ব্যবসা-বাণিজ্যে আয় উন্নতির জন্য কি শুধু বিজ্ঞাপণই দেয়া হয়, আর কিছুই করা হয় না?

হয়। উর্ব্বর ভূমি রচনা করার জন্য অনেককিছু করা হয়। বিদেশী ব্যবসায়ীরা অর্থাৎ বড় বড় কম্পানিগুলো অনেক টাকা খরচ করে, Culture চালু করে দেয় নিজ দেশে। আবার বিদেশেও রপ্তানি করে। গরীব দেশগুলোতে বিনে পয়সায় নাটক পাঠায়, ছায়াছবি পাঠায়। আরও কত কী করে। কোথায় যেন পড়েছিলাম, দেশে দেশে পত্র-পত্রিকা-টেলিভিশন নামক প্রতিষ্ঠানগুলোর পেছনে বেশ অর্থ ঢালা হয়। যাতে করে, দাতার ঋণ শোধ করে, ঐ দেশের ভাব-ভঙ্গী প্রচার করার জন্য। দেশে গিয়ে, যখন যত্রতত্র শুনতে পেলাম, ‘শিট’ – তখন বাকীটুকু আর বুঝতে বাকী রইল না। মজার ব্যাপার হল, একজন বুদ্ধিজীবীর ছেলেও অবলীলায় শিট বললে, আমি বলেছিলাম, আমেরিকায় মার্জ্জিত রুচির লোকেরা ‘শিট’ না বলে, বলে শুট, হ্যাল না বলে, বলে হ্যাক। শুট বা হ্যাক বলা লোকের চেয়ে শিট বা হ্যাল বলা লোকের সংখ্যা বেশী। তাই বাঙালী খাচ্ছে, খাচ্ছে অন্যান্য দেশের লোকজনও।

কোন নায়ক বা মডেল বা খেলোয়াড় কী খেল, কী পরল – এই নিয়ে মাসের পর মাস যখন পত্র-পত্রিকা-টেলিভিশন সরব হয়ে থাকে, তখন তার প্রভাব তরুণ-তরুণীদের উপর পড়বেই। পড়ছে বলেই সম্প্রতি ‘পাখি’ নামক পোশাকের জন্য আত্মহত্যা করেছে ১০ জন এবং ‘কিরণমালা’ নামক পোশাকের জন্য ৩ জন। ভাবা যায় ? যায়।

একি কেবল পোশাক নিয়ে? এই অসুখ ছড়িয়ে পড়েছে সর্ব্বত্র। খেলার মাঠে যখন একজন তরুণী বলে উঠে, মিলা, মেরি মি । তখন বুঝতে নিতে হয়, এই অসুখ একদিনে ছড়িয়ে পড়েনি।

এই যে উর্ব্বর ভূমি রচনার ব্যপারটা ব্যবসায়ীরা যতটা ভাল বুঝে , অন্যেরা ততটা বুঝে না। বলছি, সেই সমাজ পরিবর্ত্তনকামীদের কথা। অথচ বুঝার কথা ছিল। বামপন্থীরা না বুঝলেও ভাল বুঝেছে, ধর্ম্ম ব্যবসায়ী দলগুলো। ভারতে গো শব্দের সবগুলো অর্থ না জানা, নব্য ব্রাহ্মণ্যবাদী অর্থাৎ রাবণের উচ্চ রবে চারদিক উচ্চকিত; হুংকারে সীতা ( জনগণ )-এর প্রাণ যায় যায়।

নিজের দেশে চোখ রাখলে আমরা দেখতে পাব, উর্ব্বর ভূমি রচনায়, খুব নীরবে ধর্ম্ম ব্যবসায়ীরা অনেকদূর এগিয়ে গেছে। তারা জেনে গেছে অনেক আগেই, এই উর্ব্বর ভূমি রচিতে হয়ে গেলে, ক্ষমতায় যাওয়া এবং থাকাটা অনেক সহজ হয়ে যায়। উদাহরণ হিসাবে, যে বিষয়টির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করব, সেটি হল হিজাব।

((হিজাব ও বোরকার বাজার ২ হাজার কোটি টাকার । সূত্র goo.gl/FjqJjqcontent_copyCopy short URL) দুই হাজার কোটির বাণিজ্যের জন্য এক শত কোটির টাকার চাঁদা কিচ্ছু না। )

আমার এক চিকিৎসক বন্ধু ( উনি নিজে ধর্ম্ম বিশ্বাসী ) খুব আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ওড়না না পরার কারণে রাস্তায় তাকে বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হতো। ওড়না না পরার কারণে এক সিএনজি চালক তাকে তার যন্ত্রযান থেকে নামিয়ে দিয়েছিল।

একটু পেছনে ফিরে গেলে দেখতে পাব, হিজাব নামক এই পোশাকটির অস্তিত্ব বাংলাদেশে ছিল না। বোরকা পড়ত, কিন্তু তাদের সংখ্যাও চোখে পড়ার মত ছিল না। এখানে একটি দু’টি ছবি দেয়া হল, একটি ১৯৬২ সালের ভিকারুন্নিসা স্কুলের।

ভিকারুন্নিসা স্কুলের, ১৯৬২ সালের ছবি

নীচের ছবিটি ফেইসবুকের বন্ধু Shirin Mawla Runa-এর স্কুল জীবনের ১৯৮৫ সালের পিকনিকের।
হিজাব

হিজাব পরা একজন মেয়েও নেই। অথচ আজকালকার স্কুলগুলোতে , এমনকি ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়েও তাকানো যায় না। চারদিকে হিজাব পরা মেয়ে। কেন , এমনটি হল? আমরা কি কখনো এই প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছি? আনিনি। ঘরে বাইরে, রাস্তাঘাটে – সর্ব্বত্র কারা নীরবে-সরবে নারীদের উত্যেক্ত করে যাচ্ছে, কেন করে যাচ্ছে, আমরা কি ভেবে দেখেছি?

এই নিয়ে এক বন্ধুর সাথে কথা বলছিলাম, সে জানাল, গান শিখতে যাই, লাল টিপ পরি। অনেকে এ নিয়ে উপহাস করে। এমনকি আত্ময়ীদের কেউ কেউ পর্য্যন্ত কটু কথা বলে।

একদিন তাদের বাসায় তিনজন হিজাব পরা রমনী উপস্থিত। নামাজ ( ওরা বলে সালাত ) , রোজা ( ওরা বলে সিয়াম ) আর হিজাব পরার উপকারিতা নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিল। বন্ধুটি নিজে ব্যস্ত বলে, ওদের বিদায় করে দিয়েছিল। কারণ জিজ্ঞেস করলে জানাল, যদি কিছু হয়। ওর্থাৎ ভয় সংক্রমিত হচ্ছে। পাছে যদি কিছু হয়, তাই প্রতিবাদ করার সাহসটুকুও হারিয়ে ফেলছে প্রায় সবাই।হিজাব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিবাদ

অথচ এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সময় ছাত্রীরা মিছিল করেছে যে বেশে, দেখুন সে দৃশ্য !

হিজাব, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন

এইসব প্রচার প্রচারণার পাশাপাশি রয়েছে, মসজিদগুলো থেকে নিয়মিত মগজ ধোলাই আর ঘৃণা উদ্রেককারী খুতবা । রয়েছে ওয়াজের নামে গালাগালি। এমন অকথ্য ভাষায় গালাগালি দেয়া হয়, যা ভাবা যায় না। সমাজ নীরব। কারণ – ভয়। রাষ্ট্র নীরব – কারণ শোষণ-শাসন।

প্রায় সবগুলো প্রধান প্রধান ধর্ম্ম , নারীদের পারলে শূলে চড়ায়। কিন্তু তার গর্ভেরও প্রয়োজন আছে। দরকার, যৌন চাহিদা মেটানোর। তাই তাকে জমিতে , মানে নিজের জমি বলে যেভাবে বেড়া দেয়া হয়, ঠিক সেইভাবে নারীর শরীরকে ঘিরে দেয়া হয় একটার পর একটা বেড়া দিয়ে। ব্রা পরল , ব্লাউজ,পরল সেলোয়ার কামিজ বা শাড়ী পরল, তারপর বোরকা পরল, বা মুখ-মাথা ঢেকে ফেলার জন্য হিজাব পরল – একটা সমাজ কতটা অসুস্থ হলে একজন মানুষকে এতগুলো কাপড় পরিয়ে দিতে পারে?

কাপড় ব্যবসায়ীরা অবশ্য লাভবান, সন্দেহ নেই। তারা যদি গোপনে চাঁদা দেয়, অবাক হবার মত নয়।

বলা হচ্ছে, এটা ওদের পছন্দ। পছন্দই যদি হবে, তার আগে ওয়াজগুলোতে যে গালাগালি হয়, তা বন্ধ করুন। মসজিদে যে নিন্দা ভাষণ হয়, তা বন্ধ করুন। রাস্তাঘাটে যে উপদ্রপ হয়, তা বন্ধ করেন, নারীকে বলুন, তোমার যা ইচ্ছে পরিধান করতে পার।

এগুলো কার্য্যকর না করে, পোশাকের স্বাধীনতা বলাটা বাতুলতা মাত্র। আর এগুলোর অর্জ্জন নারীবাদ দিয়ে হবে না। শুধু লিখেও হবে না। ওরা যেমন মাঠে-ঘাটে-রাস্তায়- ময়দানে-ঘরে-বাইরে সক্রিয়, প্রগতির পক্ষের শক্তিগুলোকেও প্রায়োগিক দিক থেকে সক্রিয় হয়ে উঠতে হবে।

শিক্ষিত মা পেলে কী রকম জাতি উপহার দেয়া সম্ভব – আমরা জেনেছিলাম, ন্যাপোলিয়নের কাছ থেকে। কিন্তু গুরুত্বটা যারা বুঝবার তারা ঠিকই বুঝে নিয়েছে। নিয়েছে বলেই, নারীকে একটার পর একটা পোশাকের স্তর দিয়ে, শরীরকে এমনভাবে ঢেকে দেয়া হচ্ছে, যেন সে এক মুহুর্ত্তের জন্য ভুলে না যায়, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তার বাস। পুরুষই নির্ধারণ করে দেবে, তার পোশাক।

প্রতি মুহুর্ত্তে এই যে স্মরণ করিয়ে দেয়া , নারী , মানুষ না, পুরুষের সেবিকা, পুরুষের মনোরঞ্জনই তার অভীষ্ট লক্ষ্য, তাকে বাতিল করে দেবার মত কোন আন্দোলন কি সমাজে সংগঠিত হচ্ছে?