আচমকা বৃষ্টিটা থেমে গেল। এরপরেই শুরু হল মেঘের গর্জন। কিছুক্ষন পর সব কিছু পরিস্কার। বৃষ্টির জন্য রাস্তার মাঝে পানির গড় উচ্চতা ছিল ১০ মিমি। কোথা থেকে একটা কাক এসে যেন পানির মাঝে কি খোঁজা শুরু করল। মেয়েরা আংটি হারালে যেরকম করে খুঁজে। কিন্তু কাকের তো আংটি নেই সে কি খুজবে পানির মাঝে ! এই বিষয়টা নিয়ে মেয়েটা খুব কৌতূহলী এবং বিরক্ত। কারন সে জানতে পারছে না কাকটা কি খুজছে।

কাকের কান্ড কারখানার দর্শকই হচ্ছে আমার গল্পের নায়িকা। চোখের মাঝে যেন একটা বিল ঢুকে আছে। চাহনি দিয়েই সম্মোহনের এক অপূর্ব ক্ষমতা রাখে সে। খুব অল্প কিছু মানুষই তাদের জীবনে এরকম অদ্ভুত সুন্দর কারো দর্শন পায়। এমনই অপূর্ব রূপবতী ছিল আমার গল্পের নায়িকা। যারা বর্ণনা গুলো পরে আগ্রহ পাচ্ছেন তাদের জন্য দুঃখিত। কারন মেয়েটা এরকম বিশেষ সুন্দরী কিছুই ছিল না। ইটের দেয়াল পুরানো হয়ে গেলে তার উপরে যেমন একটা ভ্যাপসা রঙ পরে মেয়েটার রঙ ছিল সেরকমই। শ্যামলার চাইতে নিচে। চেহারায়ও বিশেষ সুন্দরের কোন ছাপ ছিল না। গল্প এদ্দুর পরে অনেকেই রেখে দেবেন, কারন কুৎসিত মেয়েদের নিয়ে গল্পগুলো কল্পনা করতে এক ধরনের অস্বস্তি লাগে। বিরক্তি হয়। সৌন্দর্য অনেক বড় একটা ব্যাপার। তাই গল্পের নায়িকাগুলো চমৎকার সুন্দরী হয়। লোকে আগ্রহ পাবে তবে।

শিল্পির অনেকদিন ধরেই একটা ইচ্ছে ছিল; একটা সাদা শাড়ি কিনবে। কারন সেবারের পহেলা বৈশাখে সাদা শাড়ি লাল পারের একটা শাড়ি দেখেছিল একটা মেয়ের গায়ে। আগে সাদা শাড়ি দেখলেই বিধবা সাইন মনে হত, কিন্তু মেয়েটার গায়ে শাড়িটা দেখে তার এতটা ভাল লেগেছিল যে সে এই জিনিসটা নিয়ে বেশ কয়েকবার সপ্নও দেখেছে। প্রথম স্বপ্নটা ছিল শিল্পি সাদা শাড়ি পরে কাশফুলের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে। কেউ একজন তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে । কে তার চেহারাটা বুঝে উঠা মুশকিল। এক ধরনের লুকোচুরি খেলা। কিন্তু ছেলেটা একটু বোকা টাইপের, সে শিল্পিকে খুঁজে পাচ্ছে না। আর কিছু সময় পরে পরেই অস্থির হয়ে উঠছে। শিল্পির জীবনে এটাই প্রথম সপ্ন যেটা সে অনেক সময় ধরে মনের আশ মিটিয়ে দেখতে পেরেছিল।

সাদা শাড়ির কথা শিল্পি মাকে অনেক বলেছিল। কিন্তু মা বিশেষ পাত্তা দেয় নি। শিল্পীর মা আসলে তাকে বুঝাতে চাচ্ছে না যে সাদা শাড়িতে শিল্পিকে মোটেই ভাল লাগবে না। কারন সাদা শাড়ির আড়ালে ভ্যাপসা কেউ। মোটেই মানাবে না। অনেক কৌশল করেও শিল্পীর মা তাকে সেটা বুঝাতে পারে নি। যদি তার অনেক টাকা থাকত তাহলে সে মেয়েটাকে অবশ্যই সাদা শাড়ি দিত। এমনকি না মানালেও। কিন্তু যাদের কাছে অনেক টাকা থাকে না তাদের কে বেছে বেছে কিনতে হয়। মানানো না মানানোর বিষয়গুলো নিয়ে অনেক ভাবতে হয়। অথচ ২৪ বছরের এই মেয়েটাকে সেই সহজ কথাটা বুঝানো যাচ্ছে না। বিয়ে করালে ঠিক সময়ে এখন এর একটা বাচ্চা থাকত।

– মা, জান কালকে রাত্রেও সপ্নে দেখি আমি সাদা শাড়িতে, একটা নৌকার উপরে । চারিপাশে পানি আর পানি , চলন বিল।
– তোর বয়স কত?
– ২৪-২৫ ক্যান?
-আমি এরকম সপ্ন দেখতাম ১৫ বছর বয়সে। তোর মাথায় কি কিছু নাইরে শিল্পি। এত বড় হইছস। কি অবস্থা সংসারটার। আর তার মইদ্ধে…
-থাক হইছে, আর চিল্লাফাল্লা কইরো না, তোমার চিল্লাফাল্লায় কান ঝালাফালা হইয়া যায় ।

শিল্পির মা কথা না বাড়িয়ে চলে গেলেন। শাহানা বেগমের তিন মেয়ে। শিল্পি মেঝ। অথচ তার আচরণে মনে হয় সেইই যেন সবার ছোট। শিল্পীর বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। আর ছোট বোনটা তার স্কুলের এক ছেলের সাথে পালিয়ে যায়। সংসারে এখন শুধু শিল্পীই একা। শাহানা বেগমের এই বয়সে এসে কাউকে নিজের সাথে সাথে সবসময় রাখতে ইচ্ছে করে। শিল্পীর বিয়ে নিয়ে তাই তার বিশেষ কোন মাথা ব্যাথা নেই। কিন্তু তারপরেও মাথা ব্যাথা আনতে হয়। কারন মেয়েটার বয়স হয়ে যাচ্ছে। এর যদি এখন বিয়ে দেয়া না যায় ……… । ‘ মেয়েটা আমার একটু রংচটা বলে………… মানুষ কে কি শুধু চেহারার সুন্দর দিয়েই বিবেচনা করা যায় ! ? ? মনের কি কোনই দাম নেই !’ খুব সম্ভবত যাদের চেহারা সুন্দর না তারাই এমনটা ভাবে।

এত অসৌন্দরযের মাঝেও, কেউ হয়ত সত্যিই শিল্পীর সৌন্দর্য খুঁজে পেয়েছিল। যাকে সে প্রায়ই সপ্নে দেখত, কিন্তু কখনই মানুষটার সম্পূর্ণ মুখ দেখে উঠতে পারে নি। হয়ত তাকে দেখতে দেয়া হচ্ছে না। কেউ একজন যদি সৌন্দর্য খুঁজে নাইই পায় তবে প্রকৃতির উদ্দেশ্য সফল হবে কি করে। প্রকৃতি সবসময়ই একটা বন্ড পেয়ার তৈরি করে। আমাদের জীনের এলিলে এক্স আর ওয়াই এর শতকরা মান ৫০% করে। কিছু মারাত্মক রকম স্বার্থপর জীনকে ট্রান্সফারের জন্য প্রকৃতি আমাদের প্রোগ্রাম করে রাখছে, এখানে সে প্রত্যেকের জন্যই কোন না কোন একজনকে ঠিক করে রেখেছে। সেই ঠিক করা মানুষটাকে শিল্পী চিনে উঠেও চিনতে পারছে না।

স্বভাবতই যৌবনে প্রেম ভালবাসা করতে না পারার কারনে শিল্পীর মনের প্রেমের অতৃপ্ত শুন্য স্থানটা আরও গভির হতে থাকে। এই কারনেই পাঁচ টাকার নোটের উপরে লিখা নিঃস্বার্থ প্রেমিকদের নাম্বারে তাকে প্রায়ই ফোন করতে দেখা যায়। এদের সাথে শিল্পীর কথাবার্তা খুব একটা এগোয় না। কারন এই নিঃস্বার্থ প্রেমিকরা ছেঁচোড়ের দলে। শিল্পী এখনো তাদের মত হতে পারে নি। কিন্তু চারিদিক তাকে ক্রমশই ছেঁচোড় করে তুলছে। এখন হয়ত অনেকের সাথে ১০ মিনিট বেশি গ্যাজাতে দেখা যায় ফোনে। কারন যেই মেয়ে প্রেমের জন্য ছেলেদের নাম্বারে ফোন দিয়ে দিয়ে বেড়ায় সে ছ্যাঁচোড় না হয়ে যায় কোথায় !

শিল্পীর বাবা নিষ্কর্মা মানুষ। তিন সন্তান জন্ম দানের পর চারিপাশের রঙ্গমঞ্চ দেখে নিজে থেকেই চুপসে গেছে। বাসায় ঢুকলে তার কাছে সবসময়ই চিড়িয়াখানা থেকে দুই আনা ভাল কিছু মনে হত না। কিন্তু সেই চিড়িয়াখানা আজ শ্মশান খানায় পরিনত হয়েছে। সেই শ্মশান খানা থেকে মাঝে মাঝে হয়ত ভ্যাপসা কারও ফোনে কথা বলার শব্দ পাওয়া যায়। কিন্তু পূর্বের নিস্করমতা তাকে এখনও গ্রাস করে আছে। ছ্যাপলার মত সব ব্যাপারেই তাকে হাঁসতে দেখা যায়। বড়ই অদ্ভুত মানুষ সে।

বর্ষা কাল যেদিন শুরু হয় ঠিক তার তিন দিন পরে শিল্পীকে এক পাত্র পক্ষ দেখতে আসে। পাত্রের যোগ্যতা কিছু কম নয় বটে। কিন্তু সমস্যা একটাই তার আগে একটা বিয়ে হয়েছিল। সেই বউয়ের বাচ্চা হয় না। তাই তার সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। মধ্যবয়স্কের শেষ সীমায় এসে তার নিজের একজন সঙ্গী আর উত্তরসূরি রেখে যাওয়ার চিন্তা তীব্র ভাবে তাড়া করতে থাকে। সেই তাড়াহুড়োর ব্যাতিবাস্ততায়ই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার রফিকুল ইসলাম শিল্পীদের সেই অসম্পূর্ণ গলিতে।

শিল্পীর বাবা মায়ের আত্মিয়তার কোনই কমতি ছিল না। অন্য কিছু দিয়ে না হোক অন্তত আপ্যায়ন দিয়ে যেন তাদের মুগ্ধ করা যায়।

ছেলের বড় চাচি আর ছেলে যেদিন আসে সেইদিন প্রায় ৩২ পদের আইটেম ছিল। এতটা আপ্যায়ন মনে হয় তারা এর আগে কাউকেই করে নি, এমনকি বড় মেয়ের সময়েও না। শিল্পীকে পরের বাড়ি পাঠানো যেহেতু নেহায়েত সহজ কাজ না তাইই এই আপ্যায়নের ছদ্মবেশ।
-মেয়ের পড়াশুনা কতটুকু?
-আই এ পাস। পড়াশুনায় ও অনেক ভাল। কিন্তু আই এ পাসের পরে আর পড়াশুনা করাই নি। মেয়ে মানুষ এত পড়াশুনা করবে, তারপরে কি? — কথাটা বলেই শাহানা বেগম বুঝে ফেললেন কথাটা বেফাঁসে হয়ে গেছে। শিক্ষিত ফ্যামিলির কাছে পড়াশুনা করিয়ে কি লাভ এই ধরনের প্রশ্ন রাখা চরমতম বোকামি। তবে এতে শাহানা বেগমেরও দোষ ছিল না, কারন তার এই নিয়ে পূর্বঅভিজ্ঞতা নেই, এর আগে শিল্পীকে দেখতে কোন ছেলেপক্ষ আসে নি। আর বড় মেয়ের বিবাহের সময়ও তার এত জিজ্ঞাসাবাদের উত্তর দেবার প্রয়োজন হয় নি।
-মেয়ে আর কি কি করতে পারে ? এই যেমন শখ বলতে।
– সেলাই করতে পারে। আমার মেয়ের রান্নাও খুব সুন্দর আপা। আর সে খুব ভাল কবি লিখতে পারে।
নার্সারির গন্ডিতেও পা না মাড়ানো শাহানা বেগমের কবিতার তা টা স্লিপ কেটে কবি হয়ে যায়।
কিন্তু এত অসম্পূর্ণতার পরেও কবিতা হয়ত ছেলে পক্ষকে কিছুটা আকর্ষিত করতে পেরেছিল। বিশেষ করে রফিকুল ইসলামকে।

ছেলে পক্ষ হাসি দিয়ে বিদায় হয়, সে ছিল এক রহস্যপূর্ণ হাসি। তার আড়ালে কি যেন একটা ছিল।
সেই হাসির আবেশে বেশ কয়েকদিন ধরে শিল্পীর ফোনে কথা বলাটা বন্ধ হয়। ছেলে পক্ষ বলেছিল জানাবে। এ সময় অন্য কারও সাথে কথা বলা যায় না।

-বিশ্বাস করবেন না খালা, আমি যে কি খুশি হইছি
– কি কস, এইডা কি আর বলতে। আমার মাইয়াটার একটা গতি হউক।
-আল্লাহ যা করে ভালই করে , আমরাই খালি বুঝি না।
-হহ রে, কিন্তু অয় গেলে আমি কেম্নে থাকমু। সারাদিন জ্বালাইত খালি।
-শিল্পীর হয় না হয় না কইরাও কপালে ভাল একটা ছেলে জুটব ইনশাল্লাহ। বিয়া করা এটা কোন বিষয় না। কত শিক্ষিত ! আমনে এত টেনশন নিয়েন না।
-হহ, ওইডাই, ভদ্র অনেক। ময় মুরুব্বিগরে সম্মান করতে জানে।
-ব্যাবহার অনেক বড় ব্যাপার। আমরা সবাই শিল্পীর এই বিয়া নিয়া কত চিন্তা করছি। ছেলে পক্ষ শেষ পর্যন্ত কি কয়?
– কয় মেয়ে ভাল, পছন্দ হইছি , জানাইবে সব। আরে রাজি যে দেইখাই বুঝা যায়, সব কি আর লগে লগে প্রকাশ করা যায়।
-ওইটাই।
– দুই রাকাত নামাজ মানছি রে বাপ, সব যদি ঠিকমতন হয়। আল্লাই সব। আল্লাহ তুমি আমার মাইয়াটারে একটা গতি কর।

ছেলে পক্ষ যে কতটা রাজি ছিল তা এক সপ্তাহ পরেই বুঝা যায়। কবিতার জোরদারিটা খুব একটা টেকল না শেষ পর্যন্ত। কারন কেউ একজন ছেলে পক্ষকে বলেছিল, কবিতার উদ্দেশ্য হয়ত অন্য কেউ। কিন্তু শাহানা বেগম শত চেষ্টা করেও কেউ একজনটার পরিচয় জানতে পারলেন না। কেন কেউ একজন চায় না শিল্পীর বিয়ে হোক? সে সংসার করুক, সুখি হোক, কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে তার? কেন সে চাইবে না?

শিল্পীর সংকটের এই জীবনেও শেষ পর্যন্ত আরও তিনটে প্রস্তাব এসেছিল, কিন্তু সেই অভিশপ্ত কারও উপস্থিতি বারেবারে শিল্পীর জীবনের সেই সুখটাকে কেঁড়ে নিচ্ছিল।

– কি রে মা, আমাগো জীবনটা আল্লায় এরকম বানাইছে ক্যান? বারে বারে ক্যান এরম হয়? (হু হু হু)
-(নিশ্চুপ, প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চে তার চরিত্রের চিত্রায়ন দেখে সে হতবাক, তার বলার মতন আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না)।
-কার অভিশাপ লাগছে, কোন কুত্তার বাচ্চায় বারেবারে এরকম করে মাবুদ খোদায় জানে , আমি কিচ্ছু বুঝতাছি না, কিচ্ছু ভাল লাগতাছে না আমার।

এই নিয়ে মোট চারটা প্রস্তাবই ফিরে চলে গেল। শিল্পীর জন্য এটা অনেক বড় একটা বিষয়। তবুও তার বিকারগ্রস্থতা খুব বেশি সময় টেকে না। এই ভয়ঙ্কর বিষয়গুলোতেও সে খুব একটা বিচলিত হয় না, যদিও কিছু সময়ের জন্য তাকে নিশ্চুপ পাওয়া যায়, কিন্তু কিছু পরেই ফিরে আসে কিশোরীর উৎফুল্লতা।

শিল্পীর এই চাঞ্চল্যতা কে যে মানুষটা সবচাইতে বেশি অপছন্দ করত সে শিল্পীর খালাতো ভাই, ফারুক। সেই ছোট বেলা থেকেই সে শিল্পীকে দেখছে, কিন্তু শিল্পীর এরকম বেহাইয়াপনা আচরন তার কখনই ভাল লাগত না বিশেষ। শিল্পীর দুই বছরের বড় ছিল ফারুক, তবুও শিল্পী বড় ভাই হিসেবে ফারুককে সম্মান করত না খুব একটা। ফারুককে তুই তুই করে ডাকতো। শাহানা খালা কষ্ট পাবে বলে ফারুক কখনো কোন অব্জেকশনও তুলে নি, কিন্তু সে প্রচন্ডভাবে এই ব্যাপারটাকে অপছন্দ করত। আর শিল্পীকেও।

-কিরে তুই এইচ এস সি দিছস ! খবর কি ? রেজাল্ট তো দিল।
-খবর তো জানসই, আমার জিগাস ক্যান?
-জানি না আমি, কেউ বলে নাই তো। অবশ্য বলতে পারলে তো বলবে।
-তুই আমার ঘরের থেকে বের হ –
– তোর ঘর ? ? এটা আমার খালার বাসা। তোর কথা মত যাইতে হবে না কি?
-তোরে বের হইতে বলছি তুই বের হ। এই বাসায় আর আসবি না। লজ্জা থাকলে বের হ, যা
-বেশি ভাব কোন সময়ই ভাল না।
-তুই বের হ

ফারুক শাহানা বেগমের বাসা থেকে আস্তে বের হয়ে যায়। সে আজকে অপমানিত হয়েছে ঠিক কিন্তু তা নিয়ে ফারুককে খুব একটা বিচলিত হতে দেখা যায় না। সে মনে মনে এক ধরনের আনন্দও পাচ্ছে। আনন্দের কারন শিল্পী ফেল করেছে। এরকম অহংকারী মেয়েদের ফেলই করা উচিত। যারা বড় কাউকে সম্মান করতে পারে না, মানুষকে কষ্ট দেয় তাদের সাথে এরকম হওয়াই উচিত। শিল্পী ফেল করাতে ফারুকের অন্য একটা খুশির কারন ছিল ফারুক নিজেও আই এ পাস। শিল্পী এই আই এ পাস টা করে ফেললে হয়ত তার দেমাগের ধাক্কায় আর বাচা যেত না। যাই হোক, যা হয় ভালোর জন্যই হয়।

– ফারুক, তোর একটা বন্ধুরে দেখলাম যে, ওইটা কে রে?
-রাহাত?
-আমি তো আর চিনি না, ওই যে ওই দিন তোর সাথে ছিল যে, তোর অফিসে দেখছিলাম।
-ও আচ্ছা, ওর নাম রাহাতই।
-হুম্ম, পোলাটা কি করে রে?
-কি করব? চাকরি করে।
-কিসে?
-সরকারি চাকরি। এলজিডির বড় অফিসারের সাথেই থাকে সবসময়। এলজিডির সব কাজের জন্য ওর হাত লাগে, কোটি কোটি টাকার কাজ ওর হাত দিয়া যায়।
-অহ, পোলাটা দেখতে শুনতেও ভাল দেখলাম।
-হুম, ভালই। বাপ মা’র এক ছেলে। ভাল খুব।
-আচ্ছা ওর সাথে শিল্পীর , বুঝছসই তো বাবা। মাইয়াটা আমার……………
-কিন্তু খালা……

এই ধরনের ইনিকুয়ালিটির ব্যাপার স্যাপার ফারুককে বেশ বিরক্ত করত। যেখানে রাহাত বাবা – মায়ের এত বড় ছেলে, মোটামুটি একটা চাকরিও করে, সরকারি চাকরিতে পোস্ট যেমনই হোক, অবস্থা বেশ ভালই হয়, তাছাড়া রাহাতের কিছু ক্ষেত্রে সাইনও অনেক বড় ব্যাপার। এরকম একটা ছেলেকে শিল্পীর মত মেয়ের জন্য ভাবাটাও তো দুঃসাহস। যেখানে শিল্পীর চেহারা বাদ দিলেও আচার আচরণ সব কিছুই মূর্খের মত , পুরুষ মানুষ দেখলে ঢুলে পরে তার স্বভাব। অথচ এই দুঃসাহসের ব্যাপারটাই ইদানিং দেখাচ্ছেন শাহানা বেগম। কারন এখন দুঃসাহস ছাড়া তার গতি নাই আবার দুঃসাহসেও গতি নাই। ফারুক খালার মুখের সামনে বিশেষ কিছু বলতেও পারে নি।

-কিরে ফারুক, রাহাতের কি অবস্থা? কিছু কইছিলি?
-নাহ , আমি কি কমু? আমনে এগুলা কি বলেন? রাহাত কত কোয়ালিফাইড, এডুকেটেড একটা ছেলে। এটা হয় না কি!
-আমার মাইয়ারে যারা দেখতে আসছে তারা কেউই কি কম ছিল না কি?
-দুষ্ট গরু দিয়া ভরা গোয়াল আর কি। এগুলা কইয়া এখন কি লাভ খালা। আর আপনার মেয়ের স্বভাবও তো খুব একটা ভাল না। সে সারাদিন ফোনে এত কি করে? আপ্নেও তো ডাক দেন না, ঠিক কইরা ডাক দিলে আজকে এরকম হইত না।

শাহানা বেগম আর কিছুই বললেন না, ফারুক বাকি যতটা সময় ছিল শাহানা বেগম চুপ করেই ছিলেন। তার বলার মতন কিছুই ছিল না। মেয়েটাকে যে খুব একটা মানুষ করতে পারে নি সে সেটাও বুঝতে পারছে ভালভাবেই।

শ্রাবণ মাসের প্রথম সপ্তাহে শিল্পীর ব্রেন টিউমার ধরা পড়ল। বিষয়টা খুব একটা এগিয়েই ছিল। ডাক্তার বলেছিল তার পক্ষে বেশিদিন বাঁচা সম্ভব না। বেশি হলে তিন বছর। হাসপাতালের বিছানায় অনেক রোগীর মত তাকেও একটা বিরাট কক্ষে খাটের উপরে রাখা হয়েছে। প্রায়শই তার শরীর খারাপ করে। সপ্তাহে অন্তত একবার রক্ত পালটানোর দরকার হয়, আরও যাবতীয় কাজ ছিল।

কোন এক শ্রাবণ মাসেই শিল্পীর মৃত্যু হয়েছিল, ব্রেন টিউমারের কারনে। গল্প লেখকদের শ্রাবণ মাসের প্রতি এক ধরনের মমত্ববোধ আছে। সে কারনেই গল্পের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো হয় শ্রাবণ মাসে। আকাশে তখন থাকে কালো মেঘ। হটাত সব কিছু অন্ধকার হয়ে ঘনিয়ে আসে। এরপরেই শুরু হয় মেঘের গর্জন। তারপর ঝুম বৃষ্টি। কালো মেঘের মতন জীবনের অংশগুলোও মলিন হয়ে যায়। কখনো কখনো ঝর হলে তো সব কিছুই লন্ডভন্ডও হয়ে যায়।

তবে সেই শ্রাবনের মেঘ ঘনাবার আগে কতগুলো সুন্দর ঘটনাও ঘটেছিল। ফারুকের সাথে বিয়ে হয় শিল্পীর। ফারুক ছেলেটা আগে থেকেই ভালবাসত শিল্পীকে। সেই ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ হয়ত ছিল শিল্পীর বিয়ে ভাঙ্গার মধ্য দিয়ে। ব্রেন টিউমারের পরে শিল্পী বেশিরভাগ সময়ই সেই লুকোচুরি খেলা ছেলেটাকে বারে বারে দেখতে পেত। হয়ত তার একাকীত্বের জন্য সেই মানুষটা বারে বারে সপ্নের মাঝে এসে ভিড় করত। প্রতিদিন মনে হয় সপ্নের মানুষটা আরও বেশি কাছে এসে পড়ছে। অনেকটা কাছে, আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে আসছে তার চেহারা।

ফারুকের ব্যাবসার থেকে মন গিয়ে পরে থাকত শিল্পীর কাছে। যাকে সে দেখতে পারত না হটাত করে তার জন্যই খারাপ লাগতে শুরু করে। শত হোক, মেয়েটা আর কদ্দিনই বা বাঁচবে। তার উপরে জেদ ধরে থেকে কি লাভ। ফারুক ১ সপ্তাহের জন্য ব্যাবসা বাদ দিয়ে খালার বাড়ি চলে আসে। সবার ভাবনার তোয়াক্কা না করে সে শিল্পীর সাথে সাথে থাকত। শিল্পীর সাথে কত ধরনের অদ্ভুত সব গল্প করে বেড়াত। কোন এক শুক্রবারে হটাত সে শিল্পীকে নিয়ে বের হয় ঘুরবার জন্য। এরপরে তাকে বিয়ে করে নিয়ে আসে। এই টাইপের রোগীরা বিশেষ করে সে যখন মেয়ে হয় তার জীবনের সাথে কাউকে জড়াতে চায় না, কিন্তু সে না চাওয়াটা খুব একটা জোরালো হল না যখন সপ্নের সেই বোকা ছেলেটার চেহারা স্পষ্ট হয়ে উঠা শুরু করে।

ফারুক আর শিল্পীর একটা বাচ্চা হয়। তারা অনেক ভেবে তাদের ছেলের নাম রেখেছিল প্রকৃতি। নামটা মানুষের নাম হিসেবে চমৎকার রকম অদ্ভুত ছিল। প্রকৃতি সত্যই অদ্ভুত। সে সবসময় চায় এক ধরনের সেলফিশ জীনকে বাচিয়ে রাখতে। সে কখনো সেটাকে নষ্ট হতে দিতে চায় না। হয়ত তাদের বহন করা আর কপি করাই আমাদের চূড়ান্ত আর চরমতম উদ্দেশ্য। আর এ কারনেই গল্পের মৃত্যুপথযাত্রি মেয়েটা হটাত করে তার সপ্ন পুরুষ হিসেবে দেখতে পায় সবচাইতে অপছন্দ করা কাউকে। আর ছেলেটাও হটাত করে অসহায়ভাবে পাগল হয়ে যায় সেই ভ্যাপসা রঙের মেয়েটার প্রতি, যে একসময় পাড়ার ছেলেদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নানান রকম ছ্যাস্রামি করে বেড়াত।