ছবি ১: এসকিলাসের লেখা ‘প্রমিথিউয়াস বাউন্ড’ গীতিনাট্যের একটি চিত্ররূপ।

ইতিহাস আমার খুব প্রিয় একটা বিষয়, সবকিছুকেই ইতিহাসের আলোয় মেলে দেখাটা অভ্যেস হয়ে গেছে সেই ছোটবেলা থেকেই। এ কারণেই বিবর্তন বলুন, দর্শন, ভাষাতত্ত্ব, কসমোলজি বা এস্ট্রনমি বলুন, এমনকি মিথলজিও (আমার খুব প্রিয় একটি বিষয়) আমার ইতিহাসের অংশ বলে মনে হয়। আমরা সবাই ইতিহাসের একেকটি জীবন্ত নমুনা – হেঁটেচলে-বেড়ানো ইতিহাসের জীবন্ত বই ছাড়া আর কিছু নই আমরা। আমাদের ডিএনএতে গাঁথা রয়েছে গত সাড়ে তিনশ’ কোটি বছরের প্রাণের ইতিহাস, আমাদের পৃথিবী গেয়ে চলেছে গত সাড়ে চারশ’ কোটি বছরের গান, আমাদের শরীরের অণু-পরমাণুতে লুকিয়ে আছে হাজার হাজার নক্ষত্রের ভগ্নাংশ, মহাবিশ্বের পরতে পরতে লেখা আছে তেরশ’ আশি কোটি বছরের ইতিহাস। দুই লাখ বছর আগে, আমাদের প্রজাতির জন্মলগ্ন থেকেই সেই ইতিহাস জানার আপ্রাণ চেষ্টা করে আসলেও মোটে, গত দেড়শ দুইশ বছরে, নৈর্ব্যক্তিকভাবে সেই সামগ্রিক ইতিহাসটা পড়তে পারার ক্ষমতা অর্জন করতে শুরু করেছি আমরা।

কিছুদিন আগে এরিক চেইসনের কসমিক এভুল্যুশান বইটা পড়েছিলাম, এখন সমাজতত্ত্ববিদ রবার্ট বেলাহ-র রিলিজিয়ন ইন হিউম্যান এভুল্যুশান এবং ডেভিড ক্রিশ্চিয়ানের ম্যাপ্স অফ টাইম বই দুটি পড়ছি। তিনটি বইয়েরই বিষয়বস্তু বলা যায় ‘বিগ হিস্ট্রি’; এই ‘বিগ হিস্ট্রি’কথাটা বিগ ডাটার মতই একটা টেকনিকাল টার্মে পরিণত হয়েছে এখন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন লেখায় ‘মহাইতিহাস’ কথাটা ব্যবহার করেছেন, জীবনানন্দ দাশও তার যাত্রী কবিতায় ‘মহাইতিহাস’ কথাটা ব্যবহার করেছিলেন। তাঁদের কাছ থেকে চুরি করেই বিগ হিস্ট্রির বাংলা করলাম ‘মহাইতিহাস’। যখনই পড়ি তখনই এই ‘যাত্রী’ কবিতাটা আমাকে শিহরিত করে:

‘পথ চিনে এ-ধুলোয় নিজের জন্মের চিহ্ন চেনাতে এলাম;
কাকে তবু?
পৃথিবীকে? আকাশকে? আকাশে যে-সূর্য জ্বলে তাকে?
ধুলোর কণিকা অণুপরমাণু ছায়া বৃষ্টি জলকণিকাকে?
নগর বন্দর রাষ্ট্র জ্ঞান অজ্ঞানের পৃথিবীকে?

যেই কুজ্ঝটিকা ছিলো জন্মসৃষ্টির আগে, আর
যে-সব কুয়াশা রবে শেষে একদিন
তার অন্ধকার আজ আলোর বলয়ে এসে পড়ে পলে-পলে;
নীলিমার দিকে মন যেতে চায় প্রেমে;
সনাতন কালো মহাসাগরের দিকে যেতে বলে।

তবু আলো পৃথিবীর দিকে
সূর্য রোজ সঙ্গে ক’রে আনে

যেই ঋতু যেই তিথি যে-জীবন যেই মৃত্যুরীতি
মহাইতিহাস এসে এখনও জানেনি যার মানে;’

আজকে নতুন বছরের শুরুতে ভাবলাম অপেক্ষাকৃত নতুন কিন্তু চিত্তাকর্ষক এই ধারণাটি সবার সাথে ভাগ করে নিলে খারাপ হয় না।

নববর্ষের উপহার হিসেবে পাঠককে নীচের টাইমলাইনটিও ভাল করে স্ক্রোল করে দেখার অনুরোধ করছি। নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির মিডিয়া ল্যাবের ওয়েবসাইটে একটি গ্রুপ এই ইন্টার‌্যাক্টিভ এবং রোমাঞ্চকর (আক্ষরিকভাবেই রোমাঞ্চকর) টাইমলাইনটি তৈরি করতে শুরু করেছেন। তাঁদের অনুমতিক্রমে সেটা এখানে শেয়ার করলাম। বাংলায় এরকম আর কিছু আছে বলে আমার জানা নেই। ভালো করে দেখতে এইখানে ক্লিক করেও সরাসরি ওই সাইটে যেতে পারেন। মূল লেখায় ফিরে আসতে ব্রাউজারের ব্যাক-এরো ক্লিক করুন।

ছবি ২: মহাবিশ্বের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ইন্টারেক্টিভ টাইমলাইন। টাইমলাইনটিতে যেতে এখানে ক্লিক করুন।

মানুষের চেতনার একটা বড় অংশ তার ঔৎসুক্য, তার জানতে বুঝতে চাওয়ার আগ্রহ। সৃষ্টির আদি থেকেই আমরা আমাদের চারপাশের মহাবিশ্ব, প্রকৃতি, সমাজ, সংস্কৃতি বুঝতে চেয়েছি, জানতে চেয়েছি আমাদের নিজেদের সৃষ্টিরহস্য। যেকোন নির্দিষ্ট সময়ের লব্ধ জ্ঞান এবং উপলব্ধি অনুযায়ী তাদের ব্যাখ্যাও করেছি মনের তুলি দিয়ে রংবেরঙের গল্প, গান, ছবির মাধ্যমে – রচনা করেছি অসংখ্য পুরাণ, সৃষ্টিপুরাণ। আমাদের এই নিত্য জানতে চাওয়া এবং শিখতে চাওয়ার ক্ষমতাটাই হয়তো আমাদের এতোটা পৃথক করেছে অন্যান্য প্রাণীদের থেকে।

সম্পূর্ণ গল্পটা এখনো না জানলেও গত কয়েকশ’ বছরে জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা থেকে – পদার্থবিদ্যা, মহাকাশবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, জীববিজ্ঞান, ভূতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, ভাষাতত্ত্ব, সমাজতত্ত্বসহ আরও বহু শাখার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা এখন মোটামুটিভাবে আমাদের মহাবিশ্বের একটা সামগ্রিক চিত্র আঁকার ক্ষমতা অর্জন করেছি। গত ১৩৮০ কোটি বছরের দীর্ঘ ক্যানভাসটার অনেকাংশই এখন আমরা রাঙাতে শিখে গেছি।

আমরা আমাদের ছাত্রছাত্রীদের শুধু খণ্ড খণ্ড চিত্রটাই আঁকতে শেখাই, ইতিহাসের পুরো ক্যানভাসটা রং করতে শেখাই না। এখন ডেভিড ক্রিশ্চিয়ানের মত অনেক গবেষক, ইতিহাসবিদ, বিজ্ঞানী এবং শিক্ষকেরা মনে করেন যে আমাদের সবার জন্য এই সামগ্রিক ইতিহাসটি জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে আমরা নিজেদের মহাবিশ্বের সাপেক্ষে সঠিকভাবে স্থাপন করতে শিখব, একদিকে যেমন আমাদের ক্ষুদ্রত্ব চিহ্নিত করতে শিখব তেমনি আবার আমাদের বিশালত্ব ও দায়িত্বগুলোও অনুধাবন করতে শিখব। মহাবিশ্বের সাপেক্ষে আমরা আমাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে নতুন এক ধারণা তৈরি করতে সক্ষম হব, আমাদের চারপাশের প্রকৃতির মর্ম বুঝতে শিখব, আমরা অবনমিত হতে শিখব। শুধু তাইই নয়, যুগে যুগে আমরা আমাদের সামষ্টিক জ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে যে শিল্প সাহিত্য বা মিথগুলো রচনা করেছি সেগুলোকে আজকের দিনের নতুন জ্ঞানের আলোকে আবার নতুন করে লিখতে শিখব।

আসুন দেখি জ্ঞানের সব শাখাগুলোকে সমন্বিত করলে আমাদের সময়ের মহাইতিহাসটা কেমন শোনায়।

লেখাটা বেশি বড় করতে চাই না দেখে অত্যন্ত সংক্ষেপে সেই ইতিহাসের শুধু কয়েকটি ‘হেডলাইন’ উল্লেখ করছি। তবে ডেভিড ক্রিশ্চিয়ান তাঁর একটি টেড টকে, মাত্র ১৮ মিনিটে, অপূর্বভাবে সেই অসাধ্য সাধন করেছেন। আগ্রহী পাঠকদের অনুরোধ করব, আরেকটু বিস্তারিত জানতে চাইলে, বাংলা এই টাইমলাইনটির সাথে ক্রিশ্চিয়ানের টেড টকটিও দেখে শুনে নিন।

এইখানে ক্লিক করে সেখানে যাওয়া যাবে আর এই মূল লেখাটিতে ফিরে আসতে ব্রাউজারের ব্যাক-এরো ক্লিক করুন।

আমরা এখন জানি যে, ১৩৮০ কোটি বছর আগে এক মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে আমাদের মহাবিশ্বের উৎপত্তি ঘটে, আর সেখান থেকেই যাত্রা শুরু পদার্থের, শক্তির, স্থানের এবং কালের। হ্যাঁ, ‘সময়’ নামক এই অদ্ভুততম জিনিসটার (সময়ের ধারণাটা আমি এখনো কিছুতেই বুঝে উঠতে পারিনা) উৎপত্তিও নাকি এই মাহেন্দ্রক্ষণেই। বিস্ফোরণের প্রথম সেকেন্ডের মধ্যেই প্রোটন, নিউট্রন এবং ইলেকট্রন তৈরি হয়ে গেলেও হাইড্রোজেন এবং হিলিয়ামের নিউক্লিয়াসের(যাদের থেকেই উৎপত্তি ঘটেছে মহাবিশ্বের বেশিরভাগ জিনিসের) তৈরি হতে লেগেছিল ৩ মিনিটের মত সময়। তার পরের তিন লক্ষ বছরে তৈরি হয় হাইড্রজেন পরমাণু, আর তা থেকে নক্ষত্র এবং গ্যালাক্সি তৈরি হতে আরও লক্ষ লক্ষ বছর লেগে গিয়েছিল। আমাদের সূর্য, সৌরজগৎ এবং পৃথিবীর উৎপত্তি ঘটে মাত্র সাড়ে চারশ’ কোটি বছর আগে।

টাইমলাইনটির ভাষায় বলতে গেলে, ‘আমাদের গ্যালাক্সির (আকাশগঙ্গা) প্রান্তদেশের একটি গ্যাসপিণ্ড সংকুচিত হতে শুরু করে, পিণ্ডটির কেন্দ্রে তার ৯৯.৯% পদার্থ দিয়ে সূর্য তৈরি হয়, বাকি ০.১% গ্যাস, ধূলি, শিলাকণা সূর্যের চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে একটি চাকতি তৈরি করে। এই ঘূর্ণায়মান চাকতি থেকেই সৌরজগতের গ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহাণু ইত্যাদি সবকিছুর জন্ম। আমাদের পৃথিবীও সূর্যের জন্মলগ্নের ধ্বংসলীলারই একটি উপজাত যার জন্ম হয়েছে সৌরচাকতির কিছু পদার্থের ঘনীভবনের মাধ্যমে; জন্মের ঠিক পর পর পৃথিবী ছিল একটা প্রচণ্ড উত্তপ্ত লাভা-গ্যাস-উদ্গারি আগ্নেয়-গোলক।’ যে চাঁদ নিয়ে আমরা এত গল্প-উপাখ্যান-গান-কবিতা তৈরি করেছি তার সৃষ্টি হয়েছিল পৃথিবীর উপর মহাশূন্য থেকে আসা এক ভারি বস্তুর আঘাতের ফলে ছিটকে পড়া বিভিন্ন অংশ থেকে। আমাদের পৃথিবীর ঠান্ডা হয়ে মেঘ, বৃষ্টি, সমুদ্র, বায়ুমণ্ডল তৈরি হতে সময় লেগে গিয়েছিল আরও একশ’ কোটি বছর। আর এর পরেই উদ্ভব ঘটেছিল প্রাণের।

আগে আমরা অনেকে ভাবতাম কারো অঙ্গুলিহেলনে হয়তো এমন ‘পারফেক্ট মর্ত্য এবং স্বর্গ’ তৈরি হয়েছে । এখন জেনেছি কোটি কোটি বছরে প্রবল ধ্বংসাত্মক পদ্ধতিতে তৈরি হয়েছিল এই মহাবিশ্ব এবং আমাদের পৃথিবী। পৃথিবীকে ‘পারফেক্ট’ জায়গা হিসেবে তৈরি করে সেখানে প্রাণের বীজ গেঁথে দেওয়া হয়নি, বরং কোটি কোটি গ্রহ নক্ষত্রের ভীষণরকমের ভাঙাচোরা এবং ধ্বংস প্রক্রিয়ায় মাঝে ঘটনাক্রমে আমাদের এই ছোট্ট গ্রহটি এমন একটি কক্ষপথে স্থাপিত হয়ে গেছে বলেই এখানে প্রাণের সঞ্চার হতে পেরেছে। আমাদের সৌর জগৎ এবং গ্যালাক্সির ভিতরে এবং বাইরেও লক্ষ কোটি গ্রহ উপগ্রহ আছে। তাদের কোনটাতে, সঠিক পরিবেশ সৃষ্টি হলে, প্রাণের সঞ্চার হয়ে থাকতে পারে, যদিও আমরা এখনো তার সন্ধান পাইনি।

তবে আগেই যেমন বলেছি, আমাদের এই উত্তপ্ত টালমাটাল পৃথিবী ঠান্ডা হয়ে তাতে বায়ুমণ্ডল তৈরি হতে, হাজার বছরের বৃষ্টি থেকে সাগর-মহাসাগর তৈরি হতে আর সেই সমুদ্রের রাসায়নিক অণু-সমৃদ্ধ পরিবেশে প্রাণের উদ্ভব ঘটতে আরও একশ’ কোটি বছর লেগে গিয়েছিল। তারপর এই এককোষী প্রাণীগুলোর থেকেই ধীরে ধীরে নিউক্লিয়াস-ঘেরা বহুকোষী প্রাণীর বিবর্তন ঘটে। ৬০-৮০ কোটি বছর আগে বহুকোষী জীবের যেন এক বিস্ফোরণ ঘটে পৃথিবী জুড়ে – ‘যৌন প্রজনন, নিঃশ্বাসের মাধ্যমে অক্সিজেনের শক্তি ব্যবহার, এবং একাধিক সুকেন্দ্রিক কোষ জোড়া লাগানোর ক্ষমতা’য় বলীয়ান হয়ে পানিতে, ডাঙ্গায় এবং আকাশে বিচিত্র সব জীবের যেন মেলা বসে যায় – গাছ, ছত্রাক, মাছ, উভচর, সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী প্রাণীতে ভরে ওঠে আমাদের এই গ্রহ। এই সময়েই পৃথিবীর বুকে চড়ে বেড়াতো সেই বিশালাকায় ডাইনোসরগুলো।

তবে এই প্রাণের মেলার একটা অপরিহার্য অংশ হচ্ছে ধ্বংস এবং বিলুপ্তি। বহুবারই গণবিলুপ্তি ঘটেছে প্রাণের বিবর্তনের ইতিহাস জুড়ে। সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে একটি গ্রহাণু এসে আছড়ে পড়ে পৃথিবীর বুকে। সেই আঘাতে দীর্ঘ সময় ধরে পৃথিবীর বুকে যে মহাবিপর্যয় নেমে আসে তারই ফলে সব স্থলচর ডাইনোসর এবং অন্যান্য বহু জীব বিলুপ্ত হয়ে যায়। তবে উড়তে সক্ষমদের মধ্যে যারা বেঁচে যায় তাদের বংশধররাই বিবর্তিত হয়ে আজকের পাখিতে পরিণত হয়েছে। ডাইনোসরেরা আত্মাহুতি দিয়ে যেন আমাদের, অর্থাৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের, বিবর্তনের সুযোগ করে দিয়ে গেল। বিশালাকায় ডাইনোসরদের রাজত্বে ছুঁচোর মতো অতিক্ষুদ্র নিশাচর স্তন্যপায়ী প্রাণীরা তেমন পাত্তাই পেত না। ডাইনোসররা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পরই এই ক্ষুদ্র স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলো প্রাইমেট হিসেবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায় এবং তাদেরি বংশধর হিসেবে আমাদের অর্থাৎ আধুনিক মানুষের উদ্ভব ঘটে প্রায় সাড়ে ছয় কোটি বছর পরে। ডাইনোসরদের মৃত্যুই যেন আমাদের জন্ম সম্ভব করেছে।

ছবি ৪: প্রাইমেট পরিবার।
Nature Education Knowledge থেকে নেওয়া

খুব অদ্ভুত শোনালেও এটা এখন প্রমাণিত যে, ২ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকার সাভানায় আমাদের পূর্বপুরুষেরা বিবর্তিত হওয়ার আগে আরও অনেক ধরনের মানুষের প্রজাতির উৎপত্তি ঘটেছিল। তারা কখনো কখনো ছোট ছোট দলে অন্যান্য মহাদেশে ছড়িয়েও পড়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শুধু আমাদের পূর্বপুরষরাই, অর্থাৎ, হোমো সেপিয়েন্সরাই, টিকে থাকে আফ্রিকা মহাদেশে। এখান থেকেই মাত্র এক লাখ বছর আগে আমরা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করি পৃথিবীর অন্যান্য সব দেশে, মহাদেশে।

গত দেড়শ’ বছরে ফসিলবিদ্যা এবং জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার থেকে পাওয়া ইতিহাস থেকে আজ জেনেছি যে, আমরা সবাই এই প্রকৃতিরই অংশ, আমরা সমগ্র জীবজগতের বিবর্তনের ধারারই সংযোজিত অংশমাত্র, আমাদেরও উৎপত্তি ঘটেছে একই প্রক্রিয়াতেই। তবে এটাও ঠিক যে, আমরা এই পৃথিবীতে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী (বা সফলও বলতে পারেন হয়তো) প্রজাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছি, সমগ্র পৃথিবীটাই তো ‘দখল’ করে বসেছি আমরা এখন। শিম্পাঞ্জির সাথে আমাদের ডিএনএর ৯৮% এর বেশী মিল থাকা সত্ত্বেও তাদের সাথে আমাদের এতটা অমিল! কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব হল? ভাষা, যৌথভাবে শিখতে পারা এবং তা পরের প্রজন্মে বাহিত করতে পারার ক্ষমতা মানুষ ছাড়া আর কোন প্রাণীর নেই। মানুষের অন্য সব প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেলেও, দ্বিপদী শারীরিক গঠন এবং শরীরের তুলনায় বড়ো মস্তিষ্কের সাথে ভাষা, সমাজ ও সংস্কৃতি গড়ার ক্ষমতার যোগসমষ্টিই আধুনিক মানুষকে ৬০-৭০ লক্ষ বছরের মধ্যে আফ্রিকার সাভানায় ঘুরে বেড়ানো সামান্য এক এইপ থেকে সমগ্র পৃথিবীর শাসকে পরিণত হতে সহায়তা করেছে।

ছবি ৫ঃ মানুষের বিভিন্ন প্রজাতি। হোমো স্প্যপিয়েন্স ছাড়া বাকিরা সবাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে

গত দেড়শ’ বছরে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে, ৭০ হাজার বছর আগে যে এইপ প্রজাতিটি প্রায় ধ্বংস হতে বসেছিল সেটিই এখন কয়েক হাজার প্রজন্মে ফুলে ফেঁপে প্রায় আটশ’ কোটিতে এসে পৌঁছেছে। জিনতাত্ত্বিকদের মতে, ৭০ হাজার বছর আগে আমাদের জনসংখ্যা কমে গিয়ে মাত্র কয়েক হাজারে এসে পৌঁছেছিল, যার ফলেই আমাদের ডিএনএ-তে এত কম বৈচিত্র্য দেখা যায়। পৃথিবীর যে কোন দেশের মানুষের ডিএনএর তুলনা করলে তাদের মধ্যে ৯৯.৯% মিল পাওয়া যায়। অথচ আমাদের খুব কাছের শিম্পাঞ্জি বা গরিলাতেও আমাদের চেয়ে অনেক বেশি বংশগতীয় ভিন্নতা দেখা যায়। আমরা এখন জানি যে, আমরা সবাই এত্ত ছোট একটা দলের বংশধর হলেও, আমাদের মধ্যে এত কম বংশগতির ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কারণে ঐতিহাসিকভাবে পৃথিবীব্যাপী যে জাত বা বর্ণভেদের ধারণাটা তৈরি করা হয়েছিল তা এক্কেবারে ভিত্তিহীন।

ইতিহাস বলতে আমরা এখনো বুঝি গত ৪-৫ হাজার বছরের লিখিত ইতিহাস, কিন্তু আজ একুশ শতাব্দীতে এসে, আমরা বুঝতে পারছি যে, আমাদের ইতিহাস আসলে তেরশ আশি কোটি বছরের এক মহাইতিহাস। তবে আমাদের এই মহাইতিহাসটার সামগ্রিক সংশ্লেষণ করা সম্ভব হচ্ছে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার যৌথ প্রয়াসে। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য থেকে শুরু করে সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার অবদান এখানে অনস্বীকার্য। শুধু প্রাকৃতিক বিজ্ঞান দিয়ে বা শুধু গতানুগতিক ইতিহাস দিয়ে এটা রচনা করা সম্ভব নয়। চলুন দুএকটি উদাহরণ দিয়ে দেখা যাক আজকে একুশ শতাব্দীতে এসে জ্ঞান ও শিল্পের বিভিন্ন শাখা কিভাবে একসাথে আমাদের এই নতুন মহাকাব্যটি রচনা করে চলেছে।

অ্যান্টিবায়োটিকের মত মহৌষধির আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে তিনশ’ কোটি বছরের পুরনো বুড়ো ব্যাকটেরিয়ার বিবর্তনপ্রক্রিয়া বোঝার মাধ্যমে। সর্বত্র-বিরাজমান ব্যাকটেরিয়া যেমন আমাদের জন্য ক্ষতিকারক ঠিক তেমনি তারা আমাদের অনেক উপকারও করে, আমাদের শরীরে ভিতরেই সহবাস করে কোটি কোটি ব্যাক্টেরিয়া, তাদের ছাড়া আমাদের অস্তিত্বই সম্ভব নয়। আমাদের দেহে যত কোষ আছে তার চেয়ে বেশি আছে ব্যাক্টেরিয়া; প্রত্যেকটি জীব যেন একেকটি ব্যাক্টেরিয়া কলোনি।

আবার দেখুন, চিকিৎসাবিদ্যা থেকে আবিষ্কৃত বিংশ শতাব্দীর জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি শুধু পৃথিবীর জনসংখ্যাই নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়নি সেই সাথে পৃথিবীর ইতিহাসে আরেক বিপ্লবের সূচনা করেছে। প্রথমবারের মত নারীরা প্রতি দুই বছরে শিশুর জন্মদান এবং লালন পালনের দায় থেকে মুক্ত হয়ে নিজের জীবনের দায়িত্ব নিজে বুঝে নেওয়ার দাবি জানাচ্ছে। বিংশ শতাব্দীতে প্রযুক্তির বিস্ফোরণ আমাদেরকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে এসেছে যেখানে শুধু শারীরিক শক্তি দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপণ করা যাচ্ছেনা। বিবর্তনের হাত ধরে যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তার মূলে আঘাত হেনে সমাধিকারের দাবি জানাচ্ছে— সময়েরই দাবি এটা—সমাজবিজ্ঞানী, নারীবাদী এক্টিভিস্ট, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, থেকে শুরু করে সমাজের সব সচেতন নারী (এবং পুরুষ) সামিল হয়েছেন একই কাতারে। মানুষই একমাত্র প্রাণী যে তার চারপাশের প্রাকৃতিক এবং সামাজিক নিয়মকে ভেঙ্গে আবার নতুন নিয়ম তৈরি করতে সক্ষম।

বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানী ডেভিড বাস যখন বলেন যে নারী প্রসঙ্গে নারীবাদী সমাজবিজ্ঞানী এবং এক্টিভিস্টদের সাথে গত ২৫-৩০ বছরের প্রবল বিতর্কের ফলে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের মত বিজ্ঞানের নতুন শাখাটি সার্বিকভাবে আরও উন্নত এবং নিয়মনিষ্ঠ হতে বাধ্য হয়েছে তখন বোঝা যায় বিজ্ঞান, শিল্প এবং সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে সমন্বয় ঘটানোটা কতটা আসন্ন হয়ে পড়েছে। আবার দেখুন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মত একটা জটিল এবং দীর্ঘমেয়াদি বিষয় বুঝতে হলে একাধিক জ্ঞানের শাখার আশ্রয় না নিয়ে উপায় নেই। আমেরিকার মত একটি উন্নত দেশের সরকার কেন এমন একটি প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক সত্য প্রকাশ্যে অস্বীকার করে তার কারণটা বুঝতে হলে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ইতিহাস, ফলাফল এবং বিজ্ঞানটা বুঝলেই শুধু হবেনা এখন আমাদের সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক খেলাগুলোও বুঝতে হবে।

নিউটন যেমন স্বর্গ এবং পৃথিবীকে একই গতির তত্ত্বের আলোকে এনে তাদের এক স্তরে নামিয়ে নিয়ে এসেছিলেন, তেমনি গত কয়েকশ বছরে, শিল্পীরা শিল্পের বিভিন্ন শাখাকে দেবলোক থেকে নামিয়ে এনেছেন মর্ত্যলোকে। আবার, আইনস্টাইন, হাইজেনবার্গ, বোর, শ্রোডিঙাররা যেমন দেখিয়েছেন যে আমাদের দৃশ্যমান জগৎ আর কোয়ান্টাম জগৎ পাশাপাশি বাস করলেও তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন নিয়মে চলে ঠিক তেমনি সমাজবিজ্ঞানী, ভাষাতত্ত্ববিদ, নৃবিজ্ঞানী, শিল্পী, এক্টিভিস্ট, দার্শনিকেরা ক্রমশ চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন যে একেক সমাজ একেক নিয়মে একেক ছন্দে চললেও তারা অনুত্তম বা হীন হয়ে যায়না।

আগে আমরা ইতিহাস বলতে বুঝতাম শুধু লিখিত রাজা বাদশাহদের ইতিহাস, কোন সম্রাট কত সালে কত রাজ্য জিতেছিল, কোন ফেরাউন কোথায় হেরেছিল, বা কোন আবিষ্কারক বা কোন বিজেতা জাতি কোন দেশ বা মহাদেশ আবিষ্কার করে তার অধিবাসীদের ‘সভ্য’ বানিয়েছিল। আমরা, মানুষেরা আগে উদ্বেল ছিলাম আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে। প্রকৃতিতে আমাদের প্রজাতির অকল্পনীয় সফলতা দেখে ভেবেছিলাম যে মানুষ কোন এক বিশেষ সৃষ্টি, আমরা কোনভাবেই বাকি প্রাণীজগতের মিছিলের অংশ হতে পারি না – নিশ্চয়ই আমাদেরকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি করা হয়েছে প্রকৃতির সব কিছু। আবার এক ধাপ এগিয়ে সব জাতি, বিশেষ করে সব বিজেতা গোষ্ঠীই বা গোষ্ঠীর একাংশ নিজেকে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ বলে দাবি করেছে। সৃষ্টি হয়েছে জাতপাত, বর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গ, শ্রেণিভেদ। গ্রিকরা ভাবতো তারাই একমাত্র ‘সভ্য’ জাতি, তাদের আশেপাশের সবাই ‘বর্বর’। তবে শুধু গ্রীকরাই নয়, ভারতীয়, মুসলিম, চাইনিজ সভ্যতার মত ‘গৌরবের অভ্রভেদী শিখরে ওঠা’ সব ‘সভ্যতাই’ কম বেশি এভাবে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করেছে।

পাশ্চাত্যের বড় বড় লেখকেরা কিছুদিন আগে পর্যন্তও প্রকাশ্যে আফ্রিকাবাসীর বা আমেরিকার আদিবাসীদের ‘অসভ্য’ আখ্যা দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। তাদের কাছে তখন একমাত্র পাশ্চাত্য-ধরনের উন্নতিই ছিল ‘সভ্যতা’র একমাত্র মানদণ্ড। আফ্রিকাবাসীরা ছিল ‘আনসিভিলাইজড’, আমেরিকা মহাদেশের কোটি কোটি আদিবাসীরা ছিল ‘স্যাভেজ’ – তাদেরকে সভ্য বানানোটা নাকি ‘হোয়াইট ম্যান’স বার্ডেন’, আমেরিকা মহাদেশে হাজার হাজার আদিবাসীসের হত্যা এবং নির্যাতন করে ইউরোপিয়ানদের উপনিবেশ স্থাপন নাকি গড প্রদত্ত ‘ম্যানিফেস্ট ডেস্টিনি’।

ছবি ৬ঃ ১৮৪৬ সালে ভ্যান্ডারলিনের আঁকা ছবিতে কলম্বাসের আমেরিকা পদার্পণকে গৌরবান্বিত করা হয়েছে

অথচ আজকের আধুনিক নৃবিজ্ঞানী, জীবাশ্মবিদ, জিনতাত্ত্বিক এবং ইতিহাসবেত্তাদের কাছ থেকে জানছি যে, আফ্রিকা মহাদেশ আমাদের প্রজাতির (হোমো স্যাপিয়েন্স) জন্মস্থান, আমরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছি মাত্র ৭০-১০০ হাজার বছর আগে। চীন থেকে শুরু করে মহেঞ্জোদারো, সুমের, মেসোপটেমিয়া, আমেরিকার অ্যাজটেক বা মায়া সভ্যতার মত উন্নত সভ্যতাগুলোর বিকাশ ঘটেছিল হাজার হাজার বছর আগে। ‘মানবতা’, ‘সভ্য’, ‘অসভ্য’ এবং ‘সভ্যতা’র মত শব্দগুলোকে এখন হয়তো নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার সময় হয়ে এসেছে। বিশেষ করে আজকে আমাদের পৃথিবী যুদ্ধ, জাতীয়তাবাদী এবং ধর্মীয় বিভেদ ও চরমপন্থা, চরম দারিদ্র এবং সম্পদের অসম বণ্টন, সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন, পণ্যায়ন এবং বৈশ্বিক উষ্ণতার হুমকির দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে অনেক কিছুই হয়তো আবার নতুন করে ভেবে দেখা প্রয়োজন।

সাধারণত যেকোন সময়ের লব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতেই সমাজ এবং সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটতে থাকে, সেই সাথে বদলায় তার নৈতিকতার সংজ্ঞা এবং সঠিক বেঠিকের মানদণ্ড। আজকে আমাদের সম্মিলিত জ্ঞান, সচেতনতা এবং উৎপাদন ব্যবস্থা এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা সম্ভবত প্রথমবারের মত আমাদের প্রজাতির ইতিহাসে ধর্ম, অধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী, জেন্ডার, লিঙ্গের সমানাধিকার দাবি করতে শুরু করেছি। দিল্লি এখনো বহুদূর হলেও সমানাধিকারের অভিমুখে মানবজাতির যাত্রা যখন একবার শুরু হয়েছে গন্তব্যে পৌঁছানোর সম্ভাবনাও হয়তো ততটা অসম্ভব নয়, সেটা অদূর ভবিষ্যৎ বা সুদূর ভবিষ্যৎ যখনি হোক না কেন।

একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, এরকম একটা সমন্বিত উপাখ্যানের মাধ্যমে একটি সংস্কৃতির গোটা অস্তিত্ব এবং মননের মানদণ্ড তৈরির কাজটা আমরা সব যুগেই করে এসেছি, মিথ বা পুরাণ, বিশেষ করে সৃষ্টিপুরাণের মাধ্যমে। আগেই বলেছি, মিথ আমার খুব প্রিয় বিষয়। ছোট্টবেলায় প্রাচীন গ্রিক, মিশরীয়, ভারতীয়, ইব্রাহিমীয় উপাখ্যানগুলো পড়তে পড়তে বিভোর হয়ে যেতাম। বড় হয়ে বুঝেছি বিজ্ঞান এবং দর্শন যেমন আমাদের গল্প বলে, শিল্প সাহিত্য গান যেমন গল্প শোনায়, ঠিক তেমনি মিথও আমাদের জীবনেরই গল্প শোনায়।

ইতিহাসবিদ সিনথিয়া স্টোকস ব্রাউন তাঁর ‘বিগ ব্যাং টু দ্য প্রেজেন্ট’ বইতে বলছেন, এটা এখন প্রমাণিত যে খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০০ শতাব্দী থেকে ভূমধ্যসাগরের পানি বেড়ে দীর্ঘকাল ধরে এত বন্যা হচ্ছিল যে শেষ পর্যন্ত ইউরোপ ও এশিয়ার মাঝখানের ভূমি-সেতুটি প্রবলভাবে ভেঙ্গে পড়ে। আর সেখান থেকেই সৃষ্টি হয় বসফরাস প্রণালীর এবং মিষ্টি পানির ছোট্ট ইউক্সিন হ্রদটি পরিণত হয় বিশাল লবনাক্ত কৃষ্ণসাগরে। ভাষাতত্ত্বের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় যে, সে সময়েই হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ইরাক, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরির মত দেশগুলোতে। আর এই ভয়ঙ্কর ধ্বংসযজ্ঞ থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির ধর্মীয় এবং পৌরাণিক কাহিনির ঝুলিতে জমেছে প্রায় ৫০০ মহাপ্লাবনের কাহিনি। জিনতত্ত্ব যেমনভাবে জীবাশ্মবিদ্যার পরিপূরক হয়ে আমাদের চোখের সামনে একের পর এক ইতিহাসের পাতা মেলে ধরছে, ঠিক একইভাবে আজকে ভাষাতত্ত্বও প্রত্নতত্ত্ব এবং ইতিহাসের সহায়ক হয়ে বহু ধাঁধার সমাধান করে চলেছে।

পৃথিবীর সব বড় বড় প্রাচীন উপাখ্যান এবং পুরাণগুলো আঁকা হয়েছিল সেই সময়ের মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি, সামষ্টিক সুখ দুঃখ, সীমাবদ্ধতার রঙ দিয়ে । এগুলো সেই সময়ের মানুষের জীবনের সত্যাসত্যের বিনিসুতোয় গাঁথা, এগুলোই গেঁথে ছিল তাদের চিন্তা, ভাবনা, মননে। পৃথিবীর সব গোষ্ঠীই যেমন জীবনের বিভিন্ন বিষয়ের উপর রং চড়িয়ে পুরাণ রচনা করেছে তেমনি তার সাথে মনের মাধুরী মিশিয়ে তৈরি করেছে মানুষের আদিসৃষ্টি নিয়ে বিভিন্ন পুরাণ। ধর্মগ্রন্থগুলোর একটা বিশেষ অংশ জুড়েই আছে এই কাহিনিগুলো। এখনকার মতই প্রাচীন সময়েও একেক গোষ্ঠীর চোখে বাস্তবতা, নৈতিকতা বা অস্তিত্বের অর্থ একেকভাবে প্রতীয়মান হয়েছে তাই তাদের আদি সৃষ্টি পুরাণগুলোর মধ্যেও বিচিত্রের শেষ নেই। এই পুরাণগুলো এক ধরনের রূপক গল্প যা দিয়ে আমরা আমাদের সৃষ্টি-রহস্যের ক্যানভাসে আঁকার চেষ্টা করেছি। পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী যে প্রকৃতির সাপেক্ষে নিজের তুলনামূলক অবস্থানকে বুঝতে চেয়েছে, নিজেকে তার চারপাশের সীমাহীন বিশালত্বের মাঝখানে সুনির্দিষ্টভাবে স্থাপিত করতে চেয়েছে। কেন? এর সঠিক উত্তরটা হয়তো আমাদের জানা নেই—হয়ত বিবর্তনের ধারায় তৈরি চেতনার মত একটা ‘ইমার্জেন্ট’ বৈশিষ্ট্যের চাহিদা মেটাতে? কে জানে? তবে এই বিশেষ চাহিদাটাই যে প্রজাতি হিসেবে আমাদের সফলতার একটি বিশেষ অংশ হিসেবে কাজ করেছে সেটা নিয়ে কিন্তু সন্দেহের কোন অবকাশই নেই।

ছবি ৭: সতেরশ’ শতাব্দীতে ব্রয়েগেল এবং রুবেনের আঁকাঃ স্বর্গ থেকে মানুষের পতন

মানুষ যদি কয়েক হাজার বছর আগে তাদের সেই সময়ের লব্ধ জ্ঞানের সমন্বয়ে প্রমিথিউসের মানুষকে আগুন এনে দেওয়ার মত অপূর্ব গল্প লিখতে পারে তাহলে আমরা কেন আমাদের এখনকার নতুন জ্ঞানের আলোকে শুধু বৈজ্ঞানিক জ্ঞানেরই নয় সেই সাথে আরও চমকপ্রদ শিল্প সাহিত্যের বিকাশ ঘটাব না? বলতে পারেন, আগুন আবিষ্কারের মত (আমাদের অনেক আগেই হোমো ইরেক্টাসরাই আগুন আবিষ্কার করেছিল বলে মনে করা হয়) এত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাহিনি কেন আমাদের ইতিহাসের অংশ হবে না? অন্যান্য প্রজাতির মানুষেরাও যখন এই পৃথিবীর বুকে হেঁটে বেড়াত সেটা নিয়েই বা কেন ইলিয়াড অডেসির মত গল্প লেখা হবে না? আমরা আজকে যখন মঙ্গল গ্রহে আবাস তৈরির কথা ভাবছি তখন কেন সৌরজগত এবং প্রাণের উৎপত্তির পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস পাঠ্যসূচির অংশ হবে না? মানুষের বিবর্তনের গল্প কেন আদম হাওয়ার সৃষ্টি পুরাণের মত আমাদের উদ্বেল করবেনা? আমরা যে বিশেষ ক্ষণে আফ্রিকা ছেড়ে পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়লাম বা আমাদের খালাতো ভাই নিয়ানডার্টালদের হাপিশ করে দিয়ে ইউরোপ দখন করে নিলাম সেই কাহিনিগুলো কেন মহাভারতের গল্পের মত করে আমাদের রোমাঞ্চিত করবে না?

আমাদের এই মহাইতিহাসের গল্পটি আমাদের অস্তিত্বেরই অংশ। শুধু আমাদের ইতিহাসটুকু জানার জন্যই নয় বরং পৃথিবীর ৮০০ কোটি মানুষের জাগতিক এবং মহাজাগতিক পথের সামনের চ্যালেঞ্জগুলো বোঝার জন্য যেমন আমাদের এটা জানা দরকার, তেমনিভাবে দরকার আমাদের জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, মননের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের জন্যও।