লিখেছেন: আশ্রাফ আদর

কখনো ভাবি নি এমন অতীত হতে পারে কবিতার কাঁচামাল,​
ভাবি নি এমন দুঃখ আঁকতে হবে শব্দে শব্দে,​
কলমের কালি হবে চোখের জল,​
রাত হবে দীর্ঘশ্বাসের,​
সঙ্গ দেবে সীসার নল।​
অথচ আজ রাতেও, প্রতিটা রাতের মত, বিদগ্ধ ইতিহাস উঁকি দেয় বাতায়নে,​
কবিতার যোগান হয়ে ধীরে ধীরে নেমে আসে কাগজের পাতায়, প্রবল বরিষণে,​
বুক ভারী করে দীর্ঘশ্বাস চুপেচুপে ছেড়ে আশেপাশে চোখ ফেলে সাবধানে,​
রুক্ষ গালের উপর থেকে শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুর ফেলে যাওয়া দাগ মুছি সঙ্গোপনে।​
সেই কবে ঘটেছিল কলঙ্কিত এক অধ্যায়ের সূচনা, সেই কবে!​
আজো যে তা রবে কে জানতো তা কবে? কে ভেবেছিল তা এ ভবে?​
জননীরা স্রষ্টারুপে এসে পুরুষতান্ত্রিকতায় ফেঁসে আর কিই বা দেবে?​
তবুও ইতিহাস, ডায়েরী, পিঠের কালো দাগ, কপালের ছাপ; সাক্ষ্য দেয়​
আমি অতীতেও ছিলাম, ভালো খারাপের এক অবিমিশ্র মিশেলে।​
এক, একমাত্র জন্মে জৈনপুরী পীরের দেয়া নাম নিয়ে, দুই যুগ আগের অতীত থেকে​
আজ অবধি বর্তমান, একই অভাববোধ পুষে।​
যখনও ভাবার বয়স হয় নি, তখনো হুঁ হুঁ করে বাতাস বেরোতো বুক থেকে,​
সরষে তেল গায়ে মাখাতে মাখাতে নানু বলেছিল-​
জননী আর তার ভাইয়েরা থানায়​
অমানবিক এক ইতিহাস থেকে
বঞ্চনার ইতিহাস​ গড়ে তবেই ফিরবে।​
মুখ চেপে মেনে নেয়ার অভ্যাস হয়তো তখন থেকেই শুরু,​
স্যারের অন্যায় হাত গায়ে উঠা,
ফটিকের মত আদর পাওয়া, কাঠপিঁপড়ে
টেবিল খেয়ে বইকে কাঠ মনে করা,
ব্রণের ক্ষতে ট্যালকম পাউডার মাখা,
বদমেজাজি হয়ে টিউশনির স্টুডেন্ট মারা;
আমি শিখে নিয়েছিলাম, মেনে নিয়েছিলাম।

জননীর চোখের জল ছিল গরীবের কিস্তির মত,​
একের পর এক আসে, সপ্তাহান্তে, দিনান্তে।​
দেখতে দেখতে গা সওয়া হয়ে গিয়েছে,
জেনেছি বুঝেছি, এ জলের শেষ নেই,​
কাঁদার জন্যই তাঁর এ ধরায় আগমন,​
তবু কষ্ট হতো, কান্না পেত, আহত হতো মন।​
স্কুলের পথে তাঁর ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা
আমায় পরিচিত করে তোলে এভাবে

‘ওর মা খনকার বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছে।’​

আকাশে মেঘ মানেই জননীর ছাতা হাতে অপেক্ষায় থাকা,​
টিফিনের টাকা গুনে দেয়া,​ পড়ার টেবিলের ফ্লাক্সে লিকার চা,​
বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে পড়াশোনার অগ্রগতি দেখা,​
আর এক, না দুই, না তিন সমুদ্র ভালোবাসা।​
তবুও সেই অতীত বারবার বেহায়া বিড়ালের মত​
এসে সামনে দাঁড়ায়, দাঁড়াতো।​

আজো যে সে অতীত বিস্মৃত হবে না, কে জানতো?​
নইলে কি আর এমন ইতিহাস গড়ে উঠতো?​
হতো গভীর থেকে গভীরে এতো অভাববোধ?
কখনো ভাবি নি এমন অতীত হতে পারে​
দীর্ঘশ্বাসের এতো বিশ্বস্ত উপলক্ষ্য।​

সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিতে দিতে ক্ষয় হয়ে যাওয়া জুতোর দুঃখ,​
সবুজ পাতার ঘোমটা পরে নির্জীবতা লুকানো শুকনো পাতার দগ্ধ বক্ষ,​
বুকের আদর বেয়ে নেমে যাওয়া দুঃখ পৃথিবীর শরীর জুড়ে আঁকে অক্ষ,​
হেয়ালি বিধির লিপিবদ্ধ বিধিবদ্ধ না বুঝে, বুঝতে না চেয়ে শয়তানের সঙ্গে সখ্য,
​আমার আর কি দোষ! আমার ভাগ্য যদি হয় পূর্বনির্ধারিত, বয়ে যাওয়াই তবে লক্ষ্য।

জননীরা আঁচলে ভেজা চোখ লুকিয়ে লুকোচুরি যে খেলা খেলে,​
তাতে জলভরা নদীরও দুকূল উপচে পড়ে​ অসহায় লজ্জায়,​
যেভাবে বৃক্ষতল ছায়া বিছিয়ে অপেক্ষায় থাকে
নির্যাতিত মেয়ের স্বামীর বাড়ি ফেরত বাবা,​
জননীর হাতে ভাতের লোকমা খাওয়া সন্তান
বোঝে তেমনিই অনুপযুক্ত পৃথিবীতে​
বৃক্ষছায়া হয়ে মা,​
শামুকভাঙ্গা পায়ে বিঁধে গলগলিয়ে খুন বেরোয়,​
শিং মাছের কাঁটা বিঁধে শিরায় শিরায় বিষ বয়ে যায়,​
বাঁশের কঞ্চিতে হাত কেটে কাঁদতে কাঁদতে আসি জননীর দরবারে,​
সাথে সাথে দূর্বাঘাসের তিতা রসে অনুচক্রিকা জমাট বাঁধায় রক্ত,​
কাপড় ছিঁড়ে পট্টি করে জখম বেঁধে দেয় খুব শক্ত করে,​
নিজের ব্যথ্যার চিন্তা করে মহামানবীর চোখের কোণে
টলমল জল দেখি না,​হৃদয়ের রক্তক্ষরণ দেখি না,​
মৌন মুখের গভীর দুঃখ ছুঁয়ে যেতে পারি না,​
নিজের ব্যথ্যার চিন্তা করে।​
অথচ এই মায়ার সমুদ্র নাকি সংসারী নয়,​
উপযুক্ত নয় জনকের,​
পুরুষতান্ত্রিকতার প্রতি অনুগত হলেই বুঝি ভালো হত?​
ভালো হতো, যদি সয়ে যেতো সব অন্যায়,​
ভুল ব্যাখ্যা, জোড়া তালির সুখদুঃখ,​
হতো যদি বাড়ি না ফেরা অর্ধাঙ্গের প্রতি অভিযোগহীন,​
যদি প্রথম সন্তানের অবহেলার মৃত্যু ভোলা যেতো,​
সংসারে অধিকারহীন হয়েই পড়ে থাকতো,​
বর্ণবাদের তীব্র অভিযোগে অভিযুক্ত না হত,​
মুখ বুজে দুঃখ গুঁজে খুঁজে খুঁজে পুঁজ পেতো হৃদয় কুঠিরে,​
হায়রে জননীরা, তোমাদের মধ্য দিয়ে যে পুরুষ আলো দেখে,​
ভালো করে দেখে দুদিন সেই বলে তোমরা ছলনাময়ী,​
তোমরা তোমাদের শত যন্ত্রণার দায় চাপিয়ে ঈশ্বরে,​
দাবি করতে পারো সর্বোত্তম স্বর্গ বিনা বিচারে,​
স্বর্গবাসী জননীরা, তোমাদের ঋণ আমি চেয়ে নেব,​
কড়ায়গণ্ডায় বুঝে নেব,​ সাথে নেব পাই পাই হিসেব
নিরপরাধ এ আমার অনাকাঙ্ক্ষিত শত ভুলে
যেতে চাওয়া অতীত,​
পৃথিবী নামক নরকের সৃষ্টিলগ্নে প্রকল্পিত হাশরে।