“আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ,
চুনি উঠলো রাঙ্গা হয়ে।
আমি চোখ মেললুম আকাশে,
জ্বলে উঠলো আলো
পূবে পশ্চিমে।
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম “সুন্দর”,
সুন্দর হলো সে”।
— আমি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ২৯ মে, ১৯৩৬

১.
রবীঠাকুরের “আমি” কবিতার এই অংশটুকু আপাতত হজম করুন, এই পর্বের শেষ দিকে হয়তো এই কবিতাংশটুকুর প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাওয়া যাবে। এখন আসুন, গত পর্বের প্রসঙ্গ থেকে শুরু করি আবার।

গত দুই পর্বে ঈমাম আবু হানিফা থেকে শুরু করে ইবনে মিশকাওয়াইহ এর কথা উল্লেখ করেছি। ঈমাম আবু হানিফা ছিলেন ইসলামের খলিফাদের পরে প্রথম পরিচিত বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষ। যদিও এভাবে শ্রেনীবদ্ধ করাটা কতটা সঠিক সেটা অনিশ্চিত, তবুও আমার পাঠ বলছে, ইবনে মিশকাওয়াইহ এর সময় পর্যন্ত যে কালপর্ব তাকে হয়তো ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার প্রথম পর্যায়কাল বলা যেতে পারে। পরবর্তী পর্যায়ে অন্তত ছয় থেকে সাতজন ব্যক্তির আগমন ঘটে ইসলামের সমগ্র বুদ্ধিবৃত্তির ইতিহাস যাঁদের অবদানের কাছে কৃতজ্ঞ। এঁদের হাতেই প্রধানত গড়ে উঠেছিলো ইসলামী সমাজের শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান ও জ্ঞানচর্চার ইতিহাস। মূলত এই সময়টিকেই ইসলামের স্বর্ণযুগ বা “গোল্ডেন এইজ” হিসাবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। যদিও ইসলামের ইতিহাসে স্বর্ণযুগের ভুমিকা আরো অনেক বিস্তৃত। দর্শন, বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন ধারায় সমৃদ্ধ ছিলো এই সময়কাল। বিতর্ক আছে, এই কথিত “স্বর্ণযুগ” আসলে কতটা ইসলামিক আর কতটা ভৌগলিক প্রভাব ও রাজতন্ত্রের আনুকূল্যের কারণে গড়ে ওঠা। সেই বিতর্কটি আপাতত পাশে সরিয়ে রেখে, উপস্থাপন করছি, ইসলামী শিক্ষা ও জ্ঞান চর্চার ইতিহাসের দ্বিতীয় পর্যায়ের বা ধ্রুপদী সময়ের কয়েকজন মানুষের চিন্তা। এই পর্বে পাঁচজন মানুষের চিন্তাকে খুব সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করবো। এঁরা হচ্ছেঃ আল-ফারাবী, ইবনে সিনা, আল-বিরুনী, ঈমাম গাজ্জালী ও ইবনে রুশদ। দার্শনিক চিন্তার ঐক্যের ভিত্তিতে আল-গাজ্জালী ছিলেন সম্পূর্ণ অর্থেই বাকী চারজনের চিন্তা চেতনার প্রধান ঐতিহাসিক প্রতিপক্ষ। তাই এঁদের প্রত্যেকের চিন্তা নিয়ে আলাদা করে আলোচনায় হয়তো অন্যদের প্রসঙ্গও, বিশেষত ঈমাম আল-গাজ্জালীর প্রসঙ্গ চলে আসবে। এই পাঁচজনের দর্শন, চিন্তা ও জ্ঞানচর্চা বিষয়ক ভাবনার যে পার্থক্য সেখানেই ইসলামের শিক্ষা দর্শনের সবচাইতে বড় বাঁক বা ঘুরে দাঁড়ানোর চিহ্নটি পাওয়া যাবে। “ঘুরে দাঁড়ানো” শব্দটি এখানে কোনও রকম জাজমেন্ট বা মূল্যবোধের বিচার ছাড়াই ব্যবহার করতে চাই। এই ঘুরে দাঁড়ানোটা ইসলামী সমাজের জন্যে ঠিক কেমন ছিলো তা্র কোনও সঠিক জবাব নেই। এটা কি ঘুরে একেবারে উল্টো দিকে যাত্রা নাকি ঘুরে একটা ভিন্ন দিকে যাত্রা, এটা সন্দেহাতীত ভাবেই আপেক্ষিক। এই পাঁচজনের চিন্তার আলোচনা থেকে বোঝা যাবে, ঠিক কোথায় ইসলামী শিক্ষা-দর্শনের সবচাইতে বড় বাঁকটি তৈরী হয়েছে ইতিহাসে।

২.
ইসলামের ইতিহাসে শিক্ষা, জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির চর্চার সবচাইতে যৌক্তিক, র‍্যাশনাল পন্ডিতদের তালিকা করলে, সন্দেহাতীতভাবেই সেই তালিকার সবার উপরে থাকবেন আল-ফারাবী, ইবনে সিনা এবং ইবনে রুশদ এই ত্রয়ী দার্শনিক । এই ত্রয়ী চিন্তাবিদের চিন্তা ও দর্শনের মাঝে যে নৈকট্য ও একটি সাধারণ সূত্র পাওয়া যায় তার মূল কারণ হচ্ছে ইবনে সিনা ও ইবনে রুশদ ছিলেন মূলত আল-ফারাবীপন্থী দুজন দার্শনিক ও পন্ডিত। সেই অর্থে আল-ফারাবী হচ্ছেন পরবর্তী দুইজনের শিক্ষক। সরাসরি শিক্ষক না হলেও চিন্তার শিক্ষক। এই তিনজনের মাঝে আরেকজন পন্ডিত মানুষ জন্মেছিলেন, যদিও জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে তাঁর ঝোঁকের দিকটা ছিলো বেশীরভাগ ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের দিকে, উপরোক্ত ত্রয়ীর মতো দর্শন, রাজনীতি ও ধর্ম নিয়ে নয়। তিনি আল-বিরুনী। ইবনে রুশদ এঁদের সবার পরে জন্মেছেন। সময়ের হিসাবে এঁরা জন্মেছিলেন ভিন্ন ভিন্ন সময়ে, তাই হয়তো সময়ের প্রেক্ষিত অনুযায়ী চারজনের আলোচনা একসাথে করাটা খুব প্রাসঙ্গিক নয়, কিন্তু চিন্তা ও চিন্তাপদ্ধতির প্রসঙ্গে এঁদের ভাবনাগুলোকে একসাথে আলোচনা করাটাই অনেক যৌক্তিক। এই চারজন দার্শনিকের মধ্যবর্তী সময়ে জন্মেছিলেন আরেকজন ক্ষণজন্মা ইসলামী পন্ডিত, ঈমাম আল-গাজ্জালী। ঈমাম গাজ্জালী জন্মেছিলেন আল-ফারাবী, ইবনে সিনা ও আল-বিরুনীর পরে এবং ইবনে রুশদের আগে। চিন্তা-ভাবনার দিক থেকে ফারাবী ও তাঁর অনুসারী চিন্তকদের প্রায় সকল চিন্তার প্রধান বিরোধী পক্ষ ছিলেন ঈমাম আল-গাজ্জালী। ইসলামের ইতিহাসে চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির যে পিরামিডটিকে দাঁড় করিয়েছিলেন আল-ফারাবী, ইবনে সিনা ও ইবনে রুশদ মিলে, তাকে পুরোপুরি উলটে দেন ঈমাম আল-গাজ্জালী। বাঙলায় যাকে আমরা বলি “হেট-মুন্ডু – ঊর্ধ্বপদ” মানে পা উপরের দিকে আর মাথা নীচের দিকে। গ্রীক দর্শনের উপরে ভিত্তি করে ইসলামী চিন্তার বা দর্শনের যে সৌধটি গড়ে তোলেন ছাত্র-শিক্ষক ত্রয়ী মিলে, একজন ঈমাম গাজ্জালী সেই সৌধ করে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছিলেন। শুধু উল্টে দেন বা ভেঙ্গেচুরে দেন বললে বরং কমই বলা হবে। তিনি সফল ভাবে ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ইতিহাসের র‍্যাশনাল ধারাটিকে পালটে দিয়ে তার ওপরে তৈরী করেন আজকের অর্থোডক্স বা গোঁড়া ইসলামের কংকালটিকে। বলাই বাহুল্য পূর্ববর্তী চিন্তকদের দর্শন ও চিন্তাকে এভাবে মুকাবিলা করার কাজটি তিনি করেছিলেন, কেবলই লিখে, শত শত পাতা লিখে। এখানেও ধ্রুপদী ইসলামী সময়ের সাথে আজকের ইসলামী সমাজের একটা দারুন বিপরীত চিত্র পাওয়া যাবে। গাজ্জালী তাঁর আগের দার্শনিকদের চিন্তার অসারতা প্রমান করার জন্যে লিখেছিলেন একটি দীর্ঘ পুস্তক, “দার্শনিকদের অসঙ্গতি” নামে। বস্তুত আজকের সময়ে আমরা যে ইসলামী শিক্ষা ও তাঁর দর্শন খুঁজে পাই, তাঁর পুরোটাই হচ্ছে ঈমাম আল-গাজ্জালীর রচনা, যা মূলত আল-ফারাবী ও ইবনে সিনার শিক্ষাচিন্তার কফিনের উপরে দাঁড়িয়ে তৈরী হয়েছে। তাই আজকের ইসলামী শিক্ষা ও জ্ঞান চর্চার ধারণাটিকে সঠিক ভাবে বোঝার জন্যে আল-ফারাবী, ইবনে সিনা, ঈমাম গাজ্জালী ও ইবনে রুশদ এই চার পন্ডিত মানুষকে জানাটা দারুন ভাবে জরুরী। আল-ফারাবী, ইবনে-সিনা ও ইবনে রুশদ ত্রয়ীর সাথে ঈমাম গাজ্জালীর ঐতিহাসিক বিতর্কের বিষয়টি হয়তো প্রচলিত অর্থে “ভাল-মন্দ”র বিতর্ক নয়, “সঠিক-বেঠিক” এর বিতর্ক নয়। এই বিতর্ক ও দ্বিমতের বিষয়টিকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বিচার করাটাই যৌক্তিক, ইতিহাসের এই পর্বটির নির্মোহ বিশ্লেষন আমাদেরকে সাহায্য করবে আমাদের আজকের ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্ঞান চর্চার ধারাটিকে আরো ভালো করে বুঝতে।

আল-ফারাবী, ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তির ইতিহাসে সবচাইতে উজ্জ্বল পন্ডিত।

৩.
আল ফারাবী
আল-জাহিজ, ইবনে শানুন ও ইবনে মিশকাওয়াইহ এর পরে ইসলামের ইতিহাসে সন্দেহাতীত ভাবে সবচাইতে উজ্জ্বল পন্ডিত হচ্ছেন আল – ফারাবী। আবু নাসর আল-ফারাবী ইসলামের শিক্ষা ও জ্ঞানবিজ্ঞানের ধ্রুপদী যুগের অন্যতম প্রধান একজন পন্ডিত। মনে করা হয়ে থাকে ইসলামের প্রথম দার্শনিক আল-কিন্দির পরে প্রকৃত অর্থে ইসলামী বুদ্ধিবৃত্তির জগতে ধ্রুপদী গ্রীক দর্শনের চর্চার শুরু হয় আল-ফারাবীর হাত দিয়ে। এইজন্যে আল-ফারাবীকে বলা হতো দর্শনের “দ্বিতীয় শিক্ষক”। প্রথম শিক্ষক কে? স্বয়ং এরিস্টটল। এভাবে বলার মূল কারণ হচ্ছে ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসে আল-ফারাবীর মতো এমন একনিষ্ঠ এরিস্টটল দর্শন চর্চাকারী আর একজনও আসেননি। আল-ফারাবী অনেকটা গোগ্রাসে গেলার মতো করে এরিস্টটল পড়েছিলেন এবং নিজেও লিখেছিলেন, অনুবাদ করেছিলেন এরিস্টটল এর টেক্সট। তিনি তিনজন গ্রীক পন্ডিতের প্রায় সকল লেখার অনুবাদ পাঠ করেছিলেন বলে জানা যায়। এরিস্টটল, প্লেটো আর গ্যালেন। এরিস্টটল আর প্লেটোর দর্শন আর গ্যালেন এর শারীরতত্ত্ব বা ফিজিওলজি। এই প্রসঙ্গটি মনে রাখা দরকার এই জন্যে যে, এরিস্টটল, প্লেটো ও গ্যালেন এই তিনজন পন্ডিতের মাঝে প্রথম দুজনের লেখালেখির সাথে বিষয়গত ভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার লেখক ছিলেন গ্যালেন । দর্শনের পাশাপাশি শরীরতত্ত্ব নিয়ে পড়াশুনা প্রমান করে, আল-ফারাবী ছিলেন বহুমুখী আগ্রহের একজন মানুষ। তাঁর প্রধান আগ্রহ ছিলো বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড, প্রকৃতি আর মানুষের সম্পর্ক। তিনি বহুবিধ বিষয়ে তাঁর গভীর আগ্রহের প্রকাশ করেছেন তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে। দর্শন, প্রকৃতি নিয়ে লেখালেখির বাইরেও, তাঁর লেখা সঙ্গীতের বিশাল পুস্তক “কুতুব আল মুজিকা আল কবীর” ইসলামের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য সঙ্গীতের পুস্তক। ইসলাম ও সঙ্গীতের মাঝে এক ধরনের না-বাচক সম্পর্ক আমরা এখন শুনতে পাই, কিন্তু আগ্রহ উদ্দীপক হচ্ছে আল-ফারাবী একজন মেধাবী সংগীতজ্ঞও ছিলেন এবং তার কিছু কিছু সঙ্গীত সৃষ্টি আজও পাওয়া যায়। সঙ্গীতের তত্ত্ব রচনার ক্ষেত্রেও তার বিশেষ অবদানের কথা জানা যায়। জন্মেছিলেন ৩৩৯ হিজরি সালে যা ৯৫০ খ্রিস্টাব্দ। অধিবিদ্যা, দর্শন, রাজনীতি ও সঙ্গীত নিয়ে তার পাণ্ডিত্য সেই সময়ে আশে পাশের অঞ্চলে ব্যাপ্ত ছিলো। মধ্য এশিয়ার একটি অঞ্চল তুর্কীস্তানে (তুরস্ক নয়) জন্ম হলেও আল-ফারাবি তার জীবনের বেশীরভাগ সময়ই কাটান ইরাকের বাগদাদে। অবশ্য কিছুকাল তিনি কাটান সিরিয়ার আলেপ্পো তে। আল-ফারাবী তার সময়ের নেতৃস্থানীয় পন্ডিতদের সাথে পড়াশুনা করেছেন। তাঁর দর্শন পাঠের হাতেখড়ি হয় প্রখ্যাত খৃস্টান দার্শনিক ও অনুবাদক, ইয়োহানা বিন হাইলান এর কাছে। জানা যায়, ইয়োহানা বিন হাইলান ছিলেন ইসলামী স্বর্ণযুগের যাবতীয় অনুবাদ কার্যক্রমের একজন প্রধান মানুষ। এরিস্টটলপন্থী মুসলিম এবং খৃস্টান পন্ডিতদের সাথে একত্রিত হয়ে লেখালেখি করেছেন। শিক্ষা, শিক্ষা-দর্শন ও জ্ঞানচর্চা নিয়ে আল-ফারাবীর দৃষ্টিভঙ্গি জানার জন্যে শুরু করার দরকার ফারাবী আসলে শিক্ষা বলতে কি বুঝতেন সেই প্রশ্ন করে। এর পরে হয়তো প্রশ্ন করা যেতে পারে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে তাঁর মতামত দিয়ে। ফারবী শিক্ষা বলতে প্রাথমিকভাবে অনেক গুলো “গুণ” বা “Virtue” অর্জন করাকে বোঝাতেন। এই সকল গুণই পার্থিব জীবনের জন্যে প্রয়োজনীয় গুণ।

আল-ফারাবীর মতে শিক্ষার তিনটি প্রধান উদ্দেশ্য –
১) জ্ঞান অর্জন
২) পার্থিব জীবনের দক্ষতা অর্জন ও
৩) সমাজ জীবনের মূল্যবোধ অর্জন।

জ্ঞান, দক্ষতা আর মূল্যবোধ এই তিনটি বিষয়কেই সবচাইতে গুরুত্ব দিয়েছেন তিনি একজন “নির্ভুল” বা “সম্পূর্ণ” মানুষ হওয়ার পূর্বশর্ত হিসাবে (perfect human) । তিনি মনে করতেন, তাত্ত্বিক পড়াশুনা, জীবনের পার্থিব দক্ষতা এবং নৈতিক অবস্থান এই তিনের সম্মিলনে তৈরী হয় দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতৃত্ব। চুড়ান্ত ভাবে শিক্ষার একটি প্রধান সামাজিক উদ্দেশ্য হচ্ছে গুনগত ভাবে শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরী করা। রাজনৈতিক নেতৃত্বের মূল্যবোধ ছিলো আল-ফারাবীর কাছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই শিক্ষার উদ্দেশ্য হিসাবে মূল্যবোধ অর্জনকে তিনি মনে করতেন একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। আল-ফারাবী’র দৃষ্টিতে শিক্ষার উৎস ও উদ্দেশ্য দুটোই পার্থিব। দুনিয়ার প্রয়োজন মেটানোর উদ্দেশ্যে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনই হচ্ছে শিক্ষার প্রাথমিক লক্ষ্য।

৪.
ফারাবী মনে করতেন, প্রতিটি মানব শিশুই জন্মগত ভাবে মেধা নিয়ে আসে কিন্তু শিক্ষক হচ্ছেন সবচাইতে দায়িত্বশীল মানুষ যিনি তার ছাত্রদের গড়ে তুলতে পারেন এমন ভাবে যেনো ছাত্ররা তাদের মেধার সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহার করতে পারে। তেমনি শিক্ষকদের সাধারণ সন্মান বিষয়ে তার কোনও দ্বিমত ছিলোনা তবে তিনি মনে করতেন ছাত্রদের পক্ষ থেকে শিক্ষকদের প্রতি সম্মান – শ্রদ্ধা এতোটা হওয়া ভালো নয় যাতে ছাত্ররা শিক্ষকদের সকল কথাকেই সত্য মনে করে বিনা বাক্যে মেনে নেয়। শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা থাকতে হবে এবং তাদের মতামত কে প্রশ্ন করারও সুযোগ থাকতে হবে। তিনি খুব স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন – ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্কটি হতে হবে ভারসাম্যপূর্ণ। শিক্ষক যদি খুব বেশী নিয়ন্ত্রন পরায়ন হন তাহলে তিনি ছাত্রদের শ্রদ্ধা হারাবেন আবার তিনি যদি খুব বেশী বিনয়ী হন তাহলেও তিনি ছাত্রদের হাতে অপদস্থ হতে পারেন। তাঁর সময়ের ইসলামী পন্ডিতদের মাঝে আল-ফারাবীই অন্যতম যিনি শিক্ষাদান ও গ্রহনের মাঝে ছাত্রদের প্রশ্ন করবার বিশয়টিকে উতসাহিত করেছেন, তিনি মনে করতেন প্রশ্ন করাটা জরুরী এবং শিক্ষাদান পদ্ধতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়া উচিৎ।

৫.
আল-ফারাবী তাঁর “ইহসা আল-উলুম” নামের পুস্তকে ইসলামী শিক্ষার কারিকুলাম সম্পর্কে তাঁর প্রস্তাবনা হাজির করেছিলেন। তিনি খুব শক্ত ভাবেই মনে করতেন ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রথাগত ইসলামী শিক্ষা ছাড়াও সেই সময়ের অ-আরব অঞ্চলের শিক্ষা, জ্ঞানও অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। তিনি প্রথাগত ইসলামী শিক্ষা বলতে কুরআন ভিত্তিক শিক্ষাকে বোঝাতেন আর অ-আরব শিক্ষা বলতে মূলত গ্রীক দর্শন, গণিত ও চিকিৎসাবিজ্ঞান সহ বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার কথা প্রস্তাব করেছিলেন। আল ফারাবীর এই প্রস্তাবনা অর্থাৎ ধর্মীয় ও সেকুলার বিশয়গুলোকে পাশাপাশি পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করার ধারনাটিকে তাঁর ছাত্ররা খানিকটা এগিয়ে নেন। তাঁর ছাত্রদের মাঝে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ইবনে সিনা যিনি ইসলামী শিক্ষায় বিজ্ঞান ও সেকুলার বিষয়ের চর্চা করে গেছেন তাঁর নিজের ব্যক্তিগত শিক্ষা ও গবেষনায়। আল-ফারাবীর এই শিক্ষাক্রম তাঁর ছাত্রদের মাঝে প্রভাব বিস্তার করলেও পরবর্তীতে মূলধারার ইসলামী শিক্ষায় তা খুব একটা গৃহীত হয়নি। আজকের সারা দুনিয়ায় যে ইসলামী শিক্ষা দেখি আমরা সেখানে আল-ফারাবী ও তাঁর ছাত্রদের কোনও ভুমিকা বা প্রভাব নেই। এই লেখার শেষদিকে আমরা যখন বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসার পাঠ্যক্রম উল্লোখ করবো, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা দর্শন উল্লেখ করবো, তখন দেখবো আজকের ইসলামী শিক্ষার সাথে আল-ফারাবী বা ইবনে-সিনা প্রস্তাবিত শিক্ষা কারিকুলামের কতটা আকাশ-পাতাল তফাৎ।

৬.
আল-ফারাবীর শিক্ষা দর্শনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, শিক্ষা, জ্ঞান ও ধর্মের মাঝে সম্পর্ক বিষয়ে তাঁর নিজের অবস্থান। ধর্ম সম্পর্কে তাঁর মতামত ও দার্শনিক অবস্থান ছিলো খুবই ভিন্ন রকমের, খানিকটা মিশ্র, অপরাপর ইসলামী চিন্তাবীদদের তুলনায় খানিকটা অস্বাভাবিক (Unusual)। আল-ফারাবী মনে করতেন সমাজে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা আছে, ধর্ম মানুষকে অন্তত দুটি বিষয় অর্জনে সাহায্য করতে পারে, এক)ব্যক্তিগত সুখ বা হ্যাপিনেস আর দুই)একটি উন্নত সমাজ গঠনেও সাহায্য করতে পারে ধর্ম। কিন্তু তাই বলে ধর্মকে জ্ঞানের উৎস বা সত্য খোঁজার পদ্ধতি হিসাবে তিনি মনে করতেন না। তিনি তাঁর পুস্তক “ফালাসাফা মাদানীয়া” তে ব্যাখ্যা করেছেন ধর্ম, শিক্ষা, জ্ঞান, উন্নত মানুষ হয়ে ওঠা ইত্যাদির আন্ত সম্পর্ক নিয়ে। তাঁর এই পুস্তকটি পরবর্তীতে তাঁর ছাত্রদের মাঝে এমন কি পশ্চিমা দুনিয়াতেও অনেক গভীর প্রভাব রেখেছিলো। আল-ফারাবী বিশ্বাসী মানুষ ছিলেন। তিনি ইসলাম ধর্মেই বিশ্বাসী ছিলেন, কিন্তু তিনি মানুষকে এবং মানুষের উদ্দেশ্যকে ও মানুষের মানুষ হয়ে ওঠাকে যেভাবে ব্যাখ্যা করতেন তা তাঁর সময়ের অপরাপর ইসলামী পন্ডিত ও দার্শনিকদের মাঝে খুব দৃশ্যমান ছিলোনা। ফারাবী মানুষকে তাঁর শরীর ও আত্মার (body and soul) সমন্বয় মনে করতেন এবং মনে করতেন শরীর মরে যায় কিন্তু আত্মা বেঁচে থাকে। আত্মা শরীরের সীমার বাইরেও বেঁচে থাকতে পারে। তাই শরীরের প্রয়োজন ও আত্মার প্রয়োজন ভিন্ন রকমের। তাই ফারাবীর সুখী হবার প্রশ্নটি দুই রকমের। শারীরিক সুখের বিষয়টি নিশ্চিত ভাবেই দুনিয়াতে অর্জন সম্ভব এবং শারীরিক ভাবে সুখী না হয়ে আত্মার সুখী হওয়াটাও হয়তো কঠিন। কিন্তু আত্মার প্রসঙ্গে ইসলামের স্বর্ণযুগের অন্যান্য দার্শনিক ও ধ্রুপদী ইসলামী শিক্ষার (Classical Islamic Teachings) সাথে ফারাবীর মতামতের সুনির্দিষ্ট ভিন্নতা হচ্ছে – ফারাবী মনে করতেন, “আত্মা” ও “পরকাল” সকল অর্থেই মানসিক বিষয়। পরকাল সবসময়ই মানুষের মস্তিষ্কে, মানুষের মনে, আকাংখায়। মৃত্যুর পরে আবার পুনর্জীবিত হওয়ার বিষয়েও ফারাবীর ছিলো দ্বিমত। তিনি সম্পূর্ণ ভাবেই মনে করতেন, এটাও মানসিক, কেবলই মানসিক। সেই অর্থে আল-ফারাবীর “মানব শরীর” ও “আত্মা” দুটোই পার্থিব ধারণা। এই পার্থিবতা, আল-ফারাবীর শিক্ষা দর্শনে প্রভাব ফেলেছে। ফারাবীর শিক্ষা দর্শনের উদ্দেশ্য তাই পার্থিব জ্ঞানলাভের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। এই লেখার পরের কোনও একটি পর্বে আমরা ঈমাম গাজ্জালী প্রসঙ্গে আলোচনা করবো, যিনি মনে করতেন, পরকাল ও পুনর্জন্ম বিষয়টি এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ যে এই বিষয়টি দিয়েই “বিশ্বাসী মুমিন” ও “অবিশ্বাসী কাফের” কে আলাদা করা যায়। এখানে আল-ফারাবীর সাথে প্রায় সকল প্রধান ইসলামী পণ্ডিতের মতামতের একটি সুস্পষ্ট পার্থক্য। সেজন্যেই ইসলামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ সেকুলার পণ্ডিতদের একজন ছিলেন আল-ফারাবী।

৭.
ফারাবীর কাছে শিক্ষা ও জ্ঞানের উৎস (Source) যেমন পার্থিব তেমনি জ্ঞান ও শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যও পার্থিব। পার্থিব বিষয়টির ইংরাজী হয়তো করা যেতে পারে Worldly বা আমাদের ইসলামী লেখকেরা যাকে বলে “দুনিয়াবী”। জ্ঞান ও ইন্দ্রিয়’র সম্পর্ক বিষয়ে আল-ফারাবী ছিলেন আরো স্পষ্ট, র‍্যাশনাল। তিনি স্পষ্টতই মনে করতেন জ্ঞান অর্জিত হয়, ইন্দ্রিয়গত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে। মানুষ তাঁর ইন্দ্রিয়গত অভিজ্ঞতার উপরে বা তার সাথে ব্যক্তির নিজের কল্পনা, সৃজনশীলতা মিশ্রিত করে লব্ধ জ্ঞানের ব্যবহার করে, তাকে সংরক্ষণ করে। এমন কি আল ফারাবী তাঁর পুস্তকে এরিস্টটল কে উদ্ধৃত করে বলেছেন – “ইন্দ্রিয়গত অনুভূতি হারানোর মানেই হচ্ছে জ্ঞান হারানো”। সুতরাং, জ্ঞানার্জন ও জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে আল-ফারাবীর মতামতের সাথে আধুনিক কালের বস্তুবাদী দার্শনিকদের মাঝে পার্থক্য খুব সামান্যই। জ্ঞানার্জন প্রসঙ্গে এই পার্থিব দৃষ্টিভঙ্গি আল-ফারাবীকে ইসলামের ইতিহাসের আরো অনেক পন্ডিতের থেকে আলাদা করেছে।

তিনি স্পষ্টতই মনে করতেন জ্ঞান অর্জিত হয়, ইন্দ্রিয়গত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে। মানুষ তাঁর ইন্দ্রিয়গত অভিজ্ঞতার উপরে বা তার সাথে ব্যক্তির নিজের কল্পনা, সৃজনশীলতা মিশ্রিত করে লব্ধ জ্ঞানের ব্যবহার করে, তাকে সংরক্ষণ করে। এমন কি আল ফারাবী তাঁর পুস্তকে এরিস্টটল কে উদ্ধৃত করে বলেছেন – “ইন্দ্রিয়গত অনুভূতি হারানোর মানেই হচ্ছে জ্ঞান হারানো”।

৮.
শিক্ষাদান পদ্ধতি বিষয়ে ফারাবী ছিলেন দারুন ভাবে প্লেটো দ্বারা প্রভাবিত। তিনি নিজে যেহেতু একজন নয়া-প্লেটোবাদী দার্শনিক ছিলেন, তাই তিনি বিশ্বাস করতেন শিক্ষাদান পদ্ধতি হওয়া দরকার ডায়ালগ বা সংলাপধর্মী। তিনি মনে করতেন বিতর্ক বা যুক্তি – পাল্টা যুক্তির চাইতে ভালো কোনও পথ নেই সত্যে উপনীত হবার জন্যে। পরস্পর বিরোধী মতামতের মিথস্ক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই একটি সত্যে উপনীত হবার পথকেই তিনি জ্ঞানার্জনের সবচাইতে উৎকৃষ্ট পথ মনে করতেন। তাই মুখস্থ করার বদলে তিনি প্রশ্ন করাকে প্রাধান্য দিতেন, কোনও একটি বিষয়কে বুঝে আত্মস্থ করাকে তিনি মুখস্থ করার পদ্ধতির চাইতে কার্যকর বলে মনে করতেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, কেনো মুখস্থ করার চাইতে বুঝে পড়াটা বেশী কার্যকর। মুখস্থ করার মাঝে মানুষ তাঁর নিজের চিন্তাশীলতা, যুক্তিবোধ ব্যবহারের সুযোগ পায়না, মুখস্থ করার জন্যে মানুষ কেবলই একটি বিষয়কে বা একজন মানুষ কে ক্রমাগত অনুকরণ বা “ইমিটেইট” করে। বারবার অনুকরণ বা ইমিটেইট করার কারণে মানুষ একটি বিষয় কে আত্মস্থ করে এর অন্তর্গত অর্থ না বুঝেই। তাই মুখস্থ বিদ্যা হয়তো মানুষ রিপ্রডিউস বা পুনরাবৃত্তি করতে পারে সহজেই কিন্তু সেখানে মানুষের নিজস্ব চিন্তাশক্তি, বিবেচনাবোধ থাকেনা। তাই ফারাবী মুখস্থবিদ্যার বদলে বুঝে পড়ার, আত্মস্থ করার পদ্ধতিকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করতেন। আগ্রহী পাঠক ফারাবীর এই অবস্থানের সাথে আমাদের আজকের ইসলামী শিক্ষার পদ্ধতির তুলনা করে দেখতে পারেন। আজকের ইসলামী শিক্ষায় যে যত বেশী “মুখস্থবাদী” তিনি তত বড় আলেম। এই তুলনামূলক আলোচনা পরে আবার করবো।

৯.
শিক্ষা কারিকুলাম নিয়েও আল-ফারাবীর মতামত ছিলো সমকালীন অন্যান্য ইসলামী চিন্তকদের চাইতে সম্পূর্ণ আলাদা। যেমন – আল-ফারাবী পরবর্তী ইসলামী চিন্তক ঈমাম আল-গাজ্জালী মনে করতেন সকল জ্ঞানের শুরু হচ্ছে আল-কুরান থেকে। কিন্তু আল ফারাবীর প্রস্তাবিত কারিকুলাম বা পাঠ্যক্রমের তালিকায় কুরআন, ইসলামী আইন ও ধর্মতত্ত্ব ছিলো তালিকার শেষের দিকে।

আল-ফারাবীর শিক্ষা দর্শন ছিলো সম্পূর্ণ প্রয়োগধর্মী। তিনি মনে করতেন যে শিক্ষা প্রয়োগ শেখায়না, তা কেবলই অপচয়। যেমন বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিলো, বিজ্ঞানের শিক্ষা যদি বাস্তবে প্রয়োগ করা না যায়, যদি বাস্তবে প্রয়োগের সুযোগ তৈরী করা না যায় তাহলে সেই শিক্ষা একেবারেই অপ্রয়োজনীয়।
ফারাবী শিক্ষার অধিকার, এর অর্থনৈতিক দিক নিয়েও আলোচনা করেছেন। আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে, একজন ইসলামী চিন্তাবিদ শিক্ষার অধিকার নিয়ে কথা বলছেন। তিনি বলছেন – সমাজের সকলের শিক্ষার অধিকার পাবার কথা। এমন কি এই শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্যে আলাদা করে বাজেট বা সম্পদ তুলে রাখার কথাও বলছেন।

আল-ফারাবীর শিক্ষা দর্শন ছিলো সম্পূর্ণ প্রয়োগধর্মী। তিনি মনে করতেন যে শিক্ষা প্রয়োগ শেখায়না, তা কেবলই অপচয়। যেমন বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিলো, বিজ্ঞানের শিক্ষা যদি বাস্তবে প্রয়োগ করা না যায়, যদি বাস্তবে প্রয়োগের সুযোগ তৈরী করা না যায় তাহলে সেই শিক্ষা একেবারেই অপ্রয়োজনীয়।

১০.
মোটামুটি ভাবে, শিক্ষা প্রসঙ্গে যদি আমরা আল-ফারাবীর চিন্তাকে সারসংক্ষেপ করতে চাই তাহলে কয়েকটি বিষয় মনে রাখা জরুরী। এগুলো হলোঃ

১ – ফারাবী কে ইসলামের বিভিন্ন মজহাব কাফের বা নাস্তিক হিসাবে গন্য করলেও, আল-ফারাবী একজন বিশ্বাসী মানুষ ছিলেন। তিনি বিশ্বাসী মানুষের জীবনে যুক্তি ও কার্যকারণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। তিনি মানুষের যৌক্তিক হয়ে ওঠার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। আল-ফারাবী মূলত একজন র‍্যাশনাল মানুষ ছিলেন।
২ – মানব শিশুর মেধাকে বিকশিত করবার ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভুমিকার ধারণাটি উল্লেখযোগ্য, এর সাথেই ইসলামের অত্যন্ত শিশুকাল থেকে মক্তবকেন্দ্রিক শিক্ষাদানের প্রথাটিকে বোঝা যেতে পারে। ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিৎ এ নিয়ে আল-ফারাবীর ধারণাটি মূলত সত্যকে জানার জন্যে সহায়ক। তাই তিনি বলেছেন, ছাত্ররা যেনো শিক্ষকের সকল কথাকে অকাট্য সত্য বলে ধরে না নেয়, সেটাই ভালো। আমাদের এই সময়ের কওমি মাদ্রাসা বা এমন কি ব্রিটিশ কলোনিয়াল ভারতের সাধারণ শিক্ষার পদ্ধতিতে ছাত্র শিক্ষক সম্পর্ক এখনও “শ্রদ্ধা – ভীতি” জড়ানো যা শিক্ষার্থীর পক্ষে মুক্ত, স্বাধীন ও সৃজনশীল চিন্তার বিকাশে সহায়ক নয়। আধুনিক সময়ে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা বলতে আমরা যা দেখি এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে, তাঁর পুরোটাই হচ্ছে শিক্ষকের প্রতি শর্তহীন আনুগত্যের সংস্কৃতি। বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশেষত কওমি মাদ্রাসা শিক্ষায় ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক বিষয়ে প্রায়শই নিপীড়িত – নিপীড়ক এর সম্পর্কের মতো।

৩ – আল-ফারাবী সামাজিক জীবনে মানুষ কে কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত করার জন্যে ধর্মের ভুমিকাকে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু তিনি ধর্মকে জ্ঞানের উৎস বা সত্য অনুসন্ধানের উপায় বলে মনে করতেন না। তিনি মনে করতেন ধর্ম হচ্ছে আইনের মতো, যা প্রনীত হয় মান্য করার জন্যে। আর প্রফেট বা নবী হচ্ছেন আল্লাহ্র প্রেরিত পুরুষ যার কাজ হচ্ছে সেই আইনের সংরক্ষণ ও প্রচার – প্রসার। তিনি মনে করতেন ধর্ম হয়তো মানুষকে একটি সামগ্রিক লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করে কিন্তু ধর্ম পালন বা ধার্মিক হওয়ার সাথে জ্ঞানার্জন বা সত্য অনুসন্ধানের কোনও সম্পর্ক নেই।

৪ – তিনি শিক্ষাক্রমে ধর্মীয় এবং সেকুলার বিষয়ের সমান অন্তরভুক্তির কথা বেশ জোরালো ভাবেই প্রস্তাব করেছিলেন। বাস্তবত, ফারাবীর প্রস্তাবিত পাঠ্যক্রমে বিজ্ঞান ও গনিতের বিষয়গুলোর গুরুত্ব ছিলো ধর্ম, ধর্মীয় আইন কিম্বা ধর্মতত্ত্ব’র চাইতে অনেক বেশী।

৫ – তাঁর প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রম তাঁর ছাত্রদের দ্বারা খানিকটা চর্চিত ও অগ্রসর হলেও, পরবর্তী মূলধারার ইসলামী শিক্ষায় তা গৃহীত হয়নি। আজকের ইসলামী শিক্ষার যে দর্শন তা আল-ফারাবীর শিক্ষা দর্শনের ঠিক উল্টো অবস্থান।

শেষ কথা
আল-ফারাবী, তাঁর Talkhis nawamis Aflatun, গ্রন্থে লিখেছিলেন,

“ভালোই সুন্দর, এবং সুন্দরই ভালো,
আর তাইই হচ্ছে সুন্দর যা বুদ্ধিদীপ্ত এবং বুদ্ধিবৃত্তির জন্যে গুরুত্বপূর্ণ”।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, পান্নার সবুজ, চুনীর রাঙা হয়ে ওঠা কিম্বা গোলাপের সুন্দর হওয়ার পেছনে “আমার চেতনার রঙ”ই মূল কারণ। আর ফারাবী বলছেন কোনও কিছুর সুন্দর হয়ে ওঠার জন্যে তা “ভালো” হতে হবে, “বুদ্ধিদীপ্ত” হতে হবে, “বুদ্ধিবৃত্তির জন্যে গুরুত্বপূর্ণ” হয়ে উঠতে হবে। “বুদ্ধিবৃত্তি” আর “চেতনা” হয়তো একই কথা নয়, কিন্তু তবুও, আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে একজন ইসলামী চিন্তাবীদের যুক্তিতে শুভ – সুন্দর ও বুদ্ধিবৃত্তির সম্পর্ক নিয়ে বিশ্লেষণ সত্যিই অবাক করার মতো। এটা আরো বিস্ময়কর যখন আজকের যুগে আমরা ইসলামী বুদ্ধিবৃত্তির করুন দশা দেখতে পাই।

আল-ফারাবীর বুদ্ধিবৃত্তি, চিন্তাশীলতা ইসলামী সমাজে ও শিক্ষা-দর্শনে গৃহীত হয়নি। কেনো হয়নি এবং তাঁর ফলাফল কি হয়েছে, তা নিয়ে হয়তো ভবিষ্যৎ কোনও এক পর্বে আলোচনা করবো।

(চলবে)

আগ্রহী পাঠকেরা আগের দুটি পর্ব পড়তে পারেন এখানে
পর্ব ১

পর্ব ২

এই পর্বটি লেখার জন্যে যে সকল উৎস থেকে সাহায্য নেয়া হয়েছে।
পুস্তক ও প্রবন্ধ সমুহঃ
Al-Farabi, Al-Ta’liqat, Ed. Ja’afar al-Yasan, Beirut, Dar al-manahil, 1988, p. 39.
Al-Farabi, Al-Thamra al-murdiyya fi al-rasa’il al-farabiya, edited by F. Dieterici, Leyden, Neudruck der. Ausgabe, 1890, p. 21.
Al-Farabi, Talkhis nawamis Aflatun, edited by ‘Abd al-Rahman Badawi, in: Aflatan fi l-islam, Beirut, Dar al-Andalus, 1982, p. 54.

Tanabayeva A (2015) Al-Farabi’s Humanistic Principles and “Virtuous City”, The European Proceedings of Social & Behavioural Sciences eISSN: 2357-1330

Al-Farabi, Ajwibat masa’il su’ila ‘anha, edited by F. Dieterici, Leyden, 1890.

ইন্টারনেট উৎস সমূহঃ
https://plato.stanford.edu/entries/al-farabi/
https://plato.stanford.edu/entries/al-farabi-soc-rel/
http://www.muslimheritage.com/article/al-farabis-doctrine-education-between-philosophy-and-sociological-theory
http://www.academia.edu/25263496/Bodily_Resurrection_in_Islam_Ibn_Sina_Ghazali_Said_Nursi