গুণীন্দ্রনাথের ছোটবোন কুমুদিনীর ছোটনাতি লীলানাথের সঙ্গে ১১ বছর বয়েসে বিয়ে হয় প্রতিমা দেবীর। বিয়ের দু’মাস পরে জলে ডুবে মারা গেলেন কিশোর লীলানাথ। ১১বছরের ছোট্ট প্রতিমা হলেন বিধবা। তার হাতের শাখা ভেঙে দেওয়া হলো, সিঁথির সিঁদুর মুছে দেওয়া হলো, খুলে নেওয়া হলো পরনের রঙিন কাপড়। বিধবার জীবনযাপনে বাধ্য করল তাকে তখনকার সমাজ। এভাবে পাঁচ বছর কেটে গেল। রবীন্দ্রনাথের মন এই বিধবা বালিকাটিকে দেখে হুহু করে কেঁদে ওঠে। তিনি এই মেয়েটিকে নিজের পুত্র রথীন্দ্রনাথের ঘরণী করে নেওয়ার কথা ভাবতে থাকেন। রথি ইতিমধ্যে আমেরিকা থেকে কৃষিবিদ্যায় উন্নত ডিগ্রী অর্জন করে ফিরে এসেছেন। ১৯১০ সালের ২৪শে জানুয়ারি প্রতিমা আর রথির বিয়ে হয়ে গেল। বিধবা বিবাহের আন্দোলন শুরু করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। রবীন্দ্রনাথের সময়েও বিধবা বিবাহ সহজ জিনিস ছিল না। লোকে ছি ছি করতো। কোনো লোক তার নিজের ছেলেকে বিধবার সাথে বিয়ে দিতে চাইত না। বিধবার বাবামাও চাইত না মেয়ের বিয়ে দিতে। রবীন্দ্রনাথ সেই সময় ও পরিবেশের মধ্যেই নিজের পুত্রের সাথে এক বিধবা কন্যার বিয়ে দেন।

বিয়ের পর নবদম্পতি এলেন শিলাইদহে। ওখানে তাদের একান্ত সময় কাটতে থাকে হানিমুনের মত। এসময় রবীন্দ্রনাথের চিঠি আসে রথির কাছে। রথিকে তিনি ডাক দেন শান্তিনিকেতনে। সদ্য স্থাপিত শান্তিনিকেতনে নানান প্রশাসনিক সমস্যা চলছে। কবির রথির সাহায্যের প্রয়োজন। রথি ও প্রতিমা চলে এলেন শান্তিনিকেতনে। রথি শান্তিনিকেতনে প্রশাসনিক কাজকর্মে ব্যস্ত। এদিকে রবীন্দ্রনাথ ও প্রতিমার মধ্যে গড়ে উঠেছে স্নেহ-ভালোবাসা-সম্মানের অপূর্ব সম্পর্ক। একে অপরের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে উঠেছেন তাঁরা। আস্তে আস্তে রথি ও প্রতিমার মধ্যে দূরত্ব ক্রমে বাড়তে থাকে। বাবামশায়ের প্রবল ব্যক্তিত্বের অমোঘ আকর্ষণ উপেক্ষা করার শক্তি প্রিতিমার ছিল না রথিও সূর্যসমান পিতার কাছে অনেকটা ম্রিয়মাণ। তাই তারও সাধ্য ছিল না ওঁদের মাঝখানে পাহাড় হয়ে দাঁড়াবার। রবীন্দ্রনাথ এমন কী এক দেশ থেকে অন্ন দেশে উড়ে উড়ে ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছেন প্রতিমাকে নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ১১৫টি চিঠি লিখেছিলেন প্রতিমাকে। এই চিঠিগুলিতে আছে পুত্রবধূর প্রতি তার স্নেহ, ভালোবাসা, ভালোবাসার নির্ভরতা, উৎকণ্ঠা ইত্যাদির প্রকাশ। ১৯১০ সালে ৮ই জুলাই শিলাইদহ থেকে রবীন্দ্রনাথ প্রতিমা দেবীকে প্রথম চিঠিখানা লেখেন। এবং শেষ চিঠি লিখেন ১৯৪১ সালে৩০ই জুলাই রোগশয্যা থেকে রানী চন্দের সহযোগিতায়। প্রথম চিঠিতে কবি লিখেছেন, ” বৌমা, আমরা তো কাল অনেক স্রোত ঠেলে সপ্তম দিন নদীর ধারার সঙ্গে লড়াই করে রাত্রে শিলাইদহে এসে পৌঁছেছি। এখানে কাজকর্মের ভিড় যথেষ্ট, কতদিন থাকতে হবে এখনও ঠিক বলতে পারিনে। কিন্তু তোমার পড়ার পাছে ব্যাঘাত হয়, এই উদবেগ আমার মনে আছে। তোমাকে পড়াবার জন্য অধীরকে বলে এসেছিলুম, সেই মতো তোমার পড়া চলছে তো? ইংরেজি পাঠ প্রথম ভাগ তো হয়ে গেছে, আরেকটা বই তোমার জন্য ঠিক করে দিয়েছিলুম, সেটা বেশ বুঝতে পারছো তো? সেই বইটা ইংরেজি পাঠের চেয়ে ভারী নয়, বরঞ্চ হালকা।”

এই চিঠিটা পড়লে আমরা বুঝতে পারি, প্রতিমা দেবীর জন্য কবি কতটা চিন্তিত থাকতেন এবং তাঁর পরাশোনার জন্যও থাকতেন উদবিগ্ন। তাঁর লেখালেখি, পড়াশোনা, জমিদারি, সারা বিশ্বের সাথে যোগাযোগ ইত্যাদি কর্মব্যস্ততার মাঝেও কবি পুত্রবধূর জন্য উৎকণ্ঠা বোধ করেছেন এবং চিঠি লিখেছেন। ১৯২৭ সালের ১লা অক্টবর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে কবি লিখেন,
দক্ষিণবায়ু বহিতেছিল নারিকেলের বনে
সেদিন কুহক ক্ষণে
সাগর জলে সিনান করি সজল এলোচুলে
বসিয়াছিলে বিজন উপকূলে
শিথিল পীতবাস
বক্ষ ছাড়ি লুটাতেছিল তোমার চারিপাশ
মকরচূড় মুকুটখানি ছিল আমার সাথে
সোনার বাহুবন্ধ ছিল হাতে
দাঁড়ানু রাজবৈশী
কহিনু, আমি এসেছি পরদেশী
চমকি পাশে দাঁড়ালে উঠি তৃণ আসন ছেড়ে
শুধালে, কেন এলে?
কহিনু আমি, রেখো না ভয় মনে
পূজার ফুল তুলিতে চাহি তোমার ফুলবনে
রহিলে সাথে, হাসিলে অনুকূল
তুলিনি বীথি, তুলিনি জাঁতি, তুলিনি চাঁপা ফুল
দু’জনে মিলে সাজানু ডালা, বসিনু একাসনে
দু’জনে মিলি নটরাজেরে পূজিনু একমনে
কুহেলি জাল বাতাসে গেল ভাসি
আকাশ ছেয়ে উঠিল ফুটে পার্বতীর হাসি।

এই প্রেমের কবিতাটি কবি পুত্রবধূ প্রতিমার উদ্দেশ্যে লিখেছেন এবং তাঁকে লেখা চিঠিতে সংযুক্ত করেছেন। ” শিথিল পীতবাস/ বক্ষ ছাড়ি লুতাতেছিল তোমার চারিপাশ।” ” কহিনু আমি, রেখো না ভয় মনে/ পূজার ফুল তুলিতে চাহি তোমার ফুলবনে”। কবি কবিতাটিতে লিখেন তাঁর পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর বুকের কাপড় পড়ে গেছে। এবং তার ফুলবন থেকে তিনি ফুল তুলতে চান এবং এজন্য যেন প্রতিমা দেবী ভয় না করেন। এই চিঠি তথা কবিতাটিকে শুধু কি পুত্রবধূর প্রতি তাঁর সমাজসিদ্ধ স্নেহ ব্যক্ত হয়েছে? নাকি ব্যক্ত হয়েছে সমাজনিষিদ্ধ প্রেম ও আকুতি?

১৯১৯ সালে জাপান ভ্রমণ শেষ করে কলকাতায় ফিরে এসে ২৯শে আগস্ট কবি চিঠি লিখেন প্রতিমা দেবীকে। এই চিঠির সঙ্গে একটি গান সংযুক্ত করেছিলেন তিনি। পরবর্তীতে গানটি কেটে দেন। গানটি হচ্ছে,
দিনের পরে দিন যে গেল আঁধার ঘরে
তোমার আসনখানি দেখে মন যে কেমন করে
ওগো বঁধূ আমার সাজি
মঞ্জুরীতে ভরল আজি
ব্যথার ভারে গাঁথব তারে
রাখব চরণ পাড়ে।

এই কবিতাটির মানে কী? কিছুদিন প্রতিমা দেবীকে না দেখেই কি কবির পৃথিবী একেবারে শূন্য হয়ে গিয়েছে? ব্যথায় ভরে গেছে? যে ব্যথার ভারে মালা গেঁথে তা তিনি পুত্রবধূর চরণে রাখতে চান?

ওয়াল্টেয়ারের সাগরসৈকত থেকে ১৯৩৪ সালের ৩১শে অক্টবর কবি লিখেছেন, “বৌমা, তোমার জন্য আমার মন সর্বদা উদবিগ্ন থাকে। তোমার কাছে থেকে বা শান্তিনিকেতন থেকে তোমার কোনো খবর পাইনে। আজ পর্যন্ত পুরীতে আছো কিনা বা পুরীতে কোথায় আছো তা কিছুই জানতে পারলুম না। আমার কেয়ারে এই চিঠি পাঠাচ্ছি তখন পাবে।”

কোনো অজ্ঞাত কারণে কবির সাথে প্রতিমা দেবীর সম্পর্ক কি ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল? তা যদি হয়ে থাকে তবে কেন?

১৯১৫ সনে রবীন্দ্রনাথ পুত্র রথিকে একটি চিঠি লিখেছিলেন।
“তিনি(প্রতিমা) যেন আমাকে তাঁর একতা অসুস্থ শিশুর মতো দেখেন এবং মনে জানেন, আমি এই অবস্থায় যা কিছু করেছি, তার জন্য আমি দায়ী নই।”

এই অবস্থায় আমি যা কিছু করেছি, তার জন্য আমি দায়ী নই — এর মানে কী? যা কিছু করেছি বলতে কী কী করেছেন কবি তাঁর পুত্রবধূর সাথে? এবং তার জন্য তিনি দায়ী নন বলে পুত্রের কাছে নত হয়ে কৈফিয়ত দিচ্ছেন ও আত্মপক্ষ সমর্থন করছেন?

পৃথিবীর একেক সমাজের রীতিনীতি একেক রকম। প্রেম ভালোবাসা বিয়ে এ-সম্পর্কগুলিও সমাজ নিয়ন্ত্রণ করে। মুসলমানদের মধ্যে কাজিনের সাথে বিয়ে জায়েজ। কিন্তু হিন্দুদের মধ্যে তা জায়েজ না। ইন্ডিয়ার কোনো কোনো জায়গা এবং তিব্বতে সবকটি ভাই মিলে একটি মেয়েকে বিয়ে করে। অনেক ক্ষেত্রে বাবা ও ছেলেরা মিলে বিয়ে করে একজন মেয়েকে। সেখানে এটা খুব ভালো জিনিস। কিন্তু আমাদের কাছে তা গর্হিত চরমভাবে। বাংলাদেশে কোনো কোনো আদিবাসীদের মধ্যে কোনো মহিলার স্বামী মারা গেলে সে মহিলাটি যদি আবার বিয়ে করে এবং মহিলার যদি মেয়ে থাকে মেয়েটির বয়স যখন ১২-১৩ হয় তখন সেই একই লোক মেয়েটিকেও বিয়ে করে। তার মানে, মা ও মেয়ের স্বামী হয় একই লোক। এবং তারা সবাই একই গৃহে বাস করে। এটা সে সমাজে ভাল তবে আমাদের সমাজে ঘৃণ্য। আমাদের সমাজের নিয়মকানুন নির্মাতারা তাদের ভাল লাগা মন্দ লাগা আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। আমাদের বাধ্য করছেন, সেসব মেনে চলতে বিনা প্রশ্নে। কিন্তু প্রেম কি এসব চাপিয়ে দেওয়া নিয়ম মানে সব সময়?

সহায়ক,
ছিন্নপত্রাবলী – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ঠাকুরবাড়ির বঞ্চিতা নারী – পৃথ্বীরাজ সেন