লেখক: পিপেল দাস
অভিজিৎ রায় কে আমি চিনতাম না। তিনি কি বিষয় নিয়ে লেখা-লিখি করেন তাও জানতাম না। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি যখন তিনি কিছু পাষন্ড বর্বর বিপথগামী অমানুষ দ্বারা খুন হন আমি সেদিনই প্রথম তার নাম জানতে পারি।

জানতে আগ্রহ জাগলো কে তিনি? কি নিয়ে লিখেন? কেন লিখেন? জানলাম ধর্মের বিরুদ্ধে তিনি লিখেন, আরও জানলাম ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে লিখেন। ভাবলাম কেন শুধু শুধু ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে লিখতে গেলেন, মাঝখানে প্রানটা খোয়ালেন। মনে হলো যারা খুন করলো এদের বিচার হওয়া উচিত কিন্তু উনার কি দরকার ছিল এসব লিখার, একদম উচিত হয়নি তাঁর।

আমি এখানেই থেমে যেতে পারতাম। কত শত কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যেতে পারতাম। না আমি থামিনি, মনে হলো কী লিখেন তিনি, আমি জানবো, আমি পড়বো। এখন টেকনোলজির যুগ, সবকিছুই উন্মুক্ত। খুঁজতে থাকলাম। হার্ডবই পাইনি কিন্তু পিডিএফ খুঁজে বের করলাম তার প্রতিটি বই, “আলো হাতে চলিয়াছে আধারের যাত্রী”, “শুন্য থেকে মহাবিশ্ব”, “ভালবাসা কারে কয়”, “সমকামিতা”, “বিশ্বাসের ভাইরাস” এক একটা গুপ্তধন। মনোযোগ দিয়ে সব পড়লাম। জানলাম, বুঝলাম, শিখলাম।

তার প্রতিটা লেখা চিন্তার নতুন দিক উন্মোচিত করে। ভাবনার জগতে বার বার আঘাত করে মানবতার দ্বার অবারিত করে। তিনি যা লিখতেন সত্য লিখতেন। বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমানিত প্রতিটি বিষয়কে সহজ করে লিখতেন। মানবতার কথা লিখতেন। অযৌক্তিক বিশ্বাসের বিরুদ্ধে লিখতেন। মহাবিশ্বের উৎপত্তি, সৃষ্টি, গঠন, জীবজগৎ এর বিবর্তন নিয়ে লিখতেন। ধর্মের অপব্যাখ্যার সুন্দর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করতেন। এতটা তথ্যবহুল লেখা আমি খুব কমই পড়েছি। প্রচলিত মতবাদের সাথে যা মিলতো না। ধার্মিক নামের একশ্রেনীর বর্বর ধর্ষকদের সাথে মিলতো না। তাই তাকে বলা হলো ধর্মের বিরুদ্ধে লেখেন। এই অভিযোগে খুন করা হলো একে একে নীলয় নীল সহ আরও অনেককে। তার কোন লেখা ভুল প্রমান করার সাধ্য কারো ছিল না। যেটা সাধ্য ছিল সেটাই করে দেখাল খুনীরা।

প্রতিটা বই পড়ে আমার শুধু একটা কথাই মনে হলো এত সহজ সুন্দর প্রাঞ্জল করে লেখা তার প্রতিটা বই এক একটা গবেষনা পত্র। এতোটা মেধাবী লোক যদি এই সমাজ, সরকার রক্ষা করতে না পারে তাহলেতো এটা দেশের বিরাট ক্ষতি, এই বিশ্বের ক্ষতি। এসব মেধাবী সন্তানেরাইতো দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এ এক দারুন অপচয়। আমরা বঞ্চিত হলাম অনেক কিছু থেকে।

শুধু একটা কথাই বলবো আমি বদলে গেছি। অন্তত ধর্মের গোঁড়ামো, ভণ্ডামো থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলতে পেরেছি। তার পুরো কৃতিত্ব অভিজিৎ রায়ের। এমন শত সহস্র তরুন যুবকদের কাছে অভিজিতরা সবসময় আদর্শ হয়ে থাকবে। ধর্ম কখনো মানবতার কথা বলে না এই সহজ সত্যটুকু আমরা যতদিন না বুঝতে পারবো ততদিন ধর্মের নামে খুন, নির্যাতন আর ভণ্ডামো চলতেই থাকবে।

হয়তো অভিজিৎ নেই, খুনীরা হয়তো ভেবেছে অভিজিৎ নেই তো সত্য বলা থেমে গেল, বর্বরতার বিরুদ্ধে মানবতার সংগ্রাম কখনো থেমে যাবে না। খুনীরা কি একবারো ভাবলো না এই অভিজিতের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে লক্ষ লক্ষ অভিজিৎ সৃষ্টির প্রেক্ষাপট তৈরী হয়ে গেলো।

শেষে শুধু একটা কথাই বলবো, অভিজিৎরা কখনো মরে না, অভিজিৎদের মেরে ফেলা সম্ভব না, এক অভিজিৎ এর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কত শত অভিজিৎ এর জন্মের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়ে গেল সেটা হয়তো ধর্মান্ধ খুনীরা জানেনা। এখন শুধু দেখার বিষয় এটাই যে, কত মৃত্যু আর কত রক্তের বিনিময়ে ধর্মের বর্বরতা থেকে আমরা আমাদের আকাঙ্ক্ষিত সভ্যতা পেতে পারি।

জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা।