দু’হাজার নয় সালের কথা। আমি তখন কানাডায় নতুন এসেছি। হটাতই সুযোগ এলো আলবার্টায় একটা কনফারেন্সে যাওয়ার। তেমন বিশাল কিছু নয়, কিন্তু কাজের চাপ কম থাকায় ভাবলাম ঘুরে আসলে মন্দ হয় না। আর কিছু না হোক, অন্তত দু-একজন চেনা-মুখের সাথে দেখা হবে। আয়োজকরা জানিয়েছিলেন যে আগ্রহীদের আলবার্টার ডাইনোসর পার্ক ঘুরে দেখার সুযোগ রয়েছে। তবে যারা ডাইনোসর পার্কে যেতে চান তাদের কনফারেন্স শুরু হওয়ার আগের দিন সকালে হোটেলের লবিতে রিপোর্ট করতে হবে। সত্যি বলতে কি ডাইনোসর পার্ক সম্পর্কে আমার তেমন কোন ধারনা ছিল না। আমি ভেবেছিলাম হয়ত কোন ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের মত কিছু ফসিল আর ডাইনোসরের মডেল থাকবে, যা আমি এর আগেই বিভিন্ন জায়গায় কয়েকবার দেখেছি। যাব নাকি বাদ দেব এমন দো-মনা ভাব নিয়েই জানিয়ে দিলাম যে আমি আগ্রহী।

কনফারেন্স শুরুর দু’দিন আগে ছিমছাম শহর ক্যালগারীতে পৌঁছে গেলাম। রেজিস্ট্রেশন করতে দেরী হওয়ায় মূল হোটেলে রুম পাইনি; তবে বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে (সস্তাও বটে) ইউনিভার্সিটির গেস্ট হাউজে রুম পাওয়া গেল। বাস আর মেট্রো ধরে সেখান থেকে সহজেই ডাউনটাউনের হোটেলে, যেখানে কনফারেন্স হচ্ছে, যাওয়া যায়। রাতে টানা ঘুম দিয়ে সকাল-সকাল তৈরি হয়ে পৌঁছে গেলাম আমাদের ‘রন্দেভু’-র জন্য নির্ধারিত হোটেলের লবিতে, যা ততক্ষণে তরুণ (আমার মত অল্প কিছু বুড়ো মানুষ বাদে) অংশগ্রহণকারীদের কলতানে মুখর হয়ে উঠেছে। চেনা, স্বল্প-চেনা কয়েকজনের সাথে কুশল বিনিময় করে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতেই ঘোষণা এলো বাসে উঠে পড়ার। লাইন দিয়ে বাসে ওঠার সময় হাতে একটা স্যান্ডুইচের ব্যাগ আর ঠাণ্ডা পানির বোতল ধরিয়ে দেয়া হল দুপুরের খাবারের জন্য। এরপর পরিচ্ছন্ন, আরামদায়ক বাসের সিটে বসতে না বসতেই চলতে শুরু করল বাস। হাতের ঘড়িতে তখন সকাল আটটা।

বাসে আয়োজকদের একজন মাইক্রোফোন হাতে সেদিনের কর্মসূচীর একটা ধারনা দিয়ে দিলেন। সে অনুযায়ী প্রায় আড়াই ঘণ্টার যাত্রা শেষে আমাদের প্রথম গন্তব্য ডাইনোসর পার্কের তথ্যকেন্দ্র। সেখানে প্রায় মিনিট পঁয়তাল্লিশ কাটিয়ে আমরা কেন্দ্রের বাইরে আমাদের সেদিনের সফরের পরিচালক ডক্টর ডোনাল্ড ব্রিঙ্কম্যান আর তাঁর দু’জন সহকর্মীর সাথে মিলিত হব। ডক্টর ব্রিঙ্কম্যান একজন স্বনামধন্য ডাইনোসর-বিশারদ, আলবার্টার টাইরেল মিউজিয়ামের গবেষণা পরিচালক। তিনি তাঁদের চলমান গবেষণা আর সেদিনের ট্যুর সম্পর্কে দু’চার কথা বলবেন, তারপর হেঁটে হেঁটে শেষ বিকেল পর্যন্ত পার্কটির অংশবিশেষ ঘুরে দেখা হবে। এর মধ্যেই পার্কের ভেতরে কোন এক জায়গায় বসে আমরা দুপুরের হাল্কা খাবার খেয়ে নেব। সন্ধ্যায় ফেরার পথে রাস্তার পাশে একটি হোটেলে বারবিকিউ শেষে আমাদের আবার ডাউন-টাউনের হোটেলের লবিতে নামিয়ে দেয়া হবে।

মধ্য-গ্রীষ্মের সুন্দর ঝকঝকে সকালে চলতে চলতে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের বাস শহরের বাইরে চলে এলো। দু’পাশের ক্ষেত-খামার আর উঁচু-নিচু ভূমির সৌন্দর্য দেখতে দেখতে কখন যে আড়াই ঘণ্টার পথ শেষ হয়ে গেল টেরই পেলাম না। আমাদের প্রথম গন্তব্য ডাইনোসর পার্কের লাগোয়া তথ্যকেন্দ্রটি ছোট হলেও বেশ গোছান। অঞ্চলটির ভূপ্রকৃতি, ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস, পাওয়া ফসিলের নমুনা, বর্তমান উদ্ভিদ আর প্রাণী ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে নমুনাসহ নানা তথ্য দেয়া আছে। দর্শনার্থীদের তথ্য দেয়া ছাড়াও কেন্দ্রটি টাইরেল মিউজিয়ামের মাঠ পর্যায়ের গবেষণাগার হিসাবে কাজ করে থাকে। ডাইনোসর পার্কের ফসিলগুলো মিউজিয়ামে পাঠানোর আগে এখানেই তাদের সংরক্ষণ আর প্রদর্শনীর জন্য প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো করা হয়। উল্লেখ্য যে ২০১১ সালে পাওয়া আলোড়ন তোলা, প্রায় অবিকৃত নডোসরাসের ফসিলটি পাথর কুঁদে বের করে আনার সময়সাপেক্ষ এবং শৈল্পিক কাজটি এখানেই করা হয়েছে। এই কাজে সময় লেগেছিল প্রায় সাত হাজার ঘণ্টা। ফসিলটির বিশেষত্ব এই যে কেবল হাড়ই নয়, ত্বকসহ শরীরের নরম টিস্যুগুলোও ফসিলায়িত হয়েছে, যা অতি বিরল ঘটনা। এতে করে ডাইনোসরটি দেখতে কেমন ছিল তা জানার জন্য আর বিজ্ঞানীদের ধারনা বা শিল্পীর আঁকা ছবির আশ্রয় নিতে হবে না। এ বছর থেকেই এই অনন্য ‘মাস্টার পিস’-টি টাইরেল মিউজিয়ামে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে (ছবি-১)।

ছবি-১ঃ টাইরেল মিউজিয়ামের প্রদর্শনীতে রাখা নডোসরাসের ফসিলের ছবি (ন্যাশনাল জিওগ্রফিক-র পাতা থেকে সংগৃহীত)।

তথ্যকেন্দ্রের সংগ্রহশালার শুরুতেই সচিত্র বিবরণীর মাধ্যমে অঞ্চলটির ভূ-প্রাকৃতিক ইতিহাস সম্পর্কে ধারনা দেয়া হয়েছে। এই অঞ্চলটিকে বলা হয় ব্যাডল্যাণ্ডস (Badlands), যা কানাডার আলবার্টা প্রদেশের দক্ষিণ-পূর্ব পাশের একটি বিশাল জায়গা জুড়ে আছে। ব্যাডল্যাণ্ড নামটি প্রথমদিকে এই অঞ্চলে আসা ফরাসী অভিবাসীদের দেয়া। আক্ষরিক অর্থেই অঞ্চলটি চাষাবাদ, খামার বা ভ্রমণের উপযোগী নয় বলেই এই নাম। হিমবাহ, বরফ-গলা জল, বৃষ্টি, বাতাস আর তাপমাত্রার মত প্রাকৃতিক শক্তিগুলোর সমন্বয় যে কিভাবে একটি ভূখণ্ডকে ক্যানভাসের মত ব্যবহার করে এক আশ্চর্য প্রাকৃতিক দৃশ্য ফুটিয়ে তুলতে পারে তা এখানে এলে ভালমতো বুঝতে পারা যায় (ছবি-২)।

ছবি-২ঃ আলবার্টার ব্যাডল্যাণ্ড।

জুরাসিক কালে (Period) যখন নডোসররা আলবার্টার পশ্চিমের উঁচু ভূমিতে দাপিয়ে বেড়াত, বর্তমানের পার্ক এলাকাটি তখনও একটি অগভীর সাগরের তলদেশ। ভূতাত্ত্বিক সময়পঞ্জী অনুযায়ী আমাদের গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের সৃষ্টি হতে তখনও বহু দেরী, হিমালয়েরই জন্ম হয় নি যে। অন্য যেকোনো ব-দ্বীপ অঞ্চলের নদীগুলোর মতই এখানকার আদি নদীগুলোও পলি জমিয়ে ভরে তুলেছিল সাগরটির অংশবিশেষ, যা পরবর্তীতে রূপ নিয়েছিল নিচু জলাভূমি আর বনাঞ্চলে। আমাদের উপকূল অঞ্চলের মতই এখান দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীগুলোতে জোয়ার-ভাটার খেলা চলত। কালক্রমে সেই জলাভূমি আর আশেপাশের অরণ্য ভরে উঠলো জুরাসিক পরবর্তী ক্রিটেশিয়াস কালের প্রাণী আর উদ্ভিদে। এদের মধ্যে ছিল মাংসাশী, নিরামিষাশী, ছোট, বড় বিভিন্ন জাতের ডাইনোসরও (ছবি-৩)।

প্রায় ছেষট্টি মিলিয়ন বছর আগে বর্তমান মেক্সিকোর উপকূলে আছড়ে পড়া বিশাল উল্কার প্রলয় তাণ্ডবে পৃথিবীর জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনের পর পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মত আলবার্টার ডাইনোসরগুলোর বেশীর ভাগই লোপ পেয়ে গেল। বেঁচে গেল কেবল কিছু খেচর-ডাইনোসরের (avian dinosaur) দল, যাদের উত্তর পুরুষরা খুব সম্ভব এখন চিকেন কারি, টিক্কা, তন্দুরি কিংবা মুরগ-মুসাল্লম হয়ে আমাদের খাবার থালাকে লোভনীয় করে রাখছে।

ছবি-৩ঃ ভূতাত্ত্বিক সময়পঞ্জী আর সেকালের প্রাণী (অন্তর্জাল থেকে পাওয়া তথ্য আর ছবি ব্যবহার করে সম্পাদিত)

প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে হটাতই শেষ হয়ে যাওয়া ক্রিটেশিয়াস কালের পর শুরু হল প্যালিওজিন কাল (ছবি-৩)। কিন্তু পরিবর্তিত পরিবেশে বিবর্তনের চাকা থেমে থাকে নি। নতুন পরিবেশ টিকে থাকা প্রাণীদের অভিযোজনের ব্যাপক সুযোগ এনে দিল। আরও অনেক জায়গার মত আলবার্টার এই অঞ্চলটিও ভরে উঠল খেচর-ডাইনোসর থেকে বিবর্তিত বিচিত্র সব পাখ-পাখালিতে; অন্যান্য বিভিন্ন জাতের প্রাণীর সাথে এলো নতুন নতুন স্তন্যপায়ীরা। এভাবে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এই অঞ্চলের রঙ্গমঞ্চে উদ্ভিদ আর প্রাণীর যে বিপুল আবির্ভাব বা তিরোধান ঘটেছে, পাললিক শিলার স্তরে স্তরে তার চিহ্ন ধরে রেখেছে এখানকার ভূমি; ফসিলের আকারে।

ছবি ৪ঃ ক্যাকটাসের ফুল, কটনউড আর বুনো সেজের ঝোপ।

প্রায় ছাব্বিশ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের পরম্পরা মেনে শুরু হল সর্বশেষ হিম-যুগ। বরফের বিশাল স্তূপ ভরে ফেললো অঞ্চলটি। হিমবাহর সরণ আর পরবর্তীকালের উষ্ণ পৃথিবীতে গলন্ত হিমবাহ থেকে বের হওয়া জলপ্রবাহই প্রাথমিকভাবে অঞ্চলটির বর্তমান ভূ-প্রকৃতির জন্য দায়ী। এই দুই শক্তি মিলে তৈরি করেছে একটি বন্ধুর ভূমি যা অসংখ্য পাহাড়/ঢিবি, উপত্যকা, খাল আর খানা-খন্দকে ভরা। ভূমি কোথাও পাথুরে, কোথাও বা বালুময়। হিমবাহর খোদাই করা ভূমির রূপরেখা পরবর্তীতে অনেকটাই বদলে গেছে চলমান ভূমি ক্ষয়ে। রূপান্তরের সেই ধারা চালু আছে আজও। গলে যাওয়া তুষার কিংবা বৃষ্টির কারণে জমা পানির প্রবাহ, বাতাস আর তাপমাত্রার বৈপরীত্য আজও প্রায় প্রতিদিনই বদলে দিচ্ছে এখানকার ভূমির নকশা। শেষ ক্রিটেশাস কালের ডাইনোসর তো বটেই, পরবর্তীকালের তরবারি-দাঁতের বাঘ আর তাদের সমকালীন নিরামিষাশীরাও বিদায় নিয়েছে বহু আগেই। তাদের প্রতিনিধিত্ব করছে এখন শিং-ওয়ালা অ্যান্টিলোপ, বুনো শেয়াল আর র‍্যাটলস্নেক। সেই সবুজ বনভূমিও আর নেই, আছে প্রেইরীর ঘাস, ইতস্তত ফোঁটা বিভিন্ন বুনো-ফুল, ক্যাকটাস, সেজের ঝোপ আর বড়গাছ বলতে কেবল কটনউড ট্রি (ছবি-৪)। (চলবে)

(লেখাটি কয়েক বছর আগে শুরু করলেও অতি সম্প্রতি শেষ করতে পেরেছি। কয়েকটি পর্বে এটি প্রকাশিত হবে। কাজী রহমান আর নীলাঞ্জনাকে অনেক ধন্যবাদ, তাঁদের লেখা দেয়ার অনুরোধে উৎসাহিত হয়েছি। সূত্রের উল্লেখ না থাকা সব ছবিই সহকর্মী ডির্ক হাবমাখার এই লেখার জন্য তুলে দিয়েছেন)