লিখেছেন: ফাহিম আহমেদ

অভিজিৎ, রাজন, খাদিজা, রিশাসহ নানান সহিংসতার ঘটনা সাম্প্রতিক অতীতে আমাদের দেশে ঘটে গেছে। কিন্তু এ ঘটনাগুলোর একটি সাধারণ বৈশিষ্ট হলো এগুলোর জনসম্মুখে সংঘটন ও সাধারন মানুষের নির্লিপ্ত দাঁড়িয়ে থাকা। অভিজিত হত্যাকাণ্ডের সময় আশেপাশের মানুষ দাড়িয়ে ছিল অথর্বের মতো। তার স্ত্রী বন্যা আহমেদের হাহাকারের চিত্রও অনেকে মোবাইলের ক্যামেরায় ধারণ করেছেন। ঘটনাটি প্রতিরোধ করা তো দূরের কথা, ঘটনাটি ঘটার পর অভিজিৎ ও বন্যাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে যেতেও তারা বিলম্ব করে। অবহেলার সবচেয়ে খারাপ অজুহাত এসেছে পুলিশের কাছ থেকে। তাদের এ হত্যাকাণ্ডটি প্রতিরোধ না করার যুক্তি ছিল এটিকে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষ মনে করা। অর্থাৎ, ছাত্রলীগের দু গ্রুপের সংঘর্ষ স্বাধীন বাংলাদেশে এখন অলিখিত বৈধতার পর্যায়ে।

রাজন ও খাদিজার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ ভিডিও ধারণ করেছে, পাশ দিয়ে হেটে চলে গেছে, কেউ কেউ দাঁড়িয়ে থেকে তা উপভোগ করেছে; কিন্তু ঘটনাটি প্রতিহত করার সাহস সঞ্চার করতে পারেনি। রিশার ক্ষেত্রে ভিডিও ধারণ করা না হলেও ঘটনাটি প্রতিহত করতে এগিয়ে আসেনি। অভিযোগ উঠেছিল স্কুলের প্রিন্সিপালের ওপর যিনি স্কুলের গাড়ি দিয়ে রিশাকে হাসপাতালে পাঠাতে বিলম্ব করেছেন। সব মিলিয়ে এ ঘটনাগুলোর মাঝে সাধারণ মানুষের অবহেলা খুবই উহ্যভাবে লক্ষণীয়। মানুষ হিসেবে আরেকজন মানুষের প্রতি নূন্যতম দায়বদ্ধতা এ মানুষগুলো উপলব্ধি করেনি। তবে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যে মানুষগুলো ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে থেকে এ সহিংস ঘটনাগুলো উপভোগ করেন কিংবা নির্লিপ্ত থাকেন তারাই পরের দিন প্ল্যাকার্ড হাতে বেরিয়ে পরেন বিচারের দাবিতে। স্ববিরোধীতা আর কাকে বলে!

পাশের বাড়িতে স্বামী-স্ত্রীর কলহের মাঝে একজন সাধারণ শিক্ষিত প্রতিবেশী নাক না গলানোর সিদ্ধান্ত নেন এই ভেবে যে এটি
তো তাদের “ব্যক্তিগত” ব্যাপার। চার্লস ডিকেন্স হয়তো এ বাস্তবতা উপলব্ধি করেই বলেছিলেন, “Charity begins at
home, and justice begins next door.”; কিন্তু ব্যক্তিগত ব্যাপারের মোড়কে আমরা নিজেদের এভাবে আবদ্ধ করে
ক্রমেই নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছি। তবে এ অবহেলা শুধু আমাদের দেশের সমস্যা নয়। সমগ্র বিশ্বের মানুষের মাঝে
আজ এ অবহেলা প্রকট আকার ধারণ করেছে। সুদানে দুর্ভিক্ষের সময়ের একটি ছবি তুলে ১৯৯৪ সালে পুলিত্‍জার পুরস্কার
পেয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ফটোসাংবাদিক কেভিন কার্টার। ছবিটি ছিল এরকম- একটি ক্ষুধার্ত অপুষ্ট শিশু হামাগুড়ি দিচ্ছে
আর তার পিছনে পিছনে একটি শকুন পায়ে পায়ে অগ্রসর হচ্ছে কখন শিশুটি মারা যাবে এবং শকুনটি তার মৃতদেহটি খাবে।

কিন্তু শিশুটিকে উদ্ধার না করে প্রথমে সেই ছবিটি তোলার জন্য কেভিন কার্টারকে যেভাবে সমালোচিত হতে হয়েছিল অনেকের
মতে সেই অপরাধবোধের কারণেই তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন।

নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার The Idea of Justice বইয়ের ১৭নং অধ্যায়ে বলেন, “মানুষের বিভিন্ন ধরণের Obligation থাকে। এর একটি হলে Perfect Obligation আর অন্যটি Imperfect Obligation। একটি অন্যায় ঘটনার সংঘটনের সময় তা প্রতিহত করতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক দায়িত্ব পালন করা হলো Perfect Obligation । অন্যদিকে Imperfect Obligation হলো ঘটনাস্থলের আশেপাশের মানুষের সেই অন্যায়টি প্রতিরোধ করা।
তারা যদি এ Imperfect Obligation টি পালন করতে অপারগতা প্রকাশ করে তাহলে মানুষ হিসেবে তাদের যে দাবি, অহংকার কিংবা গর্ববোধ তা মূল্যহীন হয়ে পড়বে।” পৃথিবীতে আধুনিক যুগের সূত্রপাত হয়েছিলো অন্যায়, অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে মানুষের সংগঠিত হওয়া ও তা প্রতিহত করার মধ্য দিয়ে। কিন্তু আধুনিকতার এ পর্যায়ে এসে আমরা অনেক বেশি ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছি। আজ অভিজিৎ, কাল রাজন, পরশু খাদিজা, তার পরের দিন রিশারা সহিংসতার শিকার হবে আর আমরা ততোদিন তাদের রক্ষার জন্য এগিয়ে যাব না যতদিন না আমাদের কিংবা আমাদের কোন স্বজনের নাম এই তালিকায় যুক্ত হবে।

আধুনিকতার এ যুগে শুধুমাত্র প্রযুক্তি উপভোগ কিংবা দৈনন্দিন জ্ঞান আহরণ আমাদের একমাত্র ব্রত হতে পারে না। সত্যের
পথে অবিচল অগ্রসর হওয়া ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে বলিষ্ঠ কন্ঠস্বরের মাধ্যমে আধুনিক যুগের সূচনা হয়েছিল সেই পথেই আমাদের ধাবিত হতে হবে। আর একারণেই বিপদে আমাদের প্রার্থনা হওয়া উচিত বিপদকে মোকাবেলা করার সামর্থ্য, বিপদ
থেকে রক্ষা নয়।