অফিস থেকে দুঘণ্টা আগে ছাড়া পেয়েই ছুট। ঠিক দুবছর পর একুশের বইমেলায়। বলবেন, কেন? সে এক মেলা উত্তর, না হয় এইবেলা থাক। আপাত কারণ একটাই, অভিজিৎ নাই!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেই মধুর কেন্টিনের কথা মনে পড়ে। অরুনের চায়ের কাপে চুমুক দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সেখানে বিস্তর ভীড়। ৯০ এর এরশাদ সামরিক জান্তা বিরোধী ছাত্র আন্দোলন সময়কাল আর নাই গো নাতি, মুঠো মুঠো ছাতি খাতি! এখন সব সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ভীড়। হাতে হাতে দামী ফোন। সারি সারি গাড়ি।

লাইব্রেরি মাঠ বরাবরই তেকোনা হেটে শর্টকাট মেরেছি। এই প্রথম পারি না। সেখানে সিরামিকের ডোবা ঘেষে সিড়ি বিস্তর। ঠোক্কর খেয়ে, একদা হাকিম চত্তরের পথ পেরিয়ে, কড়ই গাছ ছুয়ে মিলন চত্তর। সেখানে ভবঘুরেদের নিয়মিত নিশি যাপনের বালিশপত্র পাট করে রাখা, কাছেই বেঞ্চে পুলিশ, ২৫ টাকা দামের কফির কাপে যেন ঝড়।

অভিজিৎ রায় হত্যার ঘটনাস্থলে কোনো চিহ্ন নাই, না ব্যানার, না ফুল! পুরো মেলার কোথাও নাই অভিজিৎ। তার খুনের ঘটনাস্থলে মুক্তচিন্তা স্তম্ভ হবে, ঢাবি উপাচার্য সংবাদে এমনটাই বলেছিলেন। অবশ্য এর মানে এই নয় যে, অভিজিৎ হত্যার বিচার হবে। আর সেটি এখন তেমন কেউ আশা করে না। হেফাজতের বাংলায় মদিনা সনদই চলুক না হয়।

আরো এগিয়ে বর্ধমান হাউজের পুরনো অংশ। অদ্ভুত স্টলের বিন্যাসে চক্কর খেতে খেতে ছড়াকার, ব্লগার লুৎফর রহমান রিটন ভাইয়ের সংগে দেখা। হাত নেড়ে ডাকলেন।

কুশলের পর জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কোন বই বেরিয়েছে? বললাম, আমি তো সেরকম লেখক নই, প্রতি মেলায় বই থাকে না।

আরো এগিয়ে বহেরা তলায়। সেখান লিটল ম্যাগাজিন চত্তরটিকে এই প্রথম খুব অচেনা মনে হয়। কিম্ভুত সব স্টল, মানুষজন। ক্ষেপা কবিদের আড্ডা নেই। আদিবাসী ছোটকাগজ “হুচ” ও সাহিতপত্র “শুদ্ধস্বর” এর স্টল নেই।

ভাঙা মনে এগিয়ে দোতলায় নোংরা সিঁড়ি পেরিয়ে পর্যটন ফুডকোর্ট। বিশাল মেন্যু লিস্ট, খাবার আছে অল্পই।

ক্যান্টিনের সমস্ত টেবিল অসম্ভব নোংরা। মেঝেতে গড়াগড়ি দিচ্ছে কাগজের কফি কাপ, ডিশ, টিস্যু। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সেখানেই সজনেরা এটাসেটা খাচ্ছেন, উপায় কি!

পথ পেরিয়ে মূল মেলায়। তথ্যকেন্দ্র শুরুতেই। “শুদ্ধস্বর” প্রকাশনের স্টল কতো নম্বর? “জাগৃতি”?

জানা গেল “শুদ্ধস্বর” এবার স্টল দেয়নি। আহমেদুর রশীদ টুটুল -বন্ধু, প্রকাশক জংগিদের চাপাতির কোপ খেয়ে দেশ ছাড়ার পর এবারই স্টল দিতে পারেননি।

“জাগৃতি”র স্টল শুরুতেই। সেখানে জংগি হামলায় নিহত প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনের ছবির চোখের দিকে তাকাতে পারি না। কেমন যেন অপরাধ বোধ গ্রাস করে।

অভিজিৎ রায়ের বই আছে?

এমন প্রশ্নে সব বিক্রেতা এক সংগে আমার দিকে ফেরেন। নিজেরা মুখ চাওয়া-চাউয়ি করেন। প্রধান বিক্রেতা মাথা দিয়ে জানিয়ে দেন, নাই।

এলোমেলো স্টলের ভীড়ে রবীন আহসানের সাথে দেখা। “শ্রাবন” এর স্টল নিয়ে ব্যস্ত। তার স্টল বরাদ্দ পেতে এবার রীতিমত আন্দোলন করতে হয়েছে! রবীন নিশ্চিত করেন, এবার মেলায় অভিজিৎ নাই। মানে নাস্তিক ব্লগার নিধন হয়েছেন বাস্তবেই। পুরাই সহি, পুলিশী পুস্তক মেলা।

এরই মাঝে বন্ধু প্রকাশক দীপক কুমার রায়ের সাথে ফোনাফোনি। “সংহতি”র স্টল নম্বর ৫৯০-৫৯১। সুন্দরবন বাঁচাও আন্দোলনের ছাপ স্টল জুড়ে। সবুজ সাইনবোর্ড।

কি আপন ছেলেমেয়েগুলি! আমায় ডেকে ভেতরে নিয়ে বসান। সব পরিচিত মুখ, বুকের বন্ধুজন। ঝটিকা ক্যামেরাবাজি। আমার বই “পাহাড়ে বিপন্ন জনপদ” এর কয়েকটি কপি নিতে গিয়ে শুনলাম, এর সমস্ত কপি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে! শুনে ভালই লাগে, “সাংবাদিকের জবানবন্দিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের অকথিত অধ্যায়ের” পাঠকও আছে তাহলে!