লেখক: কে এইচ রুধির

“উনিশ শ পঁচাশি সনে একদিন লক্ষ্মীবাজারে শ্যমাপ্রসাদ চৌধুরী লেনের যুবক আবদুল মজিদের পায়ের স্যান্ডেল পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি বিধানে ব্যর্থ হয়ে ফট করে ছিঁড়ে যায়। আসলে বস্তুর প্রাণতত্ত্ব যদি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতো, তাহলে হয়তো বলা যেত যে, তার ডান পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেলের ফিতে বস্তুর ব্যর্থতার জন্য নয়, বরং প্রাণের অন্তর্গত সেই কারণে ছিন্ন হয়, যে কারণে এর একটু পর আবদুল মজিদের অস্তিত্ব পুনর্বার ভেঙে পড়তে চায়”।

উপন্যাসের শুরুটা এমন। বাক্যগুলো পড়া মাত্র ভ্রু কুঁচকে উঠতে পারে! মানে কী! কিন্তু এই দুটো দীর্ঘ বাক্য পুরো উপন্যাসটির সারমর্ম ইঙ্গিত করছে। উপন্যাসটির শব্দসংখ্যা সীমিত কিন্তু প্রেক্ষাপটের ব্যাপ্তি বা বিস্তৃতি বিশাল। এই প্রায় চল্লিশ পৃষ্ঠার উপন্যাসে শহীদুল জহির একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন এবং তার প্রায় চৌদ্দ বছর পরের রাজনৈতিক এবং আর্থ-সামাজিক জীবনপ্রবাহকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন এবং সফল হয়েছেনও বটে। পুরো উপন্যাসটিকে একটি বিমূর্ত চিত্রের সাথে তুলনা করা যায়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশগুলোকে পাঠোদ্ধার করে একসাথে ধরলে সম্পূর্ণ চিত্রটি পরিষ্কার হয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠবে।

এক নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে উপন্যাসটির শুরু হয়েছে। রায়সা বাজারে যাওয়ার পথে কারকুন বাড়ি লেন থেকে বের হয়ে নবাবপুরের ওপর উঠলে মজিদের স্যান্ডেলের ফিতে ছিঁড়ে গেলে সে খানিকটা থেমে যায়। সেই বিরতিতেই নবাবপুরের বাতাসে সে ‘মানুষ আর যানবাহনের শব্দ ও চাঞ্চল্যের ভেতর আরো অধিক কিছু অনুভব করে’ এবং অবচেতনভাবেই ‘এক ঝাঁ ঝাঁ শব্দের জগতে সে ঢুকে পড়ে’। নবাবপুর রোডে ম্রিয়মাণ বিকেলে ‘কাকের চিৎকার এবং উইপোকার নিঃশব্দ পলায়ন প্রচেষ্টা’ তার মনে ‘এক ধরনের নীরব সন্ত্রাসের’ ইঙ্গিত দেয়। তার ইন্দ্রিয় তখন খুব নিকট থেকে ভেসে আসা লাউড স্পিকারের শব্দ শোনে সচেতনভাবে। তার উৎস সন্ধানে ব্যস্ত ইন্দ্রিয় আরো উদ্দীপ্ত হয় পুলিশ ক্লাবের কাছে রিকশায় বসে থাকা আবুল খায়েরের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ হওয়া মাত্র। ‘কাকের চিৎকার এবং যান্ত্রিক শব্দের ভেতর’ তার কানে আসে আগেরদিন হরতালে অংশগ্রহণ করার জন্য সবার উদ্দেশ্যে ধন্যবাদজ্ঞাপন। সেই ‘উইপোকার হত্যাযজ্ঞের বিষণ্ণ বিকেলে’ আবুল খায়েরের কথা শোনে তার বহুদিন আগে বিদীর্ণ ‘হৃদয়ের তন্তু তার স্যান্ডেলের ফিতার মতো পুনরায় ছিন্ন হয়’। তার কাছে মনে হয় আকাশে উড়ন্ত কাকগুলো সব নীল শ্মশ্রু আবুল খায়েরের নীল রঙের জোব্বার ভেতর থেকেই যেন বের হয়ে আসছে। কাকের সাথে যে আবুল খায়েরের পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা আছে তা তার অতীত স্মৃতি জানান দেয়। তারপর নাটকীয়তা ছেড়ে আখ্যানটি এগুতে থাকে সময়ের কাঁটায় অগ্র-পশ্চাৎ করে।

কাকের প্রতি এক অজ্ঞাত রহস্যময় ভালোবাসা ছিল আবুল খায়েরের পিতা বদরুদ্দিন মওলানার। একাত্তর সনে যখন মানুষ শঙ্কায় আচ্ছন্ন ছিল প্রতি মূহুর্ত তখন নাকি তিনি ‘নরম করে হাসত আর বিকেলে কাক ওড়াত মহল্লার আকাশে’। এই চিত্রকল্প দিয়েই শহীদুল জহির বদরুদ্দিন মওলানার চরিত্রের আগাম ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছেন। পাঠকের কল্পনার আকাশে মেঘ-রৌদ্রছায়া শুরু হয় মওলানাকে নিয়ে যার ঘোর পুরোপুরি কাটবে প্রথম যেদিন মিলিটারির আগমন ঘটবে মহল্লায় সেদিন, যখন সে হঠাৎ করে কাঁধের ওপর কালো খোপ খোপ চেকের স্কার্ফটি ফেলে এগিয়ে আসে এবং মহল্লার লোক পাঞ্জাবি মিলিটারির পাশে তাকে দেখে শনাক্ত করতে পারে না সে বাঙালি কিনা। প্রত্যেকদিন নাকি সে এক থালা মাংস নিয়ে ছেলেদের নিয়ে ছাদে উঠে যেত। আকাশে ছুঁড়ে দিত মাংসগুলো কাকদের উদ্দেশ্য করে। ‘মহল্লায় তখনো যারা ছিল, তারা বলেছিল, বদু মওলানা প্রত্যেকদিন যে মাংসের টুকরোগুলো আকাশের দিকে ছুড়ে দিত, সেগুলো ছিল মানুষের মাংস’ – বাক্যটি একই সাথে তখনকার জনমানব শূন্য মহল্লার ইঙ্গিত দিচ্ছে এবং বদু মওলানার ভয়ঙ্কর রহস্যময় চরিত্রের দিকে আলোকপাত করছে। সেই মাংসের টুকরোগুলো যে মানুষের ছিল সেটার সত্যতা প্রমাণের জন্য ঔপন্যাসিক কয়েকটি ঘটনার অবতারণা করেছেন। প্রথম প্রমাণটি পান ‘মহল্লার সবচাইতে প্রাচীন মুসলমান পরিবারটির প্রধান, খাজা আহমেদ আলী’। তিনি চামড়ার মসৃণতা আর টুকরোটির গায়ে লেগে থাকা পাথরের ফুল দেখে নিশ্চিত হন যে সেটা কোন মেয়ের শরীরের অংশ এবং সেই অদেখা মেয়ের জন্য মাগরিবের নামাজের সময় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলেন। কিন্তু ‘এখন তার বাসার আঙিনায় তার নিজের আর ছেলের জোড়া কবর’ যারা কিনা কয়েকদিন আগে তাদের বাড়ির আঙিনায় ঐ অদেখা মেয়েটির মাংসের টুকরোটি কবর দিয়েছিল। ঔপন্যাসিক এইখানেও প্রচ্ছন্নভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছেন পিতা-পুত্রের নির্মম পরিণতির! পরবর্তীতে উনি ঘটনার বর্ণনা করেছেন বিস্তারিত। সেদিন প্রথম মিলিটারি এসেছিল মহল্লায়। মাত্র এক ঘন্টার তান্ডব অভিযানে স্তব্ধ এবং শোকাতর করে দিয়েছিল মহল্লার প্রাণ চাঞ্চল্যকে। মোট সাতজন নিহত হয়েছিল এবং শ্লীলতা হারিয়েছিল তিনজন। তিনি দুই পিতা-পুত্রের নিহতের অবতারণা করেছেন এইভাবে – ‘তারা তাদের পরিবারের বেঁচে থাকা পরিবারের লোকসংখ্যা গুনে দেখে, পাঁচটি পরিবারের একজন করে কমে যায়, খাজা আহমেদ আলীর পরিবারে কম পড়ে দুজন’। খাজা শফিককে তারা বাসায় প্রবেশ করেই গুলি করেন। চোখের সামনে পুত্রের মৃত্যু দেখে পিতা ছাদে উঠে আজান দিতে থাকেন। সেই অবস্থায় ই তাকেও গুলি করে মেরে ফেলে মিলিটারিরা। ইসলাম রক্ষার প্রতিশ্রুতি নিয়ে যে মিলিটারিরা এই বাংলায় নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালালো তারা কিনা একজন বৃদ্ধকে তার আজানের সময় ই গুলি করে মেরে ফেলল! এই চিত্রকল্পটাই আঙুল তুলে দেখায় তাদের প্রতিশ্রুতিটি কতটুকু হাস্যকর এবং কৌতুকপূর্ণ ছিল! সেদিন চৌষট্টি নম্বর বাড়ির আলতাফ হোসেনকে পাওয়া গিয়েছিল কুয়োর পানিতে, মাথার চাঁদিতে গুলির সরু প্রবেশপথ খুঁজে পেয়েছিল কিন্তু নির্গমন পথ খুঁজে পায়নি। সেইখান থেকেই তারা নিশ্চিত হয়েছিল সেই প্রাণ কেড়ে নেওয়া গুলিটি তার চাঁদির ভেতরই রয়ে গেছে। এইখানে ঔপন্যাসিক কিছুটা কৌতুক ছলেই বলছেন – ‘এতে আলতাফ হোসেনের কি লাভ হয়েছিল সে কথা মহল্লার লোকেরা বলে না, তারা শুধু বলে, গুলি ঢুকছে, কিন্তু বাইরাইয়া পরেনিকা’।

সেদিন বদু মওলানার কলজের টুকরো ছোট ছেলে আবুল বাশারের কান্না শুনে মহল্লার লোকেরা নিশ্চিত হয়েছিল যে আরেকটি লাশ বাকি রয়ে গেছে এবং সেটি ছিল কুকুর ভুলুর। সেদিন একমাত্র আবুল বাশার ই কাঁদার অনুমতি পেয়েছিল। বাদবাকি মহল্লার লোকেরা লাশ উঠোনে সাজিয়ে রেখে ডুবে গিয়েছিল শোক, ভীতি, শূন্যতা ঘেরা এক নিস্তবদ্ধতায় যা ভঙ্গ হয়েছিল তখন, যখন ‘হেমন্তের এক অপরাহ্নে স্টেনগান হাতে, জলপাই রঙের পোশাক আর মুখ ভর্তি লম্বা দাড়ি নিয়ে একদল মুক্তিযোদ্ধা মহল্লায় এসে দাঁড়ায়’ এবং বলে ‘আর ভয় নাই, শালারা খতম’। সেদিন সবার অন্তরের গহীনে চেপে রাখা শোকের পাহাড়টুকু কান্না হয়ে নেমে আসে দু’চোখ বেয়ে! সবাই ভেঙে যাওয়া যন্ত্রের মত আর্তনাদ করে উঠে আর প্রাণখুলে কাঁদে!

বদু মওলানার কলুষিত আত্মার ছায়া শান্তিতে কবরে শায়িত হতে দেয়নি খাজা আহমেদ আলী আর খাজা শফিকের প্রাণহীন লাশকে! তাদের কবরের পাশে গর্ত খুঁড়ে কবর দিয়েছিল তার পুত্রের পোষা কুকুর ভুলুকে এবং মহল্লার আতঙ্কিত জনতার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘এই কবরে কোন পীর নাই, কুত্তা আছে’। একজন মৃত মানুষের প্রতি যে সম্মানটুকু দেখানো উচিত ছিল তার বিন্দুমাত্রও উনি দেখাননি বরঞ্চ তার ভেতর ছিল সেই মৃতদেহগুলোর প্রতি তুচ্ছতা এবং ঘৃণা! এই রাজাকার প্রধান বদু মওলানাদের কোন শাস্তি হয়নি। যুদ্ধের ঠিক দু’বছরের মাথায় সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরপর ই তারা খোলস পালটে পদচারণা শুরু করে দেয় এই রক্তস্নাত বাংলায়। এমনকি আশি সনে এসে ভিক্টোরিয়া পার্কে দাঁড়িয়ে সভা-সমাবেশ করে মহাসমারোহে! অনুতপ্ততা প্রকাশ করে যুদ্ধের সময় নিহত দুটি প্রাণীর জন্য প্রথমটি তার প্রিয় পুত্রের কুকুর ভুলু আর দ্বিতীয়টি তার সহচর রাজাকার আবদুল গণির। এই গণিকেই একাত্তর সনের ডিসেম্বরের একুশ তারিখ মুক্তিযোদ্ধারা ধরে ফেলেছিল এবং এই ‘কোণঠাসা শৃগাল’ কে ভিক্টোরিয়া পার্কের চত্বরে এক পাকা বেঞ্চের সাথে উপুড় করে শুইয়ে তার দুই উরুসন্ধির ভেতর দিয়ে এলএসআর এর নল প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়। এই নরপশু তখন ভিটকোলার স্ট্র চুষতে চুষতে তিনটি তালিকার একুশ জন নিখোঁজ ব্যক্তিকে মৃত বলে শনাক্ত করে। তার কথামতো খ্রিস্টানদের কবরস্থানের পাশ খুঁড়ে পাওয়া গিয়েছিল ছাপান্নটি মাথার খুলি! সেই শোকার্ত ক্রোধে জ্বলে উঠা মানুষগুলো ধাবিত হয়েছিল ভিক্টোরিয়া পার্কের দিকে এক অদম্য ঘৃণা এবং প্রতিশোধ স্পৃহা নিয়ে। কিন্তু সেখানে পৌঁছার আগেই নরপশুটার মাথা আর ধড় আলাদা হয়ে গিয়েছিল। এই ঘৃণ্য নরপশুটির অন্তিম পরিণতিও যথার্থ হয়েছিল। খাজা আহমেদ আলী আর তার ছেলের কবরের পাশ থেকে কুকুরের হাড়গুলো সন্তর্পণে তুলে গণি রাজাকারের দ্বি-খন্ডিত দেহের সাথে চটের ব্যাগে পুরে বুড়িগঙ্গা নদীর মাঝখানে ফেলে দেয়া হয়। এই দুই পশুকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার অন্তিম অভিপ্রায় বলা যায়।

একাত্তরে যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছিল বা মানুষে-মানুষে যে মানবিক ভালোবাসা ছিল তার কিছু সূক্ষ্ম ইঙ্গিতও পাওয়া যায় এই উপন্যাসে। পাশের বাড়ির মায়ারাণীর মা প্রতি শনিবার সন্ধ্যেয় শনিপুজো করতেন আর আবদুল মজিদ দুই বাড়ির মধ্যেকার দেয়ালের ওপর চড়ে বসে তার শনিপুজো দেখতেন। ‘পুজো হয়ে গেলে, মায়ারাণী হাতে করে একটি বড় বাটি নিয়ে আসত এবং প্রাঙ্গনে অপেক্ষমান বালক-বালিকা ও দেয়ালের ওপর বসে থাকা আবদুল মজিদের প্রসারিত করতলের ওপর কলা ও দুধ মাখানো ভিজে চিড়ার একটি মণ্ড অর্পণ করত’। এই সেই মায়ারাণী যার জন্য যুদ্ধে যাবার আগে মোট একুশটি চিঠি লিখেছিল মোহাম্মদ সেলিম যে চিঠিগুলো বহন করত আবদুল মজিদ হাত ভরা লাড্ডু-বিস্কুটের বিনিময়ে। তার এখনো মাঝে মাঝে মনে হয় হাত পাতলেই ঠিক সেরকমভাবেই প্রসাদ তুলে দেবে ‘কালো এবং বোকাটে মায়ারাণী’!

কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার কলকাঠি নাড়ার মানুষও কম ছিল না। বদু মওলানা সেই তথাকথিত ধার্মিকদের প্রতিনিধিত্ব করে যারা কথায় কথায় ধর্মের বুলি আওড়াতে থাকেন, ধর্মকে আত্মরক্ষার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন কিন্ত নিজে সেই নীতির ধারও ধারেন না। হাফপ্যান্টের একপাশ গুটিয়ে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করায় আলাউদ্দিনের উপর তিনি ক্ষেপে গিয়েছিল এবং বলেছিল – ‘হারামযাদা, খাঁড়ায়া খাঁড়ায়া মোতচ, খাঁড়ায়া মোতে কুত্তা’। কিন্তু মিলিটারি ক্যাপ্টেন ইমরান যখন দেয়ালের কিনারায় দাঁড়িয়ে দু’পা ফাঁক করে খুব আয়েশে ‘তরলবিদ্যুৎ রেখার মতো একটি সাদা ধারা’ মাটিতে ত্যাগ করছিল তখন তার মুখ দিয়ে একটি কথাও বের হয়নি। ‘হাত দুটো নাভির নিচে বেঁধে বিনীত এবং কোমল ভঙ্গিতে’ তাকিয়ে ছিল যেন কোন এক অসাধারণ দৃশ্য জীবনে প্রথমবার দেখছে! তার ধর্মীয় মূল্যবোধ তখন হাওয়া হয়ে গিয়েছিল। হাস্যকর এবং ন্যক্কারজনক ঘটনা হচ্ছে সেই ক্যাপ্টেনের প্রস্রাবমিশ্রিত হাতখানা যে আলখাল্লা এবং জোব্বাতে মুছেছিল সেই আলখাল্লা এবং জোব্বা সে সংরক্ষণ করেছিল স্মৃতিস্বরূপ। অশুদ্ধতার গ্লানির বদলে তার মুখে সেদিন খেলে গিয়েছিল বিস্তৃত হাসি! শুদ্ধতা আর পবিত্রতার বুলি আওড়ানো বদু মওলানার ধর্মের কল তখন কিন্তু একটুও নড়ে উঠে নাই! সদ্য কৈশোরে পা দেয়া আলাউদ্দিনও কিন্তু গর্জে উঠেছিল মওলানার কথায়, মুখ ভেঙচিয়ে বলেছিল ‘কুত্তা তো মুখ দিয়া খায়, আপনে অখনথন হোগা দিয়া খায়েন’। কিন্তু তার পরিণাম সুখকর হয়নি, মিলিটারির গুলি খেয়ে চিৎ হয়ে আছড়ে পড়েছিল তাদের বাড়ির সামনের রাস্তায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মিলিটারি এবং তাদের দোসররা হিন্দু-মুসলিম, প্রাপ্তবয়স্ক-অপ্রাপ্তবয়স্ক, নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে পরোয়া না করে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। সেটার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত পাওয়া যায় এই বাক্যটিতে – ‘বস্তুত একাত্তর সনে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পর মহল্লায় প্রথম যে ব্যক্তি নিহত হয়, সে ছিল একজন মুসলমান ও অপ্রাপ্তবয়স্ক’। বদু মওলানা এক এক করে তার বিরুদ্ধে এসে দাঁড়ানো মানুষগুলোকে নির্মম পরিণতি দিয়েছেন। মালিটোলার ইসমাইল হাজামের কথায় ধরুন। বদু মওলানার মিথ্যা খাতনা নাটকের পর ইসমাইল হাজাম যখন জানতে পারে যে, সে ঐ নাটকের একজন বাধ্য অভিনেতা মাত্র তখন সে ক্ষোভে উচ্চারণ করে উঠেছিল ‘হালার হিজড়ার আবার মুছলমানি!’। এই বাক্যটি একমাত্র আবদুল গণিই শুনেছিল এবং তার মাধ্যমে বদু মওলানার কান পর্যন্ত পৌঁছে। এই উদ্ধতপূর্ণ বাক্য উচ্চারণের শাস্তিস্বরুপ তাকে জবাই করে হত্যা করা হয়।

এই নৃশংসতা আর দুঃস্বপ্নের স্মৃতিগুলো আবদুল মজিদের অন্তরে সুপ্ত ছিল এতদিন কিন্তু রায়সা বাজারে যাওয়ার পথে যখন বদু মওলানার ছেলের ধন্যবাদজ্ঞাপন শুনল তখন সেই পুরনো ক্ষতগুলো সব জেগে উঠে। পরাজয় আর বিশ্বাসঘাতকতার এক অস্বস্তিকর মিশ্র অনুভূতি তাকে গ্রাস করতে শুরু করে। সে অনুভব করতে শুরু করে, সে কৈশোর থেকে যৌবনে পা দিয়েছে অনেক আগেই কিন্তু সেই ভীরুতা আর কাপুরুষতা এখনো তাকে গিলে গিলে খাচ্ছে। যে কাপুরুষতা প্রথম সে অনুভব করেছিল ঘৃণা আর প্রতিহিংসার আড়ালে, যখন বদু মওলানা, সিলভারডেল স্কুলের এক অনুষ্ঠানে গান গেয়ে ফেরার পথে তার বোন মোমেনাকে ‘মাগি, ডিম পারবার যাও!’ বলে গালাগাল দিয়েছিল। রায়সা বাজারের ঘটনায় হঠাৎ করে তার বিশ্বাস আর মূল্যবোধের ভীতটা নড়ে উঠে। তার মস্তিষ্কে তখন সেই বীভৎস দৃশ্যটা ফুটে উঠে যখন চারদিন উন্মাদের মত তন্ন তন্ন করে খুঁজে ‘রায়েরবাজারের পশ্চিমপ্রান্তে, বুড়িগঙ্গা নদীর কিনারায়, বালুচরের মতো দেখতে এক মাঠের ওপর’ মোমেনাকে আবিষ্কার করে। সে যখন মোমেনাকে দেখে তখন ‘তার একটি স্তন কেটে ফেলা, পেট থেকে উরু পর্যন্ত ক্ষতবিক্ষত, ডান উরু কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত চিরে তরমুজের মতো হাঁ করে রাখা; সে চিৎ হয়ে শুয়ে ছিল, তার পিছমোড়া করে বাঁধা হাত দুটো দেহের নিচে চাপা পড়েছিল, মুখটা ছিল আকাশের দিকে উত্থিত’। তার বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠেছিল এবং বিকারগ্রস্তের মতো ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ ধ্বনি উচ্চারণ করছিল। আজ চৌদ্দ বছর পর স্বজন হারানোর ব্যথা, পরাজয়ের গ্লানি, ভুলুন্ঠিত মানবতা, বিশ্বাসঘাতকতা সবকিছু আবার চেপে ধরে তাকে। সে জ্বরগ্রস্তের মতো তার স্ত্রী ইয়াসমিনের গলা জড়িয়ে ‘আপা, আপা’ বলে ফোঁপায়। আজিজ পাঠানকে তার পরদিন যখন অবগত করেছিল যে ‘বদু মওলানারা এখন তাদেরকে ‘ভাইসব’ বলে ডাকে এবং হরতাল করার জন্য ধন্যবাদ দেয়’ তখন আজিজ পাঠান তার ‘কাঁধের ওপর প্রাচীন বৃক্ষ শাখার মতো তার শিরা-ওঠা হাত রেখে’ অনেক কথা শুনিয়েছিল যার কোনটাই তার সরল মস্তিষ্কে ঢুকেনি শুধুমাত্র একটা নির্মম সত্য ছাড়া – ‘রাজনীতিতে চিরদিনের বন্ধু অথবা চিরদিনের শত্রু বলে কিছু তো নেই, কাজেই অতীত ভুলে যাওয়া ছাড়া কিইবা করার থাকে মানুষের’। কিন্তু আবদুল মজিদরা এই ভয়ংকর অতীতকে কখনোই ভুলতে পারে না বা এই ভয়ংকর অতীত তাদের পিছু ছাড়ে না! তারা অন্তরে অন্তরে পুড়তে থাকে কিন্তু সেই হৃদয়পোড়া গন্ধকে আজিজ পাঠানরা পাত্তাও দেয় না। মানবতার উর্দ্ধে উঠে যায় রাজনৈতিক বাস্তবতা তাই বদু মওলানাদের মত ঘৃণ্য নরপশুরাও সাহস পায় ভিক্টোরিয়া পার্কে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেবার! আজিজ পাঠানরা যে চেতনাকে ধারণ করে লাফিয়ে পড়েছিল দেশমাতৃকাকে রক্ষার জন্য, সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি মুখ থুবড়ে পড়ে না যখন রাজাকার, আলবদর বদু মওলানারা সদর্পে ভাষণ দেয়? মুক্তিযুদ্ধের সেই বিশুদ্ধ চেতনা কি অশুদ্ধ হয়ে যায় না? সেই চেতনা কি প্রশ্নবিদ্ধ হয় না? তাই দুঃখজনক হলেও অপ্রিয় প্রশ্নটি হৃদয় চিঁড়ে বেরিয়ে আসে – ‘বদু মওলানা আর আজিজ পাঠানদের রাজনৈতিক চেতনা ভিন্ন হলেও রাজনৈতিক চরিত্র ও উদ্দেশ্য কি তাহলে এক?’। রাজনৈতিক বাস্তবতার কাছে বারবার পরাজিত হয় বিশুদ্ধ মানবতা আর নিষ্পাপ জীবন। তাই আবদুল মজিদরা পলায়নরত উইপোকার মত বাসস্থান পাল্টাতে বাধ্য হয় কাকেদের ভয়ে!

শুধুমাত্র আবদুল মজিদদের ভীরুতা আর কাপুরুষতাকে হাতিয়ার করে বদু মওলানারা গা ঝেড়ে উঠে! আবদুল মজিদরা প্রয়োজনবোধ করে সাহসী হয়ে উঠার, কিন্তু সাহসী হয়ে উঠা আর হয় না! সমষ্টিগত প্রতিরোধের কথা চিন্তা না করে ‘প্রথমে নিজেকে বাঁচাতে চায়’ আর সেই ফাঁকে বদু মওলানারা একাত্তরের সেই একই রাজনীতি চর্চা করে এবং একটু একটু করে পরিমাণে বাড়তে থাকে! আবদুল মজিদরা নিজেকে বাঁচাতে ভীতসন্ত্রস্ত উইপোকার মতো পালাতে থাকে কিন্তু তারা জানে না উইপোকার পিছু নেওয়া কাকগুলোর মতো বদু মওলানাদের অশুভ আত্মা সবখানেই ছড়িয়ে আছে! এই নির্মম বাস্তবতাটুকু আবদুল মজিদদের সরল মস্তিষ্ক বুঝতে পারে না!! তারা বুঝতে পারে না যে এই বদু মওলানাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না যতক্ষণ না আত্মিক জাগরণের মাধ্যমে সমষ্টিগত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। সেই একাত্তর সনে যেমন জিঞ্জিরা পর্যন্ত পালিয়ে আবার লক্ষ্মীবাজারে ফিরে এসেছিল তেমনি বারবার এসে পড়তে হবে বদু মওলানাদের সৃষ্ট সেই প্রতিহিংসা, ঘৃণা, নৃশংসতা আর বিভাজনের রাজনৈতিক বাস্তবতার বৃত্তে!