ডিসেম্বর বিয়ের মাস-ফেসবুক ফিড খুলতেই বিয়েবাড়ির ফ্যাশনে হাসিখুসি মুখের রোশনাই। এর মধ্যে কটা বিয়ে পাঁচ বছর অব্দি টিকবে জানি না-তবে ডিভোর্স রেট সর্বত্রই এত বেশী, এই প্রশ্নটা সামাজিক এবং রাজনৈতিক ভাবে তোলাই উচিত- একবিংশ শতাব্দিতে “বিয়ে” নামক ইন্সটিটুশনটা আর কদ্দিন ?

যেহেতু কৃত্রিম গর্ভে সন্তানের জন্ম হতে এখনো ত্রিশ চল্লিশ বছর বাকী- সেহেতু প্রশ্ন উঠতেই পারে, সন্তান মানুষ করতে বিবাহ নামক সেই বাতিল প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া উপায় কি? ফ্রান্স সহ ইউরোপে পোষাকি বিয়ে প্রায় উঠে গেলেও -সেখানে লিভ টুগেদার করাকে বিয়ের লিগ্যাল স্টাটাস দেয় রাষ্ট্র। নাগরিকের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে রাষ্ট্রই কোলাপ্স করবে- বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের চিকিৎসার খরচ চালাতে তরুন সমাজকেই ট্যাক্স দিতে হয়। সুতরাং ভারত চীনের মতন জন সংখ্যায় জর্জরিত হাতে গোনা কিছু দেশ বাদ দিলে, উন্নত বিশ্বে যেখানে ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রসারের সাথে সাথে “মা” হওয়ার প্রবণতা কমে এসেছে- সেখানে রাষ্ট্রকে প্রচুর খরচ করতে হয় মা হওয়ার জন্য ঘুঁশ দিতে। ইউরোপের কমবেশী সবদেশেই এটা সমস্যা -এর মধ্যে রাশিয়ার জন সংখ্যা কমছে এত দ্রুত হারে ২০০৬ সালে পুতিন পার্লামেন্টে ঘোষণা করেন, জনসংখ্যা বাড়ানোর জন্য তারা “মায়েদের” প্রচুর ইন্টেন্সিভ দেবেন। রাশিয়াতে যেসব মেয়েরা তিনটি সন্তান নেয়, রাষ্ট্র তাদের বিনা পয়সায় ফ্ল্যাট এবং গাড়ি দেয়। এতে অবশ্য লাভ হয়েছে সামান্যই। রাশিয়ার ফার্টালিটি রেট 1.34 থেকে বেড়ে এখন 1.46. অর্থাৎ অধিকাংশ মেয়েরাই ফ্ল্যাট গাড়ির লোভের থেকে চাইল্ডলেস থাকাই পছন্দ করছেন বেশী।

অধিকাংশ ডিভোর্সের ক্ষেত্রে, মেয়েদের নিজস্ব কেরিয়ার সংক্রান্ত চাহিদাটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যেহেতু শিল্প বিপ্লবের চাহিদা অনুযায়ী আমরা সংসার কেন্দ্রিক থেকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক কেরিয়ার কেন্দ্রিক অবজেক্টিভ গুলিকেই রাজনৈতিক এবং সামাজিক ভাবে মেনে নিচ্ছি- সেহেতু অধিকাংশ চাকুরীজীবি বিবাহিত মহিলারাই প্রশ্ন তুলছেন একটা হ্যাজবান্ড রেখে হ্যাজ ছাড়া জীবনে পাচ্ছি টা কি? সন্তান নেওয়া এর অনেক পরের ব্যপার। আসলে ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তা, তার সাথে বলিউডের আফিঙে বড় হওয়া এই নতুন প্রজন্মের মেয়েরা প্রায় সবাই বিবাহিত জীবনে অখুশী। যেহেতু স্বামীর রোজগারের দরকার এদের নেই, অধিকাংশই একটা “কারন” থেকেই ডিভোর্স করছে। একটা অচেনা ছেলে, যার ওপর ডিপেনডেন্ট ও নই, তার জন্য আমরা কেরিয়ার বিসর্জন দেব কেন?

মুশকিল হচ্ছে বিবাহিত জীবনে রোম্যান্স কোন কালেই ছিল না-সাধে কি বৈষ্ণব সাহিত্যে প্রেম মানেই পরস্ত্রীর সাথে পরকিয়া! কিন্ত এই শারুখ খান, আমির খান, ঋত্বিক রোশনের মতন রোম্যান্টিক নায়কদের যুগে কোন মেয়ে বিশ্বাস করতে রাজী না- বিয়ে সংসারের অধিকাংশটাই কর্তব্য-বাকীটা মায়াময়।

এই বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটির সংজ্ঞা নিয়েও নৃতাত্ত্বিকদের মধ্যে একাধিক মতানৈতক্য। বিবাহে স্বামী এবং স্ত্রীর অধিকার ঠিক কি কি হবে, কি কি হওয়া উচিত-সেই নিয়ে কোন কোনসেন্সাস নেই কোন দেশে, কোন সংস্কৃতিতে। শুধু ডিভোর্স আইনের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও অধিকাংশ রাষ্ট্রের ঐক্যমত -ইহা মৌলিক অধিকার হতে পারে না। পৃথিবীর সব থেকে লিব্যারাল কোর্ট ইউরোপিয়ান ইউনিয়ানের সুপ্রীম কোর্ট ও মেনে নিয়েছে, ডিভোর্স মৌলিক অধিকার হতে পারে না।

তবে আসল সমস্যার দিকে ফিরি। মূল সমস্যা এটাই আজকে মেয়েরা যেখানে কেরিয়ারে এগোতে চাইছে-খুব স্বাভাবিক ভাবেই মা হতে গেলে তাদের কেরিয়ারে স্যাক্রিফাইস করতে হচ্ছে। খাস ভারতেই ২৭% মহিলা আই টি ইঞ্জিনিয়ার শুধু মা হওয়ার জন্য কেরিয়ার বিসর্জন দেন। যারা টিকে যান, তারাও কেরিয়ার কম্প্রোমাইজ করেই টেকেন। যারা কম্প্রোমাইজ করতে চান না-তারা ডিভোর্স করে বেড়িয়ে আসেন। কিন্ত এর কোনটাই কি সমাধান?

খুব অদ্ভুত হলেও সত্যি- মেয়েদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, রাষ্ট্রকে যে সন্তান পালনের দ্বায়িত্ব নিতে হবে, এটা প্রথম কার্যকর করেন লেনিন- অক্টবর বিপ্লবের সাথে সাথেই। রাশিয়াতে বিয়ে প্রায় তুলে দেওয়া হয়, আবর্শণ আইন শিথিল হয়-এবং সাথে সাথে সরকারি ক্রেশ বা সন্তানালয় গড়া হয়। কিন্ত কমিনিউস্ট রাষ্ট্র ত- এরা যত পরিকল্পনা করে-বাস্তবে হয় তার উলটো। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয় নি। সরকারি কেয়ারটেকার সংস্থা গুলোতে দেখভালের অভাবে শুধু ১৯১৯-২৩ সালের মধ্যেই ৫ লাখ শিশুর মৃত্যু হয়। ফলে স্টালিন ক্ষমতা হাতে পেয়েই দেখলেন, লেনিনের আদর্শবাদি কার্যকলাপে রাশিয়ার জনসংখ্যা কমছে। মিলিটারিতে লোক পাওয়া সমস্যা হতে পারে। ১৯২৫-২৯ একাধিক ডিক্রি জারী করে স্টালিন আবার লোকজনকে বিয়ে করতে বাধ্য করলেন। আবর্শন প্রায় বন্ধ হল। রাষ্ট্রীয় শিশুপালন সংস্থা বন্ধ করে, মেয়েদের মায়ের দ্বায়িত্ব পালন করতে বাধ্য করলেন স্টালিন। ইনফ্যাক্ট ১৯৩৪ সালের মধ্যেই রাশিয়াতে বিভিন্ন উচ্চ পজিশনে মেয়েদের সংখ্যা কমে আসে-সেন্ট্রাল কমিটিতে বোধ হয় মোটে দুজন ভদ্রমহিলা ছিলেন-কারন তখন লেনিনের “নারীবাদ” বাতিল করে সর্বত্র স্টালিনের “মাতৃবাদের” ভজনা চলছে। সোভিয়েত ইউনিয়ানের ইতিহাসের এই দিকটা অনেকেই জানে না– যে নারীর সমানিধিকার সংক্রান্ত সব থেকে বড় পরীক্ষাটি এক শতাব্দি আগেই ব্যর্থ হয়েছে।

অর্থাৎ এই মৌলিক সমস্যা-যে ছেলে মেয়ে মানুষ করার ক্ষেত্রে মেয়েদের অনেক বেশি দ্বায়িত্ব নিতে হয়-এটার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত- ডিভোর্স কিন্ত বাড়তেই থাকবে।

তবে সবটাই দিশাহীন না। আমেরিকাতে ১৯৮০ সালে ডিভোর্স রেট ছিল হায়েস্ট। আস্তে আস্তে সেটা কমেছে। এখন প্রায় ৭০% সম্ভাবনা যে একটা বিয়ে ১০ বছর টিকবে। যেটা ১৯৮০ সালে ছিল ৪৮%। এটা কি করে হল?

আসলে ভুল থেকেই সবাই শিক্ষা নেয়। এখন আমেরিকাতে বিয়ের আগে ছেলে মেয়েরা “আবেগ” এবং “প্রেম” বাদ দিয়ে, প্রাক্টিক্যাল কন্সিডারেশন গুলোকে সামনে রেখেই বিয়ে করে। ইহার্মোনির মতন ডেটিং সাইট, এখন ডেটাসায়েন্স ম্যাচিং করাচ্ছে-অর্থাৎ একজনের কাছ থেকে প্রায় সাতশো আটশো রকমের প্রেফারেন্স জেনে, জানিয়ে দিচ্ছে কোন পার্টনার তার জন্য স্টেবল। প্রেমের থেকে প্যার্টান ভিত্তিক বিয়ের দিকেই এগোচ্ছে আমেরিকান সমাজ, যার সুফলও মিলছে কম ডিভোর্স রেটে। ভারতে এখনো এটা আসে নি। হয় এরেঞ্জড মেরেজ না হলে লাভ মেরেজ। দুটোই আসলে ডিজাস্টার। হওয়া উচিত ডেটা সায়েন্স ভিত্তিক মেরেজ-যেখানে আগে থেকেই বলে দেওয়া সম্ভব-এই পার্টনারশিপ চলবে কি না।

অর্থাৎ সমাধান সেই বিজ্ঞানের পথেই। আবেগ, আইন, প্রেম -কোন কিছুই বিবাহ নামক এই অচলায়তনকে বাঁচাতে পারবে না।