(১)
গুগুল ইঞ্জিনিয়ার জেমস ডিমোরো (২৮) এখন আমেরিকার সংবাদ শিরোনামে। ছেলেটি হার্ভাডের মাস্টার্স। ২০১৩ সাল থেকে গুগলে সফটোয়ার ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কর্মরত। সপ্তাহ খানেক আগে সে দশ পাতার মেমো লেখে-যার মূল বক্তব্য কর্মস্থলে বৈচিত্রের ( ডাইভার্সিটি) আছিলায়, গুগলে মহিলা কর্মীদের বেশী সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে যোগ্য পুরুষকর্মীরা বঞ্চিত এবং ডিমটিভেটেড।

মুশকিল হচ্ছে মেমোটি ( যেটি আমি বেশ ধৈর্য্য নিয়ে পড়লাম -দশ পাতার গোছানো নোট) বেশ সুন্দর এবং যুক্তিপূর্ন ভাবে পান্ডিত্যব সহকারে লেখা। তাতে নরনারীর পার্থক্যের বৈজ্ঞানিক দিকটি তুলে ধরার চেষ্টা করেছে জেমস। কিন্ত শেষরক্ষা হয় নি। গুগল “নারী ইঞ্জিনিয়ারদের” স্টিরিওটাইপ করার জন্য সে চাকরি থেকে এই সপ্তাহে বহিস্কৃত হয়। এটা নিয়েই এখন তুলকালাম গোটা আমেরিকার মিডিয়াতে। রক্ষনশীল মিডিয়া বলছে গুগলের এই কাজ বেয়াইনী-কারন জেমস মোটেও ঘৃণাপূর্ন কিছু লেখে নি-সে বৈজ্ঞানিক সত্যকেই তুলে ধরেছে যে মেয়েরা ছেলেদের থেকে অঙ্ক এবং কোডিং এ পিছিয়ে। অন্যদিকে গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই এবং লিব্যারাল মিডিয়া বক্তব্য মেয়েদের এইভাবে স্টিরিওটাইপ করলে, তাকে কোম্পানী থেকে তাড়িয়ে দেওয়াই ঠিক।

সিলিকন ভ্যালির প্রচুর পুরুষ ইঞ্জিনিয়ার ডিমোরোর পক্ষে। অন্য অনেক কোম্পানীই তাকে ভাল ভাল চাকরির অফার দিচ্ছে। ডিমোরো গুগুলকে কোর্টে টানছেন এবং লেবার আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন আমেরিকার লেবার আইনে ডিমোরোকে বহিস্কার করা বেয়াইনি। ‘

কিন্ত এসব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে চিরকালীন বিতর্ক- মেয়েরা কি সত্যিই ছেলেদের থেকে অঙ্ক বা কোডিং এ পিছিয়ে? যা ডিমোরোর মূল থিসিস?

(২)
ছেলেদের এবং মেয়েদের মাথার গঠনে কি আদৌ কোন পার্থক্য আছে-যার ভিত্তিতে বলা সম্ভব মেয়েরা অঙ্কে একটু কাঁচা হবে?

উত্তর হচ্ছে নেই। এখনো পর্যন্ত অনেক রিসার্চেই প্রমান করার চেষ্টা হয়েছে ছেলে এবং মেয়েদের ব্রেইনের গঠন আলাদা-তার জন্য কগনিটিভ ক্ষমতাও আলাদা । কিন্ত কিছু কিছু এনাট্মিক্যাল পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ( যেমন মেয়েদের মাথায় দুটো লোবের মধ্যে ওয়ারিং বেশী-যেখানে ছেলেদের ব্রেইনে লোবের মধ্যেই ওয়ারিং বেশী) -পার্থক্য এমন কিছু বেশী না যার ভিত্তিতে বলা সম্ভব মেয়েরা ছেলেদের থেকে অঙ্কে কাঁচা হবে। ইনফ্যাক্ট এইসব ব্যাপারের অধিকাংশ রিসার্চ দুবছরের মধ্যেই ভুল প্রমানিত হয়েছে।

অর্থাৎ মেয়েরা অঙ্কে কাঁচা-এর কোন বায়োলজিক্যাল ভিত্তি নেই।

কিন্ত আমেরিকাতে অঙ্কের অধ্যাপকদের মোটে ৮% মহিলা, ফিজিক্সে ৬%, কেমিস্ট্রিতে ১২%। সফটোয়ারে ১২-১৪%।

এটা কেন হবে?

তাহলে কি বাবা মায়েরা মেয়েদের বিজ্ঞান বা অঙ্কে উৎসাহিত করে না?

উলটো দিকে এটাও দেখা যায় ছোটবেলা থেকেই মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে একটা ভয় ঢুকিয়ে নেয়। যে অঙ্ক তাদের জন্য না। তাদের জন্য সাহিত্য বা ইতিহাসই ভাল। নিদেন পক্ষে বায়োলজি। এটা অনেকটা ওই সামাজিক মীম। একটা মেয়ে একদম ছোটবেলা থেকে শিখছে অঙ্ক সাবজেক্টটা মেয়েদের জন্য বেশ কঠিন-ফলে এক কাল্পনিক ভয়ের শিকার হয়ে অধিকাংশ মেয়েরা বিজ্ঞান বা অঙ্কের দিকে ঝুঁকতে চাইছে না।

অবশ্য সত্য এত সরল এবং তরল নহে।

(১) বৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে বয়ঃসন্ধির আগে ছেলে এবং মেয়েদের অঙ্কে এপ্টিচুড একই থাকে। কিন্ত শরীরে সেক্স হর্মোন ঢোকার সময় থেকেই মেয়েরা আস্তে আস্তে অঙ্কে পিছিয়ে পড়ছে।

(২) কেন এমন হয়? এর বিবর্তনীয় ব্যখ্যা দিচ্ছেন অনেক বিজ্ঞানী। তবে কতটা সত্য বলা মুশকিল। বলা হচ্ছে বয়ঃসন্ধির সাথে সাথেই মেয়েরা ছেলেদের থেকে কেরিয়ার “এগ্রেশন” এবং” পারসুয়েশনে” এ পিছিয়ে যায়। এর মূল কারন মেটিং চয়েস। ব্যপারটা বেশ জলের মতন সহজ। একজন ছেলে যদি কেরিয়ারে ওঠে, ভাল রেজাল্ট করে, জীবনে উচ্চ প্রতিষ্ঠা পায়-তার ভাল সঙ্গীনি পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। ফলে কেরিয়ারে ভাল করার জন্য ছেলেরা আলরেডি ইন্সেন্টিভাইজড। সেক্ষেত্রে মেয়েদের ক্ষেত্রে উলটো। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেয়েটি কেরিয়ারে ভাল করলে, তাদের মেটিং চয়েস বা সঙ্গী পাওয়ার ক্ষেত্রটি সংকুচিত হয়-কারন সেক্ষেত্রে মেয়েটি তার সমতুল্য বা তার থেকে ভাল পাত্র চাইবে। এই জন্যে অধিকাংশ মেয়ে জীবনে ওপরে ওঠার ক্ষেত্রে আগ্রহ হারায়।

(৩) ২ নাম্বার পয়েন্টটি আবার সব মেয়ের জন্য সত্য না। সাধারনত যেসব মেয়েরা অঙ্ক বা ইঞ্জিনিয়ারিং এ ওপরে ওঠে -তাদের গ্লাস সিলিং ভাঙার জন্য, নিজেদের প্রমান করার জন্য অনেক বেশী পরিশ্রম করতে হয়। তারা অনেক ক্ষেত্রেই তাদের পুরুষকর্মীদের থেকে ভাল।

(৪) এরপরে আছে সংখ্যাতাত্ত্বিক ডিসপার্সন-বা কতটা ছড়িয়ে আছে এই সিদ্ধান্তগুলি। যেমন দেখা গেছে অঙ্কের ক্ষেত্রে সব থেকে বুদ্ধিমান এবং গাধা-উভয় ক্ষেত্রেই পুরুষের প্রাধান্য। মেয়েরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মধ্যেখানে।

(৩)
ডিমোরো তার মেমোতে মেয়েদের কিছু কিছু স্টিরিওটাইপিং কে বিজ্ঞানভিত্তিক বলার চেষ্টা করেছেন-যা সম্ভবত বিজ্ঞান প্রমানিত না। আমি শুধু একটা উদাহরন দিচ্ছি। যেমন আমরা প্রায় দেখি মেয়েরা ম্যন ম্যানেজমেন্ট ভাল করে। যার জন্য অধিকাংশ কোম্পানীর কমিউনিকেশন ডিরেক্টর বা পি এর এর কাজ মেয়েরাই করে। হিউমান রিসোর্সেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেয়েদের প্রাধান্য। অন্যদিকে অঙ্ক বা কোডিং এ মেয়েরা নেই। আর কারন হিসাবে অনেকেই মনে করে মেয়েরা মানুষ নিয়ে নাড়াচাড়া পছন্দ করে কিন্ত বস্তু বা এবসস্ট্রাকশন তাদের পছন্দ না। এটি নিয়ে ডিমোরো তার মেমোতে দুপাতা খরচ করেছে। কিন্ত এখানেও সেই প্রশ্ন? অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়েটি সত্যিই এটা পছন্দ করে না সামাজিক মিমের প্রভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করে, হিউম্যান রিসোর্সেই সে দক্ষ কোডিং এ না?

দ্বিতীয়টিই সত্য। ছবছর বয়স থেকে যদি মেয়েদের মাথায় ঢোকানো হয়, ঐটি বাপু তোমার কম্মো না-তাহলে সে সেটাই বিশ্বাস করবে।

আধুনিক যুগে মেয়েদের বাবা-মায়েদের এটি বাড়তি দ্বায়িত্ব। অন্তত এটা বোঝানো যে মেয়ে মানেই অঙ্কে কাঁচা এটি শ্রেফ প্রচলিত ভুল ধারনা। মেয়ে হয়ে জন্মানো মানে অঙ্কে বিকলাঙ্গ- এই ধরনের ভাইরাসে যেন কোন কন্যা সন্তান আক্রান্ত না হয়। বা বাড়িতে এই ধরনের পরিবেশ যেন না থাকে। অঙ্ক এবং ভাষা-দুটোতেই ভাল দখল রাখা যে কোন চাকরি বা জীবিকার জন্যই জরুরী।