[৮] সাম্প্রদায়িকতার বিকাশ

এই রকম ইতিহাস শিক্ষা আমাদের দেশে দীর্ঘকাল ধরে, সেই নেহরুর কংগ্রেসি আমল থেকেই, চালু ছিল বলেই সঙ্ঘ পরিবারের পক্ষে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা অনেক সহজ হয়ে গেছে। তারা ইংরেজদের থেকে মধ্য যুগের ভারতের এমন একটা ছবি সংগ্রহ করেছে এবং প্রচার করে চলেছে যে মনে হবে, মুসলিম শাসনের সমস্ত সময়টাই বুঝি হিন্দু মুসলমানের লাগাতার সংঘর্ষের ইতিহাস। উপযুক্ত ইতিহাসবোধ ও বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তির অভাবে অধিকাংশ শিক্ষিত হিন্দুর মনে এই ছবিটা পাকাপাকিভাবে মুদ্রিত হয়ে আছে।

কথাটা কি সত্য?

শুধু সঙ্গীতের কথাই ভাবুন। ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের সমস্ত ভাষা-উপাদানেই রয়েছে হিন্দু দেবদেবীর কাছে আরাধনার উপাখ্যান। আর ইসলাম ধর্ম হিসাবে কঠোরভাবে একেশ্বরবাদী এবং মূর্তিপূজার বিরোধী। কিন্তু ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের দীর্ঘ ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে এবং তার সংরক্ষণ ও লালন-পালন হয়েছে মধ্যযুগের সেই মুসলিম শাসনের কালেই। প্রশ্নটা রবীন্দ্রনাথকেও ভাবিয়েছিল। তিনি বিশ্বভারতীর এক অধ্যাপক ক্ষিতি মোহন সেনকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন এই বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য অনুসন্ধান করে দেখতে। অধ্যাপক সেন দেখালেন, সুলতান ও মোগল আমলের সমগ্র সময়কাল ধরে শুধু সঙ্গীত নয়, শিক্ষা, সাহিত্য, ভাষা, চিত্র, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, ধর্মচর্চা, এবং যুদ্ধবিগ্রহ—সমাজ জীবনের সব কিছুই গড়ে উঠেছিল “হিন্দু মুসলমানের যুক্ত সাধনা” হিসাবে। [সেন ১৯৯০] আমাদের দেশের কতজন এই উপলব্ধিটা গ্রহণ করতে পারলেন?

আবার এও দেখার বিষয়, বৌদ্ধ পুঁথিগুলি ইতিমধ্যে (অর্থাৎ, মুসলমান সুলতান বা বাদশাহি শাসন শুরু হওয়ার আগেই) অদৃশ্য বা লোপাট হয়ে গেলেও হিন্দু ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃত পুঁথিগুলি কিন্তু সমস্তই মুসলমান শাসনকাল বেয়ে শুধু টিকে রইল তাই নয়, তার আরও অনুলিপি তৈরি হল, বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হল, ফার্সিতে অনুবাদ হয়ে তা বিদেশে গেল, ইত্যাদি। এর তাৎপর্য কী? ভারতীয় গণিত (বিশেষত, শূন্যের ধারণা এবং দশমিক সংখ্যা পাতন পদ্ধতি) আরবদের হাত ধরেই ভারত থেকে নবম শতকে ইউরোপে গিয়ে পৌঁছল। এটাই বা সম্ভব হল কী করে?

এই রকম যাবতীয় কঠিন তথ্য অস্বীকার করে মিথ্যা এবং ভ্রান্ত এক কল্পিত-সাম্প্রদায়িক আবেগাশ্রিত ইতিহাস বোধের উপর দাঁড়িয়েই এখন সঙ্ঘ পরিবারের মুখিয়ারা প্রচার করছে, মুসলমানরা যেখানেই গেছে, সেখানেই নাকি সমস্ত স্থানীয় সংস্কৃতি ধ্বংস করে দিয়েছে, সেখানকার নাকি সার্বিক “ইসলামিকরণ” ঘটিয়েছে। এখন আমাদের ভেবে দেখা দরকার, ১১৯২ সাল থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত প্রায় সাতশ বছরের মুসলিম শাসনকালে ভারতে কত মন্দির তৈরি হয়েছে, কত মন্দির শাসকরা ভেঙে ফেলেছে, যেগুলো টিকে আছে সেগুলোই বা তারা ভাঙল না কেন। এই দুটো সংখ্যা ঠিক কত এবং তাদের অনুপাতই বা কেমন? ভেবে দেখতে হবে, আরব থেকে বেরিয়ে মোটামুটি একশ বছরের মধ্যেই সিরিয়া লেবানন ইরাক ইরান প্যালেস্তাইন আফঘানিস্তান মিশর—সর্বত্র তারা সমস্ত জনসাধারণকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে ফেলল, আর ভারতবর্ষে এত সুদীর্ঘকাল রাজত্ব করার পরেও ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত জনসংখ্যার মাত্র এক-চতুর্থাংশও পুরোপুরি মুসলিম ধর্মান্তরিত হল না। কেন? আরও ভেবে দেখা দরকার, একশ শতাংশ মুসলিম দেশ আফঘানিস্তানে প্রায় তেরশ বছর ধরে তারা বামিয়ানের বিশাল বুদ্ধমূর্তি আস্ত রেখে দিয়েছিল কেন? মার্কিন মদত ও প্রশিক্ষণ পুষ্ট তালিবানদের হাতে ধ্বংস হওয়ার আগে পর্যন্ত (২০০০ সাল) তা টিকে রইল কীভাবে? অর্থাৎ, এই সংক্রান্ত প্রচারগুলি আসলে আগাগোড়াই মিথ্যা।

তার মানে কি এই যে ইসলাম ধর্ম বা মুসলমান রাজাদের মধ্যে সেকালে বা আগাগোড়া এক প্রবল উদারভাব কাজ করেছে বলে এই সব প্রাক-ইসলামি উপাদান রক্ষা পেয়েছে? না, তাও নয়। উদারতা সহিষ্ণুতা—এগুলো আধুনিক ধারণা এবং উপলব্ধি। হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান—কোনো ধর্মের প্রবর্তক বা প্রচারকদের মধ্যেই প্রাচীনকালে এই রকম কোনো আধুনিক ধারণা ও বোধ কাজ করেনি, করা সম্ভবও ছিল না। আসলে, যারা সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে, তাদের জাগতিক স্বার্থের সামনে যতক্ষণ একটা ধর্ম বিশ্বাস বা আচরণ বাধা হয়ে না দাঁড়িয়েছে, তারা তার বিরুদ্ধে কিছু করার কথা মাথায়ই আনেনি। বিপরীতে, তারা বরং চেষ্টা করেছে, স্থানীয় ধর্ম বিশ্বাসীদের মন জয় করে আস্থা অর্জন করে সাম্রাজ্যকে সুরক্ষিত রাখতে। তাদের প্রধান ও সচেতন উদ্দেশ্য ছিল ইহজাগতিক, সম্পূর্ণ বৈষয়িক, স্বার্থ চরিতার্থ করা।

তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, সাম্প্রদায়িকতার জন্ম হল কবে থেকে?

আগেই বলেছি, মধ্য যুগে বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাস ও আচরণ এবং তা নিয়ে মাঝে মধ্যে বিভিন্ন ধর্মালম্বীদের মধ্যে মারামারি কাটাকাটি হলেও তা কখনই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার দিকে যায়নি। গেলে এতকাল ধরে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে পাশাপাশি হিন্দু-মুসলমানের বসবাস সম্ভবই হত না। ঊনবিংশ শতাব্দ থেকেই প্রথম শুরু হল সাম্প্রদায়িক বিভাজন এবং তার ভিত্তিতে পর্যায়কালিক সংঘর্ষ। বিংশ শতাব্দে তার সংখ্যা বৃদ্ধি পেল এবং মাত্রা তীব্রতর হতে লাগল। তারপর একে একে মুসলিম লিগ, হিন্দু মহাসভা, আর এস এস ইত্যাদি সম্প্রদায় ভিত্তিক সংগঠন গড়ে ওঠার সাথে সাথে এই সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ প্রায় একটা কর্মসূচি হিসাবে পালিত হতে শুরু করল।

মৌলবাদের জন্ম হল কীভাবে?

যখন আমাদের জাতীয় মনীষীরা এক প্রাচীন আদর্শ জগতশ্রেষ্ঠ মিথ্যা ভারতবর্ষের চিত্র এঁকেছেন, তাঁদের অজান্তেই তাঁরা আজ আমরা হিন্দু মৌলবাদের যে ভয়াল রূপ দেখছি তার চিন্তা-আদর্শগত ভিত স্থাপন করে গিয়েছেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে যখন “রামরাজ্য” স্থাপনকে স্বাধীন ভারতের স্বপ্নানুষঙ্গে পর্যবসিত করা হয়েছে তখন তাও সেই মৌলবাদী চিন্তার আরও দু মহল বৃহদায়তনে নির্মাণ করে দিয়ে গেছে। অথচ, তারপরও যখন সেই স্বপ্নময় রামরাজ্যে হিন্দুর শ্রেষ্ঠত্ব এবং ব্রাহ্মণ্য অনুশাসন স্থাপনের কোনো সার্থক সদর্থক পরিকল্পনা রচিত হল না; মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, খ্রিস্টান, আর্য, অনার্য, ব্রাহ্মণ শূদ্র—সকলকে নিয়েই এক বহুত্ববাদী ঐক্যবদ্ধ সুহৃদ ভারতের ভবিষ্যত ছবি আঁকা হল, তখনই হিন্দু মৌলবাদী শক্তির উত্থান (১৯২৫) কার্যত অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল। একে একে হেডগেবার, সাভারকর, গোলওয়ালকর, প্রমুখ এসে ঠিক এই কথাই বললেন। রাম রাজ্য মানেই তা হিন্দু রাজ্য। হিন্দু রাজ্যে বাকিরাও থাকতে পারে, কিন্তু তাদের থাকতে হবে হিন্দুর অধীনে, হিন্দুত্বের অনুগ্রহে।

মুসলিম লিগের জন্ম হয়েছে তার অনেক আগে। ১৯০৬ সালে। তখন সে মুসলিম স্বার্থকে আলাদা করে তুলে ধরলেও এবং তার মধ্যে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন হলেও তার শক্তি সঞ্চয় করতে অনেক সময় লেগেছে। সেও শক্তি সংগ্রহ করেছে তিলক গান্ধী প্রমুখ জাতীয় নেতাদের প্রতিটি ভ্রান্ত পদক্ষেপ থেকেই। দুই রাস্তায়। কখনও তাঁদের হিন্দু-মুখী মতাদর্শের থেকে বিকর্ষণ-প্রতিক্রিয়ায়, কখনও তাঁদের মুসলিম রক্ষণশীল প্রবণতার প্রতি সস্নেহ আকর্ষণে। ১৯২০-র দশকে যখন গান্ধীবাদী আন্দোলন তুঙ্গে, তখনই মুসলিম সাম্প্রদায়িকতারও চূড়ান্ত আত্মপ্রকাশ।

অন্যদিকে, গান্ধীর রামরাজ্য প্রচার যতই ব্রাহ্মণ্যবাদী চিন্তাধারাকে শক্তিশালী করতে শুরু করল, ততই তা ভারতীয় তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষদেরও শঙ্কিত করে তুলল। গান্ধী এটা ধরতে পেরেছিলেন। তবে তিনি ভেবেছিলেন, “হরিজন” সম্বোধন, অস্পৃশ্যতাবিরোধী প্রচার, ইত্যাদির মাধ্যমে তাঁদের মধ্যে এই আশঙ্কা দূর করতে পারবেন। কিন্তু ইতিহাসের দু আড়াই হাজার বছরের চলে আসা ও জমে ওঠা পাপ শুধুমাত্র নাম বদল করে যে স্খালন করা যায় না, এই বিষয়টা তাঁর ধর্মাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে ধরা পড়ল না। কংগ্রেসের বরোদা অধিবেশনে গান্ধীর ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানেও দেখা গেল, আলোচনা হচ্ছে একই প্যান্ডেলে একই শামিয়ানার নিচে বসে, পাশাপাশি। কিন্তু খাওয়াদাওয়া হচ্ছে হিন্দু-মুসলমান আলাদা আলাদা ভাবে বসে; হিন্দুদের আবার জাতিগত মান ধরে পংক্তিভোজনের ব্যবস্থা। প্রশ্ন তুললেন দক্ষিণ ভারতের পেরিয়ার: এমনটা কেন হবে? যেখানে স্বয়ং গান্ধী বসে আছেন? গান্ধীকেই তিনি অনুরোধ করলেন, আহার-বিহারে এই জাতি-ধর্মগত ভেদরেখা বিলুপ্ত করে দিতে। গান্ধী রাজি হলেন না। আসলে এত বড় একটা সংস্কার সাধনে তাঁর রক্ষণশীল মন সায় দিতে পারল না। তাঁর উপস্থিতিতেই ফলে ভেদরেখাগুলি স্পষ্টতর ও তীক্ষ্ণতর হয়ে উঠতে লাগল।

বস্তুত, এই তিনটি পরিঘটনা—মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা, হিন্দু মৌলবাদ এবং দলিত জাতির অধিকারের দাবিতে অম্বেদকরের আন্দোলন—সবই যে প্রায় কাছাকাছি সময়ে জন্ম নিয়েছে এবং স্বাধীনতা আন্দোলনকে অনুভূমিকভাবে সিধে চার ভাগে বিভক্ত করে দুর্বল করে দিয়েছে, এটা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়। তিনটি ভিন্ন ধারার আন্দোলনের জন্মের পেছনেই রয়েছে গান্ধী নেতৃত্বাধীন জাতীয় কংগ্রেসের সেই একই ভ্রান্ত রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। আমরা আজ পর্যন্ত সেই সব মারাত্মক ভুলের মাশুল গুণে চলেছি।

মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুসলিম মৌলবাদের জন্ম নিতে আরও কিছু সময় লেগেছে। একদিকে মধ্য প্রাচে ইস্রায়েল রাষ্ট্র স্থাপন করে প্যালেস্তাইন থেকে আরবদের উচ্ছেদ করার ইং-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সঠিক পথে আন্দোলন গড়ে তোলার প্রক্রিয়ার অনুপস্থিতিতে প্যালেস্তাইন এবং তার আশেপাশের মুসলিম রাষ্ট্রগুলির ভেতর থেকে ধীরে ধীরে এক অস্থির সন্ত্রাসবাদী প্রবণতা জন্ম নিয়েছে। পাশাপাশি, আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের সক্রিয় উদ্যোগে সোভিয়েত ইউনিয়নের এশিয়ান ভূখণ্ডে মুসলিম জনবসতি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে সমাজতন্ত্র বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল চক্রগুলিকে অর্থ অস্ত্র প্রচার ও অন্যান্য ভাবে সাহায্য দিয়ে এই প্রবণতাকে এক সাংগঠনিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে তুলেছে। তারপর থেকে তা সম্প্রসারিত হয়েছে ইরানে, আফঘানিস্তানে, আরও নানা জায়গায়। এই পথ বেয়েই বিশ্বপ্রেক্ষিতে ১৯৫০-এর দশক থেকে ইসলামি সন্ত্রাসবাদের জন্ম অভ্যুত্থান ও প্রসার।

ভারত (বিভক্ত হওয়ার পরেও) একটা যথেষ্ট বড় ভূখণ্ড। হিন্দু মৌলবাদীদের এখানে সরাসরি সরকারি ক্ষমতায় আসতে অনেক সময় লেগেছে।
স্বাধীনতা-উত্তর কালে অনেক দিন পর্যন্ত সক্রিয় সাম্প্রদায়িকতার তুলনায় নিষ্ক্রিয় সাম্প্রদায়িকতাই প্রধান প্রবণতা হিসাবে চলমান রয়েছে। ভারতীয় বুর্জোয়াদের বৃহত্তর অংশই যেহেতু হিন্দু (“উচ্চবর্ণ”), তারা এই ভূখণ্ডেই থেকেছে; অখণ্ড ভারতের খনিজ সম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ (নদী, জঙ্গল, পাহাড়, ইত্যাদি) বেশিরভাগটাই এখানে রয়ে গেছে; ইংরেজ আমলে গড়ে ওঠা কলকারখানারও প্রায় আশি শতাংশই এ অংশে পড়ে গেছে। ফলে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে পাকিস্তান (ও পরবর্তীকালে বাংলাদেশ)-এর তুলনায় ভারত স্বভাবতই অনেক বেশি এগিয়ে যেতে পেরেছে (বস্তুত, ১৯৯৭ উত্তর কালে এখন এও জানা গেছে যে, ভারত বিভক্তির পরিকল্পনা নেহরু-প্যাটেলরা এমনভাবেই করেছিলেন যাতে ভারতীয় বুর্জোয়ারা এই সুবিধাগুলি পায়)। তার সেই বিকাশমান স্থিতিশীল অর্থনীতিই রাজনীতির ক্ষেত্রেও বহুদিন পর্যন্ত এক ধরনের আপেক্ষিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। সংসদীয় রাজনীতি ধীরে ধীরে একটা স্থায়ী রূপ নিতে পেরেছে। তারই সুবিধা নিয়ে শিক্ষা স্বাস্থ্য যোগাযোগ পরিবহন—সর্ব ক্ষেত্রেই ভারতের অগ্রগতি তুলনামূলকভাবে বাকি দুই অংশের চাইতে বেশি হয়েছে। এর সাথে হিন্দুত্ব বা হিন্দু-গরিষ্ঠতার কোনো সিধা সম্পর্ক নেই। পুঁজির শক্তি ও পরিপক্কতার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। এই আর্থসামাজিক পৃষ্ঠভূমিতেই বোঝা যাবে, কেন পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে ভারতের দিকে যতটা উদ্বাস্তু ও জনসংখ্যার অভিবাসন ঘটেছে, বিপরীত অভিমুখে তার তুলনায় কিছুই হয়নি। আবার অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে রাজনীতিও অস্থির হওয়ায়, সংসদীয় রাজনীতির বদলে মিলিটারি শাসনেই বেশির ভাগ সময় থাকার ফলে পাকিস্তানে ধীরে ধীরে সক্রিয় সাম্প্রদায়িকতার শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। আর তার সামনে বিপরীত সাম্প্রদায়িকতা কার্যত না থাকায় এবং বাইরের পূর্বোল্লেখিত ঘটনাবলির প্রভাবে সে ক্রমাগতই মৌলবাদী সন্ত্রাসের আকার নিতে থাকে। ভারতের সাথে কাশ্মীর-ভাগাভাগি নিয়ে ভৌগোলিক-কূটনৈতিক দ্বন্দ্বে পাকিস্তানের ক্রমে ক্রমে কোনঠাসা হয়ে পড়ার ফলে সেই সব শক্তি এইদিকে আরও বেশি করে ঝুঁকে পড়তে থাকে।

পক্ষান্তরে, বাংলাদেশে আবার যেহেতু ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবোধের অভ্যুত্থান ধর্মকে পরাস্ত করে এক নতুন স্বাধীন জাতীয় সার্বভৌম রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করেছে, সেখানে মুসলিম সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রায় সর্বতোভাবে রাজনৈতিক পরাজয় ঘটেছে। আর পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে তার কোমরটাই কার্যত ভেঙে গেছে। দেশের বুকেও তারা জাতীয়তা বিরোধী বেইমান ও দালাল হিসাবে এমনভাবে সুচিহ্নিত হয়ে পড়েছে যে নতুন করে তার পক্ষে মুসলিম স্বার্থের নাম করে উঠে দাঁড়ানো মুশকিল। সেই কারণেই সেই সব প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বাধ্য হয়ে নিজেকে পরিবর্তিত করেছে ইসলামি মৌলবাদী শক্তিরূপে। কোনো এক অদৃশ্য বিপদ থেকে ইসলাম ধর্ম রক্ষার নামে অন্ধ আবেগ, গোঁড়ামি, নারী বিদ্বেষ, হিংসা, ঘৃণা, সন্ত্রাস তারও হাতিয়ার, তবে এখনও তা মধ্য প্রাচ্য বা পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদী শক্তিগুলির সমতুল্য নয়।

কিন্তু ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণিও যত সঙ্কটের সামনে পড়ছে, ততই সে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতির উপর আস্থা হারিয়ে ফেলছে। খুব সন্তর্পনে সেও এখন ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান চাইছে। বিশ্বায়নের পথ ধরেই বহুজাতিক পুঁজিরও যেমন অবাধ চলাচল বেড়েছে বা বাড়ানো হয়েছে, বহুমাত্রিক মৌলবাদী সন্ত্রাসও তেমনই সীমান্ত অগ্রাহ্য করে বিভিন্ন দেশের রাজনীতি সংস্কৃতি সমাজ জীবনকে অবাধে গ্রাস করে নিতে চলেছে। ১৯৯১ সালের নতুন গ্যাট চুক্তি, ডাঙ্কেল প্রস্তাব, বিশ্বায়ন; বিশ্ব পুঁজির স্বার্থে অর্থনীতির উদারীকরণ; ভারতে মনমোহনী নতুন অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ; সেই বছরেই অবাধ বাণিজ্যের হল্লাগুল্লার মাঝখানে বাজার এড়িয়ে তেলের খনি দখলের লক্ষ্যে আমেরিকার ভয়াবহ ইরাক-যুদ্ধ; ১৯৯২ সালে ভারতের বুকে সঙ্ঘ পরিবারের প্রত্যক্ষ হামলায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসসাধন—এগুলোর কোনোটাই নিপাতনে সিদ্ধ নয়; এই সমস্ত ঘটনাকে এক বৃহত্তর আর্থ-রাজনৈতিক অদৃশ্য সূত্রে গাঁথা বললে বোধ হয় ভুল হবে না।

[৯] আজকের আদর্শ: প্রাচীন ভারত

এবার বিশুদ্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞানের তরফে একটু হিন্দু মৌলবাদের গালগল্পগুলিকে নাড়াচাড়া করে দেখা যাক। কেন ওদের যুক্তি বিজ্ঞান ইতিহাসবোধ সব কিছু জলাঞ্জলি দিয়ে প্রচার করতে হয়।

দীননাথ বাত্রা বা নরেন্দ্র মোদী প্রাচীন ভারতে যে সমস্ত বৈজ্ঞানিক কৃৎকৌশলের প্রসঙ্গ তুলছেন সেগুলির মধ্যে এক চিত্তাকর্ষক উপাদান লক্ষ করা যায়। স্টেম সেল রিসার্চই হোক, আর জিন প্রযুক্তিই হোক কিংবা প্লাস্টিক সার্জারিই হোক—সব ক্ষেত্রেই প্রাচীন ভারতে সেই সব গবেষণাই হয়েছিল বলে তাঁরা দাবি করছেন, যেগুলো এখন উন্নত বিশ্ব করে চলেছে বলে জানা গেছে। এরকম কেন হচ্ছে না যে ভারতে একটা এমন ধরনের গবেষণা হয়েছিল, যা সারা বিশ্ব আজ অবধি কল্পনাও করে উঠতে পারেনি?

যেমন ধরুন, গণেশের ধড়ে হাতির মাথা বসিয়ে দেওয়ার গল্প। একে প্লাস্টিক সার্জারি বলার দরকার কী? এই প্রযুক্তির জন্ম তো ভারতেই। তা, এর এরকম একটা নাম দেওয়া হোক না (আমার পরামর্শ)—অথ-অন্যশরীরমুণ্ড-সংযোজন (হেটারোসেফালোথোরাসিক ফিউসন)! তাতে মৌলিকতা অনেক বেশি ফুটে বেরয়। কর্ণের জন্ম রহস্য কিংবা গান্ধারীর একশ এক সন্তানের জন্মদান বৃত্তান্ত ব্যাখ্যা করতে পশ্চিমি বিজ্ঞানের বা জিনতত্ত্বের পরিভাষার সাহায্য আমরা নেব কেন? ভারতীয় বিজ্ঞান, ভারতীয় প্রযুক্তি, ভারতীয়দের কৃতিত্ব; নামও তার সংস্কৃত ভাষায় ভারতীয় স্টাইলে দেব।

মেঘনাদ সাহার সঙ্গে অনিল বরণ রায়ের বিতর্কের কথা অনেকেই জানেন। সেখানে তিনিও এই রকম ভাবেই আধুনিক পশ্চিমি বিজ্ঞানের নানান আবিষ্কারগুলিকে প্রাচীন ভারতীয় বিভিন্ন শাস্ত্র গ্রন্থে খুঁজে পাচ্ছিলেন। তিনি অবশ্য সেদিন দাবি করেছিলেন, সব কিছুই বেদে পাওয়া যাবে, এমনটা নয়। কিন্তু বেদ উপনিষদ পুরাণ স্মৃতি ন্যায় বেদাঙ্গ বেদান্ত তন্ত্র ইত্যাদি সংস্কৃত ভাষায় লিখিত বিভিন্ন বিশাল সংখ্যক পুঁথির সব মিলিয়ে কোনোটা না কোনোটাতে পাওয়া যাবেই। সে ইলেকট্রনই হোক, আর বিবর্তন তত্ত্বই হোক। দুঃখের বিষয়, তখন যেহেতু বিদেশে জিনবিদ্যার প্রায় কোনো অগ্রগতিই হয়নি, সবে তার শুরু তখন, তাই অনিলবাবুর চোখেও বাত্রা বা মোদীর দেখা স্টেম সেল বা জিনপ্রযুক্তি জাতীয় আবিষ্কারগুলো ধরা পড়েনি। অথচ গণেশ-গান্ধারী-কর্ণ সংশ্লিষ্ট ভারতীয় ঘটনাগুলো তো তখনও ছিল।

এই রহস্যের ব্যাখ্যা কী?

ব্যাখ্যা আমি যেটা ভেবেছি, কিছু কিছু জায়গায় বলেছিও, তা হল, এর মধ্যে রয়েছে এক রকম হীনম্মন্যতা, যাকে আমরা এক জাতীয়-আবেগ দিয়ে ঢেকে রেখে এইভাবে এক মিথ্যা গর্বের পলেস্তারা দেওয়ার চেষ্টা করে থাকি। বিজ্ঞানের নিত্য নতুন জয়যাত্রার খবর আমরা পাচ্ছি। বিভিন্ন শাখায় কত কিছু আবিষ্কার হয়ে চলেছে। তার থেকে কত রকম প্রযুক্তি উদ্ভাবন হচ্ছে। খুব জটিল যন্ত্রপাতির কথা ছেড়ে দিই, কম্পিউটার, সেলফোন, লেজার বিম প্রোজেক্টর, ইত্যাদি। ডট পেনের জেল, জুতো পালিশ করার ক্রিম, মাছ কাটার কাঁচি—সবই আমরা হাতে পেয়ে যাচ্ছি, চমৎকৃত হচ্ছি তাদের উপযোগিতা দেখে—অথচ এরকম খুব সাধারণ জিনিসগুলোরও কোনোটাই আমাদের দেশে আমাদের কৃতিমানদের হাতে উদ্ভাবিত হয়নি। আইনস্টাইন কিংবা হাইজেনবার্গের পিএইচ ডি থিসিস থেকে নোবেল পুরস্কারের ডাক আসে; আর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির হাজার হাজার ডক্টরাল থিসিস আট-দশ বছর পরে সংশ্লিষ্ট ছাত্র ছাড়া আর প্রায় কারোর মনেই পড়ে না! যদি আধুনিক বিজ্ঞানের বড় বড় মৌলিক তত্ত্বগত আবষ্কারের কথা ধরি, সেখানে তো ১৯৩০ সালের পরে আমাদের দেশের বিজ্ঞানীদের এমনকি একজনের কোনো কমা সেমি-কোলন পর্যন্ত অবদানও নেই। অথচ হাতে আমাদের বেদ উপনিষদ গীতা এবং আরও কত সব গুরুগম্ভীর শাস্ত্র। তাতে আত্মা-পরমাত্মা জীব-শিব ব্রহ্মতত্ত্ব দ্বৈত-অদ্বৈত দ্বৈতাদ্বৈত বিশিষ্টাদ্বৈত ভেদ-অভেদ অচিন্ত্যভেদাভেদ—কত সব জটিল জটিল বুদ্ধিঘুর্ণায়ক প্রতিজ্ঞা, বা আরও কত কী! অতএব কী আর করা? সংস্কৃত শব্দগুলোকে ধরে সামান্য সাদৃশ্য দেখিয়েই বলতে থাকি—এই দ্যাখো, এখানেই রয়েছে। কণা আছে, শক্তি আছে, তরঙ্গ আছে, স্পন্দন আছে, কোষ আছে, মূল আছে, কাণ্ড আছে, প্রাণ আছে, . . ., আর কী চাই? সব আছে। নতুন কিছুই হচ্ছে না। আমাদের মুনিঋষিরা সবই করে রেখেছেন।

হ্যাঁ, সবই আছে। নেই শুধু দুটো সামান্য জিনিস—মূল জ্ঞান আর কাণ্ড জ্ঞান।

থাকলে এই সব মহান(?) আবিষ্কার-দাবি(!!)-কর্তারা বুঝতেন, ভাগ্যিস ওই পশ্চিমি বিজ্ঞানীদের হাতে এই সব বড় বড় শাস্ত্র-ফাস্ত্র নেই, তাই ওঁরা এরকম মৌলিক আবিষ্কার করতে পারছেন। আর উল্টোদিকে, আমাদের মাথায় এই শাস্ত্রগুলোই দিল্লি গেট লাহোর গেট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নতুন চিন্তা নতুন জ্ঞান ঢুকতে চাইলেই সেখানকার শান্ত্রীরা ভারি গলায় বলছে, “ইধর কুছ করনা নহি, যাও ভাগো ইহাঁ সে! হমারা পরম্‌ ব্রহ্ম্‌ হ্যায়, অওর কুছ নহি চাহিয়ে।”

থাকলে তাঁরা এও দেখতে পেতেন, প্রাচীন শাস্ত্রের যেখানে কণা আছে, সেখানে হয়ত স্পন্দন নেই; যেখানে শক্তির কথা রয়েছে সেখানে তরঙ্গের কথা নেই; যেখানে কোষের কথা আছে, সেখানে দেহের কথা নেই; ইত্যাদি। অর্থাৎ, আধুনিক বিজ্ঞান তো দূরের কথা, বিজ্ঞানের কোনো স্তরের বোধবুদ্ধির সাথেই এই সব শব্দের কোনো জ্ঞানতাত্ত্বিক সম্বন্ধ নেই। . . . ইত্যাদি, ইত্যাদি।

থাকলে তাঁরা বুঝতে পারতেন, প্রশ্নটা নিছক প্লাস্টিক সার্জারি বা স্টেম সেল রিসার্চ থাকা না-থাকার কথা নয়। তর্কের খাতিরে না হয় ধরেই নিলাম, ছিল। কিন্তু মানুষের ধড়ে যখন হাতির মুণ্ড বসাতে যাবেন, তখন সংশ্লিষ্ট শিরা-ধমনীগুলি সংযুক্ত হতে পারবে কিনা, মিলবে কিনা, রক্তের গ্রুপ মিলবে কিনা, স্নায়ুসমূহের আকার প্রস্থচ্ছেদ স্নায়ুরসের রাসায়নিক উপাদান সযুজ হবে কিনা, হাড়ের কাঠামো ও উপাদানগুলি সাথে সাথে বসবে কিনা—এই সব বিষয়গুলোর মীমাংসা তো করতে হবে। ব্যাসদেবের বা তদানীন্তন মুনিঋষিদের এই সব সমস্যা ভাবার বা ভাবানোর কথা নয়। তাঁদের বিদ্যাবুদ্ধির সীমানায় যে এই সব পড়ত না সেকথাটা বেশ বোঝা যায়। তাঁরা বলেই খালাস। তাঁদের আমলের শ্রোতা বা পাঠকরাও শুনে বা পড়েই খুশি। হয়ত কেঁদে বা হেসেই আকুল হতেন তাঁরা সবাই। কিন্তু আমরা একালের মানুষরাও যদি না ভাবি, কী করে চলবে? একজন মানুষের রক্তই যেখানে আর একজন মানুষকে দেওয়া যায় না গ্রুপ একেবারে খাপে খাপে না মিলিয়ে, সেখানে এই সব প্রশ্ন না তোলা মানে হল নিজেদের বিদ্যাবুদ্ধিকে একেবারে বাজারের মাঝখানে উলঙ্গ করে দেওয়া। [এই বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য: মুখোপাধ্যায় ২০১৫]

কিংবা ধরুন খাদ্যাখাদ্যবিচারের প্রশ্ন। বহুজন সমাজ ও মুসলমানদের তরফে গোমাংস ভোজন ও তথা কথিত উচ্চবর্ণের হিন্দুদের গোঁড়ামির দৃষ্টিতে গোহত্যা নিবারণের প্রশ্ন। মুসলমান সমাজের তরফে শুয়রের মাংস ভোজনকে হারাম ঘোষণা। এগুলো খুবই স্পর্শকাতর এক অভিপাদ্য। আগেই আমি সংশ্লিষ্ট ধর্মবিশ্বাসীদের কাছে মার্জনা চেয়ে রাখছি। আপনাদের বিশ্বাস বা আচরণকে আমি ছাড়তে বলছি না, কিন্তু আমার নিজের কাছে যুক্তি দিয়ে তা বুঝে নিতে চাইছি। আশা করি, কোনো পক্ষ থেকেই আপত্তি উঠবে না। অবশ্য উঠলেও আমি নাচার। ধর্মকে আশ্রয় করে সাম্প্রদায়িকতা এবং মৌলবাদ ও সন্ত্রাস এখন যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে তাতে এই সব মুদ্দাকে আর চেপে রাখা সম্ভবই নয়।

গরুর মাংস খাওয়া হিন্দুদের পক্ষে খারাপ কেন?

শুয়রের মাংসই বা মুসলমানদের পক্ষে হারাম কেন?

এই সব বিধিনিষেধের পেছনে বৈজ্ঞানিক যুক্তি ছেড়ে দিন, ধর্মীয় যুক্তিই বা কতটা পাকাপোক্ত?

উনিশ শতকের শেষ ভাগে যখন স্বামী দয়ানন্দের ইয়দ্যোগে উত্তর ভারতে গোরক্ষা আন্দোলন এক হিন্দু পুনর্জাগরণের অঙ্গ হিসাবে শুরু হয়, সেই সময়, বিদ্যাসাগর-অক্ষয় দত্তের সমসাময়িক ও সমভাবুক ভারতবিদ রাজেন্দ্রলাল মিত্র এই বিশেষ ব্যাপারটিতেই বেশ অনেকটা মাথা ঘামিয়েছিলেন। হয়ত সিপাহি বিদ্রোহ, তার পরিণতিতে ব্রিটিশদের প্রচার, ক্রমবর্ধমান হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণ—এই সব লক্ষ করে বাস্তব তাগিদেই তিনি এই কাজে হাত দিয়েছিলেন। তাঁর Beef in Ancient India শীর্ষক একটি প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছিলেন, ঋগ-বেদের যুগ থেকে শুরু করে গুপ্ত যুগ হয়ে প্রাচীন ও মধ্য যুগের এক বিস্তীর্ণ সময় ধরে গরুর মাংস বৈদিক আর্য ও তাদের বংশধরদের, এমনকি ব্রাহ্মণদেরও, খুবই প্রিয় খাদ্য ছিল। [Mitra 1967] পরবর্তীকালে আরও অনেকেই এই বিষয়ে গবেষণাকে সম্প্রসারিত করেন। [Lal 1954-55; Sankalia 1967] বৌদ্ধ এবং/অথবা জৈন ধর্মের অহিংসা ও পশুপ্রীতি বিস্তারকালেই হয়ত বা তাদের একাংশের মধ্যে ধীরে ধীরে—শুধু গরুর মাংস নয়, যে কোনো পশুপাখির মাংস ভোজনের প্রতি এক ধরনের অনীহা জন্ম নেয়। প্রাণী হত্যা পাপ—এরকম কোনো মূল্যবোধ তাদের মধ্যে জেগে ওঠে। তারপর কালক্রমে এটা ব্রাহ্মণ্যবাদের পক্ষেও ধর্মানুবৃত্তির একটা অংশ হয়ে ওঠে। আজ দেখা যায়, উত্তর ভারতের ব্রাহ্মণরা শুধু গরু নয়, সাধারণভাবে আমিষ ভোজনের প্রতিই বীতস্পৃহ হয়ে পড়েছে। অন্যান্য অঞ্চলের হিন্দুদের মধ্যে শুধু গরুই খাদ্য তালিকা থেকে কাটা পড়েছে।

কৃষির উদ্ভাবন ও বিস্তৃতির সাথে গোহত্যা নিবারণের কোনো সম্পর্ক নেই। কেন না, কৃষির কাজে ও বাহন হিসাবে গরুর ব্যবহার এমন যে একই পশুকে অন্তত বার থেকে পনের বছর পর্যন্ত কাজে লাগানো যেত। দ্বিতীয়ত, সে ক্ষেত্রে পারস্য, ইরান, মিশর, ইত্যাদি যে সমস্ত দেশেও বহু প্রাচীন কাল থেকেই কৃষি প্রচলিত, সেখানেও গোমাংস ভোজন বন্ধ না হলেও অন্তত কমে যেত। সেটা হয়নি। সুতরাং, প্রাচীন বৈদিক-পৌরাণিক আচার বা প্রথা অনুসরণই যদি আধুনিক কালের ধর্মাচরণের দিক নির্দেশক হয়, তাহলে এই সময় হিন্দুদের আবার নতুন করে গোমাংস ভোজনের দিকে আকৃষ্ট করাই হিন্দুত্ববাদীদের একটা বড় মৌলবাদী কাজ হওয়া উচিত।

আরও একটা ব্যাপার আছে।

তথাকথিত উচ্চবর্ণের মুষ্টিমেয় হিন্দুদের বাদ দিলে সারা বিশ্বের এক বিরাট অংশই প্রতিদিন গোমাংস ভোজন করে থাকে। হৃদরোগ রক্তচাপ ইউরিক অ্যাসিড ইত্যাদির সমস্যা না থাকলে গরুর মাংস খাওয়ায় কোনো শারীরিক সমস্যা নেই, বরং তা শরীরের পুষ্টির পক্ষে ভালো। বাস্তুতন্ত্রের পক্ষে, দেশের তৃণভূমি রক্ষার পক্ষেও তা ভালো বই মন্দ নয়। হিন্দুত্ববাদীদের এটা না করার একমাত্র কারণ, মুসলিম সমাজের সাথে একটা স্থায়ী সাংস্কৃতিক বিরোধ বাধিয়ে রাখা।

অন্যদিকে, শুয়রের মাংসে ইসলামের আপত্তি কিসে, আমার কাছে তাও আদৌ পরিষ্কার নয়। পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি নিয়ে একটা যুক্তি উত্থাপনের প্রচেষ্টা অনেকে করেন বটে, কিন্তু তা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আমরা মানুষরা যা যা খাই, তার সবই যে খুব পরিচ্ছন্নভাবে বা পরিষ্কার জায়গায় উৎপন্ন হয়, এমনটা সত্য নয়। বরং, আমার ধারণা অনুযায়ী এর পেছনে দুটোর যে কোনো একটা কারণ কাজ করে থাকতে পারে। এক, এটা হয়ত নিতান্তই কাকতালীয় যে যাঁদের হাত ধরে ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠিত ও প্রচারিত হয়েছিল, তাঁরা সম্ভবত যে কোনো কারণেই হোক শুয়রের মাংস পছন্দ করতেন না। পরে কালক্রমে তাঁদের অভ্যাসটাই সাধারণভাবে একটা ধর্মীয় নির্দেশ হিসাবে বিবেচিত ও দুনিয়া জোড়া চর্চিত হতে থাকে। অথবা দুই, যে প্রধান প্রধান জনজাতির মধ্য থেকে ইসলামের প্রথম প্রজন্মের শিষ্যবৃন্দ সংগৃহীত হয়েছিল, তাদের হয়ত পুরনো ট্রাইবাল সংস্কৃতিতে শুয়র সম্পর্কে কুলকেতু (টোটেম)-সম্বন্ধীয় কিছু বিধিনিষেধ (ট্যাবু) ছিল। ইসলাম ধর্ম পরে তাকেই ধর্মীয় আচার হিসাবে গ্রহণ করে নেয়। কিন্তু আপত্তির কারণ যাই হোক, এক্ষেত্রেও সেটা স্বাস্থ্যবিধি ও মানবিক খাদ্যগুণের দিক থেকে একেবারেই যুক্তিসম্মত নয়। যাঁরা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করেন তাঁরা তাঁদের ব্যক্তিজীবনে ধর্মীয় মত অনুযায়ী খাদ্যবিচার মেনে চলতেই পারেন, অন্যদের তাতে কিছু বলার থাকতে পারে না। কিন্তু এর সপক্ষে কোনো সাধারণ যুক্তি উত্থাপন একেবারেই সমর্থনযোগ্য নয়।

তাত্ত্বিক দিক থেকে ধর্মীয় চিন্তার তরফেও এই খাদ্যাখাদ্য বিধিনিষেধের ব্যাপারে একটা সাধারণ স্ববিরোধিতার অস্তিত্ব তুলে ধরার প্রয়োজন আছে। সমস্ত ধর্মেই ঈশ্বর আল্লাহ গড য়িহাবে প্রমুখ সম্পর্কে ধরে নেওয়া হয়, (যার যার যে ঈশ্বর) তিনিই সকলের জন্য খাদ্য যোগান দিয়েছেন। “মুখ দিয়াছেন যিনি, আহার দিবেন তিনি।” সেই ভগবানের একটি সৃষ্টি খাদ্য হিসাবে ভালো, আর একটি খাদ্য হিসাবে হারাম—এই বিচারটাই কিন্তু ভগবানের ক্ষমতা সম্পর্কে একটা সন্দেহ জাগিয়ে দেয়। অন্যদিকে, আজকাল সমস্ত ধর্মে বিশ্বাসীই মনে করেন, ধর্মে ধর্মে মূলগতভাবে কোনো প্রভেদ নেই। সমস্ত ধর্মেরই মূল কথা নাকি একই। নামে আলাদা হলেও সকলে সেই একই মহাশক্তিরই উপাসনা করে। সাঙ্কেতিক ভাবে লেখা যায়: ঈশ্বর = য়িহাবে = গড = আল্লাহ = ইত্যাদি। তাই যদি হয়, সেই একই ভগবানের সৃষ্ট গরু ভগবান ভক্ত খ্রিস্টান ও মুসলমানরা খাচ্ছে, ক্ষতি হচ্ছে না, গড এবং আল্লাহ রাগ করছেন না; সেই তাঁরই সৃষ্টি শুয়র ভগবানে বিশ্বাসী খ্রিস্টানরা চিনারা ভারতের দলিত জাতির লোকেরা খাচ্ছে, ক্ষতি হচ্ছে না, গড এবং ভগবান আপত্তি করেননি; তাহলে, সেই একই ঈশ্বরের অন্য অন্য ইহুদি বা মুসলমান ভক্তরা সেই বিশেষ বিশেষ খাদ্যগুলিই খেলে আবার দোষ হয় কীভাবে? [এই বিষয়টির উপর আরও বিস্তারিত আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য: মুখোপাধ্যায় ২০১৬]

এর অর্থ একমাত্র এটাই হতে পারে যে, সকলের ঈশ্বর এক নয়, পৃথক পৃথক। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ঈশ্বর রাজত্ব করে যাচ্ছেন; যে যার অঞ্চলে নিজস্ব খাদ্যবিধি চালু রাখতে চান। গড যা খেতে অনুমতি দেন, আল্লাহ তা দেন না; আল্লাহর সাথে ভগবানের নির্দেশের পার্থক্য ঘটে যাচ্ছে। প্রাচীন কালের ট্রাইবাল সমাজের মতো। এটা বললে বিশ্বাসের সাথে আচরণের একটা সঙ্গতি স্থাপন হয়। আর তখন আমরা ধর্মের সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার এবং আরও এগিয়ে মৌলবাদী সন্ত্রাসের সম্পর্কটা ধরে ফেলতে পারি। প্রতিটি ধর্মের তরফে এ হচ্ছে তার তার বেঁচে থাকার এলাকা দখল ও অবলম্বন সন্ধান। পক্ষান্তরে, একজন ধার্মিকের তরফে এ হচ্ছে আধুনিক সমাজ মননের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারার অক্ষমতার প্রকাশ।

[১০] ধর্মীয় মৌলবাদ বনাম নারীর স্বাধীনতা

এই শেষের কথাটা বোধ হয় একটু ভাব সম্প্রসারণ দাবি করে। উপরে হিন্দু-মুসলমানের খাদ্যাখাদ্য বিচারের প্রসঙ্গে আমি এটা বোঝানোর পক্ষে একটা খুব সহজবোধ্য সূত্র উত্থাপন ও আলোচনা করেছি। এবার নারীর স্বাধীন অস্তিত্ব ও সামাজিক অধিকার সম্পর্কে আরও একটা সহজ অভিপাদ্য তুলে আনতে চাই।

সকলেই জানেন, সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে ধনতান্ত্রিক সমাজের অভ্যুদয়ের কালে একটা বড় অগ্রগতি এসেছিল নারীর জীবনে। প্রথমে ইউরোপে। তারপর একে একে অন্য অনেক দেশে। সামন্তযুগ পর্যন্ত মানুষের সংজ্ঞায় নারীকে ধরা হত না। কী ভারতীয় কী গ্রিক কী চৈনিক—সমস্ত দেশের প্রাচীন কালের জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা মানুষ বলতে বুঝতেন শুধু পুরুষকে। নারী ছিল শুধুমাত্র পুরুষ উৎপাদনের যন্ত্র। নারীর জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ শুভকামনা বা আশীর্বাদ ছিল: “শত পুত্রের জননী হও।” সন্তান নয়, পুত্র। পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা। মানুষ তো মানুষই চাইবে। তাই সে পুত্র চাইত। বিশ্বের কোনো ধর্মই এই ধারণার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। পারেনি তার কারণ এটা নয় যে তারা চায়নি বা কোনো পরিকল্পনা করে এবং চক্রান্ত করে করেনি। না পারার কারণ হল, তদানীন্তন সমাজ বাস্তবতায় কোনো ধর্ম প্রবর্তক বা আদিগুরুর মাথাতেই এই চিন্তার উদয় হয়নি যে নারীও মানুষ।

কথা সাহিত্যিক শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যের একটা বড় নিবন্ধ আছে—“নারীর মূল্য”। যুক্তিবাদীদের, গণ আন্দোলনের কর্মীদের, নারীমুক্তি আন্দোলনের কর্মীদের পক্ষে এটি একটি অবশ্য পাঠ্য। তাঁদের হাতে হাতে এই অণুবইটি ঘোরা উচিত। এমনকি মার্ক্সবাদীদেরও। আমাদের এই প্রবন্ধের আলোচ্য ধর্মীয় মৌলবাদের ক্ষেত্রেও এই নিবন্ধটির বক্তব্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। যদিও, শরৎ চন্দ্র হিন্দু ও খ্রিস্টান ঐতিহ্য নিয়ে যতটা বিস্তৃতভাবে এবং সোচ্চারে আলোচনা ও বিশ্লেষণ করেছেন, ইসলাম ধর্মের আওতায় নারীর অবস্থান নিয়ে সেই তুলনায় প্রায় কিছুই সেখানে বলেননি।

প্রবন্ধটির শিরোনাম লক্ষ করুন: নারীর মূল্য। অবশ্যই তিনি এই মূল্যের অনুসন্ধান করেছেন সামন্ততান্ত্রিক সমাজের মধ্যে। এবং যথার্থই লক্ষ করেছেন, সামন্তী সমাজে নারী যে পরিমাণে এবং যতক্ষণ সন্তান উৎপাদন করতে পারে সেই অনুপাতে এবং ততক্ষণই পুরুষতন্ত্রের কাছে তার মূল্য। বিত্তবান পরিবারের পুত্র সন্তান চাই সম্পত্তির উত্তরাধিকার রক্ষার স্বার্থে, বিত্তহীনেরও পুত্র সন্তান চাই মাঠেঘাটে কাজ করার হাত বাড়ানোর প্রয়োজনে। অন্য উৎপাদন যন্ত্রের মতো তাই এই যন্ত্রটিকেও ঘরে-পরিবারে সুরক্ষিত রাখতে হবে। যাবতীয় ধর্মীয় অনুশাসন এবং বিধিনিষেধ তারই জন্য। ধর্ম পালন তারও কর্তব্য, কিন্তু ধর্মানুষ্ঠানে তার প্রকাশ্য অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ। ধর্মানুষ্ঠানের (আসলে সাংসারিক যে কোনো অনুষ্ঠানের) সমস্ত কঠিন গায়ে-গতরে কাজের দায়ভার তার উপর; কিন্তু ফল বর্তায় শুধু পুরুষদের উপরে। সন্তানের কল্যাণের কামনায়, স্বামীর কল্যাণ কামনায় কত ব্রত, কত তার উপাখ্যান। কিন্তু স্ত্রীর কল্যাণ কামনায় কোনো আচার অনুষ্ঠান নেই।

বৈবাহিক সম্পর্কের যাবতীয় কঠোরতা নারীর জন্য। খ্রিস্ট ধর্মে শুরু থেকেই একগামিতা (monogamy)-র প্রচলন হয়েছিল। কিন্তু সেখানেও বিত্তবান পুরুষের বিবাহোর্ধ্ব একাধিক নারীসঙ্গ অনুমোদিত না হলেও নিন্দিত ছিল না। হিন্দু ও ইসলাম ধর্মে পুরুষের বহুগামিতা (polygamy) ধর্মমতেই সিদ্ধ। অতএব এই সব আদি বিশুদ্ধ অবিকৃত ধর্মীয় বিশ্বাস গ্রহণ করলে তাকেও বৈধতা দিতে হবে। পর্দা ঘোমটা বোরখা ইত্যাদি যা কিছু নারীকে তার শরীর ও মুখ ঢেকে রাখতে বাধ্য করে, এবং আসলে তাকে সমাজে এক নিম্নতর অবস্থানে এইভাবে নামিয়ে দেয় তারও পেছনে আছে নারীকে পুরুষের সম্পত্তি-কল্পনার সমাজমনস্তত্ত্ব। নারীকে সেই নিম্নস্থান-সূচক পরিধান আজীবন অঙ্গে ধারণ করতে বাধ্য করা হয়েছে তাকে অস্তিত্বের প্রতি পলে মনে করিয়ে দেবার জন্য, সে নিচে, সে অধীন, সে পরনির্ভর, সে গুপ্ত সম্পত্তি হিসাবে পুরুষের ঘরে বন্দিনী। আধুনিক জীবনযাত্রার সাথে, নারী-পুরুষ সমানাধিকারের ধারণার সাথে, নারীস্বাধীনতার বাস্তব প্রক্রিয়ার সাথে এই সমস্ত বিধিব্যবস্থাগুলির বিরোধ দেখা দিতে বাধ্য। ধর্মকে বাঁচিয়ে রেখে, সৎ ভাবে পালন করে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে এই আধুনিক বোধ ও আচরণকে গ্রহণ ও লালন করার কোনো উপায়ই নেই। ফলে যাঁরা ধর্মকে কিছুতেই ছাড়তে চান না, তাঁরা শেষ পর্যন্ত হয় এই প্রাচীন প্রথাগুলির বৈজ্ঞানিক ও উপকারী ভাষ্য খুঁজতে থাকেন; অথবা, ইতিহাস এবং বাস্তব তথ্য না জেনে, ধর্মের পরবর্তীকালীন বিকৃতিকে এই সব অন্যায় প্রথাগুলির প্রচলনের জন্য দায়ী করেন।

কিন্তু, লক্ষ করুন, ধর্মীয় মৌলবাদ সেই দুদিক থেকেই লাভবান হতে থাকে। বহুবিবাহ বোরখা বা ঘোমটার বৈজ্ঞানিক সমর্থন পেলেও তার লাভ। ধর্ম কত ভাবনাচিন্তা করে কাজ করত দেখ! আবার পরবর্তী বিকৃতির তত্ত্ব গৃহীত হলেও তার সুবিধা। দেখ দেখ, আদিতে ধর্ম কত ভালো ছিল। চল, আমরা সেই আদি যুগের আদর্শকেই তুলে ধরি।

বুর্জোয়া মানবতাবাদীরাই প্রথম নারীমুক্তির কথা ইতিহাসে উত্থাপন করেন। ব্যক্তি স্বাধীনতার যে ধারণা তাঁরা তুলে ধরেন, তাতে নারীকেও যুক্ত করতে হবে—এই বোধটা তাঁরাই প্রথম বলেছেন। এইভাবে তাঁরাই প্রথম সমাজ মননে সামাজিক মতাদর্শে নারীকেও মানুষ বলে গণ্য করার চিন্তা নিয়ে আসেন। কিন্তু ধনতন্ত্রেও নারীর যথার্থ মুক্তি আসেনি। কিছু আনুষ্ঠানিক অধিকার সে পেয়েছে মাত্র। মাত্র কয়েক পা সে এগোতে পেরেছে। তবুও যতটুকু অধিকার সে পেয়েছে তার সমস্তটাই এসেছে ধর্মীয় গণ্ডি অতিক্রম করেই। তার ঘেরাটোপে থেকে নয়। নারী শিক্ষায় সমস্ত ধর্ম, সমস্ত ধর্মীয় শক্তি সাধ্যমতো বাধা দিয়েছে। বাল্যবিবাহ রোধে, বহুবিবাহ রোধে সমস্ত ধর্ম সমস্ত ধর্মীয় শক্তি আজ অবধি বাধা দিয়ে যাচ্ছে। হিন্দু সমাজে সতীদাহ প্রথা নিবর্তন কিংবা বিধবা বিবাহ প্রবর্তন—কোনোটাই ধর্মের শুভবুদ্ধিতে সম্ভব হয়নি। ধর্মীয় বিশ্বাস আচার ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে গিয়েই তা সম্ভব হয়েছে। যাঁরা আদিতে ধর্মের খুব ভালো ভূমিকার দাবি তোলেন, তাঁদের ভুলে গেলে চলবে না, সমাজ সংস্কার ধর্মসংস্কার আন্দোলনকে কোনো আদি-ভালো-ধর্ম পন্থী ব্যক্তি বা শক্তি ভালো চোখে দেখেননি বা সমর্থন করেননি। শুরু করা তো দূরের কথা। আজও প্রাচীনপন্থী ধর্মীয় লোকেরা সতীপ্রথার মতো একটা বীভৎস নিষ্ঠুর কাজকে খুব উচ্চ মূল্য দিয়ে থাকে। অর্থাৎ, আরও এগোতে হলে নারীদের ধর্মীয় গণ্ডি থেকে আরও বেশ অনেক পা হেঁটে যেতে হবে।

নারীর পোশাকের প্রশ্ন।

ধর্মীয় মৌলবাদকে চিনতে হলে, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ধর্মীয় মৌলবাদীদের মধ্যে আত্মিক ঐক্যকে দেখতে হলে এই জায়গায় এসে আমাদের শেষ পর্যন্ত দাঁড়াতেই হবে।

ধনতন্ত্র নারীকে সামন্তী নাগপাশ থেকে যতটা মুক্ত করেছে, তার চেয়ে বেশি সে চেয়েছে নারী শরীরের মুক্তি। পর্দা বোরখা ঘোমটার সে বিরোধিতা করেছে প্রথম যুগে নারীশ্রমশক্তিকেও উৎপাদনে নিযুক্ত করার অভিপ্রায়ে; আর এখন সে উন্মুক্ত পোশাকের ওকালতি করছে নারী শরীরের পণ্যায়নের জন্য। নারী দেহ যত অনাবৃত তত বেশি করে এবং ভালো করে পণ্য হবে। তত শক্তিশালী মুনাফাকর্ষী পণ্য। শরীর পণ্য বিপণন, আবার শরীর দিয়েও অন্য পণ্য বিপণন। নারী পাচার, নারী বেচাকেনা, গণিকাবৃত্তি, বার-পাবে নারীর নগ্ন বা প্রায়-নগ্ন শরীরী উপস্থিতি—এইখানে নারীদেহ নিজেই পণ্য। আর চলচ্চিত্র, বিজ্ঞাপন, সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা, মডেলিং—ইত্যাদির ক্ষেত্রে নারীশরীর অন্য পণ্যের বিক্রির আকর্ষক-পণ্য! এই সব কিছুর মধ্যেই নারী শরীরের পণ্যায়নের আয়োজন। পুঁজির এতে বিপুল মুনাফা হলেও সমাজ জীবনে এর থেকে যে বিপুল কুফল বর্তাচ্ছে তা নিয়ে এখানে সবিস্তার চর্চার সুযোগ নেই, বোধ হয় দরকারও নেই। কিন্তু একটা কথা বলতেই হবে। এই সবের মধ্য দিয়ে সমাজের এক বিস্তীর্ণ মণ্ডলে এই ধারণা নিরুচ্চারে প্রসারিত করে দেওয়া হয়েছে যে নারীর শরীর নিতান্তই সহজলভ্য এক দ্রব্য। যা ইচ্ছামতো ব্যবহার করা যায়। আর এই নিঃশব্দ ধারণাই সামন্তী সমাজ থেকে চলে আসা ঘরোয়া নারী নির্যাতনের বহুপ্রচলিত সিলেবাসে যুক্ত করল আর একটি ধারাপাত: বহির্নিযাতন। কটূক্তি, বিরক্তি উৎপাদন, অশ্লীল ভঙ্গিমা, শারীরিক আক্রমণ, ধর্ষণ। [এই বিষয়ে আমি অন্যত্র বিস্তারিত আলোচনা করেছি: মুখোপাধ্যায় ২০১৪, ৪৩-৬২] সাম্প্রতিক অতীতে নারী ধর্ষণ এক সাংঘাতিক বিপজ্জনক প্রবণতা হিসাবে ভারত বাংলাদেশ পাকিস্তানে দেখা দিয়েছে। ছয় বছর বয়সের শিশু থেকে শুরু করে সত্তর বছর বয়সের বৃদ্ধা নারী পর্যন্ত কেউই এই আনুক্রমিক আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না।

আরও দেখুন, যখনই কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটে, এক শক্তিশালী সম্প্রদায় আর এক দুর্বল প্রতিপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাদের প্রথম লক্ষ্য হয় নারী। নারীদেরকেই সে মনে করে সবচেয়ে সহজ শিকার। ধর্মীয় বিশ্বাস, আদিকালের ভালো ধর্মের ধারণা—কোনো কিছুই তখন এর বিরুদ্ধে সামান্যতমও বাধা হয়ে উঠতে পারে না। গুজরাতের ক্ষেত্রে এই ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। আবার, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়, বিশেষ করে, আল বদর, রাজাকার, প্রমুখ বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনগুলিই পাকিস্তানি হানাদারদের কাছে বাঙালি মেয়েদের যোগান দেবার প্রধান আড়কাঠি হয়ে ওঠে। জানা গেছে, এইভাবে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক সেনারা কমপক্ষে তিরিশ লক্ষ বাঙালি নারীর ইজ্জত লুট করে, ভয়ঙ্করভাবে নির্যাতন করে এবং অবশেষে তাদের বড় অংশকেই তারা হত্যা করে ফেলে। এই সব তথ্য এখন এত সুবিদিত যে একে আর চাইলেও অস্বীকার করা যাবে না।

সেই সঙ্গে এও বলে রাখি, আমার জানায় আজ অবধি কোনো মুসলিম ধর্মীয় সংগঠন—কি বাংলাদেশে, কি এপারে—পাক বাহিনীর সেই অত্যাচার বা জামাত শিবিরের সেই নারীদেহ যোগানদারিকে নিন্দা করেনি। করতে পারেনি। নিশ্চয়ই কিছু আরবি বয়েত এই নিন্দাকার্যের পক্ষে বাধা হয়ে আছে।
স্বভাবতই আজকের সমাজে এই সব ক্রমবর্ধমান ধর্ষণের ঘটনায়ও সাধারণ মানুষ গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন। তাঁরা এটা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বুঝতে পারেন, কোনো ধর্মমতেই এর কোনো সমাধান নেই। অথচ তাঁরা এর থেকে সমাধানের রাস্তা খুঁজে বেড়াছেন। আর ঠিক তখন—হ্যাঁ, এই সব জটিল মুহূর্তেই তো বিভিন্ন শক্তির আসল চেহারাটা বাইরে নগ্ন ভাবে বেরিয়ে আসে—ভারতে বিজেপি এবং তার সহযোগী শক্তিগুলির প্রতিনিধিরা, বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের সমচিন্তক ব্যক্তিরা কী বলছেন? তাঁরা নারীর পোশাককে দায়ী করছেন এই সব ঘটনার জন্য। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নারীকে মধ্যযুগীয় ঘরবন্দি জীবনচর্যায় ফিরে যেতে বলছেন। কেন? কারণ, সমস্ত ধর্মীয় চিন্তার মূল কথাই হল, নারীর স্থান ঘরের মধ্যে, সন্তান উৎপাদন ও তাদের লালন-পালনের কাজে। সমস্ত ধর্মই নারীকে পুরুষের অধীনস্থ জীব হিসাবে দেখেছে, পুরুষের শাসনাধীনে রাখার কথা বলেছে। নারী স্বাধীনতা, নারীর ঘরের বাইরে পুরুষের সাথে সমানভাবে সামাজিক দায়দায়িত্ব পালনে তার আপত্তি একেবারে মৌল ভিত্তিগত। এই সব আধুনিক জীবনবোধ আপন জীবনে পেতে হলে, আয়ত্ত করতে হলে, একে সমর্থন করতে গেলে ধর্মের গণ্ডি ছাড়িয়ে আসতেই হবে।

অথচ কী অদ্ভুত দেখুন! কি বিজেপি কি জামাতি—কেউই কিন্তু পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে, বৃহৎ বাণিজ্য সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে, টুঁ শব্দটিও করছে না। একবারও বলছে না, সাবান শ্যাম্পু তেল ক্রিম ইত্যাদির বিজ্ঞাপন বন্ধ করতে হবে, বা এই সব পণ্যের বিজ্ঞাপনে নগ্ন নারীদেহ প্রদর্শন বন্ধ করতে হবে, কিংবা এই জাতীয় সমস্ত বিজ্ঞাপন পুরুষদের দিয়ে করাতে হবে। কেন? কারণ, ধর্মীয় মৌলবাদী পাঁকে হাবুডুবু খেলেও তারা বোঝে, কোথায় খাপ খুলে লাভ নেই। আর আমাদের এখান থেকেও বুঝে নিতে হবে, এরা কাদের পক্ষের লোক! এদের শালীনতার দৌড় কতদূর! বুঝে নিতে হবে, নারীর পোশাক নিয়ে এদের মাথাব্যথার আসল জায়গাটা কী!!

ভারতে তথাকথিত লাভ-জেহাদিদের কথা শুনলেও এটা আরও সুন্দর করে বোঝা যাবে। যখন বলা হচ্ছে, মুসলিম যুবক হিন্দু নারীকে বিয়ে করলে মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি হবে (কথাটা যদিও ভুল), তখনও সে নারীকে শুধু সন্তান উৎপাদনের কারখানা হিসাবেই দেখছে (কথাটা ভুল, কেন না, সেই যুবক একজন মুসলিম নারীকে বিয়ে করলেও একই সংখ্যক সন্তানের জন্ম দিতে পারে। বরং বলা যায়, এতে হিন্দু সন্তান উৎপাদনের সংখ্যা কমানো সম্ভব হবে)। আর এইভাবে হিন্দু-মুসলিম পরিবারের ছেলেমেয়েদের পারস্পরিক প্রেম ভালোবাসা বিবাহ—সব কিছুরই বিরোধিতা করছে। ধর্ম এখানেও আধুনিক জীবন ধারণার বিরোধী।

কেউ কেউ এরকম একটা ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেন, কোরানে বোরখার কথা নেই, আদি ইসলামি শাস্ত্রে নারীর মুখ-চোখ ঢাকার কথা নেই, ইত্যাদি। তাঁরা বুঝতেই পারেন না, আজকের দিনে এই সব কথার কোনো মানে নেই। যদি আদি ইসলামি শাস্ত্রে নারীর হিযাব পরিধানের কথা থেকে থাকে, সেটাই মৌলবাদীদের জন্য যথেষ্ট। তার ইঞ্চিফুট নিয়ে আমি আপনি বিবাদ করতে পারি, কিন্তু মৌলবাদ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে: সমস্ত ঢাকো। তাই এখানে আমাকে আপনাকে যুক্তি তর্ক করতে হবে, কোরানে বলেছে বলেই কি আজকের দিনে তা মেনে চলা সম্ভব, না উচিত? কোরানে একজন মুসলিম পুরুষকে পরপর চারটে বিয়ে করার অধিকার দিয়েছে বলে কি আজকের দিনে তা আমরা অনুমোদন করতে পারি? সেখানে কোন কথাটা কেন বলা হয়েছিল, তা নিয়ে আমরা চর্চা করতে পারি, তর্ক করতে পারি, বুঝবার চেষ্টা করতেও পারি। কিন্তু সেই সব বিধান আজ আর আমরা পালন করতে পারি না। এই সরল কথাটা সহজ করে স্পষ্ট করে বলার সাহস আমাদের অর্জন করতে হবে।

ভয়ের কিছু নেই। প্রথমে বোঝাতে না পারলেও ধীরে ধীরে পারব। যেমন করে একদিন রামমোহন পেরেছিলেন, বিদ্যাসাগর পেরেছিলেন। আমরা দেখাতে পারব, দেখ, কোরানে সর্বাধিক চার জন স্ত্রী রাখার কথা বলা হলেও হজরত মহম্মদের নিজেরই ছিল বারো (বা মতান্তরে তেরোটি) স্ত্রী। তাহলে তুমি কোনটা মানবে? প্রিয় নবীর কথা না আচরণ? তখন এই কথাও উঠবে, কোরান হজরত মহম্মদের জীবদ্দশায় লিখিতই হয়নি। হয়েছে তাঁর মৃত্যুর অনেক বছর পরে। সেও ঠিক। তাহলে হজরতের ব্যক্তি জীবনের আচরণ জানা থাকা সত্ত্বেও যাঁরা সঙ্কলন করলেন, তাঁরা কোরানে কেন সংখ্যাটাকে চার-এ সীমাবদ্ধ করলেন? নিশ্চয়ই তাঁরা বুঝেছিলেন, উদাহরণ যাই থাকুক, যত উঁচু আসন থেকেই এসে থাকুক, সমাজে তাকেই নিয়ম হিসাবে চালু করা যাবে না। আর, বিশ পঞ্চাশ বছর বাদেই যদি এই অভিজ্ঞতা আর উপলব্ধি হয়ে থাকে, তাহলে এটা বুঝতে বা বোঝাতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, সেই সময় থেকে দেড় হাজার বছর পরে সেদিনকার নির্দেশ বা উদাহরণ আজ তো আমরা আর চাইলেও মেনে চলতে পারি না।

আরও দেখুন, কোরানে দাস বা গোলামদের প্রতি সদয় ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে। যার মানে হল, দাসপ্রথাকে সেখানে মেনেই নেওয়া হয়েছিল, তার ভিত্তিতেই সেই সব কথা বলা হয়েছে। আজ কোনো সভ্য দেশের সংবিধানে দাসপ্রথা মেনে নিয়ে দাসদের প্রতি কী আচরণ করা হবে তা লেখা যাবে? যাবে না। পক্ষান্তরে, এই যে বোকো হারাম, আইসিস, ইত্যাদি কিছু ইসলামি মৌলবাদী সংগঠন বিধর্মীদের দাস করার পক্ষে ফতোয়া দিচ্ছে, লক্ষ করলেই দেখা যাবে, তারা কিন্তু কোরান বা হাদিশের বিধান থেকে উদ্ধৃতি দিয়েই সেই কথা বলছে। ফলে কোরানের অন্য বাণী দিয়ে অথবা এই সব বিধানের অন্যতর ব্যাখ্যা উপস্থিত করে আমি আপনি এদেরকে পরাস্ত বা নিরস্ত করতে পারব না।

আবার আমি পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিই: মৌলবাদ মানুষকে ইতিহাসে মানুষেরই বর্জিত জীবন-ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়। অন্তত তার পক্ষে দাবি করে। আর যেহেতু অনেকেই না জেনে বিশ্বাস করেন, আদিতে ধর্ম অনেক ভালো ছিল, পরে স্বার্থান্বেষীরা এসে তাকে বিকৃত ও খারাপ করেছে, তাই তাদের বক্তব্য একটা বিরাট অংশের ধর্মবিশ্বাসীকে আকৃষ্ট করতে পারে।

[১১] মতাদর্শগত সংগ্রাম: সামনেই দুই-পা

কিন্তু একথা তো ঠিক, রামমোহন এবং বিদ্যাসাগর দুজনেই তাঁদের সংস্কার কার্যক্রমের সমর্থনে আদি হিন্দু শাস্ত্রের দোহাই দিয়েছিলেন। অনুকূল নজির তুলে এনেছিলেন। সুতরাং আজ আমরাও যদি সাম্প্রদায়িকতা মৌলবাদের বিরুদ্ধে আদর্শগত লড়াইতে বেদ পুরাণ বা কোরানের থেকে প্রাসঙ্গিক ভালো ভালো কথা তুলে ধরতে পারি, তাতে ক্ষতি কী? এই প্রশ্নটাও অনেককে ভাবাচ্ছে। অনেকে এইভাবেই লড়াই করার কথা ভাবছেন। লড়াইটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার কথা ভাবছেন।

রামমোহন এবং বিদ্যাসাগরের রণকৌশলের কথাটাই আগে বিচার করি। তাঁরা যথাক্রমে ঊনবিংশ শতাব্দের গোড়ায় এবং মাঝামাঝি পর্বে তাঁদের সংগ্রামগুলি করেছিলেন। তখন সাধারণ মানুষের জীবনে ধর্মের বিপুল প্রভাব ছিল। অবস্থাটা আজকের মতো ছিল না। শাস্ত্রটাস্ত্রে কী লেখা আছে কেউ জানত না পড়ত না, কিন্তু টিকিধারী ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের দেওয়া ব্যাখ্যা তারা মেনে চলত। ফলে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে রামমোহনকে, বিধবা বিবাহের পক্ষে বিদ্যাসাগরকে শাস্ত্রীয় সমর্থন দেখাতে হয়েছিল। সেই পরিস্থিতি আজ আর নেই। ধর্মের দাপট আগের তুলনায় অনেকখানি কমে গেছে। ধোপা-নাপিত বন্ধ করে রাস্তায় হাঁটার পথ বন্ধ করে বা খাওয়ার জল নিতে না দিয়ে বেকায়দায় ফেলার ক্ষমতা তার আজ আর প্রায় নেই বললেই চলে। এই ক্ষমতা চলে গেছে রাজনৈতিক দলগুলির হাতে। তারা অবশ্য সরকারে থেকে এই একই ধরনের কাজ করতে পারে, আজকাল করেও থাকে বিরোধী দল বা ব্যক্তি বিশেষের বিরুদ্ধে। কিন্তু শাসক দলের মদত না পেলে ধর্মের নামে এরকম কাজ করার ক্ষমতা বা সাহস কোনোটাই আর ধর্মগুরু সাধুবাবা কিংবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নেই।

দ্বিতীয়ত, সেই সময়ে রামমোহন এবং বিদ্যাসাগর—দুজনের ক্ষেত্রেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে আশ্বস্ত করার একটা মস্ত ব্যাপার ছিল। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের আগে পর্যন্ত কোম্পানির লোকদের মনোভাব ছিল, উপনিবেশের দেশি লোকদের ধর্ম চর্চায় বাধা না দিয়ে বা হস্তক্ষেপ না করে যতদূর পারা যায় নির্বিঘ্নে বাণিজ্য ও লুণ্ঠন চালিয়ে যাওয়া। তখন পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেওয়ার কথা তাদের মাথাতে আসেনি। তাই তারা সাবধান হয়ে এগোতে চাইছিল। ভারতীয় মনীষীরা যদি সতীপ্রথার বিরুদ্ধে বা বিধবা বিবাহের সমর্থনে কোনো প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রীয় প্রমাণ দাখিল করতে না পারতেন, তারা আইন করে একটার নিবর্তন ও অন্যটার প্রবর্তনের দিকে যেত না। এটা রামমোহন এবং বিদ্যাসাগর—দুজনেই বেশ ভালোরকম জানতেন। এই ব্যাপারটাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। আমাদের সামনে এখন এই সমস্যাটাও নেই। আমরা যদি আজকের দিনে সমাজের কোনো কুপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করি (যেমন, ডাইনি প্রথা), তার জন্য শাস্ত্রীয় সমর্থন খুঁজে বের করার খুব একটা দরকার নেই।

রামমোহনের না থাকলেও বিদ্যাসাগরের অবশ্য আরও একটা গূঢ় উদ্দেশ্য ছিল। ব্যক্তিগত বিশ্বাসের পর্যায়ে তিনি ছিলেন নাস্তিক, ধর্ম ঈশ্বর ব্রহ্ম—কোনো কিছুতেই তিনি বিশ্বাস করতেন না। ভারতীয় প্রাচীন শাস্ত্রগুলির সম্পর্কে এবং বড় বড় শাস্ত্রকারদের প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা ছিল না। কিন্তু বুদ্ধিমান মানুষ, তাই তাঁর এই মনোভাব তিনি বড় একটা প্রকাশ্যে ব্যক্ত করতেন না। ঘনিষ্ঠ বন্ধুমহলে অফ-লাইন আলোচনায় এই সব ব্যাপারে কিছু কিছু যা বলে গেছেন তা থেকে (মানে, তাঁদের স্মৃতিচারণ থেকে) আমরা এটা জানি। তিনি চেয়েছিলেন, বিভিন্ন হিন্দু শাস্ত্র গ্রন্থে এই সব (বিধবার পুনর্বিবাহ, বাল্যবিবাহ, গর্ভনিষেক, ইত্যাদি) সামাজিক সমস্যার ব্যাপারে যে অনেক রকম বিচিত্র ও পরস্পর বিরোধী, এমনকি হাস্যকর সব বিধান দেওয়া আছে—সেই দিকে সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। তাঁর শাস্ত্রোল্লেখ, শাস্ত্র চর্চার ধরন এবং বিতর্কের রীতি অনুসরণ করলেই এই সত্য ধরা পড়বে।
হ্যাঁ, অনেকেই বলবেন, এই কথাগুলো হয়ত হিন্দু সমাজের ক্ষেত্রে সত্য। তারা নানা কারণে শিক্ষাদীক্ষা চাকরিবাকরি ইত্যাদি নানা দিক থেকে বেশ খানিকটা এগিয়ে আছে। অন্তত পশ্চিম বাংলায় এই সব প্রসঙ্গ এখন খোলামেলা আলোচনা করা যায়। কিন্তু মুসলমান সমাজের ক্ষেত্রে এই ভাবে কথা বলা চলে না। তারা সব ব্যাপারেই আজও অনেকটাই পশ্চাদপদ। এইভাবে বললে তারা নেবে না। নিতে পারবে না। হয়ত লাঠি নিয়ে তাড়া করবে। এরকম যুক্তিও অনেকে করে থাকেন। ফলে বোরখাই হোক, বিবাহ বিচ্ছেদই হোক, আর বহুবিবাহই হোক, কোরান হাদিশ ইত্যাদির সাহায্য আমাদের নিতেই হবে। অন্তত নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। তার বিরুদ্ধে কিছু বলা উচিত হবে না।

কেউ কেউ এর সমর্থনে আবার মার্ক্সের সেই বিখ্যাত উক্তির “পুরোটা” তুলে ধরে বোঝাতে চান, তিনি ধর্মকে শুধু আফিমের তুলনা করেননি। বলেছেন, ধর্ম হচ্ছে সাধারণ নিপীড়িত মানুষের আত্মিক সান্ত্বনার জায়গা। গরিব মানুষের দীর্ঘশ্বাস। পার্থিব শোষণ জুলুমের বিরুদ্ধে স্বর্গীয় প্রতিবাদ। [Marx 1976, 39] তাই ধর্মীয় আবেগে আঘাত করে কোনো সামাজিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না। মাঝখান থেকে মানুষ আরও আমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে।

এর উত্তরে আমি আপাতত দুটো কথা বলব। প্রথমত, এরকম চেষ্টা আমরা বহু দিন ধরে করে এসেছি। কোনো লাভই হয়নি। মাঝখান থেকে, বামপন্থী মার্ক্সবাদী বা যুক্তিবাদীদের তরফ থেকে এরকম যুক্তি উত্থাপন করার দ্বারা আমরা তাদের মধ্যে ধর্মীয় গোঁড়ামি, প্রাচীন শাস্ত্রগ্রন্থের প্রতি ভক্তিভাব ও মান্যতা বাড়াতেই সাহায্য করেছি। সেইগুলিকে ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক প্রেক্ষিতে দেখবার সামান্য আগ্রহটুকুও তৈরি করতে পারিনি। অতএব এখন থেকে অন্তত এই চেষ্টা আমাদের পরিত্যাগ করা উচিত। বিদ্যায়তনিক পর্যায়ে মুসলিম (বা অন্য যে কোনো) ধর্মশাস্ত্র নিয়ে আলোচনা চলতেই পারে। আমার বক্তব্য হল, আমাদের তরফে আমরা প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রগুলির প্রশংসা বা সমালোচনা কোনোটাই নিজের থেকে আম জনতার কাছে নিয়ে যাব না। প্রশ্ন উঠলেও আমরা তার মধ্যে আজকে নেওয়ার মতো কী কী ভালো জিনিস আছে, তার ব্যাখ্যায় ঢুকব না। আমাদের কাজ হচ্ছে শুধুমাত্র এইটা দেখানো যে তার মধ্যেকার ভালোটাও শুধুমাত্র সেই সময়ের পক্ষেই হয়ত ভালো ছিল, তার খারাপটাও তাই। বর্তমানে আমরা যে সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন, তার সমাধান সেখানে নেই বা থাকার প্রশ্নও নেই।

দ্বিতীয়ত, ভারতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসাবে মুসলিম সমাজের ভেতরে মানসিকভাবে এমনিতেই একটা ভয়-ভয় ভাব কাজ করে। এই বুঝি তাদের ধর্ম ধর্মীয় সংস্কৃতি বা তাদের স্বসত্তা (identity) বিপন্ন হয়ে পড়ল। ফলে তাদের আচারে বিচারে আহার বিহারে এর একটা প্রতিফলন সব সময়ই ঘটতে থাকে। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে যত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে, তা ক্রমশ একপেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন, উচ্ছেদ, নারী-ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও গণহত্যাকাণ্ডের দিকে গড়িয়েছে (পাকিস্তান বা বাংলাদেশেও অবশ্য তাই)। তাই তারা তাদের শাস্ত্র, আচার-প্রথা, পোশাক, ইত্যাদিকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরে নিজেরাও বাঁচতে চায়, তাদের আপাত-স্বসত্তাকেও ধরে রাখতে চায়। এই অবস্থায় আমরাও যদি সেই দিক থেকেই তাদের মধ্যে শুভবুদ্ধি জাগাতে যাই, আমরা এই পশ্চাদ-আকর্ষণকেই আরও শক্তিশালী করে বসব। অন্যদিকে আমরা যদি তাদের ব্যক্তিগতভাবে ধর্মচর্চার বিরোধিতা না করার পাশাপাশি সমাজ জীবনে তাদের শ্রেণি ও পেশাগত অবস্থানের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি, সেখানে সহজেই দেখানে যাবে, তারা আর সংখ্যালঘু নয়। শ্রমিক চাষি অসংগঠিত শ্রমিক শিক্ষক অধ্যাপক কেরানি দোকানদার অটোচালক রিকশাচালক—কোনো হিসাবেই সে আর সংখ্যালঘু নয়। সে তখন সংখ্যাগুরুর অন্তর্ভুক্ত। বিশাল শোষিত সমাজের একজন। তখন এমনিতেই কোরানে বা হাদিশে কী বলা আছে, তা নিয়ে আমাদের আর মাথা ঘামাতে হবে না।

বরং খুব সত্যি কথা বলতে গেলে, মুসলিম সম্প্রদায়ের একটা ক্ষুদ্র অংশের মধ্যেও এই বোধটা ধীরে ধীরে জাগছে। বিজেপি-র লোকেরা যখন বলছে, আমরা বামপন্থীরা মার্ক্সবাদীরা নাকি ভোটের জন্য মুসলিম তোষণ করছি, তখন তারা আসলে আমাদের আদর্শগত আপসের কথাই ইঙ্গিত করছে, আর বাস্তবে মুসলিম জনসাধারণের আর্থিক সামাজিক অবস্থান ক্রমশ নিচের দিকে তলিয়ে যাচ্ছে। সাচার কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর এই সত্য আরও বেশি করে সকলের চোখ খুলে দিয়েছে। অর্থাৎ, আমরা যতই টুপিদাড়ির তোষামোদ করছি, ততই তারা শিক্ষায় চাকরিবাকরিতে ক্রমাগতই পিছিয়ে পড়ছে। এই তোষণ তাদের মধ্যেও আর বেশিদিন সাড়া জাগাতে পারবে না। তারাও আর বেশি দিন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভোটব্যাঙ্ক হয়ে থাকতে চাইবে না।

আজকে পশ্চিম বঙ্গে তৃণমূল সরকার এই পরিচিত রাস্তাই বেছে নিয়েছে। তারও চাই মুসলমান ভোট। যে কোনো মূল্যে, যে কোনো পন্থায়। ইমামভাতা, ইত্যাদি আদালতের রায়ে আটকে গেলেও তার লক্ষ্যও একই। এখন সে ঘুরিয়ে ওয়াকফ বোর্ডের মাধ্যমে সেই টাকা বরাদ্দ ও খয়রাত করে যাচ্ছে। এমনকি পশ্চিম বঙ্গ নজরুল অ্যাকাডেমি গঠনকেও তারা তাদের সংখ্যালঘু উন্নয়নের কর্মসূচির একটি পদক্ষেপ বলে ঘোষণা করেছে। ভাবা যায়? নজরুলের কাব্য সঙ্গীত চর্চা মানে মুসলিম সংস্কৃতির চর্চা? শুধুমাত্র মুসলিমদের মধ্যে এই চর্চা হবে? আধর্ম বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি সঙ্গীতের সাথে নজরুলের সম্পর্ক নেই? আসলে এই ছোট বৃত্তের মধ্যে তারা নিজেরাও আটকে পড়েছে, মুসলিম জনসাধারণকেও আটকে রাখতে চাইছে।

এটাও তো সত্যি কথাই যে কিছুকাল আগে এই মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক অটুট ধরে রাখার জন্যই সি পি আই (এম) সরকারে থাকার সময় তসলিমা নাসরিনের একটা বই “দ্বিখণ্ডিত” নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছিল। আদালতে সেই সিদ্ধান্ত বিশ্রীভাবে খারিজ হয়ে যাওয়ার পর তারা কলকাতার রাস্তায় কিছু মুসলমান যুবককে জড়ো হয়ে একটা প্রক্সি-গোলমাল পাকাতে দিয়ে এবং তারপর (এক অলিখিত স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী) তা অচিরেই সামলে নিয়ে এরকম একটা বাতাবরণ তৈরি করে যে তসলিমা কলকাতায় থাকলে রাজ্যে হিন্দু-মুসলিম অশান্তি বাড়বে। এমনকি, সত্যিই তা ঘটে কিনা তা দেখার জন্য একদিনও অপেক্ষা না করে সেই রাতেই তারা তসলিমাকে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে যোগসাজশে জবরদস্তি কলকাতা থেকে এক বিজেপি শাসিত রাজ্যে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। এতে মুসলিম সমাজের কার কী উপকার হয়েছে? বরং এর মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছিল মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সেই ভ্রান্ত লাইন: মুসলিম সমাজকে আকর্ষণ করতে তাদের মধ্যেকার সবচাইতে পিছিয়ে থাকা চূড়ান্ত রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল প্রবণতাগুলিকে লালনপালন কর। উৎসাহ দাও। আধুনিক শিক্ষা, আধুনিক জীবনরীতি, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিকে তাদের টেনে আনার চেষ্টাও কোরো না। এর ফলে মুসলিম সমাজের মধ্যে থেকে যাঁরা রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন, তাঁরা দুর্বল হয়ে যাচ্ছেন, ঘরে-বাইরে আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছেন। আর প্রতিক্রিয়ার শক্তি, মৌলবাদী শক্তি, উজ্জীবিত হয়ে উঠছে। আবার এই জাতীয় ঘটনা দেখিয়েই সঙ্ঘ পরিবার তথাকথিত মুসলিম তোষণের অভিযোগ এনে সাধারণ হিন্দু জনসাধারণের মন বিষিয়ে তোলার সুযোগ পায়।

হ্যাঁ, একথা ঠিক যে তসলিমা নাসরিনের বেশ কিছু রচনায় ধর্মের বিরুদ্ধে, ইসলামের বিরুদ্ধে অনেক কড়া কড়া কথা আছে। তাতে হয়ত কিছু ধর্মভিরু মুসলিম আহত বোধ করতে পারে। কিন্তু ইসলামপন্থীদেরও হাত পা তো কেউ বেঁধে রাখেনি। তাঁরা তার জবাব দিন না। তসলিমার লেখায় যদি ভুল তথ্য থাকে, ইতিহাসের বিকৃতি থাকে, হজরত মহম্মদ সম্পর্কে ভুল সমালোচনা থেকে থাকে, তাঁরা সেটা উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ সাক্ষ্য দিয়ে ধরিয়ে দিন। প্রচার করুন, বক্তৃতা দিন, লিখুন। আমরাও পড়ি শুনি। ভয়ের কী আছে? তাঁকে মেরে ফেলতে হবে কেন? তাড়িয়ে দিতে হবে কেন? তর্ক এড়িয়ে আঘাত করতে চাইছ মানে হল: তুমিও সম্ভবত মনে মনে মেনে নিচ্ছ, তাঁর বক্তব্যের মধ্যে কিছু না কিছু সত্য আছে। যা নিয়ে আলোচনা হোক, তুমি একেবারেই চাও না। কেন না, তুমি সেই সব কথাকে কাটতে পারছ না। এই কথাটা যদি সেদিন বামফ্রন্টের নেতারা বলতে পারতেন, সি পি আই (এম) নেতারা জোর দিয়ে বলতে পারতেন (সেই সাংগঠনিক তাকত তখন তাঁদের ছিল), শুধু ইসলামি নয় হিন্দু মৌলবাদেরও হাত থেকে একটা বড় অস্ত্র চলে যেত। তারপর তাঁরা তসলিমার লেখায় কোথায় কতটা উগ্রতা আছে অহেতুক আঘাত আছে, তা নিয়ে তাঁরও সমালোচনা করতে পারতেন। কিন্তু সরকারপক্ষ যুক্তিতর্কের স্বাভাবিক পথটি এড়িয়ে গিয়ে ধর্মান্ধ মোল্লাতন্ত্রের কাছেই আত্মসমর্পণ করলেন। সেই সহজ রাস্তাটা তাঁরা বেছে নিলেন, যার দ্বারা দুই মৌলবাদী শক্তিরই উপকার হল।

অথচ সাম্প্রতিক কালে ফ্রান্স একটা অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর উদাহরণ আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। তারা ঘোষণা করেছে: পাব্লিক স্কুলে পড়তে হলে মুসলিম মেয়েদেরও স্কুল পোশাক ছাড়া অন্য বাড়তি কিছু (যথা বোরখা/ওড়না ইত্যাদি) পরে মাথা মুখ ঢেকে ক্লাশে আসা চলবে না। কিছুদিন সেখানকার পশ্চাদপদ মুসলিম জনসাধারণের একটা অংশ কিছু কিছু জায়গায় ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা করেছিল, কিচ্ছু লাভ হয়নি। সরকার তার সিদ্ধান্তে অটল থেকেছে। মুসলিমদের কোনো একটা গোষ্ঠী ইউরো আদালতে মামলা করেছিল এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। সেই আদালতও রায় দিয়েছে ফরাসি সরকারর সিদ্ধান্তের পক্ষেই। আমি মনে করি, পৃথিবীর সমস্ত দেশেই যদি যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলি এইভাবে কড়া হাতে রক্ষণশীল ও মৌলবাদীদের মোকাবিলা করে, মৌলবাদীদের পায়ের তলা থেকে মাটি অনেকটাই সরে যাবে। প্রগতিশীল শক্তি আর একটু দৃঢ় পায়ে এগিয়ে চলার ভরসা পাবে। এখনকার তুলনায় দু চারশ বছর আগে সাধারণ মানুষের উপর ধর্মের অনেক বেশি প্রভাব থাকা সত্ত্বেও যদি মধ্যযুগের ধর্মতান্ত্রিক সমাজ থেকে বেরিয়ে এসে পৃথিবীর এতগুলো দেশে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সমাজ গঠন সম্ভব হয়ে থাকে, আজ তো তাকে ভয় পাওয়ার কারণ আরও কম, যদি অবশ্য তাকেই ব্যবহার করার বদিচ্ছা না থাকে!

পরিশেষে, মার্ক্সের মন্তব্য সম্পর্কেও কিছু কথা বলা দরকার। এক নম্বর কথা হল, অনেকেই ভুলে যান যে মার্ক্স যখন (১৮৪৪) এই কথাগুলো বলেছেন তখনও তিনি পুরোপুরি মার্ক্সবাদী হয়ে ওঠেননি, হওয়ার পথে। তখন তিনি হেগেলের প্রভাব কাটিয়ে উঠে মূলত ফয়ারবাখের মানবকেন্দ্রিক বস্তুবাদের ভাবশিষ্য। ধর্মের আধ্যাত্মিকতা, ঐশ্বরিকতার বিরুদ্ধে পার্থিব চিন্তাকে, ঐহিক চিন্তাধারাকে জাগিয়ে তুলতে চাইছেন। স্বর্গের মোহ থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্য এই পৃথিবীতেই স্বর্গ স্থাপনার কথা ভাবছেন। দ্বিতীয়ত, তখন জার্মানিতে খ্রিস্টীয় ভাবধারার বিরুদ্ধে নানা রকম দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মের সমালোচনা চলছিল। ব্যক্তি যিশু খ্রিস্টর ঐতিহাসিক বাস্তবতা নিয়ে তখন তুমুল চর্চা বিতর্ক ও গবেষণা চলছিল। কিছু কাল পরে এঙ্গেল্‌সও সেই বিতর্কে যোগ দিয়ে খুব মূল্যবান কিছু কথা বলেছিলেন। সেই পরিস্থিতিতে মার্ক্স এই কথা কটা বলে বোঝাতে চেয়েছিলেন, ধর্ম একটি মোহময় ভাবধারা হলেও এই মোহ থেকে মুক্ত করতে হলে, যে সমাজ ব্যবস্থা সেই মোহর জন্ম দেয়, তাকেই পাল্টাতে হবে। তাহলে কি সেই সমাজ পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত মার্ক্সবাদীরা ধর্মের সমালোচনা মুলতুবি রাখবে? এরকম ভাবনা যে অন্তত মার্ক্সের তরফে হাস্যকর তার প্রথম এবং প্রধান প্রমাণ এই যে মার্ক্স নিজেই তা স্থগিত করে দেননি। একটা বেশ বড় আকারের প্রবন্ধ লিখেছিলেন এই বিষয়ে।

সুতরাং মোহ সৃষ্টিকারী বর্তমান শোষণমূলক ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা এবং তৎসৃষ্ট ধর্ম-মোহাঞ্জন—এই দুইয়েরই বিরুদ্ধে চলবে আমাদের যুগপৎ সংগ্রাম। আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক শ্রেণি সংগ্রামের মধ্যেই অঙ্গীভূত করে নিতে হবে এই মোহমুক্তির সংগ্রাম প্রয়াসকেও। কাজটা কঠিন। ঠিক। কিন্তু মার্ক্সবাদীদের কেউ তো দিব্যি দেয়নি কাজটাকে সহজ করে তোলার জন্য বা কঠিন কাজকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য। তাদের যে মতাদর্শগত লড়াই, তার মধ্যেই একটা অধ্যায়ে থাকবে এই ধর্মীয় মোহমুক্তির যুক্তি তর্ক ও প্রেরণা। একজন বুর্জোয়া মানবতাবাদী কবি হয়ে রবীন্দ্রনাথ যদি “ধর্মমোহ” কবিতা লিখতে পেরে থাকেন, “যে পূজার বেদী রক্তে গিয়েছে ভেসে” তাকে ভাঙবার সোচ্চার আহ্বান জানিয়ে থাকতে পারেন, মার্ক্সবাদীদের এই প্রশ্নে এত দ্বিধা দ্বন্দ্ব থাকবে কেন?

[১২] আমাদের কাজ

তবে, পাশাপাশি এটাও আমাদের অবশ্যই ভুলে গেলে চলবে না, সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে আমাদের এই কাজটা মূলত সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামের প্রধান কাজের একটা অঙ্গ, এটাই আমাদের সকলের প্রধান কাজ নয়। সেই সমাজ পরিবর্তন মানে হল, বর্তমান শ্রেণিবিভক্ত সমাজের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের পরিবর্তন, শুধু হাত আর পায়ের নয়। শুধু মাথারও নয়। এই সমাজ পরিবর্তন সম্ভব হবে সমগ্র শোষিত শ্রেণির সুদৃঢ় ঐক্যের ভিত্তিতে। আর এই ঐক্য গড়ে উঠবে একমাত্র সমমতের সহমতের ভিত্তিতে, ধর্ম বর্ণ জাতি লিঙ্গ ভাষা ইত্যাদি সমস্ত বিভাজনরেখাকে অতিক্রম করে। মুছে দিয়ে নয়; এর মধ্যেকার সামাজিক ভেদচিহ্নগুলি সমাজে আরও বহু দিনই থেকে যাবে। নারীপুরুষের ভেদ তো আরও মৌলিক ও জৈব চরিত্রের। তার তো অবলুপ্তির প্রশ্নই ওঠে না। কিন্ত ভেদ মানেই বিভাজন নয়, বিভাজন মানেই বৈষম্য নয়। মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক কিছু ভেদ সহই শ্রেণিগত ঐক্য গড়ে উঠবে, অন্তত সেইভাবেই গড়ে তুলতে হবে। আর তার জন্যই এই সব প্রশ্নের স্পষ্ট সদুত্তর দিয়ে দিয়ে আমাদের মধ্যে মতাদর্শগত নৈকট্য স্থাপন করতে হবে। শুধু আন্দোলন করব, কিন্তু আন্দোলনের মধ্যেকার সমস্ত মতাদর্শগত প্রশ্নগুলির সুষ্ঠ মীমাংসা করব না—এই ফাঁকি দিয়ে আর বামপন্থী মার্ক্সবাদী বা যুক্তিবাদীদের কাজ চলবে না। সঙ্ঘ পরিবার (অন্যান্য দেশে তাদের অন্যান্য জাতভাইরা) এবার এমন জায়গায় আমাদের ঠেলে দিয়েছে যে পুরনো ফেলে রাখা কাজগুলো আমরা চাই বা না চাই এখন সম্পন্ন করতেই হবে।

শাসক শ্রেণির এখন ধর্মকে দুই কাজে প্রয়োজন। একটা হল, তার নিজের অপকর্মের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে মানুষকে অন্য দিকে অন্য বোগাস কাজেকম্মে ব্যস্ত রাখা। আর একটা হল, শোষিত মানুষের সার্বিক ঐক্যে ফাটল ধরানো। তার দ্বারা ক্রম অগ্রসরমান সমাজ বিপ্লবকে কিছু দিনের জন্য হলেও ঠেকিয়ে রাখা। অথবা কোথাও সমাজ পরিবর্তন ঘটে থাকলে তাকে ভেঙে দেবার আয়োজন করা। ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশ—কোনো দেশই এই পরিকল্পনার বাইরে নেই। ফলে সংশ্লিষ্ট সকলেরই সাবধান হওয়ার সময় এসেছে।

ভারতবর্ষের বুকে আমরা বিজেপি-আরএসএস ইত্যাদির মাধ্যমে এই পরিকল্পনারই এক রুদ্রমূর্তি দেখতে পাচ্ছি। এবারে ওরা একটা সাঁড়াশি আক্রমণ হানতে চাইছে। একটা হল চিন্তার জগতে আক্রমণ। গণেশ, কর্ণ, গান্ধারী ইত্যাদি-সম্পৃক্ত প্রশ্ন। প্রাচীন ভারতের মুনিঋষিদের ঘাড়ে অসম্ভব সমস্ত আবিষ্কারের কৃতিত্ব চাপানোর গল্প। গীতা কিংবা সংস্কৃত ভাষা চাপিয়ে দেবার অপপ্রয়াস! আর সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিদ্বেষবাষ্প ছড়ানোর আয়োজন। আর একটা হল, সরকারি শাসন ক্ষমতায় বসে জনসাধারণের উপর একটার পর একটা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আক্রমণ। দ্বিতীয়টাই আসল। মনমোহন সিং সরকার একচেটিয়া পুঁজিপতিদের আদেশ পালনে যথেষ্ট তৎপরতা দেখাতে পারেনি বলেই ওদের সরিয়ে এদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়েছে ওরা। মোদীর সঙ্গে আদানী আম্বানীদের প্রতিদিনকার ওঠাবসা এখন বুর্জোয়া গণমাধ্যমগুলির চোখেও খুবই বিসদৃশ ঠেকছে। তারাও মাঝে মাঝে তীর্যক মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রীকে সচেতন করে দিতে চাইছে: তুমি কাদের কুলের জামাই সেটা এত প্রকাশ্যে রোজ রোজ দেখিয়ে দিও না বাপু। জাতীয় সম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ, আর্থিক সম্পদ—সমস্ত কিছু দেশি বিদেশি করপোরেটদের হাতে বিনি পয়সায় অথবা নামমাত্র মূল্যে তুলে দিচ্ছে মোদী সরকার। জনসাধারণের স্বার্থে প্রয়োজনীয় সমস্ত ভর্তুকি ছাঁটাই করে লক্ষ কোটি টাকার ভর্তুকি দিচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের বিরাট অঙ্কের ঋণ খেলাপি করা বৃহৎ ব্যবসায়ীদের। দেশের অর্থনীতিকে বিদেশি পুঁজির যথেচ্ছ লীলাভূমি করে ফেলতে চাইছে তারা।

আর ওদের মাধ্যমে বুর্জোয়া শ্রেণির এই দ্বিমুখী আক্রমণের চরিত্র এমন যে আমরা হয়ত অসতর্কভাবেই যে কোনো একটার দিকে নজর দেব, অপরটা দৃষ্টির বাইরে চলে যাবে। কেউ বেশি শ্রেণি সচেতন হতে গিয়ে সাংস্কৃতিক আক্রমণগুলিকে অবহেলা করবেন; কেউ আবার হয়ত সাংস্কৃতিক আক্রমণগুলিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে আর্থরাজনৈতিক আক্রমণগুলিকে খাটো করে ফেলবেন। আর যেটাই নজরের বাইরে থাকবে, সেখান দিয়েই এক মারাত্মক বিপদ এসে উপস্থিত হবে। তাতে ওদের লাভ। ওরাও এটাই চাইছে।

অতএব আমাদেরও সাবধান হতে হবে। শিখতে হবে, কীভাবে ওদের দ্বিমুখী আক্রমণকে এক যোগে মোকাবিলা করা যায়, তার জন্য কীভাবে উভয় ফ্রন্টে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

সামনে এক কঠিন পরীক্ষা।

সেই পরীক্ষায় আমাদের সার্থকভাবে উত্তীর্ণ হতে হবে।

তথ্যসূত্র

অশোক মুখোপাধ্যায় (২০১৪), “মেঘে ঢাকা যে অর্ধেক আকাশ”; অস্তিত্বের সংলাপ: সমাজ-অর্থনীতি-সংস্কৃতি উপকথা; সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সায়েন্স অ্যান্ড সোশাইটি [সেস্টাস], কলকাতা।

অশোক মুখোপাধ্যায় (২০১৫), “প্রাচীন ভারতে “আধুনিক”(?) বিজ্ঞান”; অনীক, বর্ষ ৫২ সংখ্যা ৩-৪, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ২০১৫ বিশেষ সংখ্যা।
আরও দ্রষ্টব্য: “বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি: প্রাচীন ভারত”; মুক্তমনা বাংলা ব্লগ; https://blog.mukto-mona.com/2015/02/21/44470/

অশোক মুখোপাধ্যায় (২০১৬), “ভারতীয় রাজনীতিতে গোবলয় সম্প্রসারণ”; একুশ শতকের যুক্তিবাদী, সেপ্টেম্বর ২০১৬। আরও দ্রষ্টব্য: “সাম্প্রতিক
ভারতীয় রাজনীতি ও গরু-মোষের দ্বন্দ্ব”; মুক্তমনা বাংলা ব্লগ; https://blog.mukto-mona.com/2016/03/23/48652/

ক্ষিতি মোহন সেন (১৯৯০), ভারতে হিন্দু মুসলমানের যুক্ত সাধনা; বিশ্বভারতী, কলকাতা।

B. B. Lal (1954-55), “Report on the excavation at Hastinapur”; Ancient India, Nos. 10-11.

Karl Marx (1976), “Contribution to the Critique of Hegel’s Philosophy of Law: Introduction”; Karl Marx
and Frederick Engels (1976), On Religion; Progressive Publishers, Moscow.

Rajendra Lal Mitra (১৯৬৭), Beef in Ancient India (edited and annotated by Swami Bhumananda, 1926);
Manisha Granthalay, Kolkata;

H. D. Sankalia (1967), “The Cow in History”: Seminar, No. 93 (May 1967)