লিখেছেন: ফাহিম আহমেদ

ছয় বছর পূর্বে সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি বাশার-আল-আসাদের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণের যে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচি শুরু হয়েছিল তা পরবর্তীতে একটি গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়ার মধ্য দিয়ে ৩ লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি সিরিয়াব্যাপী ধ্বংসযজ্ঞ ও বিদেশী শক্তির হস্তক্ষেপের সূচনা করেছে। এক্ষেত্রে কিছু প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান আবশ্যক। কিভাবে যুদ্ধটি শুরু হলো? ২০০০ সালে বাশার-আল-আসাদ ক্ষমতায় আসার অব্যবহতি পর সিরিয়ার সাধারণ জনগণ বেকারত্ব, দুর্নীতি, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। ২০১১ সালে আরব বসন্তের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সিরিয়ার দক্ষিণের দিরা শহরে গণতন্ত্রের পক্ষে জনগণের বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু হয়। এ বিক্ষোভ দমনে সরকারের দমন-পীড়নের ফলে সারাদেশে রাষ্ট্রপতি আসাদের পদত্যাগের দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু হয় যা পরবর্তীতে সরকার বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দমন-পীড়নের প্রতিবাদে সরকারবিরোধীরা প্রথমে অস্র হাতে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং পরবর্তীতে সরকার বিরোধী সশস্র সংগ্রাম শুরু করে। রাষ্ট্রপতি আসাদ এ আন্দোলনকে “বিদেশী মদদের জঙ্গি তৎপরতা” হিসেবে আখ্যা দিয়ে তা দমন করার শপথ নেন। পরবর্তীতে বিদ্রোহীরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে সশস্র ব্রিগেড গঠন করতে শুরু করলে সিরিয়ায় দ্রুত গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে।

কেন এ যুদ্ধ এখনও চলমান? বর্তমান সময়ে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ সরকারপন্থী ও সরকারবিরোধীদের মাঝে দ্বন্দের চেয়েও বড় কিছু হয়ে দাড়িয়েছে। এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিভিন্ন শক্তি যেমন- ইরান, রাশিয়া, সৌদি আরব, তুরস্ক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ। এসকল দেশ কর্তৃক প্রদত্ত সিরিয়ার সরকার ও বিদ্রোহীদের সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহায়তা এ গৃহযুদ্ধটিকে আরো বেশি তীব্র ও দীর্ঘ করার মাধ্যমে সিরিয়াকে একটি প্রক্সি যুদ্ধের ক্ষেত্রে পরিণত করেছে। বহিঃশক্তিগুলো সিরিয়ায় নানাভাবে সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দেয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি আসাদের শিয়া সমর্থিত বাহিনী ও সুন্নি বিদ্রোহীদের পরস্পর বিরোধী অবস্থানে নিয়ে এসেছে। এ বিভাজনের ফলে উভয়পক্ষই নৃশংসতার মাধ্যমে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ওপর অন্যায় অত্যাচারের মধ্যমে রাজনৈতিক সমঝোতার পথ রুদ্ধ করে চলেছে। ইসলামিক স্টেটসহ অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠিগুলোও এ যুদ্ধটিকে একটি নতুন মাত্রা দিয়েছে। সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমের ইদলিব প্রদেশের একটি বড় অংশ আল-কায়দা সমর্থিত আল-নুসরা নামক জঙ্গি গোষ্ঠি দখলে নিয়েছে। অন্যদিকে উত্তর ও পূর্ব সিরিয়া দখলকৃত আইএসের সাথে যুদ্ধ করছে সরকার বিরোধী বিদ্রোহী, কুর্দি মিলিশিয়া, রুশ এবং মার্কিন সমর্থিত বহুজাতিক জোট। ইরান, লেবানান, ইরাক, আফগানিস্তান ও ইয়েমনের শিয়া মিলিশিয়ারা সিরিয় সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে বিভিন্ন পবিত্র ও ঐতিহাসিক শহর রক্ষায় যুদ্ধ করে চলেছে।

কেন বিভিন্ন বহিঃশক্তি এ যুদ্ধে যোগ দিল? রাষ্ট্রপতি আসাদকে সমর্থন দিয়ে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে সিরিয়ায় আসাদ বাহিনীর বেশ কিছু হারের পর এ যুদ্ধে তার সরকারকে স্থিতিশীল করার লক্ষে রাশিয়া সিরিয়ায় জঙ্গি দমনে বিমান হামলা শুরু করে। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সূত্র থেকে জানা যায় রুশ হামলার মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল পশ্চিমা সমর্থিত সুন্নি বিদ্রোহীদের ব্রিগেডগুলো। ২০১৬ সালের মার্চে যুদ্ধের গতি পুনরায় আসাদের দিকে ফিরিয়ে আনার পর রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন সিরিয়ায় রাশিয়ান বাহিনীর প্রধান অংশকে ফিরে আসতে বলেন এবং সিরিয়ায় তাদের প্রধান লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে বলে ঘোষণা দেন। রাশিয়ান বিমান বাহিনীর এ সহায়তায় সিরিয়ার সরকারি বাহিনী ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে পূর্ব আলেপ্পো বিদ্রোহীদের কাছ থেকে দখলে সমর্থ হয়। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় শিয়াপ্রধান ইরান আসাদকে সমর্থন করে এ যুদ্ধে কয়েক বিলিয়ন ডলার ব্যয় করার পাশাপাশি তাকে সামরিক সহায়তা, অস্র ও তেল ক্রয়ে ভর্তুকি দিয়ে চলেছে। আরবে রাষ্ট্রপতি আসাদ ইরানের প্রধান মিত্র এবং সিরিয়া হলো ইরান থেকে লেবাননের ইসলামি বিদ্রোহী গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর জন্য প্রেরিত অস্রের শিপমেন্টের প্রধান ট্রানজিট রুট। একারণে আসাদের পক্ষে হাজারো হিজবুল্লাহ বিদ্রোহীও যোগ দিয়েছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে রাসায়নিক অস্রের ব্যবহারের জন্য আসাদকে দায়ী করলেও যুক্তরাষ্ট্র স্থানীয় সুন্নি বিদ্রোহীদের খুবই সীমিত পরিমান সামরিক সহায়তা দিয়েছে এই ভয়ে যে তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্র আইএস জঙ্গিদের হাতে চলে যেতে পারে। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে মার্কিন সমর্থিত যৌথ বাহিনী ইরাক ও সিরিয়ার আইএস দখলকৃত এলাকাগুলোতে ১১ হাজার ২০০ বার বিমান হামলা পরিচালনা করেছে। সুন্নি প্রধান সৌদি আরব সিরিয়ায় ইরানের প্রভাব হ্রাসের লক্ষ্যে আসাদ বিরোধীদের সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান করে চলেছে। তুরস্ক সুন্নি বিদ্রোহীদের আরেকটি সমর্থক। মার্কিন সমর্থিত Syrian Democratic Forces (SDF) এর সহযোগী হিসেবে Kurdish Popular Protection Unit (YPG) আইএস এর সাথে যুদ্ধ করছে।

আলেপ্পোর উমায়াদ মসজিদ; ২০১০ ও ২০১৬তে

এ যুদ্ধের প্রভাব কী? জাতিসংঘের তথ্য মতে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে গত ৫ বছরে ২ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তবে ২০১৫ সালের আগস্টের পর সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ বিষয়ক জাতিসংঘের প্রতিবেদনটি আর নবায়ন করা হয়নি। Syrian Observatory for Human Rights (একটি যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা) এর তথ্য মতে, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে ৩ লক্ষ ২১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দ্যা গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে এ সংখ্যা ৪ লক্ষ ৭০ হাজার বলে দাবি করে। জাতিসংঘের তথ্য মতে, ৫০ লক্ষ মানুষ এ যুদ্ধের কারণে সিরিয়া ত্যাগ করেছে। প্রতিবেশি দেশ লেবানান, জর্ডান ও তুরস্ককে উদ্বাস্তুদের এ ঢল সামলাতে বেগ পেতে হচ্ছে। সিরিয়ার মোট জনসংখ্যার ১০% ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া ৬০ লক্ষাধিক সিরিয় নিজ দেশের অভ্যন্তরেই বাস্তুচ্যুত অবস্থায় আছে। জাতিসংঘের তথ্য মতে সিরিয়ার যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ১ কোটি ৩৫ লক্ষ মানুষকে মানবিক সহায়তা দিতে ৩.৪ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। সিরিয়ার দুই-তৃতীয়াংশ জনগণ বর্তমানে দারিদ্র সীমার নিচে বাস করে। ১ কোটি ২৮ লক্ষ সিরিয়বাসীর চিকিৎসা-সেবা প্রয়োজন। ১৭ লক্ষাধিক সিরিয় শিশু স্কুলে যেতে পারছে না।

এ সংঘাত নিরসনে কী করা হচ্ছে? জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এ সংঘাত নিরসনে ২০১২ সালের Geneva Communique বাস্তবায়ের পক্ষে মত দিয়েছে যেখানে “পারস্পারিক সমঝোতার ভিত্তিতে” একটি অন্তবর্তী সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছে। ২০১৪ সালে Geneva II নামক শান্তি আলোচনা মাত্র দুই রাউন্ড পরই বন্ধ হয়ে যায় যেখানে জাতিসংঘ সিরিয়ার সরকারকে বিদ্রোহীদের দাবি নিয়ে আলোচনা করতে অনিচ্ছুক বলে অভিযোগ করে। পরবর্তী বছর আইএস এর সাথে সংঘাতের ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া নিজেদের প্রতিনিধিদের জেনেভায় মিলিত হয়ে “Proximity Talks” এ অংশগ্রহণের জন্য সম্মত হয় যা দ্বারা যুদ্ধ বিরতি ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের আলোচনা শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এ আলোচনাও প্রথম রাউন্ডে স্থগিত করা হয় যখন সিরিয়ার সরকারি বাহিনী আলেপ্পো আক্রোমণ করে। তুরস্ক ও রাশিয়া আরেকটি যুদ্ধবিরতি বিষয়ক আলোচনার লক্ষ্যে পরবর্তীতে কাজ শুরু করে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে রাশিয়া, তুরস্ক ও কাজাখস্তানের আয়োজনে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের পর প্রথমবারের মত সরকারি ও বিদ্রোহী বাহিনী মুখোমুখি বৈঠকে অংশ নেয়। পরবর্তীতে জাতিসংঘের মধ্যস্ততায় জেনেভাতে নতুন আলোচনা শুরু হয় যা জাতিসংঘের সিরিয়া বিষয়ক প্রতিনিধি স্টেফান ডে মিস্তুরার মতে, “এমন কিছু অর্জন করেছে যা মানুষ চিন্তাও করতে পারে নি যে আমরা পারবো।” সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ হলো প্রাকৃতিক সম্পদ, ধর্ম ও অর্থসম্পর্কিত একটি কৌশলগত ভূরাজনৈতিক সংকট এবং রাসায়নিক অস্রের ব্যবহারের বিষয়টি এই ভূরাজনৈতিক স্বার্থের তুলনা খুবই নগণ্য। সিরিয়ায় হস্তক্ষেপের পেছনে মার্কিন-যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার বিপরীতমুখী কারণটি হলো রাষ্ট্রপতি আসাদের ক্ষমতায় থাকা না থাকা। তবে সিরিয়ায় পুনরায় শান্তি প্রতিষ্ঠার আলোচনায় প্রেসিডেন্ট আসাদের উপস্থিতি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।