লিখেছেন: ঘুণপোকা

অবশেষে মাননীয়াও স্বীকার করেছেন এই ‘মূর্তি’ তাঁর পছন্দ হয়নি। এই প্রথম আল্লামা শফি সহ হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের সাথে বৈঠকে তিনি এই ঘোষণা দেন। শুধু তাই নয়, এই ‘মূর্তি’ যাতে সরানো হয় সে বিষয়ে প্রধান বিচারপতির হস্তক্ষেপও কামনা করেছেন এবং হেফাজত নেতাদের আশ্বস্ত করেছেন এটা সরাতে যা যা করা দরকার সে ব্যবস্থা শীঘ্রই তিনি নেবেন।

প্রথম কথা হচ্ছে এই ভাস্কর্য, যাকে হেফাজত কিংবা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন ‘মূর্তি’ হিসেবে, সেটা উচ্চ আদালত ভবনের সামনে না থাকলে আমাদের সমস্যা কোথায়? একজন জিজ্ঞেস করেছেন এই মূর্তি না থাকলে তাতে বাংলাদেশের মুক্তমনাদের ক্ষতি কোথায়? কাল সকালে যদি এই ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলা হয় তাহলে মুক্তমনাদের কি অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হবে?
না, হবে না।
তাহলে আমরা ন্যায়ের প্রতীক এই ভাস্কর্য টিকিয়ে রাখতে উঠেপড়ে লেগেছি কেন?
কারণটা হচ্ছে এই ভাস্কর্য একটা প্রতীক মাত্র, সারা দেশে, বিশেষ করে ঢাকায় এমন আরও শতাধিক ভাস্কর্য আছে, যেগুলো আমাদের ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধকে ফুটিয়ে তুলেছে, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পরিচয় তুলে ধরেছে। এখন দেবী থেমিসের ভাস্কর্য যদি সরিয়ে ফেলা যায়, এরপর অন্যান্য ভাস্কর্যগুলো উপড়ে ফেলার দাবি উঠবে সেটাই স্বাভাবিক (ইতিমধ্যেই হেফাজতের একজন শীর্ষ নেতা সে দাবি তুলেছেনও)। আর এসব দাবি হেফাজতের নতুন নয়, ২০১৩ সালে তারা যে ১৩ দফা দাবি জানিয়েছিল তার মধ্যে সারা দেশ থেকে ‘ভাস্কর্যের নামে যত মূর্তি’ আছে সব অপসারণ করতে হবে এই দফাটার সন্নিবেশও ছিল। এরা এর আগেও বিমানবন্দরে লালনের ভাস্কর্য ভেঙেছে, মতিঝিলে বক ভাস্কর্য ভাঙতে চেষ্টা করেছে। আর আরও বড় ভয়ের কথা হচ্ছে এসব অলিখিত অনুমোদনের পর বাংলাদেশের ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের পুজা-প্রার্থনায় নির্মিত প্রতিমা ভাঙার সরকারি সম্মতি মিলে গেল! ফলে যে ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে আমরা পড়তে যাচ্ছি এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় সমস্যা। সুতরাং দেবী থেমিস সমস্যা নয়, সমস্যা উগ্র ধর্মান্ধদের আস্কারা দেয়ায়। আজকে থেমিস সরলে কাল রাজু সরবে, পরশু শহীদ মিনার সরবে, পরদিন শেখ মুজিবের ভাস্কর্যও সরবে। এরই ধারাবাহিকতায় একদিন এদেশে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতিমাও নিষিদ্ধ হবে।

null

ছবি: লালনের ভাস্কর্য ভাঙছে মৌলবাদিরা

দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, একদিকে উগ্র জঙ্গিবাদের ভয়াবহ উত্থান যখন সারা দেশ প্রকম্পিত তখন সরকারের হেফাজত তোষণ(গণভবনে ডেকে নিয়ে জামাই আদর করা, সরকারি জমি দান, ভাস্কর্য অপসারণে সায় ,কোন নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই কওমি শিক্ষার স্বীকৃতি প্রদান) বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যায় সেটাই এখন বড় আশঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশের অস্তিত্বের স্বার্থেই(এখনো সংবিধানে মূল চারটি স্তম্ভের একটি হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা, যদিও সেটা ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই’ হিসেবেই আছে) এই উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন দরকার ছিল। পরের কথা হচ্ছে এই ঘোষণাটি নিজেদের সেক্যুলার হিসেবে পরিচয় দেয়া দলের সভাপতি এবং রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর মুখ থেকে এসেছে। তাহলে আওয়ামীলীগ কি সেক্যুলারিজমের ছাল খুলে ফেলেছে? অথবা সেক্যুলারিজমের কার্ড খেলে আর বেশি আগানো যাবেনা বলে মনে করছে? সেক্ষেত্রে কাদের নিয়ে আগাচ্ছে আওয়ামীলীগ?

এতদিন যা করেছে আড়ালে-আবডালে করেছে। এখন খুল্লাম-খুল্লা নেমে পড়েছে। এ দিক থেকে বিএনপি অন্তত সৎ। এদের জন্মই হয়েছে মৌলবাদী শক্তিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে এবং তারা সব সময় প্রকাশ্যেই মৌলবাদীদের পক্ষে কথা বলেছে, তাদের বিভিন্ন সুবিধা দিয়েছে, মন্ত্রী বানিয়েছে। তাদের সমর্থক যারা তারা অন্তত বিভ্রান্ত নয়, কখনো ছিলও না। কিন্তু আওয়ামীলীগ যে সেক্যুলার মুখোশ পরে অগণিত মানুষকে ঠকিয়েছে তার দায় কি তারা নেবে? ধর্মান্ধ-মৌলবাদী গোষ্ঠীকে কাঁধে তুলে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া যাবে ভেবে তারা যেভাবে তাদের মাথায় তুলেছে, এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীই একাত্তরে কী দিয়েছে? পঁচাত্তরের পরে কী দিয়েছে? একুশে আগস্ট, পাঁচই মে কী দিয়েছে?

ভুলে গেল আওয়ামীলীগ?