রোহিঙ্গারা আসছে


সম্প্রতি পত্রিকান্তরে প্রকাশিত দুই রোহিঙ্গা শিশুর কাহিনী পড়ে ও তাদের অসহায় ছবি দেখে আমি অশ্রুসিক্ত হয়েছি এবং জানি যেকোনো বিবেকবান মানুষেরই সে রকম হওয়ার কথা। মোহাইউদ্দিন ও ইয়াজউদ্দিনের কাহিনী অসংখ্য রোহিঙ্গার সর্বস্ব হারানোর করুণ গাঁথার একটি মাত্র। এই রোমহর্ষক কাহিনীগুলি দেশের সকল নাগরিকের মধ্যেই ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে বিশেষ করে এই ইস্যুতে যুব সমাজের উপলব্ধি এবং সহমর্মিতার বদ্ধ দুয়ারগুলি আমাদের বর্ডারের মতোই উন্মুক্ত হয়ে গেছে বলেই মনে হয়। যদিও এরমাঝে রাজনৈতিক কাদা ছুড়াছুঁড়ি আছে ধর্মীয় বিষ নিঃশাস আছে এগুলি আমাদের আদর্শহীন শিক্ষা এবং ভোগবাদী রাজনীতির ফসল সুতরাং এজন্য আমি যুব সমাজের অনুভূতিকে দায়ী করবনা। রোহিঙ্গা ইস্যুর মধ্য দিয়ে একাত্তর না দেখা তরুন প্রজন্ম আমাদের অতীতটাকে দেখার একটা সুযোগ পেয়েছে যদিও রোহিঙ্গা জেনোসাইড একাত্তরের গণহত্যার তূলনায় একটি ছোট্ট আঁচড় মাত্র। অনেকটা শংখের ভেতরে সমুদ্রের শব্দ শুনার মতো। অবশ্য সম্প্রতি একজন স্বনামধন্য অভিনেতা নাকি বলেছেন রোহিঙ্গা নির্যাতনের তূলনায় একাত্তরের নির্যাতন কিছুই না। এই একাত্তর না-দেখা ভদ্রলোকের সমালোচনা করার রুচিও আমার নেই শুধু বলব ঐসব আগড়ম বাগড়ম অভিনয় বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পড়া লেখা করতে বাকি জীবনেও সেই নিষ্টুরতার কাহিনী পড়ে উনি শেষ করতে পারবেননা।একাত্তরে আমাদের দেশের জনসংখ্যা ছিল সাত বা সাড়ে সাতকোটি এর মাঝে প্রায় এককোটি মানুষই সর্বস্ব হারিয়ে সীমানার ওপাড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। একটি দেশের এক সপ্তমাংশ বা দশ মিলিয়ন মানুষ যখন বাস্তুচ্যুৎ হয়ে অজানা এবং অনিশ্চিত এক গন্তব্যে্র দিকে ছুটে যায় তা থেকেই অনুধাবন করা যায় এই জনপদে মানবসৃষ্ট গজব কী রকম ভয়াবহ মাত্রায় নেমে এসেছিল। আর ক্যাম্পের অবস্থা ? আজকের রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরের দুরাবস্থার জন্য যারা সমালোচনামুখর হচ্ছেন তারা কি একাত্তরের শরনার্থী শিবিরের কথা চিন্তা করতে পারবেন? এখানে বিশদ বলার অবকাশ নেই কারণ এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে তাই সামান্য একটু বর্ণনা দেই যা আমার শরনার্থী শিবির-ফেরা সহপাঠী বন্ধুদের কাছ থেকে শুনা। বালাটে অবস্থিত শরনার্থী শিবির প্রসঙ্গে বন্ধুরা বলেছিলেন সেখানে জীবন আর মৃত্যু এক কাতারে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।একই ছাউনির নিচে নবজাতকের প্রথম কান্না্র সাথে পাশেই আরেকজনের শেষ নিঃশাস নেয়া ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। নবজাতককে স্বাগত জানাবার যেমন কেউ ছিলনা তেমনি কলেরায় মৃত মানুষটির সৎকারেরও কোনো অবকাশ ছিলনা। মৃত মানুষটিকে কোনো রকমে টেনে হিঁচড়ে ক্যাম্পের অনতিদূরে ফেলে দেয়া হতো। ক্যাম্পের আশপাশ গলিত অর্ধগলিত লাশ আর মানব বর্জ্য মিলে আক্ষরিক অর্থেই নরক হয়ে উঠেছিল। যত্রতত্র প্রশ্রাব পায়খানা মিলে থকথকে কাদা। বেঁচে থাকার জন্য খাওয়া যেমন অপরিহার্য বর্জ্য ত্যাগ করাটাও তাই। কিন্তু চারপাশের কাদাতে বসে প্রাকৃতিক কর্মটি সারার কোনো উপায় ছিলনা অগত্যা মানুষ গলিত অর্ধগলিত কংকালের উপর বসেই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাধ্য হতো। এরচেয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের কথা কি আমরা চিন্তা করতে পারি? পরে অবশ্য অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। মাত্র কয়েক সপ্তাহের মাঝেই কয়েক লক্ষ মানুষ যখন একটি দেশে গিয়ে আশ্রয় নেয় তাৎক্ষণিকভাবে তা মোকাবেলা করা কোনো দেশের পক্ষেই সম্ভব নয়।


আমাদের একাত্তর

পশ্চিম বাংলার শরনার্থী ক্যাম্প দেখতে সুদূর মার্কিন মুল্লুক থেকে উড়ে গিয়েছিলেন আমেরিকার বিখ্যাত কবি এলেন গিনসবার্গ। শরনার্থী শিবিরের করুণ জীবনচিত্র কবির নরম মনে এতই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে তিনি দেশে ফিরে নিউ ইয়র্ক টাইমসের ১৯৭১ এর ১৭ ডিসেম্বর সংখ্যায় ‘সেপ্টেমবর অন যশোর রোড’ নামের দীর্ঘ এক কবিতা লেখেন যার লাইনে লাইনে শরনার্থী জীবনের করুণ আর্তি প্রকাশ পেয়েছে।

One Million aunts are dying for bread
One Million uncles lamenting the dead
Grandfather millions homeless and sad
Grandmother millions silently mad

Millions of daughters walk in the mud
Millions of children wash in the flood
A Million girls vomit & groan
Millions of families hopeless alone

Millions of souls nineteenseventyone
homeless on Jessore road under grey sun
A million are dead, the million who can
Walk toward Calcutta from East Pakistan

সেই এক কোটি শরনার্থীর একটা উল্লেখযোগ্য অংশই মৃত্যুর মিছিলে শরিক হয়ে গিয়েছিলেন যারা আর নিজ মাটিতে ফিরতে পারেননি। স্বজন হারানো মানুষ হয়তো স্বপ্ন দেখেন- “ওরা আসবে চুপি চুপি……..।


সে দিনের ভারত আজকের অবস্থায় ছিলনা। দারীদ্র আর রাজনৈতিক সহিংসতায় ক্ষত বিক্ষত দেশটি এক কোটি মানুষকে আশ্রয় দিতে গিয়ে হিমসিম খেয়েছে। তাদের খাদ্য আর চিকিৎসা দিতে তারা সাধ্যের মধ্যে সবকিছু করেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ এর ১৫ জুন রাজ্যসভায় শরনার্থী প্রসঙ্গে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা একদিকে যেমন ছিল হৃদয়স্পর্শী অপরদিকে তাতে ছিল কঠিন বাস্তবতার প্রতিধ্বণি। “ When any country has to face a large influx- not an influx over a long period, but a sudden influx with in a few weeks, of nearly six million people- it is not a joke ; it is not a small thing…………….If even ten thousand refugees arrive in any European country, the whole continent of Europe will be afire with all the newspapers, the governments and everybody aroused. We are trying to deal with nearly six million human beings who have come wonded, with disease, with illness, hunger and exhaustion. And they have come to our country, which is one of the poorest of the world. We certainly have the fullest sympathy with this war evacuees of refugees…………… তার পরের লাইনটি মানবিক অনুভবের এক অবিস্মরণীয় উচ্চারণ যা আমাদিগকে যুগ যুগ মনে রাখতে হবে। “we are going to do our very best to look after them. Even if we have to sacrifice, even if we have to go hungry, I hope the hon. Members will be the first to initiate a movement of missing a meal.” আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন সংসদে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে বলেন-‘প্রয়োজনে আমরা খাদ্য ভাগ করে খাব” তখন সেই বাক্যটি যেন একাত্তর সালের শ্রীমতি গান্ধীর সেই মানবিক উচ্চারণের প্রতিধ্বণি হয়ে যায়। হাঁ একটি জাতীয় ক্রাইসিসের সময় একজন রাষ্ট্র নায়কের এভাবেইতো বলা উচিৎ। এখানে শ্রীমতি গান্ধীর সেই ঐতিহাসিক ভাষণের আরেকটি অংশ উদ্ধৃত করছি এবং এই অংশটির উপরই এখন সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন। “I am not begging now, and I have no intention to begging. If our emissaries go from this country to other countries, they are not speaking with a voice of weakness; they are not begging. We are sending them because this is an international responsibility. And we are not going to let the international community get away with it. They cannot avoid their responsibility. They may give help or they may not give help. But they will certainly suffer from the consequences of whatever happens in this part of the world. রোহিঙ্গারা একাত্তরের আমাদের মতোই দলে দলে এসে নিরাপদ একটু আশ্রয় চাইছে আমরা আমাদের অতীতকে স্মরণ করেই বর্ডার উন্মুক্ত করে দিয়েছি। আমাদের সাধ্য সীমিত কিন্তু উদারতা সীমাহীন। ‘ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই ছোট এ তরী’ ছোট্ট এ ভূখন্ডটি মানুষের ভারে টালমাটাল তবুও আমরা রোহিঙ্গাদের ধারণ করছি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন-ষোল কোটি মানুষ খেলে রোহিঙ্গারাও খাবে’ এরচেয়ে বড় উদারতা আর কী হতে পারে ? এ হলো আমাদের উদারতার দিক কিন্তু বাস্তবতা অন্যরকম। বিশেষজ্ঞদের ধারণামতে এ পর্যন্ত যত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে তাদের পেছনে বছরে আট হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হবে। কিন্তু রোহিঙ্গা স্রোত থেমে নেই। সুতরাং খরচের পরিমান কোথায় গিয়ে থামবে তা এখনও নির্ভুলভাবে নিরূপণ করা সম্ভব নয়। এতো হলো অর্থনৈতিক দিক কিন্তু এই বাড়তি এবং ভিন্ন সংস্কৃতিধারী জনস্রোত আমাদের অরণ্য অঞ্চলে যে ডেমোগ্রাফিক পরিবর্তন ঘটাবে তা এই এলাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্যের উপরও বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এজন্য অনন্তকাল ধরে রোহিঙ্গাদের আমরা আশ্রয় দিতে পারিনা। সামর্থ থাকলেও পারিনা। কেন আমরা অন্য আরেকটি দেশের নাগরিকদের দায় যুগের পর যুগ বহন করব ? শ্রীমতি গান্ধীর ভাষণের উদ্ধৃত শেষ অংশটি পড়লেই মনে হয় কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় আমরা কতটুকু পিছিয়ে আছি। আমরাও শক্ত গলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তাদের দায়বদ্ধতার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে পারি। বিশ্বের দায় কেন আমরা গ্রহণ করব? রোহিঙ্গাদের অবশ্যই তাদের নিজ দেশে তাদের পূর্ণ রাষ্ট্রিয় অধিকার নিয়ে ফিরে যেতে হবে এজন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করতে হবে। একাত্তরে ভারত বাংলাদেশের বিপুল স্মরনার্থীদের সীমাহীন দুর্ভোগের চিত্র এবং পাকিস্তানীদের নৃশংসতা তুলে ধরতে কূটনীতির পাশাপাশি শত শত পাম্পলেট পুস্তক প্রকাশ করে বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে দিয়েছে শুধু রাষ্ট্রীয় ভাবেই নয় বিভিন্ন প্রতিষ্টান বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি বিশেষ প্রচার ও গবেষণা সেল করে পুস্তকাদি রচনা করেছে এবং অনেক সহৃদয় ব্যক্তি ব্যক্তিগত উদ্যোগেও অনেক বই প্রকাশ করে বিলিয়ে দিয়েছেন। টাইম ম্যাগাজিনের একাত্তরের সংখ্যাগুলি খুললে দেখা যায় এর চিঠিপত্র বিভাগে প্রচুর ভারতীয় নাগরিক পাকিস্তানী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় লেখালেখি করেছেন। আর এইসব প্রচার আমাদের পুরো মুক্তিযুদ্ধকেই কয়েক দাপ এগিয়ে দিয়েছিল। আর আমরা ? মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বরতা নিয়ে কয়টি পাম্পলেট পুস্তক প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে তুলে ধরতে পেরেছি ? বাংলায় গালাগাল আর ওয়াজ নসিহত জঙ্গি মিছিল করলে এগুলি দেশের ভেতরেই প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরবে আর দেশের বাতাসকে কলুষিত করবে। এতবড় একটি সমস্যা মাথায় নিয়েও আমরা সংকীর্ণ দলীয় কাদা ছুড়াছুঁড়ির ঊর্ধ্বে উঠতে পারিনি কী কান্ডজ্ঞানহীন জাতি আমরা। আর ব্যক্তিগতভাবে আমরা কি শুধু ফেসবুকে অথেনটিক বা প্রায়শঃ ফেক ছবি আপলোড করে শেয়ার, উস্কানীমুলক বক্তব্য প্রদান আর আমীন বর্ষণ ছাড়া আর কিছু করতে পেরেছি?


সব ধরণের নেতিবাচক প্রভাবের ঝুঁকি নিয়েও সম্পূর্ণ মানবিক কারণে বাংলাদেশ বিপন্ন মানুষকে গ্রহণ করে চলেছে। কিন্তু এর সাথে যখন ধর্মের লেবেল সেটে দিয়ে একটি এথনিক মাইনরিটি জাতিগোষ্টিকে নিশ্চিহ্ন বা বিতাড়িত করার নৃসংশতাকে ধর্মের বিরুদ্ধে ধর্মের আগ্রাসন হিসেবে প্রচার করে এদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মাঝে আতংক ছড়ানোর চেষ্টা করা হয় তখন দেশের সকল সচেতন নাগরিকের মাঝেই সে আতংক ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য।
এবার দেখা যাক যারা এই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার নেপথ্যে কাজ করছে তারা কারা। এ পর্যায়ে প্রথমেই আসে পাকিস্তানের নাম। তিরিশ লক্ষ মানুষের রক্তের দাগ শরীরে নিয়ে যারা অন্য আরেকটি দেশের গণহত্যার বিরুদ্ধে লাফালাফি করে তাকে প্রহসন ছাড়া আর কী বলা যায়। একাত্তরের ভূমিকার জন্য পাকিস্তান রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমা প্রার্থনা না করা পর্যন্ত মানবতার স্বপক্ষে তাদের কোনো ভূমিকাকেই আমরা অকপট নিঃসার্থ এবং নিঃশর্ত ভাবতে্ তো পারিইনা বরং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তাদেরকে আমরা ঘৃণা করে যাব। ধিক্কার জানিয়ে যাব। পাকিস্তান রোহিঙ্গা-আগুনে যতই তেল ঢালার চেষ্টা করুকনা কেন আমরা মিয়ানমারের মিলিটারিদের বর্বর মুখগুলির মাঝে একাত্তরের পাকিস্তানীদের মুখগুলিই দেখতে পাব এতে তাদের প্রতি আমাদের ঘৃণার মাত্রা বাড়তেই থাকবে। অবশ্য আরসাকে উস্কানী দিয়ে পাকিস্তান এই অঞ্চলে অস্থিরতা সৃষ্টির যে পরিকল্পনা করেছিল সে লক্ষ্যে তারা পুরোপুরি সফল হয়েছে কেননা কয়েক লক্ষ মিয়ানমার নাগরিক এখন জনসংখ্যার ভারে ডুবো ডুবো দেশটির ঘাড়ে এসে চেপে বসেছে। এতে একদিকে বাংলাদেশ চরমভাবে আর্থিক চাপে পড়বে যা পাকিস্তান সব সময়ই কামনা করে থাকে অন্যদিকে দুর্বৃত্ত চরিত্রের রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে পাকিস্তানীদের নিজ দেশের সন্ত্রাসবাদ বাংলাদেশে রফতানী করার নতুন একটি রুটও তারা পেয়ে গেল। ইতোমধ্যে পাকিস্তানীরা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছে। এই ঘোষণা আমাদের যুব সমাজের ইমোশনকে জঙ্গিবাদের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তুলতে পারে। অনেকেই নতুন করে জঙ্গিবাদের প্রতি ঝুঁকে পড়তে পারে।

এরপরে আসে তুরস্কের নাম। গণহত্যার দিক দিয়ে তুরস্ক হলো পাকিস্তানের আদর্শিক বড়ভাই। তুরস্কের ফার্স্টলেডি ঝটিকা সফরে এসে যেমন চমক দেখিয়েছেন তেমনি রোহিঙ্গাদের কষ্ট দেখে তার অশ্রুপাত সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। পক্ষে বিপক্ষে অসংখ্য মন্তব্য পড়েছে। কারা পক্ষে বলেছেন কারা বিপক্ষে বলেছেন তারা কোন কোন তরিকার লোক তা তাদের মন্তব্যেই প্রকাশ পেয়েছে সুতরাং আমি এ প্রসঙ্গে যাবনা। যেকোনো কান্নার দৃশ্যই আমাদের চিত্তকে নাড়া দেয়। সিনেমা নাটকে স্রেফ অভিনয় জেনেও নায়ক নায়িকার চোখের অশ্রু সবার মাঝেই সংক্রামিত হয়ে যায় মিসেস এরদোগানের কান্নাও তেমনি। কিন্তু তুরস্কের বর্তমান বা অতীত ইতিহাসের দিকে একটু নজর দিলে এ কান্নাকে বিপন্ন মানবতার প্রতি তার হৃদয় নিংড়ানো অশ্রুপাত ভাবাটা কষ্টকর হয়ে পড়ে। কেননা এখনও তুরস্কের সেনাবাহিনী কূর্দিদের বিরুদ্ধে যে নিষ্টুরতা দেখাচ্ছে তা রোহিঙ্গা নির্যাতনের চেয়ে কম নয়।


মিসেস এরদোগানের কান্না

১৯২৩ সালে তুর্কি রিপাবলিক প্রতিষ্টা হওয়ার পর থেকে কুর্দিদের বিরুদ্ধে তুরস্ক যে গণহত্যার সূত্রপাত করেছিল পর্যায়ে পর্যায়ে সে গণহত্যা আজও চলছে। আজও রোহিঙ্গাদের মতো কুর্দিরা নিহত হচ্ছেন স্বজন হারাচ্ছেন ভিটে মাটি থেকে চ্যুৎ হচ্ছেন সেই চলমান গণহত্যার সমকালীন নায়কের সহধর্মিনী আরেক গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গাদের কষ্ট নিজ চোখে দেখার জন্য যখন বাংলাদেশ ছুটে আসেন তখন সেটাকে মানবতা প্রসূত ভাবাটা অসম্ভব হয়ে পড়ে।


ধারাবাহিক কুর্দি গণহত্যার একটি দৃশ্য

শুধু কূর্দি গণহত্যা নয় তূর্কিদের কাধে আছে আর্মেনিয়ান গণহত্যা গ্রীক গণহত্যার দায়ভারও। আর্মেনিয়ান গণহত্যায় ১৫ লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছিলেন বলে দাবি করা হয়। আর্মেনিয়ানরা গণহত্যার স্বীকৃতির জন্য আজও লড়ে যাচ্ছেন। বিশ্বের আটাশটি দেশ ইতোমধ্যে অফিসিয়েলি আর্মেনিয়ান গণহত্যাকে স্বীকৃতি দিয়েছে আন অফিসিয়েলদের মাঝে এশিয়ার সিরিয়া এবং ইরানও রয়েছে। তুরস্ক নিজে শুধু একাধিক গণহত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি তার ঘনিষ্ট মিত্র পাকিস্তানীদের গণহত্যার স্বপক্ষেও তারা স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে। আমাদের দেশে যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয় তুরস্ক তা বন্ধের জন্য নানা ভাবে চাপ প্রয়োগ করেছে প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে অনেক তৎপরতা দেখিয়েছে। আমাদের দেশের দুর্বল ইমিগ্রেসনের সুযোগ নিয়ে একদল তুর্কি ডানপন্থী দেশে প্রবেশ করে কারারুদ্ধ কয়েকজন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর সাথে সাক্ষাৎ পর্যন্ত করে গেছে। কাদির মোল্লার ফাঁসির পর তুরস্কের পার্লামেন্টে নিন্দা প্রস্তাব আনা হয় এমনকি কাদের মোল্লার নামে একটা রাস্তারও নাকি নামকরণ করে ফেলেছে। সে সময় তুরস্কের সাথে দর কষাকষির ভাল সুযোগ বাংলাদেশ হাতছাড়া করেছে। আমাদের সরকার তুরস্ককে বলতে পারত তোমরা আমাদের গণহত্যাকে স্বীকৃতি দাও নইলে আমরাও সিরিয়া বা ইরানের মতো আর্মেনিয়ান গণহত্যার স্বীকৃতি দিয়ে দেব। এতে কিছুটা হলেও এরদোগানের টনক নড়ত।


কয়েক লক্ষ আর্মেনিয়ানকে মৃত্যুকুপে ঠেলে দেয়ার পূর্বে অনেককে এভাবেই প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়

পাকিস্তান আর তুরস্কের মতো দুই গণহত্যাকারী জাতীর পরে দেশের অভ্যন্তরে যে গোষ্টিটি রোহিঙ্গা নিপীড়নকে ধর্মীয় নিপীড়নের রং দিয়ে চলেছে প্রতি শুক্রবার জুম্মা উত্তর জঙ্গি মিছিল করে দেশের সরল ধর্মপ্রাণ মানুষের মাঝে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছে তাদেরকেও আমরা চিনি এবং তাদের কর্মকান্ড অভিনব কিছু নয় কেননা এরা চিরকাল পাকিস্তান তুরস্কের প্রয়োজনই সার্ভ করে এসেছে। জন্মসূত্রে বাঙ্গালী হলেও এরা মনেপ্রাণে বাঙ্গালী বা বাংলাদেশের বিরুদ্ধ শিবিরের লোক। এরা কোনোদিন বাংলাদেশের কল্যাণ চায়নি আজও চায়না। একাত্তরেও এরা একইভাবে ইসলাম রক্ষার নামে সমাবেশ করেছে মুক্তিবাহিনীকে কাফের ফতোয়া দিয়ে তাদেরকে হত্যার ঘোষণা দিয়েছে। পাক হানাদারদের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে।
পাকিস্তান তুরস্ক এবং আমাদের দেশের উগ্র ধর্মীয় মতবাদী আলিম সম্প্রদায় এই ত্রয়ীর উল্লম্পন যখন একসূত্রে একপথে এসে মিলে যায় তখনই বুঝতে হবে ‘ডালমে কুচ কালা হে’ অর্থাৎ এ অঞ্চলে নতুন আরেকটি ষঢ়যন্ত্রের ক্ষেত্র উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য হিসেবে কুখ্যাত পাকিস্তান তার ঘনিষ্টতম পেট্রন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক সন্ত্রাসের লালনকারী হিসেবে ঘোষিত হওয়ার পর নিজেদের মুখ রক্ষার জন্য হলেও কিছুটা টাইট দেয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছে কিন্তু এত দিনের সাধনা এত কামনা বাসনাতো শূন্যে মিলিয়ে যেতে পারেনা এগুলি ছড়িয়ে দিতে আরেকটি আদর্শ ব্রিডিং গ্রাউন্ড প্রয়োজন। তাদের এই পরিকল্পনায় নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায় মূল লক্ষ্য নয়, লক্ষ্য এই ইস্যুকে দীর্ঘায়িত করে এই অঞ্চলে তাদের ঘাটিকে সুসংহত করা। মিয়ানমারের সেনা সমর্থিত ঘাতক সরকারও সম্ভবত এরকমটিই চাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের পিঠে কোনো রকমে ইসলামী টেররিস্ট এর লেবেলটি একবার লাগিয়ে দিতে পারলে পৃথিবীর সমর্থন তাদের সপক্ষেই যাবে কেননা ঘৃণার দিক দিয়ে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের কাছে হিটলার আর আই এস তথা ইসলামী সন্ত্রাসীগোষ্টি সম্ভবত এক নম্বর দুই নম্বরে। রোহিঙ্গা সমস্যাকে ইসলামায়িত করার আরেক অর্থ বাংলাদেশ যত দুর্বহই মনে করুকনা কেন মিয়ানমারে অবস্থানকারী বাদবাকি সকল রোহিঙ্গাকেই পর্যায়ক্রমে গ্রহণ করে নিতে হবে অর্থাৎ বাঙ্গালী জাতিস্বত্তার সাথে মিলে মিশে রোহিঙ্গা নামক জাতি গোষ্টির নিজস্ব পরিচয় পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এর সাথে বাংলাদেশের অনেকগুলি ক্ষুদ্র নৃগোষ্টির নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আশংকাও মাথায় রাখতে হবে। এর বিভিন্ন আলামত কিন্তু ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
—————-

তথ্যসূত্রঃ- ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ এর অংশ বিশেষ নেয়া হয়েছে The New York Times on the web থেকে। মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণের অংশ বিশেষ ১৯৭১ সালে Ministry of external affairs, New Delhi থেকে প্রকাশিত Refugees are International Responsibility নামক পাম্পলেট থেকে নেয়া হয়েছে।