প্রগতিশীলরাও কি moron হতে পারে? অবশ্য সে যদি সত্যিই প্রগতিশীল বা আধুনিক ধ্যানধারণার ধারক হয়ে থাকে। এখানে moron শব্দটির কেন বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহার করলাম না,সেই প্রশ্নটি আসতে পারে। তার উত্তরে বলা যায় যে এর কিছু দূর্বল বাংলা অর্থ থাকলেও তার কোনোটিই এর আসল ব্যঞ্জনাটিকে ধারণ করে না। তাই ইংরেজি শব্দটি রেখে দিলাম। সোজা বাংলায় এর মানে দাঁড়ায় মানসিক পঙ্গুত্ব। সম্প্রতি বাংলাদেশ ও ভারতের প্রগতিশীল পরিচয় দানকারী মানুষদের নানা কান্ডকারখানা দেখে এই শব্দটিই মাথায় আসল। কিছুদিন আগেই বাংলাদেশে ভারতীয় কয়েকটি টিভি চ্যানেল বন্ধ করার জন্য একটি হাস্যকর ও তথাকথিত সেলেব্রিটিদের দ্বারা আয়োজিত আন্দোলন হয়ে গেল। কোর্টে সম্ভবত রিট আবেদনও করা হয়েছিল। বাংলাদেশের কোর্ট একটি ধামাধরা প্রতিষ্ঠান হলেও এই রিটে কি রায় আসবে তা একটি নাদান শিশুও বুঝবে বলেই মনে হয়। দেশবিরোধী বা তথাকথিত কিম্বা ফালতু ধর্মীয় অনুভূতিতে (প্রধানত ইসলামনুভূতি) আঘাত হানার মত কিছু না থাকলে কোনোকিছু নিষিদ্ধ করা এই মুক্তবাজারের যুগে কঠিন, এই সহজ বিষয়টি উনাদের মাথায় ছিল না।
একইভাবে তারা ওই বিশেষ কয়টি চ্যানেলে বাংলাদেশী পণ্যের বিজ্ঞাপন বন্ধের জন্যেও উঠেপড়ে লেগেছিলেন। অবশ্য এতে তারা সম্ভবত সাময়িকভাবে সফল হয়েছেন। ভারতীয় চ্যানেলে প্রচারিত অধিকাংশ মেগাসিরিয়ালই যে সম্পূর্ণ বস্তাপচাঁ, আজগুবি, মধ্যযুগীয় এবং পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণা ও মালমশলায় পরিপূর্ণ সে বিষয়ে আমার কোনোই সন্দেহ নেই। কিন্তু সেগুলোইত দেশের দর্শকেরা গোগ্রাসে গিলছেন। এর চেয়ে উঁচুমানের কিছু কি বাংলাদেশী নির্মাতারা বাংলাদেশের দর্শকদের দিতে পেরেছেন? বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো ত সস্তা ভাঁড়ামিপূর্ণ, চটুল, অন্ত:সারশূন্য, কুতকুতমার্কা নাটক সিরিয়াল দিয়ে পরিপূর্ণ। দর্শক যাবে কোথায়? আর উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির যুগে আমি কোন অধিকারে একজন মানুষের দেখার অধিকার কেড়ে নিতে চাইব? আর একজন বিজ্ঞাপনদাতা তার প্রতিষ্ঠানের প্রচার কোথায় কিভাবে করবেন এটা সম্পূর্ণই তার ব্যাপার। যেখানে প্রচারিত হলে বেশি মুনাফা হবে সেখানেই উনি প্রচার করবেন এটাই স্বাভাবিক। তাকে বাধা দেওয়া কতটুকু যৌক্তিক? দূর্ভাগ্যজনকভাবে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন এককালে প্রগতিশীল বলে পরিচিত ব্যক্তিরাই। কিন্তু শুধু তা নিজেদের স্বার্থে টান পড়েছে বলেই। কিন্তু সাম্প্রতিককালের অন্যান্য ন্যায্য ও যৌক্তিক আন্দোলনে তাদের টিকিটিও দেখা যায়নি। সেটা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বিরোধী আন্দোলনই হোক কিম্বা মুক্তমনা ব্লগার, লেখক ও একটিভিস্ট হত্যার বিচার চাওয়ার আন্দোলনই হোক। এছাড়া দলীয় লেজুড়বৃত্তি ত বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার আমলে সীমা ছাড়িয়েছে। না হলে বাল্য বিবাহ আইনের সংশোধনী কিম্বা পাঠ্যপুস্তক থেকে অসাম্প্রদায়িক লেখকদের রচনাসমূহকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার পরও এই দলীয় লেজুড়দের কিছু নামকাওয়াস্তে প্রতিবাদ করা ছাড়া আর কোথাও দেখা যায়নি। হতাশার ব্যাপার হল এই দলীয় লেজুড়েরাই এখন বাংলাদেশে প্রগতিশীলতার সোল এজেন্ট হয়ে গেছে। শুধু এখানেই তারা সীমাবদ্ধ নেই অনলাইন জগতেও তারা ভীষণ ক্রিয়াশীল। এমনকি এদের অনেকে আবার নিজেদের মুক্তমনা নাস্তিক বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন।
ভারতীয় প্রগতিশীলতার প্রসঙ্গে যদি এখন আসি তবে বলতে হয় তা এখন অনেকটা মুখ চিনে মুগের ডাল খাবার মত পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। হিন্দু উগ্রবাদীরা কোন কান্ড ঘটালেই তারা হা-রে-রে-রে করে তেড়ে আসেন। কিন্তু ইসলাম ধর্মীয় মোল্লাদের কাজকর্মের বেলায় তারা একদম নিশ্চুপ। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের পা ধরতেও তারা পিছপা হবেন না। আজ ভারতীয় মুসলমান সমাজের নারীরাই যখন মধ্যযুগীয় তিন তালাক প্রথা বাতিলের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে চাইছেন; তখন ভারতীয় তথাকথিত প্রগতিশীল, উদার মহল একেবারে স্পিকটি নট হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। যেন এই বিষয়ে কথা বললেই তাদের জাত যাবে। আবার তারাই সম্পূর্ণভাবে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী কাশ্মিরী বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে মুক্তকচ্ছ হয়ে সমর্থন জানাচ্ছেন। যখন গরুর মাংস খাওয়ার অধিকারে হিন্দু মৌলবাদীদের বাধা দেওয়ায় দলে দলে প্রগতিশীল লেখকদের অনেকেই তাদের পদক ফিরিয়ে দিচ্ছেন, মানুষের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে বলে; সেই তথাকথিত প্রগতিশীল ব্রিগেডই আবার যখন তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারী হয়, পশ্চিমবাংলা থেকে বের করে দেওয়া হয় বা তাকে অনুষ্ঠান করতে বাধা দেওয়া হয় তখন চোখ বুঁজে থাকেন। তাদের চশমায় সম্ভবত হিন্দু মৌলবাদই শুধু চোখে পড়ে অন্য ধর্মেও যে মৌলবাদ থাকতে তারা বোধহয় তা একদমই জানেন না। সব দেখে মনে হয় দ্বিচারিতায় এই ভারতীয় লিবারেল প্রগতিশীলেরা সম্ভবত এই দুনিয়ায় সবচেয়ে এগিয়ে।
সামগ্রিকভাবে বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রগতিশীল দাবীদারদের চিন্তার দীনতা ত আছেই, এর পাশাপাশি ব্যক্তিগত স্তরেও এই মানসিক পঙ্গুত্ব এখন প্রকট। নারী পুরুষের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, সমকামীদের অধিকার, ডিভোর্স, বর্ণবাদ নিয়ে আলাপ, আলোচনা বা বিতর্ক হলেই তাদের প্রগতিশীলতার মুখোশ খুব দ্রুত উন্মোচিত হয়। ধর্মকে সমালোচনার অধিকারের সীমা কতটুকু? বা আদৌ ধর্ম কে সমালোচনা করাই জায়েজ কিনা এই প্রসঙ্গ এলে তারা ভীষণ অসহিষ্ণুতার পরিচয়ই দিয়ে থাকেন। অনেকসময় তর্কের খাতিরে বা বাহ্যিকভাবে নিজেকে উদার প্রতিপন্ন করতে চাইলেও কর্মক্ষেত্রে তার বহি:প্রকাশ খুব কমই দেখা যায়। দেশের বাইরে বসবাসরত এই প্রগতিশীল মানুষদের অনেকে আবার পরনিন্দা পরচর্চাতেও দারুন পারদর্শী। যাকে সোজা বাংলায় কূটনামীই বলা যায়। খুবই দূর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হল অনেক মুক্তমনা বলে পরিচিত ব্যক্তি বা তাদের পরিবারের সদস্যরাও এর বাইরে নন। আমি নিজেই যার ভুক্তভোগী।
আমার শৈশব কৈশোরের প্রায় পুরোটাই ময়মনসিংহ শহরে কেটেছে। সেসময় আমি কয়েক বছর উদীচি শিল্পীগোষ্ঠীর সাথে জড়িত ছিলাম। উদীচি বাংলাদেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী একটি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন। আমাদের দেশের প্রায় সব গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে উদীচির অসামান্য ও অসাধারণ ভূমিকা আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের নেতৃস্থানীয় অনেকের মধ্যেই আধুনিকতাকে ধারণ করবার যে ভীষণ নিস্পৃহা ছিল তা সত্যিই অবাক করে দিত। বিশেষ করে পাশ্চাত্যের রক পপ সঙ্গীতের প্রতি ভয়ংকর ক্ষোভ ও অবজ্ঞা মাঝেমাঝেই প্রকাশ পেত। মাইকেল জ্যাকসনের গান লাউডস্পীকারে চালিয়ে নাকি শূকর তাড়ানো হয় এরকম কথাও উনারা বলতেন। জ্যাজ, রিদম এন্ড Blues বা রক এন রোল সংগীতের ইতিহাস, শিল্পীদের ত্যাগ ও সংগ্রাম, এর সুরের মূর্ছনা বা এই ধারাগুলোর অন্তর্নিহিত সম্পর্ক সম্বন্ধে তারা যদি সত্যিই জানার চেষ্টা করতেন তাহলে হয়ত তাদের মনোভাব পরিবর্তন হত। কিন্তু তারা নিজেদেরকে প্রগতিশীল দাবী করলেও নতুন বা আধুনিকতাকে গ্রহণ করবার ক্ষেত্রে তাদের যে দীনতা তাকে তারা কখনোই অতিক্রম করতে পারেননি। অথচ এর উল্টোটাই হবার কথা ছিল।
তাই একথা নি:সন্দেহে বলা যায় একশভাগ প্রগতিশীল, উদার, মুক্তমনা ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া বা দাবী করাটা যত সহজ তাকে নিজের আচরণের মাধ্যমে প্রকাশ করানো ততটাই কঠিন, অনেকটা সোনার পাথরবাটি পাবার মতনই। খুব অল্পকিছু মানুষই হয়ত তা পারেন।