিলেন। এই কমিটি যে রিপোর্টকটি প্রকাশ করেন তাঁর শিরোনাম ছিলো – “Islamophobia a Challenge For Us All”। রিপোর্টটি প্রকাশিত হবার সাথে সাথেই মিডিয়া ও অন্যান্য মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। রিপোর্টটিকে স্বাগত জানিয়ে এবং এর বিরোধিতা করে পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা – সমালোচনা সৃষ্টি হয়।

রানিমেইড ট্রাস্ট এর এই রিপোর্টটির প্রায় বিশ বছর পরে আরেকটি ফলো-আপ রিপোর্ট প্রকাশ করে “Islamophobia – still a challenge to us all” শিরোনামে। ফলো-আপ রিপোর্টটির শিরোনামে বোঝা যায়, অন্তত রানিমেইড ট্রাস্ট মনে করছে, এই সমস্যাটি এখনও আমাদের সবার জন্যে একটা চ্যালেঞ্জ।
এবারে দেখা যায়, রানিমেইড ট্রাস্ট ইসলামোফোবিয়া বিষয়টিকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে এবং এর সাথে যুক্ত অর্থবহতার সমস্যাকে কিভাবে উল্লেখ করেছে। বোঝার সুবিধার জন্যে, আমি সরাসরি ইংরাজি ভাষাতেই হুবুহু তুলে দিচ্ছি রানিমেইড ট্রাস্ট এর রিপোর্ট টি থেকে (সাথে আমার করা বাংলা অনুবাদ ও দিচ্ছি যদি কিছু পাঠকের সুবিধা হয় তাতে।) ঃ

“The term Islamophobia refers to unfounded hostility towards Islam. It refers also to the practical consequences of such hostility in unfair discrimination against Muslim individuals and communities, and to the exclusion of Muslims from the mainstream political and social affairs”.

(অনুবাদঃ “ইসলামোফোবিয়া শব্দটি ইসলামের প্রতি অদৃশ্যমান শত্রুতা বা শত্রুভাবাপন্নতা কে নির্দেশ করে। এটা আরো নির্দেশ করে এই ধরনের শত্রুভাবাপন্নতার কারণে মুসলমান ব্যক্তি ও সম্প্রদায় যে অন্যায্য বৈষম্যের স্বীকার হন এবং তাতে যদি মুসলমান নাগরিকদের মূলধারার রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে ভিন্ন করে দেয়া হয়”।)

উপরের ইংরাজিতে দেয়া এই সংজ্ঞাটিকে আরো সম্প্রসারিত করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় রিপোর্টটিতে। যেখানে এই সংজ্ঞা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে এভাবে।

“The original Islamophobia report states that the term refers to three phenomena
• Unfounded hostility towards Islam;
• Practical consequences of such hostility in unfair discrimination against Muslim individuals and communities;
• Exclusion of Muslims from mainstream political and social affairs”
We mainly agree with this broad definition. In our view, the focus should be on the second and third phenomena.

(“আসল ইসলামোফোবিয়া রিপোর্ট এ শব্দটি সম্পর্কে তিনটি প্রপঞ্চকে উল্লেখ করেছিলোঃ
• ইসলামের প্রতি অদৃশ্যমান বিদ্বেষ
• এই বিদ্বেষ থেকে বাস্তবজীবনে মুসলমান ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের মানুষেরা যদি অন্যায্য বৈষম্যের স্বীকার হন এবং
• এর ফলে যদি তাঁরা মূলধারার রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়গুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন
আমরা মূলত এই সংজ্ঞাটির সাথে একমত পোষণ করি, তবে আমাদের মতে মূল বিষয় হিসাবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পয়েন্টটিতেই বেশী জোর দেয়া উচিৎ”।)

বিষয়টি খুব পরিস্কার। ইসলাম বা মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ আচরণের ফলে যদি মুসলিম ব্যক্তি বা সম্প্রদায়কে বৈষম্যের স্বীকার হতে হয়, মূলধারার রাজনীতি ও সামাজিক সংগঠনগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয়, সেটাই ইসলামোফোবিয়া”।)

সুতরাং এটা পরিস্কার যারা শুধুমাত্র “ফোবিয়া” শব্দটিকে টেনে এনে বলার চেষ্টা করেন, এই জন্যে মুসলমানেরা দায়ী তাঁরা হয় এই বিষয়টি নিয়ে ন্যূনতম পড়াশুনা করেন নি অথবা তাঁরা বিষয়টি অন্যদের অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে অযথাযথ ব্যাখ্যা প্রচার করছেন। বিষয়টি কেবল “ফোবিয়া” নয়, “ফোবিয়া” থেকে উৎসারিত ঘৃণা ও ঘৃণার চর্চা। এটা আরো বিস্তারিত আলোচনা করবো নীচের বর্ণনায়।

এখন প্রশ্ন হলো, কেনো হঠাত করে এই নতুন শব্দটির দরকার হয়ে পড়লো। অথবা কেনো হঠাত করে এই অপ্রচলিত, আপাতভাবে অর্থহীনতায় আক্রান্ত, খানিকটা বিভ্রান্তিকর শব্দের পুনপ্রচলন দরকার হয়ে পড়লো? এই নতুন শব্দটির অধিক প্রচলন কি সমাজের জন্যে কোনও উপকার বয়ে নিয়ে আসবে? সেই ব্যাখ্যাও রানিমেইড ট্রাস্ট এর রিপোর্ট এ উল্লেখ করা হয়েছে। মূল রিপোর্ট থেকেই তুলে দিচ্ছি এখানেঃ

“The word ‘Islamophobia’ has been coined because there is a new reality which needs naming: anti-muslim prejudices has grown so considerably and so rapidly in recent years that a new item in the vocabulary is needed so that it can be identified and acted against. In a similar way there was a time in European history when a new word, antisemitism, was needed and coined to highlight the growing dangers of anti-jewish hostility. The coining of a new word, and with it the identification of a growing danger, did not in that instance avert eventual tragedy. By the same token, the mere use of the new word ‘Islamophobia’ will not in itself prevent tragic conflict and waste. But, we believe, it can play a valuable part in the long run endeavor of correcting perceptions and relationships”.

(অনুবাদঃ “ইসলামোফোবিয়া শব্দটির প্রচলন হয়েছে কারণ একটি নতুন বাস্তবতার প্রেক্ষিত তৈরী হয়েছে যার একটি নাম দরকার। মুসলিম বিদ্বেষ এবং মুসলিমদের প্রতি সংস্কারাচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তার ঘটেছে উল্লেখযোগ্য ভাবে এবং সাম্প্রতিক সময়ে এর বিস্তার এতোটাই দ্রুত হারে হচ্ছে যে এর একটি নাম দরকার যেনো এই ধরনের ঘটনাকে কে চিহ্নিত করা যায় ও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়। প্রায় একইভাবে ইউরোপের ইতিহাসে একটি সময় ছিলো যখন একটি নতুন শব্দের দরকার হয়ে পড়েছিলো সেই সময়ে ইহুদীবিদ্বেষের ভয়াবহতাকে প্রকাশ করার জন্যে।কেবল মাত্র একটি শব্দের প্রচলন এবং তার দ্বারা সেই সকল বিদ্দেশের ঘটনাকে চিহ্নিত করাটাই এই সকল ঘটনার করুণ পরিনতিকে দূর করতে পারেনি। একই ভাবে, কেবল “ইসলামোফোবিয়া” শব্দটির প্রচলনই সমাজ থেকে এই সমস্যাগুলো দূর করতে পারবেনা। কিন্তু আমরা আশা করি, এটা হয়তো দীর্ঘমেয়াদে মানুষের ধারণার বদল ঘটাতে ও মানুষে মানুষে সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে”।)

অন্তত উদ্দেশ্যের দিক থেকে বোঝা যায় যে এই শব্দটির প্রচলন এক ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক অন্যায্য আচরণের বিরুদ্ধেই, যা একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীকে অযাচিত ঘৃণা ও বঞ্চনার হাত থেকে সুরক্ষা দিয়ে সমাজের মূলধারায় যথাযথ অংশগ্রহনকে নিশ্চিত করে। সুতরাং এই শব্দটির উৎপত্তি ও প্রচলনের সাথে অন্তত উদ্দেশ্যের দিক থেকে কোনও ভাবেই ইস্লামিস্ট দের “পারপাস সারভ” করার বা ইসলামিস্টদের উদ্দেশ্য সাধনের কোনও যৌক্তিকতা নেই। শুধুমাত্র এই ধরনের ঘতনাগুলোর শিকার একটি বিশেষ ধর্মের মানুষ বলেই সেটা ইসলামিস্টদের পারপাস সারভ করবে, তা যৌক্তিক নয়। এমন কি যদি ইসলামিস্টরা এই শব্দটিকে তাদের মতো করে ব্যবহার করেন, সেটা হবে দুর্ভাগ্যজনক এবং সচেতন নাগরিক সম্প্রদায়ের উচিৎ হবে তার বিরুদ্ধেও সজাগ সংগ্রাম জারী রাখা।
“ইসলামোফোবিয়া” শব্দটির সমালোচনা

এবারে দেখা যাক, “ইসলামোফোবিয়া” শব্দটির সমালোচনা প্রসঙ্গে। শব্দটির সমালোচনার কয়েকটি মাত্রা বা ডাইমেনশন রয়েছে। প্রথমত – শব্দটির শাব্দিক অর্থ নিয়ে সমালোচনা, সেই অর্থে অনেকেই মনে করেন শব্দটি তার আভিধানিক অর্থ যা এবং শব্দটি যা বোঝাতে চায়, তার মাঝে বিস্তর ফারাক রয়েছে। অর্থাৎ শব্দটিকে যদি নিরেট শাব্দিক অর্থে বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায় ইসলামের প্রতি অযৌক্তিক ভীতি বা ইসলামজনিত অযৌক্তিক ভীতি, কেননা “Phobia” শব্দটির অর্থ হচ্ছে irrational fear বা অযৌক্তিক ভীতি।

শব্দটি নিয়ে সমালোচনার আরেকটি মাত্রা হচ্ছে, এই শব্দটি ইসলাম সম্পর্কে যৌক্তিক আলোচনা বা সমালোচনার পথ রুদ্ধ করতে পারে। অর্থাৎ মুসলিম জনগোষ্ঠী বা ইসলামিস্ট রা এই শব্দটিকে ভিন্ন ভাবে ব্যবহার করে ইসলামের যৌক্তিক সমালোচনাকে রুদ্ধ করতে পারে এবং যারা ইসলামের যৌক্তিক সমালোচনা করেন তাঁদেরকে ইসলামোফোব বা ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত বলে চিহ্নিত করতে পারে।

“ইসলামোফোবিয়া” শব্দটি নিয়ে তৃতীয় সমালোচনা টি হচ্ছে, আদৌ কি একটি নতুন শব্দের প্রয়োজন রয়েছে? মুসলিম সমাজের প্রতি পশ্চিমা বিশ্বে কি সত্যিই এই ধরণের আচরণের ভয়াবহতা এতোটাই যে এই ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করার জন্যে একটি নতুন আলাদা শব্দের দরকার?

শব্দটি সম্পর্কে এই সকল সমালোচনারই বাস্তব ভিত্তি রয়েছে। সেজন্যেই রানিমেইড ট্রাস্ট এর রিপোর্ট এর শুরুতেই স্বীকার করা হয়েছে এই শব্দটি তাদের আবিষ্কার নয়। বরং এই শব্দটি অনেক আগে থেকেই সমাজে প্রচলিত এবং মুসলিমদের একটি অংশ এই শব্দটি তাদের প্রতি যে ঘৃণা ও বৈষম্যমূলক আচরণের ঘটনা ঘটছে চারপাশে তা বোঝানোর জন্যে ব্যবহার করে থাকেন। প্রথম রিপোর্টটিতে উল্লেখ করা হয়েছে – “ইসলামোফোবিয়া” শব্দটি নিখুত বা পারফেক্ট নয়। হয়তো মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা সূচক আচরণের প্রকাশ হিসাবে “এন্টি-মুসলিম” বা “মুসলিমফোবিয়া” ধরনের কোনও শব্দের কাছাকাছি। কিন্তু তাঁরা উল্লেখ করেছেন, অর্থের দিক থেকে ইসলামোফোবিয়া শব্দটি ইংরাজি “জেনোফোবিয়া” বা “ইউরোফোবিয়া” ধরনের একটি শব্দ। এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, এই প্রবনতাটি হচ্ছে ধর্ম হিসাবে ইসলামের প্রতি ভীতি বা ঘৃণা থেকে উতসারিৎ তীব্র ঘৃণা বা অপছন্দ প্রকাশ করার ঘটনাটিই হচ্ছে “ইসলামোফোবিয়া” আর এর প্রধান এবং একমাত্র টার্গেট মুসলিম জনগোষ্ঠী। সুতরাং যারা মনে করেন, ইসলামী পোষাক পরিহিত মানুষের থেকে ভীত হওয়াটাই “ইসলামোফোবিয়া” তাঁরা ভুল বলেন। বরং এই ভীতি থেকে উৎসারিত দীর্ঘমেয়াদী “ঘৃণা” এবং এই ঘৃণা জনিত কারণে যদি মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষমূলক বৈষম্য করা হয়ে থাকে সেটাই হচ্ছে “ইসলামোফোবিয়া”। এই ভীতি থেকে সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি বা অধিকাংশ মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি “ঘৃণাবাচক” আচরণ প্রকাশ করাই হচ্ছে “ইসলামোফোবিয়া”। সুতরাং শব্দটিকে কেবল একটি শব্দ হিসাবে নেয়ার চাইতে এটিকে একটি ধারণা হিসাবে নেয়াটাই যৌক্তিক।

যেমন ধরা যাক ইংরাজি “Homophobia” শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হয়তো হবে সমকামী মানুষদের প্রতি অযৌক্তিক ভীতি, কিন্তু বাস্তবে শব্দটি কেবল সমকামী মানুষদের প্রতি ভীতিকেই প্রকাশ করেনা বরং সমকামী মানুষদের প্রতি আমাদের সমাজে বহু বছর ধরে চলে আসা অন্যায্য সংস্কার, বিদ্বেষ, ঘৃণা ও শত্রুভাবাপন্ন মানসিকতাকেই প্রকাশ করে। এমন কি শুধু বিদ্বেষ বা শত্রুভাবাপন্নতাই নয়, সমকামী মানুষদের প্রতি সামাজিক বয়কট, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিশেধাজ্ঞার মতো বিষয়কেও সমাজ প্রশ্রয় দিয়েছে বছরের পর বছরে বিনা প্রশ্নে। সমকামী মানুষদের প্রতি এই সামাজিক ঘৃণা সুপ্রাচীন গ্রীক সমাজে খ্রিষ্টের জন্মেরও ছয়শো থেকে আটশো বছরের আগের ইতিহাসেও পাওয়া যায়। অথচ এই শব্দটি প্রথম চালু করেন রবার্ট ওয়েইনবারগ নামের একজন সাইকোলজিস্ট ১৯৬০ সালে আর এই টার্মটি প্রথম একাডেমিক স্বীকৃতি লাভ করে ১৯৬৯ সালে একটি জার্নাল আরটিকেল এর মাধ্যমে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে ১৯৯৫ সালের আগে কোনও আমেরিকান রাষ্ট্রপতি এই ধারণাটিকে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বীকার করেন নি। রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটন হচ্ছেন প্রথম রাষ্ট্রপতি যিনি এই শব্দটি উচ্চারন করেন এবং স্বীকার করেন মার্কিন সমাজে তীব্র ভাবেই হোমোফোবিয়া রয়েছে। তাহলে এতো হাজার বছরের একটি সমস্যাকে ডাকার জন্যে কেনো একটি আলাদা নাম বা Homophobia শব্দটির দরকার হলো? কারণ, যেকোনো সমস্যার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার প্রথম শর্ত হচ্ছে সেই সমস্যাটির অস্তিত্বকে স্বীকার করা। আর সমস্যাটিকে চিহ্নিত করার জন্যে তার একটি নাম দরকার, সংজ্ঞা দরকার। তাহলে সেই নামে, সেই সংজ্ঞা দিয়ে সমাজে সমস্যাটির পরিমান নির্ধারণ করা যায় এবং তাকে চ্যালেঞ্জ করা যায়, কমিয়ে আনার জন্যে নীতিগত ব্যবস্থা নেয়া যায়।

ইসলামোফোবিয়া নিয়ে এই রিপোর্ট টি তৈরী করতে গিয়ে রানিমেইড ট্রাস্ট ব্রিটিশ সমাজের অনেকের ইন্টারভিউ করেছেন। ভিন্ন ধর্মের মানুষদের সাক্ষাৎকার কে ভিত্তি করে মুসলিম সমাজের প্রতি পশ্চিমা এবং ব্রিটেনের খৃস্টানদের মতামতের একটা সারসংখেপ করেছেন তারা। ব্রিটেনের মুসলিম নাগরিকদের উপরে শারীরিক আক্রমনের কিছু ঘটনা পর্যালোচনা করেছেন। এমন কি বর্ণবাদী হামলায় নিহত মুসলিম ভিকটিমদের ঘটনাগুলোও পর্যালোচনা করা হয়েছে। তাদের রিপোর্টটি চুড়ান্ত ভাবে প্রকাশ করার আগে প্রায় ৩৫০০ নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানকে পাঠানো হয়েছিলো তাদের মতামতের জন্যে। প্রায় শ’দেড়েক দীর্ঘ মতামত পাওয়া যায় এই বিভিন্ন নাগরিক, পেশাগত প্রতিষ্ঠান, কর্পোরেট, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের কাছ থেকে। বেশীর ভাগ মতামতই (রানিমেইড ট্রাস্ট এর হিসাব অনুযায়ী ৯০% এর অধিক) ছিলো এই রিপোর্টটির পক্ষে এবং এর প্রতি সদর্থক। সবশেষে, রানিমেইড ট্রাস্ট তাদের ধারণা কে এইভাবে প্রকাশ করেছেন –

“It is possible therefore to describe ‘Islamophobia’ as an umbrella term incorporating criminal behaviour, open hostility and bigotry and prejudice aimed at Muslim or Islamic targets”.

(অনুবাদঃ তাই এটা সম্ভব, ইসলামোফোবিয়া শব্দটিকে একটি বিস্তৃত ধারণা হিসাবে ব্যবহার করা যার অন্তর্গত থাকতে পারে, মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি প্রকাশ্য বিদ্বেষমূলক আচরণ, অপরাধ মূলক আচরণ, গোড়ামী ও সংস্কারাচ্ছন্ন আচরণ।)


ইসলামের সমালোচনা কি ইসলামোফোবিয়া?

এর সোজাসাপটা উত্তর হচ্ছে- না, ইসলামের সমালোচনা করাটা ইসলামোফোবিয়া নয়। বরং ইসলামের সকল ধারণার চুলচেরা সমালোচনা করাটা যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে নাগরিকের অধিকার। আজকের আধুনিক যুগের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে ইসলামের অনেক দৃষ্টিভঙ্গি, প্রথার সরাসরি সংঘর্ষ রয়েছে। উদারনৈতিক গনতাত্ন্রিক মানুষ তাই ইসলামের সেই সকল বিষয়ের সমালোচনা করেন। এক্টিভিস্ট নাস্তিকেরা অন্যান্য ধর্মের মতোই ইসলামের সকল মৌলিক প্রতিপাদ্যকে চ্যালেঞ্জ করেন। মানুষ হিসাবে ইসলামের নবী মুহাম্মদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও সেসবের নৈতিক বোঝাপড়াকে চ্যালেঞ্জ করেন। এই সবই যেকোনো গণতান্ত্রিক সমাজের নাগরিকের মৌলিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে। পশ্চিমের, বিশেষত ইউরোপে বাক-স্বাধীনতার যে ঐতিহ্য রয়েছে, তাতে ইসলাম সহ সকল ধর্মের সমালোচনা করা খুব স্বাভাবিক চর্চা। এটা ইসলামোফোবিয়া নয়। আসুন দেখা যাক, রানিমেইড ট্রাস্ট এর রিপোর্টটিতে এ বিষয়ে কিভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সরাসরি তুলে দিচ্ছি সেখান থেকেঃ

“It is not intrinsically phobic or prejudiced, offcourse, to disagree with or to disapprove of muslim beliefs, laws or practices. Adherents of other world faiths disagree with Muslims on points of theology and religious practice. By the same token agnostics and secular humanists disagree with Muslims, as with all religious believers on basic issues. In a liberal democracy it is inevitable and healthy that people will criticize and oppose, sometimes robustly, opinions and practices with which they disagree. It can be legitimate to criticize policies and practices of Muslim states and regimes, for example especially when their governments do not subscribe to internationally recognized human rights, freedoms and democratic procedures, or to criticize and condemn terrorist movements which claim to be motivated by Islamic values. Similarly it can be legitimate to criticize the treatment of women in some Muslim countries, or the views and attitudes which some muslims have towards “the west”, or towards other world faith. Debates, arguments and disagreements on all these issues take place just as much amongst Muslims, it is important to recognize, as between Muslims and non-Muslims. “

(অনুবাদঃ “মুসলমানদের ধর্ম বিশ্বাস কিম্বা ইসলামী আইন ও বিভিন্ন চর্চার সাথে দ্বিমত পোষণ করা বা দ্বিমত করা অবশ্যই সংস্কারাচ্ছন্নতা বা ভীতি নয়। পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মের মানুষ মুসলমানদের সাথে ধর্মতাত্ত্বিক দিক থেকে ও ধর্মীয় চর্চার দিক থেকে ভিন্নমত পোষণ করে থাকে। একই ভাবে অজ্ঞেয়বাদী কিম্বা সেকুলার মানবতাবাদীরা অন্যান্য সব ধর্মের বিরোধিতার মতো করে ইসলামেরও বিরোধিতা করেন। একটি উদারনীতিবাদী গণতান্ত্রিক দেশে এটা গণতান্ত্রিক চর্চার একটি অপরিহার্য অংশ যে জনগন তার দ্বিমতের কথা প্রকাশ করবে, তাদের মতামত জানাবে। ইসলামী দেশগুলো বা ইসলামিক শাসকদের সমালোচনাও খুবই যৌক্তিক যখন সেই দেশ বা শাসকগোষ্ঠী তাদের নিজেদের দেশে আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা করেনা কিম্বা সারা বিশ্বে ইসলামী সন্ত্রাসবাদের সমালোচনা করাও যৌক্তিক। একই ভাবে কিছু ইসলামী দেশ যেভাবে নারীরদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরন করে তার সমালোচনা করা যেতে পারে কিম্বা মুসলিম দেশগুলো পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি বা অন্যান্য ধর্মের প্রতি যে আচরণ করে থাকে তারও সমালোচনা করা যেতে পারে। এই সকল বিতর্ক, যুক্তি-পাল্টা যুক্তি কিম্বা দ্বিমত শুধু মুসলমানদের ভেতরেই নয়, মুসলমান দের সাথে অমুসলিম জনগনের মাঝেও হতে পারে”।)

সুতরাং সাম্প্রতিক বছর গুলোতে বাংলাদেশে যে নব-নাস্তিকতার ধারা চালু হয়েছে, সেই ধারায় ইসলামের যে চুলচেরা বিশ্লেষণ আমরা দেখছি সেই সকল আলোচনা – সমালোচনা কখনই ইসলামোফোবিয়া নয়। আমাদের নব-নাস্তিকতাবাদী আলোচনার চত্বরে ইসলামের যে কমন বা সাধারণ বিষয়গুলো সবচাইতে বেশী আলোচিত হয় তার একটা সংক্ষিপ্ত তালিকা দেয়া যেতে পারে এখানে –

১ – আল্লাহর একত্ববাদকে চ্যালেঞ্জ করা ও এর ভন্ডামী উন্মোচন করা
২ – মুহাম্মদের নবুয়ত যে ভাওতাবাজী ছিলো তা নিয়ে আলোচনা করা
৩ – কুরআন যে একটি অসংলগ্ন পুস্তক, যা মানুষে মানুষে বিদ্বেষ ও সহিংসতা ছড়ায় সে বিষয়ে আলোচনা করা
৪ – মুহাম্মদ যে একজন যুদ্ধবাদী নেতা ছিলেন এবং সম্পদ ও ক্ষমতা অর্জনের জন্যে তিনি বাধ্য করতেন বিভিন্ন গোত্রকে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে
৫ – মুহাম্মদের অনৈতিক যৌনাচার ও নারীর প্রতি মুহাম্মদের পিতৃতান্ত্রিক ব্যবহার

এই ধরণের বেশকিছু বিষয় নিয়েই আমাদের নব-নাস্তিকতাবাদী লেখকদের মূল আলোচনাগুলো আমরা দেখতে পাই। বলাই বাহুল্য এই সকল বিষয় নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা, লেখালেখি কখনই ইসলামোফোবিয়া নয়। যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশেই এই বিষয়গুলো নিয়ে মত প্রকাশ করা, লেখালেখি করা নাগরিকের মৌলিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে। সুতরাং ইসলামোফোবিয়ার সংজ্ঞাগত দিক থেকে ইসলামের সমালোচনাকে বাতিল করেনা। তাহলে মোটের উপরে ইসলামোফোবিয়া কি?

ইসলামোফোবিয়া হচ্ছে, আপনার ইসলাম বিরোধিতা যদি আপনার মাঝে কিম্বা আপনার পাঠক, সহযোগী নাগরিকদের মাঝে দীর্ঘস্থায়ী ঘৃণার জন্ম দেয় এবং সেই ঘৃণা থেকে যদি পদ্ধতিগত ভাবে একটি বিশেষ গোষ্ঠী মুসলিম সম্প্রদায়কে বৈষম্যমূলক ভাবে আলাদা করতে শেখায়, মূলধারার রাজনীতি, সংস্কৃতি কিম্বা সামাজিক কর্মকান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়, তাইই হচ্ছে ইসলামোফোবিয়া। রানিমেইড ট্রাস্ট এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, ইসলামোফোবিয়া তে মুসলিমদের মাঝে চার ধরণের পরিনতি বা কনসিকোইয়েন্স দেখা যায় –

এই হচ্ছে সংক্ষেপে রানিমেইড ট্রাস্ট এর দেয়া “ইসলামোফোবিয়া”র সংজ্ঞা। সচেতন পাঠকের অনুধাবনের জন্যে।

উপরের এই চিত্রটিতে যে চারটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে, এসবই হচ্ছে ইসলামোফোবিয়ার মূল লক্ষণ। অর্থাৎ আমাদের আচরনে, সামাজিক অনুশীলনে, সামাজিক – রাজনৈতিক – অর্থনৈতিক জীবনে যদি মুসলিম জনগোষ্ঠীকে বৈষম্য করা হয়, তাদেরকে যদি প্রকাশ্যে বা গোপনে, সামাজিক ভাবে যদি এড়িয়ে চলা বা বয়কট করা হয়, যদি তাদের প্রতি সংস্কারাচ্ছন্ন আচরণ করা হয় কিম্বা তাদের প্রতি যদি শারীরিক ভায়লেন্স বা আক্রমন করা হয়, এই ধরণের ঘটনা গুলোকে ইসলামোফোবিয়া বলা হবে। সুস্পষ্ট ভাবেই দেখা যাচ্ছে, এখানে ইসলামের সমালোচনা করা যাবে কি যাবেনা সেই ধরণের কোনও মাত্রা নেই।

বলাই বাহূল্য, মুসলমানেরা প্রায়শই সুযোগ নিয়ে থাকেন “ইসলামোফোবিয়া” শব্দটির, তা দিয়ে ইসলামের সমালোচনা কে ঠ্যাকানোর জন্যে। সেটাও আজকের সময়ের চ্যালেঞ্জ, ইসলামোফোবিয়া বিষয়ে সত্যিকারের ধারণা না থাকলে, মুসলিমদের এই শঠতাকে চ্যালেঞ্জ করা যাবে কিভাবে?

মানবতাবাদী মানুষেরা ঘৃণার বিরুদ্ধে লড়াই করেন। যেকোনো ধরণের সামাজিক শোষণের বিরুদ্ধে, অন্যায্যতার বিরুদ্ধে লড়াই করেন। শুনতে হয়তো খুব তাত্ত্বিক শোনাবে, তবুও বলা দরকার মানবিক মানুষের মানবিকতা বা মানবতাবোধ ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোষ্ঠী দেখে নির্ধারিত হয়না। তাই ইসলামোফোবিয়া বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। এটার নৈতিক ভিত্তি নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। মানবিক মানুষদের মাঝে আলোচনা – বিতর্ক সবসময়েই সদর্থক। এই লেখাটি সেই আলোচনা বা বিতর্কের সুত্রপাত করুক বাংলা ভাষায়, সেটাই আমার প্রত্যাশা।

(ফুটনোটঃ আমি জানি এই আলোচনায় অনেক অধৈর্য পাঠক জানতে চাইবেন, ইসলাম নিজেই কি একটি মানবিক সমাজ গড়ার এক বিরাট প্রতিবন্ধক নয়? কিম্বা সারা দুনিয়াব্যাপী এই দীর্ঘমেয়াদী আতংকের জীবন তৈরী করার জন্যে কি ইসলাম নিজেই একটা দানব নয়? ইত্যাদি প্রশ্ন। এই প্রশ্নগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক কিন্তু তাঁর কিছু উল্লেখ আগামী পর্বগুলোতে থাকবে। তবে এই ব্লগ সিরিজটির মূল আগ্রহের যায়গা “ইসলামোফোবিয়া” ধারণা নিয়ে আলোচনা।)

(চলবে)