লেখক: সাইফুল ইসলাম

১) ২০১৪ এর নভেম্বর, ধর্ম প্রচারক জুনাইদ জামশেদকে মহানবী এবং তার স্ত্রীকে নিয়ে কটুক্তির অভিযোগে ব্লাসফেমী আইনের অধীনে দোষী সাব্যস্ত করা হয় । এককালের পাকিস্তানের বিখ্যাত গায়ক, ফ্যাশন ডিজাইনার এবং পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার জুনায়েদ জামশেদ ২০০৪ সালে তার পেশা, নেশা দুইটাই ছেড়ে ধর্ম প্রচারে মনোনিবেশ করেন । ২০১৪ তে ব্লাসফেমীর অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার পর তিনি তার অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থণা করেন । কিন্তু এই অপরাধ যে ক্ষমার অযোগ্য (সূত্রঃ ১) । ৭ ডিসেম্বর, ২০১৬ তে এক তাবলীগ জামাত থেকে পাকিস্তান বিমানে করে লাহোর ফেরার পথে বিমান বিধ্বস্ত হয় এবং এতে তিনি এবং তার স্ত্রী মারা যান (সূত্রঃ ২)। যদিও অপ্রমাণিত, তবে অনেকে এই ঘটনায় দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নেয়।

২) ২০১৫ তে আফগানিস্তানে কুরআন পোড়ানোর অভিযোগে পিটিয়ে এবং পুড়িয়ে মারা হয় ফারখুন্দা মালিকজাদাকে, যে নিজেই ছিল ইসলামিক ইতিহাসের ছাত্রী(সূত্রঃ ৩) । পরবর্তীতে প্রমাণিত হয় যে, সে কোরআন পোড়ায়নি, বরং তার প্রতিবেশীর সাথে বাদানুবাদের পর সেই প্রতিবেশী তার নামে এই অভিযোগ ছড়িয়ে দেয় । তবে উন্মত্ত জনতার সেসব দেখার সময় আছে কি?

৩) ২০১৪ এর মে’তে রশিদ রেহমান নামে এক আইনজীবীকে তার অফিসেই গুলি করে হত্যা করা হয় একজন ধর্মাবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে লড়ার কারণে (সূত্রঃ ৪)। হত্যার মাসখানেক আগে আদালতেই তাকে হুমকি দেয়া হয় যে, “আজকেই তোমার আদালতে শেষ হাজিরা । কারণ, মৃত মানুষ অফিস করে না!” । বিচারক এবং পুলিশের সামনেই একজন আইনজীবীকে হত্যার হুমকি দেয়া সেই ব্যক্তির কি হয়েছিল জানেন? কিছুই না ! এমনকি কোন জবানবন্ধীও না । এরপর থেকে ব্লাসফেমীর অভিযোগে অভিযুক্ত কারও পক্ষে আইনজীবী পাওয়াটাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে । সেই বছরেরই নভেম্বরে এক খৃষ্টান দম্পতিকে পুলিশের উপস্থিতিতেই মেরে, অতঃপর ইটভাটায় পুড়িয়ে হত্যা করা হয় । অভিযোগ কোরআন পোড়ানো । যদিও অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো এই অভিযোগেরও কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি (সূত্রঃ ৪)।

৪) আরেকটু পেছনে যাওয়া যাক । আসিয়া বিবি (আসল নামঃ আসিয়া নুরেন) নামে এক খৃষ্টান মহিলাকে কুরআন অবমাননার দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে, সন ২০১০ । যদিও অভিযোগকারী কোন প্রমাণ দাখিল করতে পারেনি, কিন্তু এই আইন অজামিনযোগ্য হওয়ায় সে কোন জামিন পায়নি । বরং কোন উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়াই তাকে ফাঁসির দন্ডে দন্ডিত করা হয় যেটা জুলাই ২২, ২০১৫ তে স্থগিত করা হয় এবং সে এখনো জেলে (সূত্রঃ ৫) । তার পক্ষে এবং ব্লাসফেমী আইনের বিরুদ্ধে কথা বলার অপরাধে ২০১১ এর জানুয়ারিতে হত্যা করা হয় পাঞ্জাবের গভর্নর সালমান তাসিরকে, হত্যাকারী তারই বডিগার্ড । সেই বছরেরই মার্চে হত্যা করা হয় পাকিস্তান পার্লামেন্ট এর মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টিকে (সূত্রঃ ৬) । কারণ? না, সে কোন ধর্মাবমাননা করেনি, কিন্তু ব্লাসফেমী আইনের সমালোচনা করেছিল।

৫) যে ব্লাসফেমী আইন নিয়ে এতো এতো আলোচনা, সেটা কিভাবে এলো? এটার গোঁড়া কিন্তু আজ থেকে ২০-৩০ বছর না না, প্রোথিত আছে প্রায় দেড়শো বছর আগের ১৮৬০ এর ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক করা “ধর্মানুভূতি সংরক্ষণ আইন” এ । তবে তখন সেটা প্রযোজ্য ছিল সকল ধর্মের মানুষের জন্য, এবং সেটার শাস্তিও ছিল সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদন্ড । ১৯২৭ সালে এক হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার প্রেক্ষিতে সাজার মেয়াদ বৃদ্ধি করে করা হয় ১০ বছর, তবে তখনো সেটা সকল স্তরের মানুষের জন্যই প্রযোজ্য ছিল । ১৯৫৩ সালে জামাতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মওদুদী আহমেদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণা করে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে এবং অমুসলিম কেউ যেন রাষ্ট্রপ্রধান না হতে পারে সেই দাবী তোলে । ১৯৮২ সালে জেনারের জিয়ার আমলে মওদুদীর এই দাবীই প্রাধান্য পায় যাতে মুসলমানদের ধর্মানুভূতিকেই প্রাধান্য দেয়া হয়, ধর্মাবমাননার শাস্তি হিসাবে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের বিধান দেয়া হয় এবং অমুসলিম কারও রাষ্ট্রপ্রধান না হওয়ার জন্য আইন পাস করা হয় । কিন্তু তাতেও মৌলবাদীরা শান্ত হয়নি, ১৯৮৬ সালে এই আইন আবারো সংশোধন করা হয় এবং মহানবীকে নিয়ে কটুক্তি করাকেও ধর্মাবমাননা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় । মৌলবাদীরা খুশি মনে বাড়ি ফিরে গেছে ভাবছেন? না ভুল, তারা এবার আরও বড় দাবী তুললো যে, যাবজ্জীবন কারাদন্ডের বিধান রহিত করতে হবে এবং মৃত্যুদণ্ডকেই একমাত্র শাস্তি হিসাবে আইন করতে হবে । যে বাঁদর ইতমধ্যেই মাথায় উঠে গেছে, তাকে কি আর নামানো সম্ভব? ফলাফল ১৯৯১ সালে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করে এই আইনের আরও একবার সংশোধন । শুধুমাত্র মুসলিমদের অনুভূতিকে প্রাধান্য দেয়ার কারণে কার্যতভাবেই অমুসলিমরা হয়ে পড়লো দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, যাদেরকে ইচ্ছা হলেই দমন করা যায়, ভয় দেখানো যায়, প্রয়োজনে বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদও করা যায় এবং রাস্ট্রীয় ব্যাপারে যাদের কোন মতামত থাকে না । এটি কার্যকর হয়তে খুব বেশী সময় নেয়নি । ১৯৮৪ সালের আগে যেখানে এই আইনে মামলা ছিল মোটে ১৪ টি, সেখানে ১৯৮৪ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যেই মামলার সংখ্যা ৫০০০ (সূত্রঃ ৭) । এসব মামলায় ২০০৮ সাল পর্যন্ত শাস্তি প্রাপ্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৯৬৪ (২০১৩ পর্যন্ত এই সংখ্যা ১২৭৪), যার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশী আহমেদিয়া এবং অমুসলিম সম্প্রদায়ের লোক । এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে, পাকিস্তানে আহমেদিয়া এবং অমুসলিম জনসংখ্যা মাত্র ৩.৭ ভাগ । অর্থাৎ, চার ভাগেরও কম জনসংখ্যার বিপরীতে মামলার সংখ্যা ৫০ ভাগেরও বেশি । মামলার কোন রায় না হলেও যে অভিযুক্ত ব্যক্তি রক্ষা পেয়ে যায় তা না । বরং একবার কোন ব্যক্তি অভিযুক্ত হলে তাকে সামাজিকভাবে সেই অভিযোগের জন্য হেয় হতে হয় আজীবন এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মূল্য দিতে হয় জীবন দিয়ে । অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া পাওয়ার পরেও এখন পর্যন্ত এইরকম হত্যার ঘটনা ঘটেছে ৪৬ টি (সূত্রঃ ৮) ।

৬) এবার বাংলাদেশে আসা যাক । কেনো এতোগুলো ঘটনা উল্লেখ করলাম? প্রত্যেকটা ঘটনা মিলিয়ে নিন এবার । নাস্তিক হওয়ার কারণে হত্যা, ধর্মাবমাননার অভিযোগে হত্যা, ধর্মাবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে কাজ করার কারণে হত্যা, ধর্মাবমাননার মিথ্যা অভিযোগে হামলা-হত্যা, অমুসলিমদেরকে যেনতেনভাবে ধর্মাবমাননার অভিযোগে ফাঁসিয়ে দেয়া, আহমেদিয়াদেরকে সামাজিকভাবে একঘরে করা, মুসলিম কিন্তু ভিন্ন মতবাদের হওয়ার কারণে হত্যা, প্রকাশ্য জনসভায় “নাস্তিকদের কতল করা ওয়াজিব হয়ে গেছে” ঘোষণা দেয়ার পরেও কোন শাস্তির বদলে উল্টা সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা, হামলার উস্কানী দিয়ে বিক্ষোভ করা, ওয়াজ, বক্তৃতা দেয়ার পরেও তাদেরকে কোন বিচারের আওতায় নিয়ে না আসা, উল্টা ধর্মাবমাননার আইনকেই আরও শক্ত করা ! কিছু বাকি আছে কি আমাদের দেশটাকে বাংলাস্তান বানানোর? শুধু বোমাবাজিতেই কি বাংলাস্তান হয়? বোমাবাজিটা বাংলাস্তানের একটা রূপ এবং সেটা যে আসছে খুব শিগ্রীই, এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ আছে?

৭) ২০১৫ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারী, এই রকমই সময়, সন্ধ্যা সাত টা কি সাড়ে সাতটা ! বাইরে থেকে এসে সবে হাতমুখ ধুচ্ছিলাম । মা ডাক দিয়ে বললেন, “শুনছস? অভিজিৎ রয়কে তো মেরে ফেলছে !” আম্মু অভিজিৎ রয়কে হয়তো চিনেন না, কিন্তু আমার বইয়ের শেলফে অভিজিৎ দার কয়েকটা বই থাকায় সম্ভবত নামটা চোখে পড়েছিল । প্রথমে ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি । টেলিভিশনের সামনে গেলাম । টিভি স্ক্রল দেখলাম, তার উপর হামলার রিপোর্টও চোখে পড়লো, আর কিছু সহ্য করতে পারিনি, নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলাম । কেঁদেছিলাম কি? হয়তোবা ! পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম প্রতিবাদ সভায় । গল্প বা আড্ডাবাজ ছিলাম না কখনোই, এক পাশে গিয়ে বসে ছিলাম । বক্তারা একের পর এক বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছে । কিছু কথা কানে যাচ্ছে, বেশিরভাগ যাচ্ছে মাথার উপর দিয়ে । কারণ, আগের আগের কয়েক বছর ধরে চলমান ঘটনাপ্রবাহে মাথায় একটা শঙ্কাই ঘুরছিল যে, বক্তাদের কথাগুলা জাস্ট ফাঁপা বুলি, সামনে অন্ধকার সময় আসছে, ভীষন অন্ধকার ! অভিজিৎ দা’কে হত্যার দুই বছর পরে এসে সেই শঙ্কাটা ভুল প্রমাণিত হয়নি । বরং ডাল পালা গজিয়ে আরও মহীরূহ হয়ে উঠেছে ।

মন খারাপ করিয়ে দিলাম, তাই না? আসেন একটা গান শুনি ।

গানটাও ভালোমতো শুনতে দিলো না । মন্তব্যের ঘরে একজন লিখেছে, “ শুনে এতোটাই খারাপ লাগছে যে, মনে হচ্ছে যেন সে এই সভ্যতার কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইছে !”
আমরাও কি একই অনুভূতির ভেতর দিয়েই যাচ্ছি না? নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে থাকার যন্ত্রনা যে কতোটা কষ্টকর, এটা কি বাইরের কারও পক্ষে অনুভব করা সম্ভব?  

তথ্যসূত্রঃ
১) https://en.dailypakistan.com.pk/pakistan/junaid-jamshed-and-family-among-passengers-on-board-the-pia-plane-that-crashed-near-havelian/
২) https://www.dawn.com/news/1149558
৩) http://bit.ly/afgan-farkhunda
৪) https://www.amnesty.org/en/latest/news/2016/12/pakistan-how-the-blasphemy-laws-enable-abuse/
৫) http://bit.ly/pakblasphemylaws
৬) https://www.dawn.com/news/750512
৭) http://www.pakistanblasphemylaw.com/?page_id=15
৮) http://crss.pk/downloads/Reports/Special-Posts/Blasphemy%20Law%20Extra%20Judicial%20Killings.pdf