লিখেছেন: প্রতিমা মাধুরী কল্যাণী

ডাক্তারবাবু –
সুদীর্ঘ বছর ধরে আমি আপনার রোগীর তালিকায়
এতো দিনে আপনি জেনে গেছেন আমার শরীরে তেমন কোন
রোগ নেই
সমস্ত রোগ আমার মনে।
কিন্তু কেন এমন হল?
জীবনের পথে কেন এমন ছন্দ পতন?
আমার চারপাশে যারা সমান তালে পা ফেলে চলছিল
তাঁরা সবাই কতদূর চলে গেছে আজ,
চলতে চলতে হঠাৎ আমি কেন থেমে পড়লাম!

ডাক্তারবাবু –
সেদিন আপনার চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসছিলাম,
আপনারই পূর্বনির্ধারিত সূচী অনুযায়ী;
আমার চতুর্থ কাউন্সেলিং সেরে।
আপনি বললেন, ‘বি পজিটিভ’,
‘দেখবেন, আর কিছু দিনের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে’।
ঠিক – কি কি জিনিস ঠিক হয়ে যাবার কথা
আপনি সেদিন ইঙ্গিত করলেন?
‘বি পজিটিভ’ – না, রক্তের গ্রুপের কথা যে আপনি বলেননি
তা বি–পজিটিভ গ্রুপের রক্তের অধিকারী হয়েও
আমি বেশ বুঝতে পেরেছিলাম।
আপনি বলেছিলেন, আমি যেন সমস্ত
নেতিবাচক চিন্তাকে বাদ দিয়ে
ইতিবাচক কিছু ভাববার চেষ্টা করি,
এবং আমি চেষ্টা করতে লাগলাম।

কিন্তু ডাক্তারবাবু –
কিছুতেই পজিটিভ হয়ে উঠতে পারছিনা।
সকালে যখন ঘুম থেকে উঠি
আগে কি সুন্দর পূবের জানালা দিয়ে রোদ
ভাসিয়ে দিত ঘর;
কত পাখির ডাক আর ফুলের গন্ধে মুখর,
আজকাল ৩৬৫ দিনের অর্ধেক দিনই আকাশ মেঘলা,
কিরকম ধোঁয়াশা চারিদিক,
খবরের কাগজ খুললেই ওটা বলে দেয়
শহরের ধূলিকণায় দূষণের মাত্রা বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই।
আগে কত চড়ুই খোলা বারান্দায় ঝগড়া জুড়ত
কে আগে আমার ছড়িয়ে ফেলা চাল খাবে –
আজকাল আর ওরা আসেনা। কি করে আসবে বলুন,
শহর জুড়ে রিলায়েন্স, বিএসএনএল–এর বড় বড় টাওয়ার বসেছে;
আমরা সারাদিন স্মার্টফোনে মশগুল;
এতো ইলেক্ট্রো–ম্যাগনেটিক তেজস্ক্রিয়তা, অত ছোট প্রাণীর কি সহ্য হয়?
তাই ওরা সব্বাই মরে গেল, যেমন গেল
মৌটুসি আর টুনটুনিরা।
ওরা আর কোন দিনও ফিরবেনা এই পৃথিবীতে
জুরাসিক পার্কের ডাইনোসরের মতো।

ভাবলাম এসব নিয়ে আর ভাববো না,
‘বি পজিটিভ’ বলে যেই এলইডি টিভির বোতাম টিপেছি
অমনি ‘চব্বিশ ঘণ্টা’ গম্ গম্ করে উঠল
খুন – জখম – ধর্ষণ – শ্লীলতাহানী – তহবিল তছরুপ
জমি দখল – চাপতির বাড়ি – মৌলবাদ – আগ্রাসন – অভিবাসন …
টিভি থেকে এক দৌড়ে ছিটকে বেরিয়ে পড়ল ‘বি পজিটিভ’।

এসএমএস বা ওয়াটস্ অ্যাপে যারা গতকাল গিয়েছিল ডেটে
আজ তাদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ,
কত সহজে বলে ফেলা যায় – ‘ব্রেকআপ হয়ে গেছে রে’
বন্ধু নয়, বন্ধু নয় – বন্দুক হয়ে উঠেছে সব্বাই।

ডাক্তারবাবু –
মাঝে মাঝে রাত্রে বাড়ির ছাদে হাঁটতে থাকি,
আগে এখানে, জুঁই ফুলের প্রাণ পাগল করা বাতাস
নারকেল গাছের পাতার দোলা আর
শুক্লপক্ষের জ্যোৎস্নার চাদর পাতা থাকতো,
ইদানীং দুঃস্বপ্নের কালো বাদুড়েরা ঝুলে থাকে।
শহরটাকে দেখি –
পরিচিত মানুষের মুখ আর দেখিনা,
অপরিচিত বহুতল মাথা চিতিয়ে সর্বত্র।
রাজ্যটা আগে ছিল কাস্তে–হাতুড়ির কব্জায়;
ইদানীং মাটিকে – মা বলে ডাকে,
মানুষ যে কেমন আছে – তা কে জানে?
দেশটা সবুজে ভিজে ভিজে, আজ গেরুয়া পরতে শিখেছে
আর, পৃথিবীটাকে কে দখলে রাখবে –
সাদা চামড়ার বর্তমান বৃহত্তর জনগোষ্ঠী
না আগামীতে যারা বৃহত্তর জনগোষ্ঠী হতে চলেছে
–তা’ই বা কে জানে?

অনেক অনেক বছর আগে কুরুক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে চরম অসম্মানিতা,
পুত্রহীণা, মুক্তকেশী এক নারী প্রশ্ন করেছিলেন –
‘এ কোন পৃথিবীর সাম্রাজ্ঞী আমাকে হতে বলছ কৃষ্ণ,
যেখানে পদে পদে মৃতের আর্তি, শবের দুর্গন্ধ, শেয়াল–শকুনের উল্লাস,
পুত্রহীণা মাতার ক্রন্দন আর বিধবা রমণী চোখে পড়ে’।

মধ্যপ্রাচ্য বলে আর কিছুর অস্তিত্ব আগামী পৃথিবীর মানচিত্রে
থাকবে কিনা তা কেউ জানেনা।
অভিবাসন নীতি দিয়ে আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকার ভবিষ্যৎ
অনেক প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো তাকিয়ে আছে…

তবু আপনি প্রেসক্রিপশন লিখবেন –
যে ওষুধে, আমার ক্রমশ ঘুম পেতে থাকবে
এমন কোনও ওষুধ আপনি লিখবেন না,
যাতে একবারে ঘুমিয়ে পড়ে আর কখনও জেগে উঠতে না হয়।
যে চিকিৎসায় সেরে যায় মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষত
যে ওষুধ মা ও মাটি, গেরুয়া ও সবুজকে এক স্রোতে প্রবাহিত করে;
না, সেরকম কোন ওষুধই আপনি লিখবেন না, এবং
আরও তিনটে কাউন্সেলিংয়ের পর বলবেন
‘বি পজিটিভ, সব ঠিক হয়ে যাবে’।
কিন্তু তারপরও আমি কোন দিন মূলস্রোতে
ফিরে যেতে পারবো না
গ্লোবালাইজেশনের মেঘ ঢেকে দেবে গোটা পৃথিবীর
সমস্ত বায়ুস্তর
সবুজ ও গেরুয়া হয়ে উঠবে কলহ মুখর
মধ্যপ্রাচ্য অপেক্ষা করে থাকবে আরও কঠিন থেকে
কঠিনতম পরিস্থিতির জন্য
আর চড়ুই এবং মৌটুসিরা পরিণত হবে
নামবাচক বিশেষ্য পদে।

ডাক্তারবাবু –
মেডিক্যাল সাইন্সের অত্যাধুনিকরণ
বিশ্বব্যাপী বৃহৎ ওষুধের কোম্পানি
অ্যান্টিবায়োটিক ও স্টেরয়েডের শ্রীবৃদ্ধি –
হরমোন থেরাপিতে তিলকে তাল করা সম্ভব,
এতো কিছু সত্ত্বেও আপনি চুপ করে, হাত গুটিয়ে বসে আছেন?
আপনার প্রেসক্রিপশনে কবে লিখবেন সেই ওষুধের নাম –
যাতে পৃথিবীর শরীর ও মন নীরোগ হয়ে যায়।