জংগিবাদ বলতে আমরা ঠিক কি বুঝি? কিছু বিচিত্র আরবী নামওয়ালা গোপন সংগঠনের সাথে যুক্ত বিশেষ ধরনের চেহারা এবং লেবাসধারী লোকজন ধর্মীয় জোশে হঠাত হঠাত কিছু চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে কিছু নিরীহ মানুষ মেরে আবারো গর্তে ঢুকে যায় সেসব ঘটনাকে? জংগীবাদের উত্থান রহস্য যাইই হোক এটা তো পরিষ্কার যে তাদের মূল লক্ষ্য সাধারন সন্ত্রাসী দলের মত টাকা পয়সা লুটপাট নয়, তারা একটি বিশেষ ধরনের আদর্শবাদ মাথায় নিয়ে এসব কর্মকান্ড করে আসছে যা গোপন কিছু নয়। তারা বাংলাদেশসহ সমগ্র দুনিয়াব্যাপী ইসলামী শাসন কায়েমের স্বপ্ন দেখে, যার রাজনৈতিক রূপ ইসলামী শরিয়া ভিত্তিক খিলাফত। টাকা পয়সার লোভে কেউ আত্মঘাতি হয় না, আত্মঘাতি হয় আদর্শগত কারনে। সেই আদর্শ ধর্মের চোখে সহি কিনা সেটা এখানের বিবেচ্য না।

ইসলামী জংগীবাদ সম্পর্কে ন্যূনতম ধারনা আমার ধারনা দেশের শীর্ষ নির্বাহী থেকে শুরু করে সাধারন নাগরিক কারোরই নেই, নইলে এক মুসলমান অপর মুসলমানকে হত্যা করতে পারে না, রোজার মাসে মানুষ মারে কেমন মুসলমান এই ধরনের সারল্যমাখা বিস্ময়সূচক মন্তব্য করতে পারতেন না। জংগী জেহাদীরা যে বা যারাই তাদের ইসলামী আদর্শ ভিত্তিক খিলাফত গঠনের পথে বাধা হিসেবে দেখে তাদের সকলে একই শ্ত্রু হিসেবে গন্য করে। আপনি মুসলমান, এমনকি নিয়মিত নামাজ রোজা করলেও এই কারনে তাদের থেকে ছাড় পাবেন না। সিলেটের জংগী মহিলা এই কারনেই মুসলমান ভাই পরিচয় দেওয়া পুলিশ সদস্যকে সাফ বলে দেয় আপনারা শয়তানের পথে, আমরা আল্লাহর পথে। কারন সে ভালই জানে সেই পুলিশ সদস্য তাদের ধর্মভিত্তিক খিলাফত গঠনের পথে বাধা।

কথা হল একই ধরনের লক্ষ্য নিয়ে যখন নানান প্রকাশ্য সংগঠন অবিরত অব্যাহত গতিতে তাদের ধর্মীয় অধিকার কায়েমের নামে মধ্যযুগীয় নানান কালা কানুন প্রতিষ্ঠার নামে ছোট বড় নানান গোলযোগ করে আসছে, তাদের কি বলা যেতে পারে? ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়ায় যে ২০০০ সালে ৮ জন মানুষ নিহত হল, কত হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হল সেটাকে কি বলা যেতে পারে? ২০১৩ সালে হেফাজতি উত্থান কেন্দ্র করে কয়জন মানুষ সব পক্ষ মিলিয়ে মারা গেল তার হিসেব আমিও জানি না। এ সবকে কি বলা যেতে পারে? জংগীবাদ নয়, রাজনীতি? কারন এসব যারা ঘটিয়ছিলেন তারা কোন গোপন সংগঠন নয়, আমাদের চোখের সামনেই আছেন, যাদের সমর্থন করে বুলন্দ ঈমানী আওয়াজ আমরা নিজেরাই তুলি? সর্বোপরি প্রথম দলের সাথে আমেরিকা ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যের তেল ইত্যাদী নানান বিষয় জুড়ে চটকদার নানান তত্ত্ব দাঁড় করানো যায় যেটা দ্বিতীয় ক্ষেত্রে করা যায় না সে কারনে? শফি হুজুর আমিনী হজুর সিআইএ ট্রেন্ড শুনতে কেমন যান শোনায়, তাই না? খিলাফত কায়েমের নামে সন্ত্রাস জংগীবাদ কিন্তু মুরতাদ হত্যার প্রকাশ্য ফতোয়া রাজনীতি মাত্র?

আদর্শগত ভাবে এই দুই দলের কি তেমন কোন তফাত আছে? আমি বলব দীর্ঘমেয়াদে এই দ্বিতীয় দল আরো অনেক বেশী বিপদজনক। গোপন দল যাই হোক পুলিশ সেনা দিয়ে দমন করা যায়। এই দল বহু আগেই পুলিশ র‍্যাব দিয়ে নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে গেছে, এবং সর্বোপরি তাদের জনসমরথনও প্রবল। এই দল নিয়ন্ত্রন দূরের কথা, আমাদের শিক্ষিত সমাজই বিপুল উদ্যমে গড়ে তোলায় ভূমিকা রেখেছেন, পরিনতি চিন্তা করেননি। এখনো তারা সত্য হজম করতে পারেন না, নিজেদের অনেকভাবে ভুলিয়ে রাখার চিন্তা করেন। এই দ্বিতীয় দল চুড়ান্ত আঘাতের জন্য তৈরী হচ্ছে, তারা রাজনৈতিকভাবে এখন অনেক পরিপক্ক, তারা জানে যে চুড়ান্ত আঘাতের সময় এখনো আসেনি। নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তি, এনজিও ঠ্যাংগাও, মূর্তি ভাংগো এসব নানান অজুহাতে তারা মহড়া দিচ্ছে মাত্র। এক তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সিলেবাস নিয়ন্ত্রনের কথা হত, এখন ঊল্টো তারাই সাধারন শিক্ষার সিলেবাস সংশোধনের শক্তি অর্জন করেছেন। অবস্থা এখন এমনই যে এই চক্রকে হুজুর হুজুর করে তেল মারা এবং কলেবর বৃদ্ধিতে সহায়তা ছাড়া উপায়ও নাই। যাদের মানসিক সূস্থতা সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করার অবকাশ আছে তাদেরই মাঝে মাঝে মনে হয় দন্ডমুন্ডের কর্তা।

ধর্মের নামে উগ্রবাদ এবং জংগীবাদ ভিন্ন কিছু নয়, জংগীবাদ ধর্মীয় উগ্রতার পরবর্তি ধাপ মাত্র। যেই দেশে জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উতসবে শুভেচ্ছা জানানোর কারনে শয়ে শয়ে গালি খান, সরকারী ব্যাংকের ক্যালেন্ডারে মন্দিরের ছবি দেখে অনুভূতি আহত হওয়ায় ক্যালেন্ডারই ব্দলে ফেলতে হয়, শিক্ষককে প্রকাশ্যে অনুভূতি আহত হবার মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনধি উপস্থিত আম জনতার বিপুল করতালিতে কান ধরে ওঠবস করান সে দেশে উগ্রতার সার্বজনীনতা সম্পর্কে খুব বড় ধরনের সংশয়ের অবকাশ আছে? লক্ষনীয় যে এসব কাজ কারবার যারা করে, তারা তাদের স্বনামেই করে। নাম গোপন করার প্রয়োযনও মনে করে না কারন যে এসবে এক ধরনের সামাজিক স্বীকৃতি আছে। এই ধরনের মানসিকতা আপনি র‍্যাব সেনা অভিযান দিয়ে দূর করবেন? দেশে বিদেশে নিজের ভাল ক্যারিয়ার, সম্পদ ফেলে জেহাদে শরিক হতে মধ্যপ্রাচ্যে চলে গেছে এমন কত ঘটনা আমাদের মিডিয়াতেই এসেছে। এসব কিসের চালনায় হচ্ছে? আমেরিকানরা বুদ্ধি দিচ্ছে, আরব টাকা দিচ্ছে? ভান করার চেষ্টা করে লাভ নেই, স্বীকার করা ভাল যে জংগীবাদী যে কয়জনই থাকুক, উগ্রবাদী প্রচুর আছে, এবং তাদের শুধু জামাত শিবির লেবেলে আবদ্ধ করা যায় না।

এই মানসিকতা যেখানে দিন দিন বাড়ছে সেখানে জংগীবাদের প্রকোপ বাড়বে না এমন আশা করা যায় কিভাবে? জংগীবাদের কারন কি, কিভাবে বাড়লো তা আলোচনা করতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে। আমি বহুদিন ধরে বিষয়টা নিয়ে মোটামুটি সামান্য গভীরে পড়াশুনা করেছি। সে আলোকে নিঃসংশয়ে বলতে পারি যে আমাদের দেশের এমনকি জংগীবাদের বিরুদ্ধে চরম সোচ্চারদেরও জংগীবাদের স্বরুপ বোঝায় যথেষ্ট ফাঁক আছে। ইসলামী জংগীবাদ আমেরিকা ইসরাইলের কারনে পয়দা হয়নি। আমেরিকা ইসরাইল, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের তেল বা আরবের টাকায় ওয়াহাবিবাদের প্রচারনা জাতীয় আরো বহু ছোট বড় রাজনৈতিক ঘটনা এর প্রকোপ বৃদ্ধিতে ছোটবড় ভূমিকা রেখেছে ঠিকই তবে এসব কোনটাই মূল কারন নয়।

মূল কারন নিহিত আছে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা থেকে ক্রমান্বয়ে সরে আসার প্রবনতার মধ্যে। ৭২ সালেও দেশের বেশীরভাগ মানুষ মুসলমানই ছিল, এখনো তাই আছে। এখন উগ্রতা বাড়ার কারন সিআইএ এসে উগ্রতা শিখিয়ে যাচ্ছে এমন না, ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার যা বিপরীত সেই ধর্মীয় উগ্র চেতনা দেশকে গ্রাস করেছে সেখানে। আমি মুসলিম আমার বাপ দাদা টুপি দাঁড়ি নামাজ পড়ে কিন্তু সন্ত্রাস কোনদিন করে নাই কাজেই মুসলমান ইসলামের সাথে জেহাদী সন্ত্রাসের কোন সম্পর্ক নাই থাকতে পারে না এ ধরনের সারল্যমাখা দাবির ব্যাখ্যা এখানেই। এর মানেই নিঃসন্দেহে এমন না যে ইসলামী ধ্যান ধারনা প্রকাশ যেইই করে সেইই জেহাদী হবে। ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার সাথে ধর্মীয় চেতনার সঙ্ঘাতের চুড়ান্ত রূপ এই ইসলামী জেহাদী সন্ত্রাস। এই সঙ্ঘাত প্রতিটা মুসলমান দেশেই দৃশ্যমান, প্রকাশ্য রাজনীতি আছে এমন একটা দেশও নেই যেখানে কোন না কোন ইসলামী জেহাদী দল নেই।

আল কায়েদা, আইসিস এসব বহুল প্রচারিত ব্যাপারে যেভাবে যতটাই হোক আমেরিকার নাম আসে। মুশকিল হল আমেরিকান কোন রকম ইনফ্লুয়েন্স ছাড়াই ইসলামী জংগীবাদের বহু উদাহরন আছে। আগেই বলেছি বিস্তারিত বলার অবকাশ এখানে নেই। আফ্রিকান জেহাদী দল বোকো হারাম কিছু হিসেবে আইসিস থেকেও বেশী মানূষ মেরেছে দেখায়, সেটার সাথে মার্কিন সম্পর্ক, এমনকি আরবের তেল কিভাবে পাওয়া যায়? জেহাদি সন্ত্রাস সাম্প্রতিক সময় বাড়লেও আমরা না জানলেও এটা বহুদিনই চলছে। যেমন, এখন ইউরোপে যে কায়দায় জেহাদী হামলা চলছে সেই রকম হামলার প্রথম উদাহরন সম্ভবন প্রায় ১০০ বছর আগের অষ্ট্রেলিয়ায়, যা Battle of Broken Hill নামে পরিচিত। আইসিস কায়দার উগ্রপন্থী ধর্মরাষ্ট্র আধুনিক বিশ্বে আরো ঘটেছে যার সাথে আমেরিকান/মধ্যপ্রাচ্যের কোন সম্পর্ক নেই। ইন্দোনেশিয়ায় ৫০ এর দশকে হুবহু আইসিসের আদলের শরিয়া ভিত্তিক রাষ্ট্র দারুল ইসলাম হয়েছিল। দারুল ইসলাম খুব বেশীদিন না চললেও এর সমর্থকতা এখন বিভিন্ন নামে সে অঞ্চলে জেহাদ বা সন্ত্রাস যাইই বলা হোক চালাচ্ছে।

জংগীবাদ থেকে স্থায়ী সমাধান অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা যেভাবে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা গ্রহন করেছে সেভাবেই হতে হবে, এর সহজ কোন সমাধান নেই। সমগ্র মুসলিম বিশ্বের বাস্তবতা হচ্ছে ঠিক তার উলটো। ধর্মনিরপেক্ষতার যায়গায় ধর্মের মূলে ফেরার প্রবনতা অর্তথাৎ উগ্রতা দিন দিন বাড়ছে। তুরষ্কের মত সেক্যুলার, বাংলাদেশের মত উদার কোন দেশই এর বাইরে নয়। অবস্থা এমনই যে ৭২ সালের সেক্যুলার সংবিধান প্রনেতা আওয়ামী লীগকে ৭২ এর ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের কথা বেমালুম ভুলে কন্টেক্স বিহীন মদিনা সনদ নাটক করতে হয়। কাজেই ধর্মীয় উগ্রতা কাম জেহাদী সন্ত্রাসে বিস্মিত হবার কিছু নেই, বরং এতে অভ্যাস করাই উত্তম, চুড়ান্ত সর্বনাশ যতদিন ঠেকানো যায় সে কামনাই বরং করা উচিত। ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা যতদিন না মানসিকভাবে গ্রহন করা যায় ততদিনই বিশ্বময় কোথাও দারুল ইসলাম, কোথাও আল বদর, কোথাও বোকো হারাম, আল শাবাব, আল কায়েদা, জেএমবি, হিযবুত তাহরির এসব তৈরী হতেই থাকবে। যার যেভাবে খুশী ব্যাখ্যাও করতে পারবেন, আমেরিকা……কলোনিয়ালিজম থেকে কেপ্টাগন কিছুই বাদ থাকবে না। আসলে চয়েসটা সম্পূর্নভাবে মুসলমানদের নিজেদের হাতেই, সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাদেরই।

বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ এবং ধর্মীয় ভাবে কনজার্ভেটিভ এই দুই ধারার সঙ্ঘাত সামনের দিনগুলিতে আরো বাড়া ছাড়া কমবে না। ছোট উদাহরন দিতে পারি একদিকে দেশে এখন মুসলমানদের ভেতরেও হোলি, থ্যাংক্স গিভিং পালনও শুরু হয়েছে, অন্যদিকে একুশে ফেব্রুয়ারী, পহেলা বৈশাখ বিদাত ঘোষনা দিয়ে বর্জনও শুরু হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে এই দুই ধারার শান্তিপূর্ন সহাবস্থান সম্ভব না। সর্বোপরি এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে যা প্রয়োযন অর্থাৎ রাজনৈতিক ঐক্যের তাও এখন সুদুর পরাহত। সরকারী দল এখন মৌলবাদের বিরুদ্ধে নামলে বিরোধী দল ইসলাম গেল বলে হাঁক ছাড়বে। কাজেই সামনের দিনগুলিতে আরো নানান গোলযোগ দেখা যাবে। ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা বলা সোজা, মুসলমান দেশগুলিতে তা প্রতিষ্ঠা করা কি রকম কঠিন তার একটি উদাহরন সামনে দেব। আসলে কেউ নিজেদের ক্ষতি নিজেরাই করতে থাকবেন পন করে থাকলে আল্লাহ খোদারও সাধ্য নেই তাদের সাহায্য করার। সর্বনাশ অনিবার্য।