এই প্রবন্ধে আমরা দেখতে পাবো আইসিস কিভাবে সারা বিশ্বের অর্থ ব্যবস্থায় প্রবেশাধিকার পায়। আইসিসকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী সন্ত্রাসী সংগঠন। ইসলামিক স্টেট অভ ইরাক এবং আল শাম সংক্ষেপে আইসিস বা আইসিল নামে পরিচিত। আইসিস তেল পাচার, বহুমুখী অপরাধী কর্মকাণ্ড পরিচালনা, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় আরো বিবিধ মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হয়ে গেছে।

এই বিপুল পরিমাণ অর্থকে লক্ষ্য করেই আইসিস বিরোধী দেশের সমন্বয়ে গঠিত জোট পাঁচটি কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়েছে। চলতি বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, ইটালি আইসিসের অর্থায়ন প্রতিহত করতে প্রথমবারের মত রোমে সাধারণ সভার আয়োজন করে। আইসিস বিরোধী জোটের প্রধান লক্ষ্য স্বঘোষিত ইসলামিক রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক অর্থ প্রবাহ বন্ধ করা যাতে কেউ অন্য দেশ থেকে টাকা পাঠাতে না পারে। আইসিসের অর্থের বিভিন্ন উৎস বন্ধ করতে এই সিদ্ধান্ত সঠিক পদক্ষেপ এবং সময়োপযোগী। যদিও আইসিসের সাথে আর্থিক লেনদেন ইতিমধ্যেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

আইসিস নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে ব্যবসায়িক লেনদেনে বিশাল অংকের অর্থ পুরোপুরি নগদে লেনদেন করা ঝুঁকিপূর্ণ, আবার সেটা চুরি ডাকাতির সম্ভাবনাও আছে। তাই ঝুঁকি এড়াতে আইসিসকে ব্যাংকের দ্বারস্থ হতে হয়। বিদেশি যোদ্ধাদের খরচ যোগাতে, পরিচালনার জন্য সম্ভাব্য খরচ মেটাতে আইসিসকে ব্যাংকের সহায়তা নিয়ে থাকে। সম্প্রতি ট্রেজারি সেক্রেটারি ডেভিড কোহেন ব্যাখ্যা করে আইসিসের সংগ্রহীত অর্থের যথাযথ ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিকভাবে বিস্তৃত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও যোগাযোগ নিশ্চিত করতে এই জঙ্গি সংগঠনটি সিরিয়া এবং ইরাকের ব্যাংকিং ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট আইসিসের অর্থ প্রবাহ বন্ধ করতে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আইসিস যেসব ব্যাংকে লেনদেন করে তাদের অবস্থান আইসিস নিয়ন্ত্রিত সিরিয়া কিংবা ইরাকে। এমনকি এই অঞ্চলের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্যাংকের শাখার মাধ্যমেও আইসিস আর্থিক লেনদেন করে। শুধু ইরাকের নিনাবা, সালাহ আল-দিন, আনবার এবং কিরকুক প্রদেশে প্রায় ৯০ টি শাখা দিয়ে আইসিস ব্যাংকিং করে।

ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট ইরাকি প্রশাসন, ব্যাংকের প্রধান অফিস এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান একত্রিত হয়ে কাজ করছে যাতে আইসিস তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে আর্থিক লেনদেন করতে না পারে। ব্যাংকের শাখাগুলো মাঠ-পর্যায়ে আইসিসের সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেন নিয়ে খুব কড়া নজরদারি করছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টে মূল্যবান গোপন তথ্য দিয়ে সাহায্য করছে কোন অঞ্চলে আইসিস তাদের আর্থিক কার্যক্রম চালাচ্ছে।

একই সাথে ইরাকের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইসিস নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে ইলেকট্রনিক উপায়ে টাকা পাঠানো এবং গ্রহণ প্রতিরোধ করছে। আর আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো তাদের আঞ্চলিক শাখা এই এলাকা থেকে তাদের কর্মী বদলী করেছে। যেমন সম্পূর্ণ ইরাকি মালিকানাধীন মসুল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক আইসিস দখলকৃত ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলের মসুল শহর থেকে তাদের সদর দপ্তরের কার্যক্রম বাগদাদে সরিয়ে নিয়ে গেছে।

এত নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও আইসিস ঠিকই ব্যাংকিং সেবা ব্যবহার করে আসছে। আসাদ সরকার ব্যাংকগুলোকে শুধু আইসিসের সাথে লেনদেন করতে অনুমতিই দেয় নি বরং প্রেসিডেন্ট আসাদ নিজের স্বার্থে এই ব্যাংকের শাখাগুলোর মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন আইসিসের সাথে সরকারের তেল কেনার মধ্যস্থতাকারী হিসেবে একজন ব্যবসায়ীর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। গতমাসে ফিনান্সিয়াল একশন টাস্ক ফোর্স আইসিসকে নিয়ে একটা আর্থিক প্রতিবেদনে প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানি অবৈধ আর্থিক কর্মকাণ্ড রুখতে নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রচারে ব্যস্ত। কিন্তু প্রতিবেদনে প্রকাশ, সিরিয়ার ২০ এর অধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইসিসের সাথে ব্যবসায়ে জড়িত।

এছাড়াও ব্যাংকের শাখাগুলোর দামেস্কে অবস্থিত তাদের সদর দপ্তরের সাথে অবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ আছে এবং এদের মধ্যে অনেক ব্যাংক আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থায় সরাসরি সংযুক্ত। ভাগ্য-ভালো, বেশিরভাগ বৈদেশিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন সিরিয়ার কেন্দ্রীয় এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের উপর অবরোধ করার পরে ছিন্ন করেছে সব সম্পর্ক। তারপরেও দেখা যাচ্ছে আইসিস কিছু আইনসিদ্ধ তালিকাভুক্ত কিংবা তালিকার বাইরের প্রতিষ্ঠানের সাথে অবৈধ বাণিজ্যিক লেনদেন পরিচালনা করে থাকে। এমনকি যখন স্থানীয়ভাবে ব্যাংকিং সেবা নিষিদ্ধ, দেশে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে তখন সিরিয়ার অনুন্নত অঞ্চলের ব্যাংকগুলোকে আইসিস তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে ব্যাংকিং সেবা দিতে বাধ্য করে।

সিরিয়ার মত ইরাকের অবস্থাও একই রকম। আইসিস ইরাকে তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের বাইরেও আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে আর্থিক লেনদেন করতে পারে। ফিনান্সিয়াল একশন টাস্ক ফোর্স এক রিপোর্টে প্রকাশ করেছে আইসিস এখনো রীতিমতো বহির্বিশ্বের বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ইলেকট্রনিক অথবা অন্যান্য বিকল্প মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন চালিয়ে যেতে সক্ষম। আমেরিকা প্রশাসনের মতে, আইসিস সন্ত্রাস, যোদ্ধাদের লজিস্টিকাল সুবিধা বৃদ্ধি, চোরাচালানি কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য এবং বিদেশি যোদ্ধা এবং সন্ত্রাসী সংগঠনে অর্থায়নের জন্য অর্থ পেয়েছে।

অতিরিক্ত নগদ অর্থ আইসিস আমেরিকার কোন ব্যাংক একাউন্টে জমা করে সেই অর্থ আবার নিকটস্থ কোন আইসিস নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে পাঠানো হয়। এইসব অঞ্চলে এটিএম বুথ ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ বিদেশি অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে। আর ব্যাংকের কাছে তথ্য যায় আমেরিকান ব্যাংকের কোন একাউন্টের মাধ্যমে অর্থ লেনদেন হচ্ছে।

অনেক সময় আইসিস নিয়ন্ত্রিত এলাকার এটিএম বুথের লেনদেন সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করা দেখা গেছে বিশাল অংকের অর্থ তুলে কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ব্যাংকে জমা করা হয়েছে। নেদারল্যান্ডস সেদেশের ন্যাশনাল ব্যাংকের সাথে একই ধরণের নিয়মিত লেনদেনের খোঁজ পেয়েছে যে বিদেশি যোদ্ধারা আইসিস নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করে থাকে। আইসিস ব্যাংকের শাখার মাধ্যমে শুধু বিদেশি তহবিলই সংগ্রহ করে না বরং তারা এই অঞ্চলে ইরাক সরকারের কর্মীদের জন্য যত বেতন আসে সব জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয়। যেমন শুধু মসুলে কর্মরত ইরাক সরকারের কর্মকর্তাদের জন্য পাঠানো প্রতি মাসের ১৩০ মিলিয়ন ডলার আইসিস পুরোপুরি দখল করে।

আইসিস মসুল দখলের সাথে সাথে শহরের ব্যাংকিং ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়া হয়। তাই সরকারের প্রতিনিধিকে ইরাকি বা কুর্দিশ অঞ্চলে বেতন উত্তোলনের জন্য পাঠানো হতো। যখন টাকা নিয়ে সেই কর্মকর্তারা কর্মীদের মাঝে বিতরণের জন্য ফেরত আসত তখন আইসিস অতর্কিত হামলা চালিয়ে ছিনিয়ে নিতো সব টাকা। ফিনান্সিয়াল একশন টাস্ক ফোর্সের রিপোর্টে প্রকাশ সরকারী কর্মীদের বেতনের টাকা লুণ্ঠন করেই আইসিস কয়েক বছরে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের মালিক হয়ে গেছে। নিয়মিত ব্যাংকিং’এর বাইরেও আইসিস অবৈধ উপায়ে বিদেশ থেকে অর্থ গ্রহণ এবং প্রেরণ করতে পারে। ফিনিশ প্রশাসন জানিয়েছে আইসিস নিজেদের অধিকৃত অঞ্চলের বাইরে এজেন্টের মাধ্যমে বৈধভাবেও বিদেশের সাথে অর্থ লেনদেন করতে পারে। এভাবেই সিরিয়া ইরাকের আইসিস যোদ্ধাদের অর্থের যোগান হয়। ডাচ প্রশাসন দেখতে পেয়েছেন তৃতীয় কোন মাধ্যমে আইসিস নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে অর্থের লেনদেন হয়। আইসিস অন্যান্য মাধ্যমেও অর্থ সংগ্রহ করে। সৌদি কর্তৃপক্ষ দাবী করেছে এই সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্যদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের অন্যতম মাধ্যম টুইটার এবং স্কাইপ যোগাযোগ ব্যবস্থা।

গ্রুপটি স্কাইপে আইসিস সমর্থক দাতাদেরকে আন্তর্জাতিক পারচেজ প্রি-পেইড কার্ড, ফোন ক্রেডিট কার্ড, স্টোর ক্রেডিট কার্ড কিনে কার্ড নাম্বার তাদের একাউন্টে পাঠিয়ে দিতে বলে। এই নাম্বারগুলো আইসিস সদস্যরা অধিকৃত সিরিয়া অঞ্চলে বিক্রি করে নগদ অর্থে পরিণত করে এবং সে অর্থ আইসিসের কাছে চলে যায়।

ইরাকি সরকার এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যাতে আইসিস তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে ব্যাংকের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন করতে না পারে। এজন্য সরকার নিজেদের সম্পদ সরিয়ে নেয়া, ব্যাংকের শাখা বন্ধ করে দেয়া, ব্যাংকের সদর দপ্তর পরিবর্তন করা, কর্মীদের বদলী করে দেয়া ইত্যাদি নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় নি। আইসিস এখনো সিরিয়ার ব্যাংক সেবা সুবিধা পাচ্ছে, বিদেশ থেকে ঠিকই বিকল্প পথে নিজেদের সীমান্তে অর্থের যোগান নিশ্চিত করতে পেরেছে।

আইসিসের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে গঠিত হয়েছে কাউন্টার আইসিস ফিনান্স গ্রুপ। জিহাদি গ্রুপের তহবিল সংগ্রহ এবং অর্থ প্রবাহ বন্ধ করতেই এই গ্রুপের জন্ম। বিকল্প পথে ব্যাংকিং প্রতিরোধ করা এই গ্রুপের প্রধান লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট আইসিসের সাথে আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার লক্ষ্যে এই অঞ্চলের সরকারের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। গত সপ্তাহে ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের এক প্রতিনিধিদল উপদ্রুত এলাকা পরিদর্শন করে ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করে দিয়েছে তারা যেন পারস্য উপসাগরীয় দেশসমূহ বিশেষ করে তুরস্ক এবং লেবানন থেকে আইসিসের কাছে অর্থ প্রবাহ বন্ধ করে দেয়। এটা খুবই পরিষ্কার আইসিস নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বিপদ সংকুল পরিবেশে একসাথে এতগুলো প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম পরিচালনা মোটেও সহজ কাজ নয়। লক্ষ্য হচ্ছে অর্থ সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করে নয় বরং কঠোর নীতিমালা এবং স্বচ্ছতার মাধ্যমে সীমান্ত এলাকায় অর্থ প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। অর্থ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া বাস্তবসম্মত নয় কিংবা এমন পরামর্শ দেয়াও উপযুক্ত নয়। ভেঙে পড়া অর্থনীতি এই অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ বাড়াবে শুধু, মানবিক সংকট সৃষ্টি করবে। আইসিসের জিম্মায় যারা বন্দী আছে তারা অনন্ত একদিন বেশি বাঁচতে চায়, অর্থের অভাবে তাদের অবস্থা হয়ে পড়বে আরো শোচনীয়।

কিন্তু দূরদৃষ্টিসম্পন্ন না হলে এবং আইসিস নিয়ন্ত্রিত এলাকায় অর্থ প্রবাহ বন্ধ করতে না পারলে আইসিস বিকল্প পথে অর্থ জোগাড় করে সিরিয়া ইরাক বা অন্য কোথাও নৃশংসতা এবং সন্ত্রাসবাদ চর্চা করেই যাবে।

মূল প্রবন্ধ: Here’s how ISIS still has access to the global financial system