বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে ইরাকের মঞ্চে দায়েশ বা আইসিসের নাটকীয় উত্থানে পশ্চিমা বিশ্ব হতবাক হয়ে গিয়েছে। সুন্নি যুবকদের কাছে আইসিসের জনপ্রিয়তা, আইসিসের নৃশংসতা আর বর্বরতায় তারা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, পশ্চিমা বিশ্ব অবাক হয়ে দেখছে, আইসিস এবং বহির্বিশ্বের সাথে সৌদি আরবের দ্বৈতনীতি। এটা এমন একটা অবাক করা সমস্যা যে ব্যাখ্যা দ্বারা বুঝানো যাচ্ছে না। আইসিস সৌদি আরবের জন্যেও যে কতটা হুমকি সেটা বোধহয় সৌদি কর্তৃপক্ষ নিজেরাও বুঝতে পারছে না।

আইসিস প্রসঙ্গে সৌদি শাসকগোষ্ঠী নিজেদের মধ্যেই দ্বিধা বিভক্ত। কেউ কেউ তো কট্টরপন্থী সুন্নি আইসিসের হাতে ইরানপন্থী শিয়া নিকেশ হয়ে যাওয়াকে রীতিমত স্বাগত জানাচ্ছে। শিয়া নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে একটা নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হচ্ছে ভেবে তারা আনন্দিত। কারণ সালাফি মতবাদের দায়েশ গোষ্ঠী, শাসকদের একাংশকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে ঐতিহাসিকভাবে এই অঞ্চল সুন্নিদের পিতৃভূমি। শাসকদের অন্য অংশ বাদশাহ আবদুল আজিজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী ওয়াহাবি ইখওয়ান গোত্রের ইতিহাস মনে করে আতংকে আছে। কারণ এই ওয়াহাবি মুসলিম ব্রাদারহুডই পরবর্তীতে সালাফি মতাদর্শে পরিণত হয়েছে। ফলে তারা কট্টরপন্থী দায়েশের (আইসিস) উত্থানে সৌদি আরবের যোগসাজশের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠছে।

দুমুখো সৌদি:

সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের, রাজ পরিবারের ক্ষমতা দখল, উগ্র ধর্মীয় মতবাদের পৃষ্ঠপোষকতার ইতিহাস জানলেই সৌদি আরবের সাথে আইসিসের সম্পর্ক বুঝতে সহজ হবে। ইতিহাসের পিছনে আছে ওয়াহাবিজমের প্রতিষ্ঠাতা মুহম্মদ ইবনে আবদ-আল-ওয়াহাব নামের একজন উগ্রপন্থী ধর্মীয় নেতা। ক্ষমতা এবং স্বার্থের মারপ্যাঁচে ওয়াহাবকে সৌদি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ইবনে সউদ পেলে পুষে বিষবৃক্ষে পরিণত করেন। রাজছত্রছায়ায় এই ওয়াহাব প্রভাবশালী ব্যক্তিতে পরিণত হন এবং নাজদ মরুভূমিতে ক্রমাগত বেদুইন গোত্রের উপর ধর্মীয় আগ্রাসন চালাতে লাগলেন।

এই সময়ে বাদশাহ আবদুল আজিজ কিছু দ্বৈতনীতি গ্রহণ করলেন। প্রথমত, ১৯২০ সালে ব্রিটিশ আর আমেরিকার সাহায্যে ইখওয়ান গোত্রের বিদ্রোহ দমন করে জাতি রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে গেলেন একই সাথে ওয়াহাবের প্রচারিত উগ্র ধর্মীয় মতবাদকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিলেন। দ্বিতীয়ত, ৭০’র দশকে পেট্রো ডলারের ছিটিয়ে মুসলিম বিশ্বে ইসলামী সংস্কৃতি প্রচার প্রসারে মনোনিবেশ করলেন। এই সাংস্কৃতিক বিপ্লব আসলে কোন নীরব ধর্মীয় সংস্কার ছিল না। এটা ছিল বস্তুত, আবদুল ওয়াহাবের মতাদর্শানুসারে বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় উদারতা, সহিষ্ণুতা ও অন্যান্য ধর্মের অনুশাসনের বিরুদ্ধে ইসলামী জিহাদ।

কারা মুসলিম নয়:

আমেরিকান লেখক এবং সাংবাদিক স্টিভেন কোল লিখেছেন, “মক্কায় হজ্জে আগত মিশরীয় এবং অটোমান সাম্রাজ্য থেকে আগত মুসলিমদের সুসজ্জিত বহর, হাতের নিপুণ কারু শিল্প, ধূমপান, গাঁজা সেবন, মাদল বাজানোকে ১৪ শতকের নিবেদিত ইসলামী চিন্তাবিদ এবং শুদ্ধিবাদী ইবনে তাইমিয়া, আবদুল ওয়াহাব খুবই ঘৃণার চোখে দেখতেন।” ওয়াহাবের মতে এসব যারা চর্চা করে তারা মুসলিম নয়, তারা মুসলিম না ধারণ করে ইসলামের আড়ালে শিরক করছে। এদের থেকে বরং আরব বেদুইন গোত্র অনেক ভালো। তারা আবদুল ওয়াহাবকে কামেল মনে করে, তারা মসজিদের মিনার এবং গম্বুজ স্থাপন করছে। (যদিও তারা মাজারের মত অনৈসলামিক কুসংস্কার বিশ্বাস করে) এসমস্ত কাজকে আবদুল ওয়াহাব বিদ’আত ঘোষণা করলেন। বিদ’আত অর্থ আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ। তাইমিয়া এবং আবদুল ওয়াহাব মনে করতেন, হযরত মুহম্মদের মদিনায় বসবাসকালের সময়টা ছিল আদর্শ মুসলিম সমাজ এবং সেই সময়ের সামাজিক নিয়ম, রীতিনীতি, জীবনাচরণ মেনে চলাকেই বলে সালাফিজম।

তাইমিয়া শিয়া, সুফিজম এবং গ্রীক দর্শনের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তিনি উচ্চকণ্ঠে বলে দিলেন, নবী মুহম্মদের রওজা শরীফ জিয়ারত করা, মিলাদুন্নবী উদযাপন করা খ্রিস্টানদের সংস্কৃতি, যা যিশুকে গড হিসেবে উপাসনা করার মতই কুফরি এবং পৌত্তলিকতা। আবদুল ওয়াহাব পূর্বের ধর্মীয় সব শিক্ষা একত্রিত করে মুসলিমদের উদ্দেশ্যে বললেন, শিরক বিষয়ে যদি কোন মুসলিমের সন্দেহ থাকে তবে যথাযথ শিক্ষা নিতে হবে। আর ইসলামের এই ব্যাখ্যা যদি কেউ অস্বীকার করে সে দুনিয়াএবং পরকালের সুখ শান্তি, জীবন, জীবিকা থেকে বঞ্চিত হবে।

আবদুল ওয়াহাবের ধর্ম শিক্ষার অন্যতম প্রধান নীতি হলো ‘তাকফির’। তাকফিরি নিয়মে আবদুল ওয়াহাব এবং তার অনুসারীরা মনে করতেন, যদি কেউ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ করে তবে সে কাফের হয়ে যাবে। আবদুল ওয়াহাব মুসলিমদেরকে মৃত মানুষ, কামেল জ্বিনকে সম্মান করাকে কঠোরভাবে নিষেধ করে দিলেন। তিনি মনে করতেন, অন্যকিছুকে সম্মান করার মানসিকতা একমাত্র আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। ওয়াহাবি ইসলাম কামেলের কাছে প্রার্থনা, প্রিয় মৃত মানুষকে সম্মান প্রদর্শন, মাজারে বা কোন বিশেষ মসজিদে তীর্থ করতে যাওয়া, কোন ধর্মীয় বুজুর্গ ব্যক্তি স্মরণে উৎসব, নবী মুহম্মদ স্মরণে ঈদে মিলাদুন্নবী, এমনকি কবরে স্মৃতিচিহ্ন পর্যন্ত নিষিদ্ধ করে দিলেন। আবদুল ওয়াহাব লিখিত ঘোষণা দিলেন, যারা এসব মেনে চলবে না তাদের হত্যা করা জায়েজ, তাদের স্ত্রী-কন্যা ভোগ করা যাবে এবং তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। ঠিক এই সিদ্ধান্তের কারণে, শিয়া, সুফি এবং অন্যান্য মুসলিম মতাদর্শের এমনকি আবদুল ওয়াহাব যাকে মুসলিম বলে মনে করতেন তাদের লিস্ট করে সবাইকে হত্যা করেন।

.
আবদুল ওয়াহাব তার অনুসারীদের কাছ থেকে নিশ্চিত হতে চাইলেন, সবাই যেন দৃশ্যমানভাবে সবসময় এই নিয়মনীতি মেনে চলে। তিনি যুক্তি দেখালেন, সব মুসলিমদের নেতা হবেন একজন যিনি খলিফা। বর্তমানের আইসিসের সাথে ওয়াহাবিদের কোন পার্থক্য নেই। তারা আসলে একই আদর্শের পথিক। ওয়াহাবিজম থেকে উদ্ভূত আইসিস প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এক শাসক, এক কর্তৃপক্ষ, এক মসজিদ এই তিনটি লক্ষ্য সামনে রেখে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা যার অধীশ্বর হবেন সৌদি আরবের বাদশাহ এবং এভাবেই অফিশিয়াল ওয়াহবিজমের মাধ্যমে বিশ্ব নিয়ন্ত্রণের স্বপ্ন দেখছে।কিন্তু আইসিস সৌদি আরবের এমন সম্ভাবনাকে নাকচ করে দিয়েছে। যে ওয়াহাবিজম ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল সেই ওয়াহবিজমই সৌদি আরবের জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে।

১৭৪১ থেকে ১৮১৮ সালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:

আবদুল ওয়াহাবের অতি উগ্র ধর্মীয় মতবাদ প্রচারের কারণে ১৭৪১ সালে তার নিজ শহর নাজদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিছুদিন যত্রতত্র ঘোরাঘুরির পরে নিরাপদ আশ্রয় পেলেন সৌদি রাজ বংশের প্রতিষ্ঠাতা ইবনে সউদ গোত্রে। ইবনে সউদ বুঝতে পেরেছিলেন ওয়াহাবের মতাদর্শ দিয়েই আরবের সামাজিক রীতিনীতির খোল নলচে বদলে দেয়া সম্ভব। এটা আসলে ক্ষমতা দখলের দারুণ আইডিয়া। আজকের আইসিসের মত ওয়াহাবিরাও মানুষকে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণে বাধ্য করত। তাদের লক্ষ্য চিল মানুষের মনে চিরস্থায়ী ভয় ঢুকিয়ে দেয়া। ইবনে সউদ গোত্র ওয়াহাবি মতাদর্শে দীক্ষিত হয়ে প্রতিবেশী গ্রামগুলোতে অতর্কিত হামলা করে তাদের জানমাল লুণ্ঠন করে নিয়ে যেতে লাগল। মজার বিষয় হলো, বর্তমানের এই ডাকাতি লুণ্ঠন শুধু আরবের প্রচলিত ট্র্যাডিশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না, ডাকাতি হয়ে গেল ধর্মীয় জিহাদ। ইবনে সউদ এবং আবদুল ওয়াহাব মুহম্মদের প্রচারিত শহীদের ধারণা পুনরায় সবার সামনে নিয়ে এলেন এবং বললেন, যারা জিহাদে শহীদ হবে অচিরেই বেহেশতে প্রবেশ করবে।

শুরুতেই ওয়াহাবিরা কয়েকটি স্থানীয় জনপদ দখল করে নিলো এবং অধিবাসীদের উপর তাদের শাসন ব্যবস্থা চাপিয়ে দিলো। উল্লেখ্য স্থানীয় অধিবাসীদের সামনে দুইটা পথ খোলা, হয় ওয়াহাবি মতাদর্শে দীক্ষিত হও অথবা তরোয়ালের নিচে মাথা পেতে দাও। ১৭৯০ সালের মধ্যে ইবনে সউদ এবং আবদুল ওয়াহাব জোট আরবের অধিকাংশ ভূখণ্ড দখল করে নিলো এবং ক্যান্সারের মত হামলে পড়ল মদিনা, সিরিয়া এবং ইরাকের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। ১৮০১ এই জোট ইরাকের পবিত্র নগরী কারবালা আক্রমণ করে নির্বিচারে হাজার হাজার শিয়া পুরুষ, নারী ও শিশু হত্যা করে। ধ্বংস করে দেয়া হয় অসংখ্য শিয়া মসজিদ। এমনকি নবী মুহম্মদের প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসেনের মসজিদটিকেও ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া হয়।

ঐ সময়কার ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে একজন ব্রিটিশ সামরিক কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট ফ্রানসিস ওয়ার্ডেন লিখেছিলেন, ইবনে সউদ এবং আবদুল ওয়াহাবের বাহিনী পুরো কারবালা ধ্বংস করেই ক্ষান্ত হননি, ইমাম হোসেনের কবর পর্যন্ত মাটিতে মিশিয়ে দেয়। গা শিউরে ওঠা অদ্ভুত নৃশংসতায় খুন করা হয় পাঁচ হাজার মানুষ।

সৌদি আরবের প্রথম ইতিহাসবিদ ওসমান ইবনে বসির নাজদি লিখেছেন, ১৮০১ সালে ইবনে সউদ কারবালায় গণহত্যা করেছেন। ইতিহাসে লেখা আছে, ইবনে সউদ গর্বের সাথে বলছেন, আমরা কারবালার দখল নিলাম এবং এর অধিবাসীদের দাস করে নিলাম তারপর আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে নামাজ আদায় করলাম। ঐ দিনের জন্য আমরা দুঃখিত নই, কারণ বিধর্মীদের জন্য এটাই প্রাপ্য ছিল। ১৮০৩ সালে আবদুল আজিজ মক্কা নগরীতে প্রবেশ করেন, ভীষণ সন্ত্রাস ও উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল করেন ঠিক একইভাবে মদিনারও পতন ঘটে। বিজয়ের মুহূর্তে আবদুল ওয়াহাবের যোদ্ধাবাহিনী মক্কা মদিনার যাবতীয় ঐতিহাসিক নিদর্শন, স্থাপনা, মসজিদ সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। ধ্বংস করে দেয় কাবা শরিফের কাছেই কালের সাক্ষী শত বছরের পুরনো ইসলামিক স্থাপত্য শিল্পকলা। কিন্তু ১৮০৩ সালে হঠাৎ একদিন কারবালা হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধে একজন শিয়া আততায়ীর হাতে খুন হন বাদশাহ আবদুল আজিজ। তার ছেলে সউদ বিন আবদুল আজিজ ক্ষমতা গ্রহণ করে আরব দখল বজায় রাখেন। যাইহোক, অটোমান সম্রাট আর বসে থেকে তাদের রাজ্যের টুকরো টুকরো দখল মেনে নিতে পারেন নি, অটোমান সৈন্য ১৮১২ সালে মিশরের সহযোগিতায় এই খুনি জোটের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে দিলো। এর মাঝেই ১৮১৪ সালে সউদ বিন আবদুল আজিজ জ্বরাক্রান্ত হয়ে মারা যান। বাদশাহর হতভাগ্য ছেলে আবদুল্লাহ বিন সউদকে ওটোমানবাহিনী আটক করে ইস্তাম্বুলে নিয়ে যায় সেখানে তাকে অমানুষিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, আবদুল্লাহকে ইস্তাম্বুলের রাস্তায় তিন্দিন দরে টেনে হেঁচড়ে বেড়ানো হয়, তার তাকে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। মৃতের শরীর থেকে মাথা আলাদা করে, মাথাটাকে কামানের উপর রেখে পোড়ানো হয় এবং তার হৃদপিণ্ড বের করে শরীরের সাথে বড়শি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়।

১৮১৫ সালে মিশরীয় বাহিনীর হাতে ওয়াহাবি খুনির দল ভয়ানকভাবে পরাজিত হয়, ১৮১৮ সালে অটোমান বাহিনী ওয়াহাবি রাজধানী দারিয়া দখল নিয়ে ধ্বংস করে দেয়। প্রথম সৌদি রাষ্ট্রের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেল। বেঁচে যাওয়া ওয়াহাবির দল মরুভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এবং উনিশ শতক পর্যন্ত তাদের কোন খোঁজ খবর পাওয়া যায় না।

আইসিসের হাত ধরে ফিরে এসেছে ইতিহাস:

এটা বুঝতে কষ্ট হয় না যে সমসাময়িক ইরাকে আইসিসের উত্থান ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। প্রকৃতপক্ষে ওয়াহাবি মতাদর্শ নাজদ থেকে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়নি বরং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর রণহুংকারে নতুন-রূপে প্রাণ ফিরে পায়।

বিংশ শতকে ধূর্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব আবদুল আজিজ বহু বিভক্ত আরব বেদুইন এবং ইখওয়ান জাতিকে একত্রিত করে আবদুল ওয়াহাব এবং ইবনে সউদের সঙ্গীদের মতাদর্শে উজ্জীবিত করে এক নবজাগরণ সৃষ্টি করেন। প্রায় স্বাধীন দুর্ধর্ষ ইখওয়ান গোত্র পুনরায় প্রাণ ফিরে পেল, যারা ওয়াহাবি মতাদর্শে প্রায় গোটা আরবে ক্ষমতা দখল করে ফেলেছিল। ইতিহাসের কি পুনঃ-মঞ্চায়ন! আবদুল আজিজ ইখওয়ানদের সাহায্যে ১৯১৪ থেকে ১৯২৬ সালের মধ্যে আবার মক্কা, মদিনা, জেদ্দা দখল করে নিলো। কিছুদিন পরেই তিনি বুঝতে পারলেন, এই ইখওয়ান গোত্র তার জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখা দিতে পারে। সত্যিই বাদশাহ আবদুল আজিজের আশংকা সত্যি হলো। ইখওয়ান গোত্র আবদুল আজিজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করল এবং ১৯৩০ পর্যন্ত সর্বাত্মক জনযুদ্ধে রূপ নিলো। যাইহোক, বাদশাহ আবদুল আজিজ ইউরোপ আমেরিকার অস্ত্রের বলে বলিয়ান হয়ে এই ইখওয়ান গোত্রকে নির্মূল করে দিলেন।

এতকালের এত বাদশাহ’র থেকে আবদুল আজিজের বোধহয় ভাগ্য সুপ্রসন্ন। এই সময়ে আরব ভূখণ্ডে তেল আবিষ্কৃত হয়ে গেছে। ব্রিটেন এবং আমেরিকা আবদুল আজিজের সাথে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়ে দিলেও তারা মূলত তখনো সৌদি আরবের আইনত বৈধ শাসক শরীফ হোসেনের সাথে কথা বলতে আগ্রহী। সুতরাং আবদুল আজিজের দরকার আরও আধুনিক কূটনৈতিক কৌশল। এইসব বৈরি পরিস্থিতিতে ওয়াহাবিজম জোর করেই ধর্মীয় শুদ্ধিবাদ তাকফিরি জিহাদকে পাশ কাটিয়ে কিছুটা উদার কিছুটা রক্ষণশীল একটা আধা-খ্যাচড়া সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় তোকমা লাগিয়ে ইসলামী দাওয়া নামে প্রচার শুরু হলো। কিন্তু সব ক্ষমতা থেকে গেল সৌদি রাজ পরিবারের হাতে।

ওয়াহাবিজম প্রচারে তেল সম্পদের ব্যবহার:

ফ্রেঞ্চ বুদ্ধিজীবী গিলস কেপেল লিখেছেন, তেল আবিষ্কারের সাথে সাথেই সৌদি আরবের লক্ষ্য নির্ধারিত হয়ে গেল কিভাবে মুসলিম-বিশ্বে ওয়াহাবিজম প্রচার করা যায়। ইসলামের মধ্যে বিভিন্ন মতাদর্শের বদলে একটা কণ্ঠস্বর থাকবে যা দূর করবে জাতীয়তাবাদের বিভাজন। এতে ধর্মের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাপী ক্ষমতার চর্চা অনেক সহজ হয়ে যায়। সুতরাং প্রবাহিত হতে লাগল বিলিয়ন বিলিয়ন তেল বেচা টাকা।

ধর্মের মাধ্যমে ক্ষমতার চর্চা প্রকল্পে সৌদি আরব বিশ্বব্যাপী সুন্নি অধ্যুষিত অঞ্চলে এমনকি যেখানে আমেরিকার স্বার্থ আছে সেখানেও সুকৌশলে শিক্ষাক্ষেত্রে, সামাজিক জীবনাচরণে, সংস্কৃতি চর্চায় শুরু হয়ে গেল ওয়াহাবিজম প্রচার। ফলাফল বিভিন্ন দেশে ভরে গেল সৌদি টাকায় পাড়ায় পাড়ায় এসি মসজিদ, মাদ্রাসা। শীতকালে গরু জবাই করে ওয়াজ মাহফিল যেখানে মাইকে উচ্চরবে প্রচারিত হয় বিধর্মীদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় বিষোদগার, কুৎসা।

আইসিস গভীরভাবে ওয়াহাবি মতাদর্শ প্রভাবিত এবং একই সাথে অতি উগ্রবাদী। তারা ওয়াহাবিদের নতুন সংস্করণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সৌদি ইখওয়ান যে ইসলাম প্রচার করেছিল সেটা ১৯৩০ সালের জনযুদ্ধে শেষ হয়ে যায়নি। হয়ত সময়ের প্রয়োজনে কিছুটা পিছু হটে গিয়েছিল, কিন্তু বিস্তৃত হয়েছে অন্তঃসলিলে সুদূরপ্রসারী, লোক চক্ষুর আড়ালে। তাই আমরা এখনকার আইসিস প্রশ্নে সৌদি আরবের দুইটা চেহারা দেখতে পাই। প্রকৃতপক্ষে, আইসিস হলো মদিনায় সৌদি রাজবংশের ক্ষমতায় আরোহণের পরবর্তী আন্দোলন। এই আন্দোলন স্বয়ং মুহম্মদকে নয় বরং প্রথম দুই খলিফার প্রচারিত ইসলামে বেশি আকৃষ্ট। সৌদি রাজত্ব তেল সম্পদে আশীর্বাদ প্রাপ্ত হয়ে ইখওয়ান গোত্রের শেখানো বিশ্বব্যাপী ক্ষমতা দখলের খায়েশ আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। তাদের অতীত ভূমিকার জন্যে ইখওয়ান গোত্র এখনো কোন না কোনভাবে সৌদি রাজত্বের সুবিধা ভোগ করে। ওসামা বিন লাদেন এরকমই একজন সৌদি রাজের বাগান বাড়িতে বেড়ে ওঠা একটা বিষাক্ত ফুল। আইসিস চাইছে সৌদি আরবের রাজবংশের আইনগত বৈধতা ব্যবহার করেই পূর্বেকার ইবনে সউদ এবং ওয়াহাব প্রচারিত ওয়াহাবিজমে ফিরে যেতে।

ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে পশ্চিমা বিশ্ব (সমাজতন্ত্র, বাহাইজম, নাসেরিজম, সোভিয়েত এবং ইরানের প্রভাব) খর্ব করতে সৌদি আরবের তেল সম্পদ, আধুনিক উন্নয়ন, এবং ধর্মীয় প্রভাব কাজে লাগাতে চায়। একই সাথে তারা সৌদি আরবের সাথে ওয়াহাবিজম বাদ দেয়ার জন্য দেন দরবার করছে। যদিও প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন যুগে আফগানিস্তানে রাশিয়ার পতনে ইসলামী উগ্রপন্থা যে কতটা কার্যকর সেটা পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ভালো করেই জানে। তাই এখন সময় সিদ্ধান্ত নেয়ার।

আমাদের আসলে অবাক হওয়ার কিছু নেই যখন দেখি সৌদি-পশ্চিমা বাহিনী সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা পরিচালনা করছে। এটা কি সেই ইখওয়ান গোত্রের নতুন-রূপ যারা আইসিসের সাথে মিলে মিশে কাজ করছে? এবং কেন আমরা অবাক হচ্ছি যখন কমবেশি জানি ওয়াহিবিজম সম্পর্কে। কেন মনে হচ্ছে ওয়াহিবিজম উদার নৈতিক ধর্মের জন্ম দেবে? আর কেমন করেই বা আমরা চিন্তা করি এক নেতা, এক শাসন, এক মসজিদ? আত্মসমর্পণ অথবা হত্যা এই মতাদর্শ কি কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে? এমনও হতে পারে আমরা এসব বিষয় নিয়ে কখনও চিন্তাই করি নি।

(আর্টিকেলটি ‘হাফিংটন পোস্ট’ প্রকাশিত You Can’t Understand ISIS If You Don’t Know the History of Wahhabism in Saudi Arabia আর্টিকেলের বাংলা ভাষান্তর)