কবি জীবনানন্দ দাশের প্রথম কবিতার বই “ঝরা পালক” বের হয় ১৯২৭ সালে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের মাসাধিক কালের মধ্যেই তিনি কলকাতা সিটি কলেজের কনিষ্ঠতম ইংরেজির শিক্ষকের পদ থেকে চাকুরীচ্যুত হোন। কবি জীবনানন্দ দাশের চাকুরী হারানোর প্রেক্ষিতটি বাংলাসংগীত বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীতের দিকপাল শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের ভাগ্যের শুভসূচনা নিয়ে আসে। এ দু’টি পারস্পরিক আনন্দ ও বেদনাময় ঘটনার পেছনে ছিল কলকাতা সিটি কলেজ, হিন্দুধর্মাবলম্বী ছাত্রদের সরস্বতী পূজার উদ্যোগ ও ব্রাহ্মসমাজ।

ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ব্যারিষ্টার আনন্দমোহন বসু ১৮৭৯ সালে কলকাতা সিটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এর প্রায় ১০ বছর আগে ১৮৬৯ সালে তিনি ও তাঁর স্ত্রী স্বর্ণপ্রভাদেবী ( যিনি স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর ভগ্নী) ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হোন। ব্যারিষ্টার আনন্দমোহন বসু কলকাতা সিটি কলেজের অনুরূপ নিজ জন্মস্থান ময়মনসিংহে প্রথমে ইস্কুল ও পরে আরেকটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন, যার নাম ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ।

যা হোক, কলেজ দু’টিতে কোনরূপ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু ১৯২৭ সালে কিছু হিন্দু ছাত্র সিটি কলেজে সরস্বতী পূজো করার উদ্যোগ গ্রহন করে; যা কলেজ কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দেননি সেক্যুলার সংবিধানের কথা বলে। আশ্চর্যভাবে দেখা যায়, তখনকার নেতা সুভাষ চন্দ্র বসু ছাত্রদেরকে ইন্ধন দান করেন কিন্তু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ছাত্রদের এ উদ্যোগের বিরোধীতা করেন।

কাকতালীয়ভাবে এ সময়কালেই ( ১৯২৫ সালে) শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীদের পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ প্রতিষ্টা হয়- যা আজকের ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)র মতো হিন্দুত্ববাদী দলগুলো সে নীতিকেই অনুসরণ করে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ও শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীরা হিন্দু ছাত্রদের সিটি কলেজ থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে গেলে সিটি কলেজে ছাত্রসংকট দেখা দেয়। এ সময়েই কবি জীবনানন্দ দাশের চাকুরী চলে যায় কলেজের আর্থিক সঙ্কটের জন্য।

কিশোরগঞ্জে জন্ম নেয়া দেবব্রত জর্জ বিশ্বাস তখন মেট্রিকুলেশন পাশ করে ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হয়েছেন। থাকতেন ব্রাহ্মসমাজ পল্লিতে তাঁর পিসির বাড়িতে। কলকাতা সিটি কলেজ থেকে হিন্দু ছাত্ররা চলে যাওয়ায় কলেজটিকে টিকিয়ে রাখতে তখন বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্রাহ্ম ছাত্রদেরকে নিয়ে এসে ভর্তি করানো হচ্ছিল। দেবব্রত বিশ্বাসকেও ময়মনসিংহের ব্রাহ্মসমাজের নেতারা কলকাতায় পাঠিয়ে দিলেন তখন। শুরু হলো দেবব্রত বিশ্বাসের কলকাতা জীবন।

আর কবি জীবনানন্দ দাশের জীবনে শুরু হলো চরম বেকারত্ব ও দারিদ্রতা। নিজে ব্রাহ্ম ঘরে জন্ম নিয়ে তিনিও এক প্রকার ব্রাত্য ঘোষিত হলেন। কলকাতা থেকে বাগেরহাটে এসেও টিকে থাকতে না পেরে দিল্লীর এক অখ্যাত কলেজে শুরু করলেন শিক্ষকতা। এদিকে বিয়ে করতে চলে এলেন ঢাকায় চাকুরী থেকে ছুটি না পেয়ে বিনা অনুমতিতেই। বিয়ে করলেন ব্রাহ্মসমাজে লাবণ্য দাশকে। কিন্তু কলেজের চাকুরীটা চলে গিয়ে আবার বেকার ও অর্থকষ্টে পড়লেন। এদিকে তাঁর প্রথাবিরোধী কবিতা নিয়ে প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচকদের বিদ্রুপবাণে জর্জরিত তিনি, অন্যদিকে চরম অর্থকষ্ট; সব মিলিয়ে এক দুঃসহ যন্ত্রণাতেই তিনি মৃত্যুবরণ মতান্তরে আত্মহত্যা করলেন ট্রামের নীচে পড়ে।

আর দেবব্রত বিশ্বাস তিনিও বিশাল প্রতিভা নিয়ে জন্মেও অনেকটা ব্রাত্যই রয়ে গেলেন।একদিকে নিজে ব্রাহ্ম ও কম্যুনিষ্ট, অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের সংগীতকে বিশ্বভারতীর একচ্ছত্র রক্ষণশীলতা থেকে সাধারণের কাছে পৌঁছে দেবার প্রচেষ্টা;দেবব্রত বিশ্বাসকে রুদ্ধ করে রেখে দিল বাঙালীদের চিরাচরিত অবিমৃষ্যতা ও উন্নাসিকতা।

রবীন্দ্রনাথের গানের গায়কী ও কয়েকটি গানের কথা ও সুর নিয়ে দ্বিমতের জন্য সংগীত শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের সা্থে বিশ্বভারতী সংগীত সমিতি্র দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছে ১৯৬৪ সালে। ফলে দেবব্রত বিশ্বাস রবীন্দ্রসংগীত গাওয়াই বন্ধ করে দেন এবং ১৯৭১ সালের পরে আর কোন রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড করেননি। কিন্তু পূর্ব্বংগের আঞ্চলিক ভাষায় এ নিয়ে তিনি একটি গান রেকর্ড করেন নিজের কথা ও সুরে।

“ক্যারে হেরা আমারে গাইতায় দিল না
আমি বুঝতাম পারলাম না
এই কথাডা তো ব্যাবাকের আছে জানা
জাইন্যা হুইন্যাও কেউ কিসু রাও করে না”

দেবব্রত বিশ্বাসের এ সকল ক্ষোভ লিপিবদ্ধ আছে তাঁর গ্রন্থ “ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত” আত্মজীবনীতে। এ বইটি রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীদের তো বটেই যাঁরা রবীন্দ্রনাথের গান ও রচনা ভালবাসেন সবার অবশ্য পাঠ্য।

দেবব্রত বিশ্বাসের নিজের কথাতেই-অভিমান নয়, আত্মসম্মানবোধেই তাঁর কন্ঠরোধ করে তাঁকে তাঁর অসংখ্য গুণমুগ্ধ শ্রোতাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য করেছিল – মিউজিক বোর্ডের dictatorship-এর সামনে তিনি মাথা নোয়াননি।

কিশোরগঞ্জে কৈশোরের দিনগুলিতে হিন্দু ছেলেদের কাছে ‘ম্লেচ্ছ’ বলে ব্রাত্য হওয়া থেকে শুরু হয়েছিল যে পথ চলা, দেশভাগের পর নিজ জন্মভূমে পরবাসী হয়ে এবং বিশ্বভারতীর দাক্ষিণ্যে আবার সেই ‘ম্লেচ্ছ’ (western-influenced) খেতাব পেয়ে মেইনস্ট্রীম গানের আসরে গলা ছেড়ে গান গাওয়ার অধিকারটিও খুইয়ে ‘আমার কথাটি ফুরলো, নটে গাছটি মুড়লো’র সঙ্গে সঙ্গে এই কেরানী-গায়ক-’ব্রাত্যজনের’ বৃত্তটি সম্পূর্ণ হয়”।

রবীন্দ্রসংগীতের অবিসংবাদী ও অসম্ভব জনপ্রিয় শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাস । তিনি গণনাট্য আন্দোলনেরও অন্যতম পুরোধাপুরুষ ও একজন বিখ্যাত গণসঙ্গীত শিল্পী। এই মানবতাবাদী শিল্পীর ১০৬তম জন্মদিন আজ ( ২২শে আগস্ট,২০১৭ )। তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।