সবার মতন আমিও আমার মাকে ব্যতিক্রমী, শ্রেষ্ঠ এবং অন্য ভুবনের মানুষ বলে মনে করতাম, এখনও করি। মনের মতো কাউকে পেলে মায়ের কথা বলি। তার কথা বলে তার কাছে ফিরে যাই অদৃশ্যে, বিমূর্তে। স্বশরীরে তার কাছে যাওয়ার উপায় নেই বলে। যাই হোক, এবার নিজের কথা বলি। আমার বাবা ছিলেন একজন আদর্শ ছাপোষা কেরানী। তিনি প্রচুর বই পড়তেন,আর অনেক সুন্দর সুন্দর, বড় বড় কথা বলতেন। সেইসব কথা আমার মা বুঝতেন কিনা আমার বালিকা বেলায় তাও বুঝতাম না। আর আমার তো সেইসব বিষয় বুঝারই কথা না। মাঝেমাঝে বাবা-মার ঝগড়া হতো। বাবা একতরফা বকে যেতেন, আর মা মাটির দিকে তাকিয়ে শুধু শুনেই যেতেন। সেইদিনের মতন মা কথাবলা বন্ধ করে ঘরের মাঝারী মাপের একমাত্র আয়নাটার পর্দা টেনে দিয়ে, তার সামনে বসে থাকতেন। ঝগড়ার সময় আমি ভয় পেয়ে চলে যেতাম আত্মগোপনে। বারবার মনের ভিতরে অনুভব করতাম আশ্রয় হারাবার ভয়। পায়ের নীচের মাটি মনে হতো কাঁপছে। কিছু সময় পরে অবশ্য বেরিয়ে আসতে হতো বাবার কথা মাকে, আর মায়ের কথা বাবাকে পৌছে দেওয়ার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে।

আমার মা ছিলেন পরীর মতন সুন্দরী। একটুও বাড়িয়ে বলছি না। তবে এনিয়ে তার বিন্দুমাত্র অহংকার ছিল না। আইএ পাশ ছিলেন আমার মা। এই আইএ পাশের বিদ্যা নিয়ে তিনি নীরব শ্রোতা হয়ে বাবার বক্তৃতা গিলতেন শুধু। কোনদিন তাকে কোন প্রশ্ন করতে শুনিনি, শুনিনি তর্ক করতেও। কেমন জানি বোকা বোকা সেজে থাকতেন মা। পরে বুঝেছি, এখন বুঝি- এটা ছিল তার একটা কৌশল। সংসারে শান্তি ধরে রাখার কৌশল। একঘর মে দোপীরের ক্ষতির দিক সম্পর্কে মা ভালই জানতেন বলে মনে হয়। অসম্ভব রকমের স্বাধীনচেতা, আর স্বল্পভাষী ছিলেন আমার মা। একেবারে জীবন চলে যাওয়ার মতন সমস্যা না হলে তিনি কারও কাছে সাহায্য চাইতেন না। একবার আমার বড়লোক মামার বাড়ীর অনুষ্ঠান থেকে না খেয়ে আমার হাত ধরে রাগ করে চলে এসেছিলেন, মামীর মুখে আমার বাবা ছোট কাজ করেন, এই কথা শুনে। আর কোন দিন মামার বাড়ীর কোন অনুষ্ঠানে মা যাননি। এই কারণে বেশী মানুষের সাথে আমাদের উঠাবসাও ছিল না।

এই আমার ব্যতিক্রমী মা একবার মুখোমুখী হলেন জীবনের এক জটিল সমস্যার। আমার বয়স তখন তিন কি চার। আমার বাবা হঠাৎ করে মারা গেলেন ম্যসিভ হার্ট এটাকে। তখন আমি শোক কাকে বলে বুঝি না। মা কেঁদেছিলেন, আত্মীয়-স্বজন কেঁদেছিল। তাদের দেখাদেখি আমিও কেঁদেছিলাম। বাবা মারা যাওয়ার সময় শূণ্যঘর ছাড়া কিছুই রেখে যাননি। তখনই আমি দেখেছিলাম মায়ের অসম্ভব শক্তি, সাহস আর দক্ষতার পরিচয়। সেই ঘোর দুর্দিনেও তিনি কারও আর্থিক সাহায্য নেননি। বাবার সহকর্মীদের অনুরোধে বাবার অফিসে একটা ছোট্ট কাজ নিলেন মা। তা দিয়ে মা-মেয়ের সংসার চলতে থাকে। তখন আমি স্কুলে যাই যাই। মায়ের কাছে তখন আমি বাংলা, ইংরেজী পড়া লেখা শিখে ফেলেছি। নামতা যোগ-বিয়োগ শিখে ফেলেছি। সে এক অন্য মা। আমার কোন অভাব নেই। বাবার অভাবও তখন ভুলিয়ে দিয়েছে আমার ব্যতিক্রমী মা।

কিন্তু এই নিরবিচ্ছিন্ন সুখের সময় আমাদের বেশী দিন টিকলো না। আমার মায়ের শরীরের সৌন্দর্য্যই আমাদের কাল হলো। অফিসে যেতে হয়, ডাক্তারের কাছে যেতে হয়, বাজার করতে যেতে হয় মাকে। সবখানে, নির্জন রাস্তাঘাটে সেই বিরাট যন্ত্রনা- সুন্দর মেয়েমানুষ হবার কাঁটা গায়ে বিঁধতে থাকে। এতদিন পরে নতুন এক কদর্য্য পৃথিবীর সাথে পরিচিন হন আমার মা। আমাদের চারঘর পরে শাহাদত আঙ্কেলের বাড়ী। বাবার বন্ধু ছিলেন। বাবার কাছে আসতেন, তার বড় বড় কথা শুনতেন। সেবার আমাদের সতেরো নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলার হয়েছেন তিনি। তারও আসা যাওয়া বেড়ে যেতে লাগলো আমাদের বাড়িতে। বিধবাকে সাহায্যের বড় দায় যেন তার কাঁধে। একদিন এমনি আসা-যাওয়ার ভিতরে আমার মায়ের হাতটা তিনি খপ করে ধরে কি জানি কি বললেন। সেই বয়সে তার সেই কথার মর্ম বুঝার শক্তি আমার ছিল না। তবে সেদিন মায়ের চোখে জ্বলন্ত আগুনের তাপটা আমি ঠিকই আন্দাজ করে নিয়েছিলাম। বিরাট কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে ভেবে আমি আগের মতন আবার চলে গেলাম আত্মগোপনে। সেখান থেকে শুনতে পেলাম কান ফাটানো একটা চড়ের শব্দ। ততোধিক আওয়াজে শুনতে পেলাম শাহাদত আঙ্কেলের গর্জন- আচ্ছা দেখা যাবে! গোপন আস্তানা থেকে বেরিয়ে এসে দেখি, মাটিতে বসে মা কাঁদছেন। আমাকে হাতের নাগালে পেয়ে বুকে চেপে ধরলেন সজোরে। চাপা কান্নার আওয়াজ থেমে গেল, তবে আমার মাথা গেল ভিজে তার চোখের ধারাপাতে। ঐ শিশু বয়সে পাখিদের মতো সহজাত প্রবৃত্তি দিয়ে বুঝে গেলাম- আমার মায়ের নীরবে কান্নার দিন এসে গেছে।

এইভাবে তিন-চারটা মাস কেটে গেছে। মা বাবার অফিসের চাকরীটা ছেড়ে দিয়েছেন। বাড়িতে ছোটখাটো একটা গার্মেন্টস কারখানা বসিয়েছেন তিনি। ভালই অর্ডার পাচ্ছেন। আরো একজন মহিলাকে নিয়োগ দেয়ার চেষ্টা করছেন। দিনরাত কাজ করেন আমার মা। আমি কোনই কাজে আসি না। আমাদের সংসার ভালই কেটে যায়। একদিন সন্ধ্যা হয় হয়, মা আমায় গায়ের সাথে লেপ্টে ধরে বসে আছেন। কাজের ফাঁকে বিশ্রাম করছেন হয়তোবা। পুরা পরিবেশটাও যেন বিশ্রাম নিচ্ছে সারা দিনের খাটুনী শেষে। পাখিরা ডাকাডাকি থামিয়ে দিয়েছে। সূর্য্যও বলছে যাই যাই। হঠাৎ একটা অচেনা লোক এসে দাড়ালো বারান্দার বাইরে আমাদের খুব কাছে। তাকে চেনার আগেই, কিছু বলার অবসর না দিয়ে লোকটা কি জানি ছুড়ে মারলো মায়ের মুখ লক্ষ করে। তড়িতে একটু সরে গেলেন মা। একটা শূণ্য নারকেলের মালা মায়ের কপালে এসে আঘাত করলো ঠক করে। মালার ভিতরে যে তরলটুকু ছিল তার সবটুকু পড়লো আমার মুখে। আমি অসহনীয় এক পোড়া যন্ত্রনায় মাগো বলে জ্ঞান হারালাম। নারকেলের মালায় ছিল এসিড- সুন্দর রমণী হয়ে জন্মাবার অযাঁচিত উপহার। এই উপহার কেউ চায় না। তারপরেও আসে। আমার মায়ের জন্যেও এসেছিল।

কত সময় বেহুস অবস্থায় আমার কেটেছিল জানি না, তবে নিজেকে আবিষ্কার করেছিলাম বাড়ির থেকে মাইল খানেক দূরে খ্রীষ্টান মিশনের বড় হাসপাতালটায়, সেই আমার অন্যভূবনের মায়ের বিগলিত চোখের ঘনিষ্ট সান্বিধ্যে। হাসপাতালের বড়কর্তা ফাদার এসেছেন আমাকে দেখতে, মায়ের সাথে দেখা করতে। চোখে অসম্ভব মায়া তার, অনেকটা আমার মায়ের মতন। একমাস ধরে বার্ণইউনিটে চিকিৎসা চললো। ফাদার মাকে আশ্বস্ত করলেন। ভাঙা বাংলায় কথা বললেন।
-ভালো হোয়ে যাবে ঠোমার মেয়ে। ভাইবো না। হামাডের একজন সিনিয়র ডকটর এসেছে কানাডা ঠেকে, সে ঠোমার মেয়েকে ডেকছে। টিনি একজন প্লাস্টিক সার্জারী এক্সপার্ট।
মায়ের ভিজে চোখ তাতেও শুকায় না। সময়ে অসময়ে শুধুই বিড়বিড় করেন আমার মা- তিনি তখন কেন সরে গেলেন? তাহলে তো এসিড আমার মুখে পড়তো না। এসিড পড়ার সব দায় যেন তারই। প্লাস্টিক সার্জারির ডাক্তারটা যেন ফেরেশ্তা। মানুষ এত ভাল হয় কিভাবে? দিনে তিনবার সে আসে আমাকে দেখতে। প্রতিবার একটা করে বিদেশী কেণ্ডি। আমাকে সবকিছু যেন ভুলিয়ে দেয়। লোকটা কি যাদুকর?

হাসপাতালের ফাদার ডেকেছেন মাকে। বিশেষ কথা আছে। আমি তখন হাসপাতেলের সাদা বিছানায়। আরো কিছুদিন থাকতে হবে। ফাদার মাকে অনেক করে বুঝাচ্ছেন। আমার আরো চিকিৎসা দরকার, যা এইদেশে সম্ভব না। প্লাস্টিক সার্জারির বিশেষজ্ঞ নিঃসন্তান এবং বৃদ্ধ। তার বৃদ্ধা স্ত্রীও রয়েছেন কানাডায়। তারা আমাকে এডপ্ট করতে চান। নিয়ে যেতে চান কানাডায়।
-তুমি রাজী হয়ে যাও মা।
ফাদার অনেক করে বুঝাচ্ছেন মাকে। মা কোন কথা বলছেন না। ঝিম ধরে বসে আছেন। অনেক সময় পরে মা মাথা নাড়লেন, বললেন- ঠিকাছে, তবে এখন না। আমি যখন বলি তখন।
প্লাস্টিক আঙ্কেলের সাথে আমার যাওয়ার জন্যে সব কাগজপত্রের কাজ শেষ হয়ে গেল। মা আমার কাছে কিছুই লুকালেন না। আমি সব জেনে গেলাম। মায়ের জন্যে খুব কষ্ট হতে লাগলো। আমি চলে গেলে মা কাকে কোলে করে ঘুমাবেন। কার মাথা চোখের জলে ভিজাবেন। তিন মাস চিকিৎসার পর চলে এলাম বাড়িতে। মা আবার কাজ শুরু করলেন। তবে কাজ করেন অল্প। বেশী সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকেন, আর বিড়বিড় করেন- কেন তিনি সরে গেলেন! কেন আসিডটা তার মুখে পড়লো না? মায়ের কান্নার শব্দ শুনতে পাই না, কিন্তু আমার মাথা ভিজে যায় তার চোখের জলে। আমার মা নাওয়া খাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিলেন। আমার এসিডে পোড়া এই বিভৎস মুখের জন্যে সেই যেন দায়ী। তিনি নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছেন না। মা তো আমাকে এসিড মারেন নি। তাহলে কেন তিনি শুধু কাঁদেন? কতদিন যে রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে ছোট দুটোহাত তুলে আল্লার কাছে প্রার্থনা করেছি- আল্লা তুমি অচিন পুরের রাজপূত্রের মতন আমার মায়ের মাথার ভিতরে ঢুকে গিয়ে তার ঐ দিনের স্মৃতিটাকে মুছে দিয়ে যাও। যাতে সে আর ঐভাবে না কাঁদে। কিন্তু সকালে জেগে দেখি যে মা সেই মা। আল্লা কেন শুনতে পায় না আমার কথা?

আমাদের ঘরে তিনটা আয়না ছিল। একদিন খেয়াল করে দেখলাম, সবগুলো আয়না মা ফেলে দিয়েছে। আমি যাতে নিজের মুখ আর না দেখতে পারি। মা হয়তো জানতে পেরেছিলেন- আয়নায় এই মুখ আমি সহ্য করতে পারবো না। আমার মা নির্ভুল ছিলেন। এই ভাবে আরো কিছু দিন কেটে গেল আমাদের, ভাল মন্দ মিশায়ে। প্রতিদিন সকালে মা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। একদিন তিনি আর আমাকে ডাকলেন না। যে আমি সকাল সাতটায় তার ডাকাডাকিতে উঠে যাই, সেই আমি ঘুম থেকে উঠলাম দশটায়। উঠলাম তাও উঠোনে লোকজনের গুঞ্জন আর হাকডাকে। চোখ মুছতে মুছতে বাইরে এসে দেখি মাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে একটা সাদা খাটে। গায়ে তার সাদা রঙের কাপড় জড়ানো। সবাই বললো- আমার মা উঠোনের ঐ বড় দেবদারু গাছটায় ফাঁস লাগিয়ে মারা গেছেন। আমার কারো কথা বিশ্বাস হলো না। আমিও মায়ের মতন নীরবে কাঁদলাম। একটা অদৃশ্য মোচড়ানো ব্যথার ভিতরে বসে বসে আমি ভাবতে লাগলাম- আমার এখন কি হবে? আমি কোথায় যাব এখন? ঠিক এইসময় কোথা থেকে হাসপাতেলের ফাদার এসে ফিনিক্স পাখির মতন আমাকে কোলে তুলে নিলেন। সেই যে কোলে তুলে নিলেন, আর নামালেন না। তুলে দিলেন আরেক পিতার কোলে। সেই কোলে চড়ে সোজা চলে এলাম বড় বড় সমূদ্র পার হয়ে এক অচিনপুরে।

আমি এখন কানাডায়, কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে। আমার মুখের চিকিৎসা হয়েছে। পুরান সেই আদল আর ফিরে আসেনি। সবাই বলতো- আমি দেখতে অবিকল আমার মায়ের মতন। আমি আমার সেই মায়ের মুখটা আর ফেরৎ পাইনি। তবে মা আমি তোমার আদেশ অমান্য করিনি। আমি আর আয়না দেখি না। কোনদিন দেখবো না। পাসপোর্ট ছাড়া আর কোথাও আমার ছবি নেই। ফেসবুকেও নেই। আমি আর ছবি তুলবো না মা। আমার নতুন পিতামাতাকে নিয়ে প্রায়ই যাই দেশে, বাঙলাদেশে। আমার মায়ের কবরের পাশে দাড়িয়ে কাঁদি। আমার নতুন বাবা-মারাও কাঁদেন। কিন্তু তিন জনের মিলিত সেই চোখের ধারা একজন দুঃখী মায়ের কবরটাকে ভিজিয়ে দিতে পারে না। অথচ কী সহজে আমার মা তার স্নেহাশ্রু দিয়ে আমার মাথাটা ভিজিয়ে দিতেন। সেদিন আমার নতুন বাবা বললেন- সোমা, চলো তোমার মায়ের কবরটাকে আস্ত তুলে কানাডায় নিয়ে আসি। এখানেই কোন মুসলিম গ্রেভইয়ার্ডে উনাকে শুইয়ে রাখি। তাহলে তোমাকে আর কষ্ট করে অত দূরে যাওয়া লাগবে না। আমি বড় হয়েছি, আনেক বই পড়ে ফেলেছি, আমার জন্মদাতা পিতার থেকেও হয়তো বেশী বই আমি পড়ে ফেলেছি। সেইসব জ্ঞান থেকে আমার নতুন বাবাকে আমি জবাব দিলাম- মানুষ মরে গেলে আর কিছুই থাকে না। স্মৃতির ভিতরে যে দুর্মূল্য অনুভূতিটা লুকিয়ে থাকে, সেটাই সত্য। আর সব মিথ্যে। আমার নতুন বাবা আমাকে বুকে টেনে নিলেন। তার চোখের ফোটা ফোঁটা জল আমার মাথায় পড়তে থাকলো, কিন্তু তা আমার মায়ের চোখের জলের মতন মাথা ভিজিয়ে দিতে পারলো না। কখনও তা পারে না।