সন শব্দটিকে আরবি থেকে আগত বলে ঘোষণা করে দেবার আগে, সন, সনক, সনৎকুমার, সন্ত, সন্তত,সন্ততিসহ অসংখ্য শব্দের অস্তিত্বের উৎস খুঁজে দেখুন, জানান দিচ্ছে, এটি আরব থেকে আগত নয়; বরং এখান থেকেই আরবে গিয়ে থাকবার সম্ভাবনাই বেশী।

আগ্রহীগণ চাইলে শ্রীকলিম খান এবং শ্রীরবি চক্রবর্তী রচিত বর্ণভিত্তিক ক্রিয়াভিত্তিক অভিধানের পাতা খুলে চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন। শ্রীহরিচরণ বন্দোপাধ্যায় মহোদয়ের অভিধান খুলেও দেখে নিতে পারেন। এখানে এ নিয়ে আলাপে যাবার সুযোগ নেই।
বৈশাখ শব্দটির কী অর্থ লেখা আছে আমাদের অভিধানে , দেখা যাক।
বিশাখা নামে নামের নক্ষত্র থেকে বৈশাখ নামটি এসেছে, এ কথা আমরা জানি; যা জানি না , তা হল, বৈশাখ শব্দটির বর্ণভিত্তিক ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ।
শাখা শব্দটির সাথে কমবেশী সবাই পরিচিত। কিছুটা গন্ধ ইতিমধ্যেই আপনারা হয়ত পেয়ে গিয়ে থাকবেন।
খান-চক্রবর্তীর সরল শব্দার্থকোষ জানাচ্ছে, বৈশাখ শব্দটির অর্থ হল: বিশাখার আশ্রয় যাহাতে; অথবা, শাখাচ্ছেদনের পর প্রকৃতিবৃক্ষকে পুনরায় শাখাপল্লবে পল্লবিত হইতে ছাড়িয়া দেওয়া হয় যে কালে; কিংবা, বিগত কালের ফসল সংগ্রহের নিমিত্ত সমগ্র প্রকৃতিবৃক্ষের ফলফুল ডালাপালা ( (চৈত্রে ) ছাঁটিয়া তাহাকে পরবর্ত্তী বছরে পুনরায় আবর্ত্তিত হইবার জন্য সহায়তা করার সূচনা করা হয় যে কালখণ্ডে হইতে; অথবা, পুষ্পমধু ( পণ্যমূল্য ) সংগ্রহ করা হয় যে কালে।
শ্রীহরিচরণ বন্দোপাধ্যায় বঙ্গীয় শব্দকোষে জানান দিচ্ছেন, বৈশাখ-এর অর্থ: ‘যাহার বিশাখা প্রয়োজন।
। অথবা ফসলী সন বলে যা চালু ছিল, সেই অর্থও পেয়ে যাই, শব্দের মধ্যে। দেখা যাচ্ছে, এর অর্থের মধ্যেই রয়ে গেছে নূতনের পদধ্বনি
বর্ষ শব্দটির অর্থও আগ্রহীদের জন্য এখানে দিয়ে দিচ্ছি।
বর্ষ বলতে বৎসর বুঝি, বৃষ্টি বুঝি , দেশ (ভারতবর্ষ ) বুঝি, ঝরে পড়া বুঝি ; কিন্তু কেন ?
বর্ষ: বর ( বাহীর আবর্ত্তন ) দিশাগ্রস্তভাবে বিচ্ছুরিত বা প্রযুক্ত যাহাতে; অথবা, যে ঝরণ দেশ কাল পাত্রে আবর্ত্তিত হয়; অথবা বৃষ ( আবর্ত্তনবাহীর দিশাগ্রস্ত বিচ্ছুরণ ) ঘটে যাহাতে ( যে দেশ কাল পাত্রে ) ; কিংবা, সৃজনশীলতা বর্ষিত যে দেশে ( ভারতবর্ষ প্রভৃতি দেশে ) , যে কালে ( ৩৬৫ দিনের কালখণ্ডে, বৎসরে বা বর্ষে ) যে পাত্রে (বর্ষগিরি, বর্ষপর্ব্বতে ); অথবা, যে দেশের বা জনগোষ্ঠীর শাসকেরা শাসনতাপে ভূমির জলকে (দেশের জনগণকে ) শোষণ করিয়া মেঘে ( সম্পদবাহী আমলাশ্রেণীর হস্তে ন্যস্ত বাহ্যসম্পদে ) পরিণত করিয়া প্রবল তর্জ্জন-গর্জ্জন সহযোগে সেই ভূমিতেই বর্ষণ করিয়া বা ঝরাইয়া (সেকালের রীতি অনুসারে বীজ অর্থ প্রভৃতি দিয়া ) তাঁহাদিগকে পরবর্ত্তী শষ্যজননের ব্যবস্থা করিয়া দিত ; কিংবা, যে বর্ষ শব্দের অর্থ বিস্মৃত হওয়ায় ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর তাহার ভারতবর্ষীয় শাসকেরা তাঁহাদের রচিত সংবিধানে ভারতবর্ষ-এর বর্ষ ছাঁটিয়া দেন এবং ঘোষণা করেন – আমাদের দেশের নাম ‘ভারত, দ্যাট ইজ ইন্ডিয়া’। সূত্র সরল শব্দার্থকোষ, কলিম খান রবি চক্রবর্তী । প্রতীকী অর্থ : বাৎসরিক সম্পদ শোষণ ও বর্ষণ এবং তাহার ক্ষেত্র , জম্বুদ্বীপ, ভারত; বৎসর; মেঘ-বারিপাত; বর্ষণ, বৃষ্টি ।
বর্ষ শব্দটি যে অর্থ বহন করছে তাতে, বর্ষ বরণে মঙ্গল শোভাযাত্রা হতেই পারে কিন্তু আইন করে নয়।
বঙ্গাব্দ শুরুর আগে যা চালু ছিল, সেই শকাব্দ থেকে আগত মাস দিনগুলোর নামের বর্ণভিত্তিক ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ নিয়ে আলোচনা না করে, তালিকাগুলো এখানে দিয়ে দেয়া হল।
বঙ্গাব্দের ১২ মাসের নামকরণ করা হয়েছে নক্ষত্রমণ্ডলে চন্দ্রের আবর্তনে বিশেষ তারার অবস্থানের উপর ভিত্তি করে। এই নাম সমূহ গৃহীত হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থ “সূর্যসিদ্ধান্ত” থেকে।
মাস দিন
(সংস্কারকৃত) দিন
(সনাতন) ঋতু
নামকরণের সূত্র
(নক্ষত্র)
রাশি
(যে রাশিতে সূর্য অবস্থিত)
বৈশাখ
৩১ ৩০ / ৩১ গ্রীষ্ম
বিশাখা
মেষ রাশি

জৈষ্ঠ্য (জ্যৈষ্ঠ)
৩১ ৩১ / ৩২ জ্যেষ্ঠা
বৃষ রাশি

আষাঢ়
৩১ ৩১ / ৩২ বর্ষা
উত্তরাষাঢ়া
মিথুন রাশি

শ্রাবণ
৩১ ৩১ / ৩২ শ্রবণা
কর্কট রাশি

ভাদ্র
৩১ ৩১ / ৩২ শরৎ
পূর্বভাদ্রপদ
সিংহ রাশি

আশ্বিন
৩০ ৩১ / ৩০ অশ্বিনী
কন্যা রাশি

কার্ত্তিক (কার্তিক)
৩০ ২৯ / ৩০ হেমন্ত
কৃত্তিকা
তুলা রাশি

অগ্রহায়ণ
৩০ ২৯ / ৩০ মৃগশিরা
বৃশ্চিক রাশি

পৌষ
৩০ ২৯ / ৩০ শীত
পুষ্যা
ধনু রাশি

মাঘ
৩০ ২৯ / ৩০ মঘা
মকর রাশি

ফাল্গুন
৩০ / ৩১ ২৯ / ৩০ বসন্ত
উত্তরফাল্গুনী
কুম্ভ রাশি

চৈত্র
৩০ ৩০ / ৩১ চিত্রা
মীন রাশি

(সূত্রঃ https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AC%E0%A6%99%E0%A7%8D%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%A6)
হাজার হাজার বছরের অতীত, ঐতিয্য থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করে দেবার, নানা আয়োজন বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠীর আমলে সক্রিয় ছিল্, সেই ধারা এখনও সক্রিয়।
অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে, এই ধারা এখন বিপদজনক রূপ নিয়েছে। এর পেছনে সক্রিয় শাসক-শোষকগোষ্ঠীর বল্গাহীন মুনাফা অর্জ্জনের রাজনীতি।
ফলে আমরা অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন। নব্য মুসলমান, আমরা না মধ্যপ্রাচ্যে; না নিজের মাটিতে । নিজভূমিতে উদ্বাস্তু । উৎসকে বহন করে নিয়ে চলা উৎসব নিয়েও আমাদের মধ্যে ঢুকে গেছে পাপপুণ্যের ভয়-লোভ।
অনেকে এই দিনটিকে শুধু হালখাতার হিসাব আর খাজনা আদায়ের দিন বলেই ধরে নিয়েছেন। কথা সত্য , সন্দেহ নেই । এও সত্য, এই দিনটিকে ঘিরে গ্রামীণ জীবনে মাসাধিকাল ধরেই চলত; মেলার প্রস্তুতি। কামার-কুমারের উৎপাদিত পণ্য থেকে আরম্ভ করে, হেন পণ্য নেই, যার আগমন ঘটত না মেলায়। গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রাণ সঞ্চারিনী এই দিকটিকে ভুলে গিয়ে, একে অধর্ম্মের কাতারে ফতোয়া দিয়ে, নিষিদ্ধ করে দেশটাকে মরুভূমি বানিয়ে দেবার যজ্ঞে সামিল হল, সরকারের জবরদস্তিমূলক ফতোয়া। অর্থাৎ মঙ্গল শোভাযাত্রা । শুভকে আইন করে মানতে বাধ্য করলে, তা যে অশুভ হয়ে যায়, এ কথা ভুলে গিয়ে , দু’টো কৃত্রিম বিভাজন অর্থাৎ নিষেধ অথবা মানো-এর বৃত্তে আজ আমরা বন্দী ।
অথচ কথা ছিল, বছরের শেষ দিন আমরা নিমপাতা, করলা আর নানা রকম শাকপাতা খেয়ে বিদায় জানাব; শুরুর দিনটা মিষ্টি সহযোগে, একটু ভাল খাবার খেয়ে মেলায় যাব।