১৯৮০র পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ ও নতুন বাঙালী অধিবাসীরা যে অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে সেই ইতিহাস আমাদের কাছে প্রায় সবটা’ই অজানা থেকে গেছে। এর অন্যতম কারণ সেই সময়ের সরকার এই সমস্ত বীভৎস কার্যকলাপের সংবাদকে ধামাচাপা দিয়েছেন এবং সাংবাদিকেরাও এই বিষয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করতে অসমর্থ হয়েছিলেন। বর্তমানের সামাজিক মাধ্যম সরকারি সেনসরকে পাশ কাটিয়ে আমাদের কাছে সরাসরি এই পাহাড়ি দেশে বাঙালী সেটলার ও তার সমর্থনকারী সেনাবাহিনীর অত্যাচারের সংবাদ এনে দিচ্ছে।

ছবি: ইন্টারনেট

অনেক বাংলাদেশী – যারা নিজেদেরকে প্রগতিশীল ভাবে – তারাও পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যাপারে একটা ধন্দে ভোগে। তারা ভাবে যে বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে যে কেউ যে কোনো জায়গায় বাসা বাঁধতে পারে। জিয়াউর রহমানের ইচ্ছাকৃত সেটলার নীতির ফলে যে সংখ্যালঘু নাজুক গোষ্ঠীর জীবন, জমি, সংস্কৃতি যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সেটা তারা বুঝেও বোঝে না। পাকিস্তানি সময়ে উর্দূভাষী জনসংখ্যা দিয়ে যদি পূর্ব পাকিস্তানকে ভাসিয়ে দেয়া হত সেটা কি বাঙালীরা মেনে নিত? – মেনে যে নেয় নি তার ফলশ্রুতিতেই তো বাংলাদেশ হয়েছে।

কিন্তু পাকিস্তানি ভূত তো সহজে ছাড়ার নয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর জিয়াউর রহমান যে পাকিস্তানি আদর্শে রাজাকার, আল বদর, জামায়েত পুনর্বাসন করেছিল, আবার সেই আদর্শেই পার্বত্য অঞ্চলে সংস্কৃতির বৈচিত্র রুখতে সেটলার বসিয়েছিল। এতদিনে পরে বঙ্গবন্ধু কন্যা বুঝলেন যে পাকিস্তানি আদর্শ ব্যতিরেকে দেশ শাসন করা যাবে না। তাই শান্তি চুক্তি করেও শেষ পর্যন্ত পাহাড়ের ভাগ্য সেনাবাহিনি ও সেটলারদের হাতে ছেড়ে দিলেন। ২রা জুনের লংদুর ন্যাক্কারজনক ঘটনা এরই ফলশ্রুতি।

ছবি: ইন্টারনেট

এক জটিল দাবা খেলায় বঙ্গবন্ধু-তনয়া নিজেকে বুঝিয়েছেন এই দেশকে চালানোর জন্য একমাত্র তিনিই যোগ্য, এখানে অন্য কারুর উপদেশ গ্রহণযোগ্য নয়। সেই খেলায় যেমন করলেন একাত্তরের গণহত্যার কয়েকজন সহযোগীর বিচার, আবার একই সাথে সৃষ্টি করলেন হেফাজত, আওয়ামী উলেমা গোষ্ঠী, আইসিটি ৫৭ ধারা, অগ্রাহ্য করলেন মুক্তমনাদের খুন হয়ে যাওয়া। হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের বিরুদ্ধে রাখলেন না কোনো জোরালো বক্তব্য । পাঠ্যপুস্তক থেকে হিন্দু ও মুসলিম লেখকদের অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তচিন্তার লেখা বাদ দিলেন, অন্যায় শর্ত-সাপেক্ষে বাল্যবিবাহ চালু করলেন, সুপ্রীম কোর্ট প্রাঙ্গণে মূর্তি নিয়ে অহেতুক মন্তব্য করলেন, ঘোঁট পাকালেন। এসব যে দেশের চরমপন্থী ধর্মীয় গোষ্ঠীদের চাপ ছাড়া হয় নি সেটা সবাই বুঝতে পারে।

[হেফাজত, জামাত সুন্দরবনকে রক্ষা বা তিস্তাতে পানি আনার জন্য আন্দোলন করছে না, তাদের আন্দোলন মানুষের মাথা ও হৃদয়কে বদলে দেবার জন্য। সেই বদল ভাল হবে না। অনেক বামপন্থী (কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সাম্প্রদায়িক) এদেরকে সাধারণ মানুষের প্রতিভূ বলে ভাবছেন, সেই অর্থে নাৎসী পার্টিও হিটলারের জার্মানিতে সাধারণের প্রতিভূ ছিল।]

একনায়কের সৃষ্টি হয় অর্থ ও আয়েশের লোভে নয়, বরং দেশের উপকারে তার পথই যে শ্রেষ্ঠ সেই ধরণের একটা ধারণা থেকে। সুন্দরবনে কয়লাচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সুন্দরবনকে ক্ষতি করবে সেটা বুদ্ধিমান যে কোনো মানুষই বোঝেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ভাবেন উনি সবার থেকে ভাল বোঝেন কারণ দেশকে ওনার মত আর কে ভালবাসে! এখানে অন্য কারুর ভালবাসার কোনো মূল্য নেই, কারণ বাদবাকি লোক এই দেশে নিতান্তই ভাড়াটে, বাড়ির মালিকের থেকে বাড়িকে আর বেশী ভালবাসবে? গণপ্রজাতন্ত্রে জনগণকে সেবা দেবার কথা সরকারের। কিন্তু এই দেশে সরকার এবং তার আনুষঙ্গিক অঙ্গসংগঠনরা মনে করে দেশের মানুষদের তারা নিতান্ত দয়াবশতঃ থাকতে দিয়েছে।

কিন্তু প্রশ্ন হল বঙ্গবন্ধু-কন্যা কি মনে করছেন যে উনি চিরজীবী? পুরো একবিংশ শতাব্দী ধরেই তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকবেন? ওনার পরে এই দেশের ভবিষ্যৎ কী হবে? বাংলাদেশের জন্য উনি কি ছাত্রলীগের মত একটি নিম্ন মানের দল রেখে যাবেন, আমরা কি আশঙ্কা করব আমাদের ভবিষ্যৎ নেতারা সেই দলের ক্যাডার থেকে উঠে আসবে? নাকি উনি হেফাজত, উলেমা লীগ ও ছাত্রলীগের এক উদ্ভট মিশ্রণে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ দেখছেন? গত ত্রিশ বছরের মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানী করা ভয়ঙ্কর গোঁড়া ওহাবী প্রভাব রুখতে উনি বিন্দুমাত্র প্রয়াস দেখান নি, বরং সেই মতাদর্শী আরো মসজিদ নির্মাণে সরকারি উদ্যোগ দেখিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জের খুনী মাফিয়া গোষ্ঠীকে প্রশ্রয় দিয়েছেন, হয়রানি করিয়েছেন সেই মানুষদের যারা তাঁকে সহযোগিতা করতে পারত, এবং দেখিয়েছেন কিভাবে কোনো অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের গলা টিপে মারতে হয়। আরা যারা বলে একমাত্র অর্থনৈতিক মানদণ্ডই মূল, যারা দুর্নীতি, স্বজনপোষোণ, সুবিধাবাদী পার্টিগত রাজনীতি, সংখ্যালঘু দমন, এবং সামগ্রিকভাবে ধর্মীয়করণের মাধ্যমে দেশের সংস্কৃতিকে বদলে দেয়াকে মূল্য দেয় না, তারাও জানে একটি দেশকে তখনই উন্নত বলা যায় যখন সেখানে ন্যায্য সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়।

প্রশ্ন হল আমরা এখান থেকে কোথায় যাব? দেশকে চরমপন্থী ধর্মীয় উন্মাদনার মুখে ছেড়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি আশা করতে পারেন না। তিনি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ন্যায়-বিচারের গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলোকে দাঁড়াতে না দিয়ে দেশের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দিচ্ছেন। বুদ্ধিজীবীদের দোষ দিই তাঁরা কিছু বলেন না বলে, কিন্তু কেউ কোনো কথা বললে যে তাকে কীভাবে হয়রানি করা হয় সেটা তো আমরা সুলতানা কামালের উদাহরণেই দেখতে পাচ্ছি। জলে কুমীর, ডাঙায় বাঘ। আমরা তাহলে কোথায় যাব?