জানো, ২৬ শে ফেব্রুয়ারিতে অনেক খারাপ লাগলেও আমি সেটা নিতে পারি, কিন্তু এই সেপ্টেম্বর মাসটা এখনো নিতে পারি না। ১২ তারিখে তোমার জন্মদিন, দু’দিন পরেই তৃষার। এই তিনদিনে বোধ হয় আমাদের বাসায় সর্বোচ্চ উৎসবের বন্যা বয়ে যেত – আর আমার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠত একবার তৃষার সাথে মিলে তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে আবার ওদিকে তোমার সাথে মিলে তৃষাকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে। তার উপরে আবার ছিল তোমার সেই দাবি, যতই উপহার দেই না দেই, যত এক্সটিক জায়গায় খেতে নিয়ে যাই না যাই, একটা ‘অরিজিনাল’ বড় চিঠি লিখতেই হবে তোমাকে। এই সপ্তাহে অফিস থেকে কয়েক ঘণ্টা তোমার টেক্সটের উত্তর না দিলেই বলতে, ‘কি, উধাও কেন? জানি, চিঠি লিখছ।’

এরপরে চিঠি না লিখে আর উপায় কী?

২০১৫ সালের ২৬ শে ফেব্রুয়ারির পরে মনে হতো আমার ‘আমিটার’ সব অংশগুলো দুমড়ে মুচড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে চারদিকে – চোখের পলকে যেন চেনা কক্ষপথ থেকে ছিটকে পড়ে গেলাম টুকরো টুকরো হয়ে। জানতাম বেঁচে থাকলে আস্তে আস্তে সেই টুকরোগুলো আবার কুড়িয়ে এনে এক করতে হবে, নিজেকে আবার ‘এক’ হতে হবে। জানোইতো আমি কেমন সবকিছু ভিজুয়ালি ভাবি। কতদিনই না ভোর হয়ে গেছে, সারা ঘর জুড়ে জ্বালানো মোমবাতিগুলো নিঃশেষ হয়ে এসেছে, আমাদের প্রিয় গানগুলো শুনতে শুনতে। কখনো বা স্থাণু হয়ে, কখনোবা অন্তহীন পায়চারি করতে করতে ভেবেছি, ‘আমি কি আমার আগের সব টুকরোগুলোকে ফেরত চাই নাকি এবার অনেক বুঝেশুনে শুধু পছন্দের টুকরোগুলোই ফেরত নেব?’ হাম্পটি ডাম্পটি হয়তো শুধুই বাচ্চাদের একটা ছড়া নয়, ওর টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পড়ার এলিগরিটা হয়তো অনেক গভীর কোন অর্থ বহন করে। এই ছোট্ট জীবনটা তো কতবারই নতুন করে শুরু করতে হলো – এবারেরটা না হয় হোক এক্কেবারে নতুন এবং সচেতন কোন পথে হাঁটা – ‘ভবের নাটে নতুন লোকে নতুন খেলা’। নিজেকে আবার নতুন করে জোড়া লাগাতে গিয়েই নতুন করে আবার দর্শনের শরণাপন্ন হলাম।

মনে আছে আমি বলতাম যে আমার সেই ছোটবেলায় নাস্তিক হওয়ার পিছনে বিজ্ঞানের চেয়ে দর্শন, ইতিহাস এবং সমাজতত্ত্বের ভূমিকা অনেক বেশি ছিল? আবারো তাদের কাছেই আশ্রয় নিলাম। বিজ্ঞান বল, নাস্তিকতা বল – এগুলো সবই আমার জীবনদর্শনের একটা ছোট অংশ; মেটাফিজিক্স, ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি ছাড়া এর কোনটারই অর্থ সম্পূর্ণ হয় না আমার কাছে। এ নিয়েও তো কতই না কথা হয়েছে আমাদের।

আত্ন কী? চেতনা কী? আমাদের বৌদ্ধিক জগতের সাথে বস্তুজগতের সম্পর্ক কী? আমাদের দুঃখ কষ্টগুলো কি নিজের চেতনা থেকে আলাদা করে ফেলা যায়? এই চির আমিত্ব থেকে মুক্তির কি কোনই উপায় নেই? তবে বুদ্ধ এবং এপিকিউরাসের ‘নেগেটিভ হ্যাপিনেসের’ ব্যাপারটার সাথে আমি কতোটা একমত সেটা নিয়ে এখনো কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারিনি। উপনিষদের ‘আত্ম’-র ধারণার সাথে আমি কখনোই একমত ছিলাম না, তুমিও হতে না। তবে বৌদ্ধিক রীতিতে ‘আত্ম’র সার্বিক প্রত্যাখ্যানটাও আমার সঠিক মনে হয় না।

কত ফান্ডামেন্টাল প্রশ্নের উত্তরই আমরা এখনো জানি না! চেতনার উৎপত্তির ব্যাপারটাই এখনো আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। ইমেরজেন্স কিভাবে কমনসেন্সের সব নিয়ম ভেঙ্গে একটা অংশকে তার সম্পূর্ণসত্তা থেকে বড় করে তুলতে পারে! আমাদের চেনা বস্তুজগতটা কোয়ান্টাম জগতে গিয়ে কেন ভেঙে পড়ে? পিথাগোরাসই কি ঠিক – সত্য কি আসলেই ‘মানবসত্তার নির্ভরতামুক্ত’, আমাদের সজ্ঞানতার উপর নির্ভরশীল নয়? নাকি সত্য আসলে মানবসত্তা নির্ভর এবং সেজন্যেই সময়ের সাথে, সম্মিলিত মানবসত্তার বিবর্তনের সাথে সাথে বদলে যায়, পালটাতে থাকে সত্যের সংজ্ঞাও। বিশ্বপ্রকৃতির চরম উদাসীনতার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের এই ক্ষণিকের অস্তিত্বের সুখ, দুঃখ, কষ্ট, হীনতা, স্বার্থের নিত্য টানাপোড়েন কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? আমি যেন সব কিছুতে, সর্বক্ষণ এই ডাইকটমি দেখি, এই ফান্ডামেন্টাল দ্বৈত কি সবকিছুর মধ্যেই বিদ্যমান?

অনেক ভেবে দেখলাম যে তুমি আমার চেয়ে হয়তো অনেক বেশি স্টোয়িক ছিলে, আমি তোমার থেকে অনেক বেশি এপিকিউরিয়ান। আমি সমাজ থেকে মানুষ থেকে দূরে গিয়ে, চরম প্রাইভেসির বেড়াজালে বন্দী হয়ে এপিকিউরাসের বাগান গড়তে চেয়েছি, আর তুমি সব সময় মানুষের মধ্যে থেকে গড়তে চেয়েছিলে এপিকিউরাসের সেই বাগান। তোমার মধ্যে স্টোয়িক আর এপিকিউরাসের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ ছিল।

আজকের পৃথিবীটা অদ্ভুত এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। আসলে ইতিহাসের কন্টেক্সটে ভাবলে তেমন অদ্ভুতও নয় হয়তো। আমাদের ইতিহাস তো কখনোই সরলরেখায় আগায়নি, এভাবে হোঁচট খেতে খেতে, সামনে পিছনে করেই তো এগিয়েছে সবসময়। কখনো এগিয়েছে আবার কখনো পিছিয়েছে। তবে আজকাল মনে হয়, আমরা ইতিহাসের এক বিশেষ সময় পার করছি – ব্রেক্সিট, ট্রাম্প, ইসলামিক মৌলবাদ, হিন্দু এমনকি বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ, সাদা জাতীয়তাবাদ, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, পৃথিবী জুড়ে চরম বৈষম্য – সব মিলিয়ে কেমন যেন একটা অস্থির সময়। হয়তো সব প্রজন্মই তাদের সময়টাকে ভয়াবহ ভেবে আঁতকে উঠেছে, আমিও হয়তো তার ব্যতিক্রম নই। পিঙ্কারের মত করে মানব ইতিহাসে ‘ভায়োলেন্স’ কমেছে ভাবতে পারলেও হয়তো শান্তি লাগতো। তবে আমাদের এই ইন্টেরেস্টিং সময়টা আমাদের প্রজাতির ইতিহাসের আলোকে সার্বিকভাবে বুঝতে পারলে খুব ভালো লাগতো। হয়তো সেটা করেই জীবনের এই ধার করা বাকি সময়টা কাটিয়ে দেওয়া যাবে।

দীপেনদা কবে যেন তোমাকে অভিজিৎ নক্ষত্রের সাথে তুলনা করে একটা লেখা লিখেছিল। এখন বারান্দায় বসলে টেক্সাসের বিস্তীর্ণ আকাশের উজ্জ্বল তারাগুলো দেখলেই ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ফুটে ওঠে আমার, মনে হয় তুমি আকাশ থেকে দেখছ ভাবতে পারলে ভালই লাগতো। হয়তো মনে হতো ‘…তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে’। এজন্যই মানুষ হয়তো এখনো এত মিথে বিশ্বাস করে। হয়তো আমরা সবাই সেই গ্রিক ট্র্যাজেডির নায়ক নায়িকা – ডায়োনিসাস আর এপোলোর সংঘাতের মাঝে বন্দী নিয়তির শিকারটুকু মাত্র।