লিখেছেন: সাত্যকি দত্ত

কলকাতায় ফণিভূষণের চিকিৎসা সম্পূর্ণ হলে , তার বিশ্রাম নেওয়ার প্রয়োজন হয়েছিল । রবীন্দ্রনাথ তখন ফণিভূষণকে শান্তিনিকেতনে এসে থাকবার জন্য আহ্বান করেন । বলা বাহুল্য , রাণুর সান্নিধ্য পাওয়ার স্বার্থবুদ্ধিও রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণের পিছনে কাজ করেছিল । ফণীভূষণ কলকাতা থেকে সপরিবারে শান্তিনিকেতনে আসলেন ৪- ঠা জুন তারিখে , তাঁদের থাকার ব্যবস্থা হল মহর্ষি ভবনে । শান্তিনিকেতনে এসে রাণু ভানুদাদাকে পেল কর্মক্ষেত্রের পটভূমিকায় । তখন ছুটি বলে বেশীরভাগ ছাত্র বাড়ি চলে গেলেও কয়েকজন আশ্রমবাসী শিক্ষক পরিবার নিয়ে সেখানে ছিলেন । তাদের মধ্যে থেকে লাবু , রেখা , কল্যাণী প্রভৃতি বন্ধু জুটিয়ে রাণু সারা শান্তিনিকেতন দাপিয়ে বেড়াতে লাগলো বনবালার মতো – তাঁকে দেখতে লাগত অবিকল শকুন্তলার মতো , আর তারই পিছু পিছু ঘুরত আশ্রমের পোষা হরিণটা। একদিন যখন সেই হরিণ বনে চলে গেল , রাণুর সে কি কষ্ট , সকলের বারণ উপেক্ষা করেই একা একাই খুঁজতে যায় কখনো খোয়াইতে , কখনো বা লালবাঁধের দিকে । রবীন্দ্রনাথ যখন আশ্রমে থাকতেন , তখনই তাঁকে ঘিরে জমে উঠত অনাহূত সভা – এই সভা থেকেই রাণু স্বাদ পেল রবীন্দ্রনাথের গানের তালিম , আবৃত্তি , ইংরেজি সাহিত্য পাঠ , নাটক ইত্যাদির । এর মধ্যে রাণু গোপনে ‘ অভিসার ‘ কবিতাটি মুখস্ত করে ফেলে সভায় আবৃত্তি করে সকলকে অবাক করে দিল একদিন , আর তার পর থেকেই রোজ রোজ রাণুর কাছে কবিতা শোনার আবেদনও আসতে লাগলো সকলের কাছ থেকে , এই বিষয়ে সবচেয়ে বেশি উৎসাহী অবশ্য তাঁর ভানুদাদা । কোনোকোনো দিন দেহলির ছাদে নিভৃতে বসে রাণু তাঁর ভানুদাদাকে হিন্দি দোঁহা , শিশুমহাভারত , রুপকথার গল্প । কেমন লাগতো রবীন্দ্রনাথের তা দেখা যাক রাণুকে লেখা ২৭ শে জুলাইয়ের চিঠি থেকে –

” সন্ধ্যা আকাশের তারা ঈশ্বরের খুব বড় সৃষ্টি , কিন্তু সন্ধ্যায় ছাদে রাণুর মুখের কথাগুলো তার চেয়ে কম বড় নয় – ঐ তারার আলো যেমন কোটি কোটি যোজন দূরের থেকে আসছে – তেমনি তোমার হাসি গল্প শুনতে শুনতে মনে হয় যেন কত জন্ম জন্মান্তর থেকে তার ধারা সুধাস্রোতের মত বয়ে এসে আমার হৃদয়য়ের মধ্যে এসে জমেছে । ”

অনেক সুখের স্মৃতির পর অবশেষে কাশীতে ফেরার দিন এল । সেদিন ছিল ১০ – ই জুলাই । রাণুর সে কি কান্না , সে তার ভানুদাদাকে ছেড়ে কিছুতেই যাবে না । অনেক বুঝিয়ে কিছু দিন পর আবার আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হল । দিনটা ছিল ১০ – ই জুলাই , রবীন্দ্রনাথ নিজে গিয়ে ফণীভূষণের পরিবারকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসলেন ।

ষ্টেশন থেকে ফিরে এলেন রবীন্দ্রনাথ । রাণু যেন শান্তিনিকেতন থেকে সব টুকু হাওয়া সাথে নিয়ে চলে গেছে তার পশ্চিমের দেশে , গাছের একটি পাতাও নড়ছে না – বাতাসের অভাবে আকাশটা যেন বিষণ্ণ মনে পৃথিবীর উপর মূর্ছিত হয়ে পড়ে ধুঁকছে । রাঙা মাটির উপর সবটুকু রোদ্দুরের আলপনা মুছে গেছে , আকাশ ধূসর মেঘে ঢাকা – স্নান সেরে এসে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সুদূরের পানে চেয়ে কবির মনে হলো জগতটা যেন জ্বরের রোগী , কম্বল মুড়ি দিয়ে পড়ে আছে । প্রকৃতির এই যে বিষাদময়তা , তা যেন আরও বেশি করে রাণুর অনুপস্থিতির কথা মনে করাচ্ছে , রেল গাড়ির মধ্যে কি করছে রাণু ? লক্ষী মেয়ে হয়ে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝি , নাকি নাকি জানালা দিয়ে পাহাড় দেখছে ! রাণু যেমন করে অনায়াসেই কল্পনা করে বলে দিতে পারে তার আদরের ভানু দাদা এখন কি করছে , কই তিনি তো কিছুতেই তেমন করে কল্পনা করতে পারছেন না , একটা কষ্ট কল্পনা সব সময়েই নতুন একটা কল্পনায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে , কী অসহ্য যন্ত্রণার ! রাণু পথে যেতে যেতে কি চিঠি লিখবে তার ভানু দাদাকে ? ভানু দাদার যে খুব খুব করে জানতে ইচ্ছে করছে কেমন করে মেয়েটার দিন কাটছে রেল গাড়ির কামরায় । খাওয়ার সময় এল , কবিকে ডাকতে এসেছে বনমালী – কবির খুব করে মনে হলো বলে দেই আজ খাওয়ার ইচ্ছে নেই ! পর মুহূর্তেই আবার মনে হলো , রাণু যে কড়া নিয়ম করে গেছে তাঁর ভানুদাদার খাওয়ার , শোয়ার , পড়াশুনা করার আর তার অন্যথা করবার নয় । দু – গাল মুখে দিয়েই উঠে পড়লেন , দুপুরে যে শোয়ার নিয়ম করে গেছে রাণু আর সেই মতো বিছানাও তৈরি হয়ে গেছে ততক্ষণে , অবসন্ন মনে সেখানে বসে দেখলেন , এই ফাঁকে ছেলেরা ডেস্কের উপর দুটো কেয়াফুল রেখে গেছে – কেয়াফুলের সুভাসে ঘর ম ম করছে , কি যে একটা আনন্দের হিল্লোল ঘরের মেঝেতে হামাগুড়ি দিচ্ছে তা বোঝানো যায় না , কিন্তু এই সময়েই রাণু কই , এই মুহূর্ত তার সাথে ভাগ করে না নিতে পারলে যে এই আনন্দের আয়োজন ব্যর্থ ! কবির খুব ইচ্ছে করল শুতে যাওয়ার আগে ওই কোণের ডেস্কের সামনে বসে রাণুকে দু লাইন লিখতে । লিখেও ফেললেন –

” দেখ , তুমি আমাকে বলে দিয়েচ বলে আমি যথাসাধ্য খেয়েচি , শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করব কিন্তু ঘুম হবে না , বিকেলে আজ কোনোমতেই চেঁচিয়ে বক্তৃতা করবনা – রাত্রে সকাল সকাল শুতে যাব । কিন্তু তুমি যদি বেশ করে খেয়ে দেয়ে মোটাসোটা হয়ে না ওঠ , তাহলে তোমার সঙ্গে আমার ঝগড়া হবে । যাবার আগে তোমাকে একটু গান শুনিয়ে দিয়ে শুতে যাই –
ওদের সাথে মেলাও যারা চরায় তোমার ধেনু –
তোমার নামে বাজায় যারা বেণু ।

ইতি ২৬ আষাঢ় ১৩২৫ ”

চিঠির ভাঁজে ভাঁজে রেখে দিলেন কেয়াফুলের কেশর , পুনশ্চ লিখলেন – ” কেয়াফুলের কেশর চিঠির মধ্যে একটু একটু পাবে । ” হরিশ মালী কখন জানি লাল জবা আর সাদা টগর ফুলে সাজিয়ে একটা তোড়া রেখে গেছে কবির পাশে , ইতিমধ্যে সজল হাওয়ার ছোঁয়ায় ফুল গুলো ঝিরঝির করে দুলছে , কবির মনে হলো , কন্যাসমা রাণুর অভাবের ব্যথায় বুঝি পাপড়ি গুলো থরথর করে কাঁপছে । এই সময়েই নামলো উবুশ্রান্ত বৃষ্টি , বনমালী ছুটে এসে জানলা গুলো ভেজাতে গেলে কবি বললে , ” থাক থাক ” ! বনমালী বেশ বুঝেছে রাণুর অনুপস্থিতির ব্যথায় কবি কতখানি কষ্ট পাচ্ছেন নীরবে , তাই আজ সে মাথা নিচু করে চলে আসল ঘর থেকে । বিছানা বইপত্র সব ভিজে যাচ্ছে , কবি কোণের ডেস্কের সামনে সেই ভাবেই বসে আছেন – উদাসীন ঋষিকল্প কবির ধ্যানতন্ময়তায় নিমগ্ন এক মূর্তি , গাইছেন –

পথ চেয়ে যে কেটে গেল
কত দিনে রাতে।
আজ ধুলার আসন ধন্য করে
বসবে কি মোর সাথে।
রচবে তোমার মুখের ছায়া
চোখের জলে মধুর মায়া,
নীরব হয়ে তোমার পানে
চাইব গো জোড় হাতে ।

অনেকক্ষণ এমন করেই কাটলো , এক সময় জুঁইয়ের বনে সন্ধ্যার ছায়া ঘনালো , আকাশে গোধূলির সৌরভ – কবি আর ঘরে থাকতে পারলেন না , তখনও ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে আর বৃষ্টিকে ছাপিয়ে গোধূলির বিষণ্ণ আলো পাতায় পাতায় অদ্ভুত মেদুরতায় ভুগছে । কবি ছাদে এসে বসলেন , বৃষ্টি পতনের শব্দ ছাপিয়ে রাণুর কষ্ট তাঁর বুকে বেশি করে বাজছে। আর তিনি মনে মনে এই কামনা করছেন যে , বাদলের উপরে সূর্যের আলো পড়ে যেমন ইন্দ্ৰধনু তৈরি হয়, তেমনি করে রাণুর অশ্রুভরা কোমল হৃদয়ের উপরে স্বর্গের পবিত্র আলো পড়ুক, সৌন্দর্যের ছটায় কন্যাসমা মেয়েটার জীবনের এক দিগন্ত থেকে অন্য দিগন্ত পূর্ণ হয়ে উঠুক। যার আশীৰ্ব্বাদে আমাদের জীবনের সমস্ত সুখ ফুলের মত বিকশিত হয় এবং সমস্ত দুঃখ ফলের মত কল্যাণপূর্ণ হয়ে ওঠে, তারই আশীৰ্ব্বাদ রাণুর জীবনের সকল সুখ দুঃখকেই সৌন্দর্য্যে এবং মঙ্গলে সার্থক করে তুলুক্‌।
শুধু এই প্রার্থনাতেই শেষ নয় , কবি আরও ভাবছেন , তিনি তাঁর জীবনকে যে পরম পিতার কাজে উৎসর্গ করেছেন — সেই উৎসর্গকে সেই পিতা যে গ্রহণ করেচেন তাই মাঝে মাঝে তিনি কবিকে নানা ইসারায় জানিয়ে দেন – হঠাৎ রাণু যেন তারই দূত হয়ে কবির কাছে এসেছে, আর এই যে রাণুর জন্য তাঁর গভীর স্নেহ ব্যাকুলতা সে যেন পরম পিতারই সেই ইসারা । রাণু তো তবে পরম পিতার কাছ থেকে পাওয়া কবির পুরস্কার।
এই চিন্তা গুলো করতে করতে কবির অবসাদ একটু একটু করে দূর হয়ে গেল , ওদিকে বৃষ্টি থেমে আকাশ ভরে তারারা মিটমিট করে জ্বলছে । কবি এখন , পরম পিতার কাজে লেগে পড়তে দ্বিগুণ উৎসাহ বোধ করছেন ! ভগবান তার সেবককে খুসি হয়ে মাঝে মাঝে যেমন দেবতার অমৃত পান করিয়ে দেন — তাতে আমাদের শক্তি বেড়ে যায়, অবসাদ দূর হয়, তেমন করেই সেই অমৃত তিনি যেন কবিকে পান করালেন রাণুর সাথে তাঁর এই সাময়িক বিচ্ছেদের ব্যথার মাধ্যমে ।

রাত্তির যখন আড়াইটে তখন আবার বৃষ্টি শুরু হল , তারপর থেকে তার আর থামবার নাম নেই – চারিদিকের মাঠে জল বয়ে যাচ্ছে , আকাশ জলে ঝাপসা , মেঘের কোথাও বিচ্ছেদ নেই । এমন ঘোর বাদলায় ক্লাস হওয়া অসম্ভব , রবীন্দ্রনাথ নিজের ঘরের কোণটিতে বসে আছেন সকাল থেকে । এমন সময়ে সুযোগ বুঝে এন্দ্রুজ সাহেব তাঁর খাতা নিয়ে হাজির হলো সে ঘরে , অভিপ্রায় কবির কাছ থেকে ঘরে বাইরের ইংরেজি তর্জমা শুনে শুনে লিখে ফেলবে । রবীন্দ্রনাথ পুবের জানলার কাছে বসে বসে সে তর্জমা করে যাচ্ছেন , জানলার ওপাশে উবুশ্রান্ত বৃষ্টি আর এন্দ্রুজ একটি তাকিয়ার উপর চড়ে বসে লিখছে – এমন সময়ে ডাকের চিঠি এল । গতকাল কবি রাণুর চিঠি না পেয়ে ভেবেছিলেন আজ সকালে সে চিঠি আসবে না , যদি আসে তবে তা আসবে দুপুরের ডাকে – তাই চিঠিগুলোকে না দেখেই সরিয়ে রাখলেন একপাশে । কিছু মুহূর্ত পরেই , কি যে হলো , মন বড় উতলা হয়ে উঠল – ওমনি লেফাফার গুলোর উপর চোখ বুলাতেই রাণুর হাতের অক্ষর চোখে ঠেকল । এইদিকে এন্দ্রুজ একটি লাইনের অর্ধেকটা লিখে বসে আছে কবির মুখের দিকে চেয়ে , কবি তাঁকে বললে – একটু রোস , আমার চিঠি পড়ে নেই ।

” ১০-১১ জুলাই ১৯১৮

প্রিয় রবিবাবু,

এখন গাড়ী চলছে। আমি খুব কাঁদছি। আপনার জন্যে খুব মন কেমন করছে। আপনি বোধহয় এখন নাইছেন। এখন একটু ২ মেঘলা একটু ২ রোদ। দুটো ছোট ২ ইষ্টিযান পার হয়েছি। আপনার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে। এখন গাড়ী খালী। খুব কঁপিছে গাড়ী। এই এখনি একটা ছোট ইষ্টিবানে গাড়ী থামল। এই আবার চলছে। আমার আবার খুব কান্না পাচ্চে। দুধারে জলে ভরা খেত আর মাঠ। খানিকক্ষণ পরে লিখছি। আপনার নাওয়া হয়ে গেছে কে চুল আঁচড়ে দেবে আপনাকে। একটা ইষ্টিষানে গাড়ী থেমেছে অনেক মেয়ে বউ দেখলাম। আমাদের গাড়ী খালী আছে।

আপনার এখন খাওয়া হয়ে গেছে। রোজ বিশ্রাম করবেন। একটুও ভাল লাগছেনা। চুপ করে বসে আছি। গাড়ী খুব নড়ছে।

রামপুরহাট। বেশী লোক নেই। কতকগুলি মেয়েমানুষ নথ পরে গেলেন। আমি চুপ করে বসে। সামনেই একটা ইঞ্জিন মালগাড়ীর ওপর। আপনি বোধহয় এখন বিশ্রাম করছেন। নলহাটীতে গাড়ী থামল। একজন খুব মোটা বাঙালী মেয়েমানুষ গাড়ী উঠলেন। বাবজাদের গাড়ীতে।

চাৎরা। আপনি কি করছেন এখন এসময়। মন কেমন করছে। বাজগাঁও। হিন্দুস্থানী গ্রাম সুরু হল। বাড়ীর টাইলের ছাত। লোক প্রায় উঠলই না। প্রায় মেঘলা। সবুজ মাঠ। আর জলে ভরা খেত। তার পেছনে জঙ্গল।

পাকুড়। এখানে নথ পরা মেয়েমানুষটী নামল। এটা একটু বড় ইষ্টিসন। আর একজন নথ পরা মেয়ে মানুষ প্ল্যাটফর্মে দাড়িয়ে। আমার সন্ধ্যেবেলা ভাল লাগবে না। আপনারও বোধহয় ভাল লাগবে না।

বারহাবরা । এটা বেশ বড়। অনেক লোক। কতকগুলি ক্রিশচান সাঁওতালী মেয়ে গাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে। একপাশে একটা বড় পুকুর রয়েছে। তার চারিধার গাছে ঢাকা। খুব সুন্দর দেখতে। এখন মেঘলা। আমি এতক্ষণ আপনার কথাই ভাবছিলাম। দূরে একটু ২ সবুজ পাহাড় দেখা যাচ্ছে। গাড়ী দুটো পাহাড়ের ভেতর দিয়ে গেল।

তিন পাহাড়। এখানে একটা পাহাড়ের তলায় কেমন একটা হিন্দুস্থানী প্রাম। এখন পাঁচটা বেজেছে। আপনার বোধহয় লেখাপড়া এখখুনি শেষ হল। যদি কিছু সভা হয় তো বেশী জোরে লেকচার দেবেন না।

সাহেবগঞ্জ। এ ইষ্টিসানটা তো বেশ বড়। আমাদের সামনে টিকিট কলেক্টর দাড়িয়ে। তাকে দেখে খুব হাসি পাচ্চে। এখনো আমাদের গাড়ীতে কেউ আসেনি। আমাদের গাড়ীর সামনে কল। সবাই জল খাচ্ছে। এখন আপনি বোধহয় খাচ্চেন। আজ সন্ধ্যেবেলা তো আমি আর আসব না আপনি বোধ হয় সভা করবেন। এবার যেদিন ছাতে বসবেন সেদিন নিশ্চয় আপনার আমার জন্যে মন কেমন করবে। আপনি একলাটী চুপ করে বসে থাকবেন।

কহলগ্রাম। এখানে একটা গাড়ী দাড়িয়ে ছিল। সেটা রাত্তির ১২টায় বোলপুর পৌছোবে। এখনো মেঘলা। দু ধারে উচু ২ ঘাস। খানিকক্ষণ আগে আমরা সব জল খাবার খেয়েছি। আমি অনেক খেয়েছি। আপনিও বেশী করে দুধ খাবেন।
গাড়ীতে কারোর সঙ্গে কথা হয়নি।
সবোরএ একটা কলেজ দেখলাম। তার পাশে মাঠে ছেলেরা খেলছে দেখলাম।

ভাগলপুর। এ ইষ্টিসানটা খুব বড়। বাবজা খাবার কিনছেন। একজন লোক সেজেণ্ডজে গলায় মালা দিয়ে আমাদের সামনে দাড়িয়ে আম কিনছে। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। ক্রমে অন্ধকার হচ্চে। সববাই বলছেন এখন শাস্তিনিকেতনের কথা মনে আসছে। এ সময়েই তো আমার সবচেয়ে বেশী আপনার জন্যে মন কেমন কোরবে। কাশীতে গিয়েও কোরবে। একটা ছোট্ট টনেলের ভেতর গাড়ী গেল। এই বার জামালপুর আসবে। কে জানে কেন হটাৎ বনে গাড়ী থামল আবার চলছে। অন্ধকার। এখন রাত ৮।৯, আপনি বোধ হয় ছাতে কিম্বা কোণের বিছানায় শুয়ে। জামালপুর। কাল এসময় আপনি গান গাইছিলেন। আমার এখানে ভাল লাগছে না। তাইত কাদছি। এবার শুতে যাচ্ছি কিন্তু ঘুম হবে না।

রাত ২।১। রাত্তিরে খুব বৃষ্টি হচ্চে। আমার ঘুম আসছেনা। আপনি এখন বোধহয় ঘুমুচ্ছেন। আরায় ভোরে গাড়ী পোঁচেছে। অনেক ঘুমটা পরা হিন্দুস্থানী মেয়ে নামল তারা সব কা কি, না নী নে এই সব বলে ঝগড়া বাঁধিয়েছে। আমার গাড়ীতে একটুও ভাল লাগেনি। আপনার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে। এ চিঠিটা মোগলসরাএ ফেলবো। কাশী গিয়ে কি হল আর একটাতে লিখব। দেখুন আপনাকে কত বড় চিঠি দিলাম।
আমাদের ঠিকানা ২৩৫ অগস্ত কুণ্ড।
দেখবেন যেন ২৩৬, ৩২৫ কিম্বা ৫৩২ না হয়। আর অগস্ত কুণ্ডাটাও যেন না ভুলে যান। কেমন বুঝলেন ত। চারপাতা হয়ে গেছে। আর আঁটছে না।

[২৬-২৭ আষাঢ় ১৩২৫]

রাণু। দেবী নয়।

পুঃ সকাল বেলা ৯টা। এখন আপনি ছেলেদের পড়াচ্ছেন, আমার পড়তে ইচ্ছে করছে। ”

চিঠি পড়া শেষ হতেই কবি দেখলেন তাঁর হৃদয় ব্যথায় বড় ভারাক্রান্ত , এন্দ্রুজকে বললেন – ” আজ আর লেখা চলবে না । ” এন্দ্রুজ চলে গেল । ইতিমধ্যে বৃষ্টিও ধরে গেছে । রবীন্দ্রনাথ তাঁর সেই লেখার কোণটিতে ফিরে এসে রাণুর জন্য চিঠি লিখতে বসে গেলেন , জানলা দিয়ে তখন আসছে বৃষ্টিস্নাত বেলীফুলের গন্ধ ।

কবি লিখছেন ” … আজ যে রকম বদলা, আজকের দিনে বেলার ঠিক পাওয়া যায় না। আকাশের ঘড়িতে সূৰ্য্যদেব কাটার মত পূব দিক থেকে পশ্চিম দিকে সময় ভাগ করে চলেন— কিন্তু আজ সেই আকাশ-ঘড়ির ডালা বন্ধ— সেইজন্যে মনে হচ্চে যেন সময় চলচেনা। আজ খাওয়ার পরে তোমাকে চিঠি লিখতে বসেচি। এই চিঠি লেখা শেষ না করে আমি শুতে যাবনা— এতে তুমি যদি রাগও কর তাহলেও আমি মানবনা। আমি তোমার নিয়ম প্রায় সবই মেনে চলচি। সেই অবধি আমি সভা করিনি— সকাল সকাল শুতে যাই। বিকেলে oat meal এর সঙ্গে মিলিয়ে একটু করে দুধও খেতে আরম্ভ করেচি। চুল নিজে নিজে যতটা পারি আঁচড়াই কিন্তু সে ভাল হয় না।

এর মধ্যে একদিন কেবল ছেলেরা আমার কাছে আমার কবিতার ব্যাখ্যা শুনতে এসেছিল, তোমার কথা মনে করে আমি কেবল একটা কবিতা তাদের কাছে ব্যাখ্যা করেছিলুম, সেও জোরে নয়; তারা আর একটা যখন শুনতে চাইলে আমি তাদের কথা শুনলুম না; তাই ত সেদিন আমি শ্রান্ত হইনি।

আমি যেমন তোমার কথা শুনেচি, তোমাকেও তেমনি আমার কথা শুনতে হবে। ভাল করে দুধ খেয়ে বিশ্রাম করে আগামী পূজোর ছুটির মধ্যে বেশ মোটা সোটা হয়ে ( দিনুবাবুর মত অতটা নয়) আসতে হবে। তোমাকে শ্ৰীমতী রাণু যাতে না বলি এই তোমার ইচ্ছে— কিন্তু আমাকে যদি “প্রিয় রবিবাবু” বলে চিঠি লেখ তাহলে আমি তোমাকে শ্রীমতী রাণু দেবী পর্যন্ত বলতে ছাড়ব না। তুমি আমাকে যদি রবিদাদা বল তাহলে আমার নালিশ থাকবে না। তুমি তোমার এক সন্ন্যাসী দাদাকে বশ করেছিলে, এখন তার পদটা তিনি আমার উপর দিয়ে গেছেন— তোমার সম্ভাষণে তুমি সে কথা যদি বিস্মৃত হও তাহলে চলবে না। তুমি আমাকে বেশ বড় চিঠি লিখেচ, আমিও বড় চিঠি লিখলুম। তোমার কাছে অঙ্কে এবং ভূগোলে আমি পারব না, কিন্তু তাই বলে লেখায় তোমার কাছে যদি হার মানি তাহলে আমার নোবেল প্রাইজ ফিরিয়ে নেবে। আশাকে শান্তিকে ভক্তিকে আমার আশীৰ্ব্বাদ দিয়ো। তোমার বাবজাকে” বোলো তার শরীর কেমন থাকে আমাকে যেন জানান এবং পূজোর ছুটিতে কিম্বা তার পূৰ্ব্বেই আমাকে যেন দর্শন দেন, শুধু একলা নয় সে কথা তাকে না বল্লেও বুঝবেন। তুমি যেমন বৌমার’ উপরে আমার ভার দিয়ে গেছ তেমনি ছুটি পর্যন্ত আমি তোমার মার’ উপর তোমার ভার দিলুম, সেটা তিনি যেন মনে রাখেন; এবার যখন তিনি তোমাকে সঙ্গে নিয়ে আসবেন তখন তোমাকে এবং আমাকে ওজন করে পরীক্ষায় বৌমা প্রথম হন কি তোমার মা প্রথম হন তার বিচার হবে। এই পরীক্ষায় বাংলাদেশের গৌরব বেশি কিম্বা কাশীর গৌরব বেশি আমাদের উভয়ের গুরুত্ব অনুসারে সেইটে স্থির হয়ে যাবে বড় দায়িত্ব যখন তোমার উপরে আছে তখন যত পার দুধ খেতে ছেড়ো না। আমার এমন অবস্থা হবে কে দিনবাবু কে রবিবাবু হঠাৎ চেনা শক্ত হবে। ইতি

৩০ আষাঢ় রবিবার। ১৩২৫

তোমার রবিদাদা

( চলবে )