১৯০০ সালের আগস্টে প্যারিসে পৌঁছেন জগদীশচন্দ্র ও অবলা বসু। বাংলা ও ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি প্যারিসে পদার্থবিজ্ঞান কংগ্রেসে যোগ দেন এবং জড়বস্তুর সংবেদনশীলতা বিষয়ে তাঁর পরীক্ষালব্ধ ফলাফল ব্যাখ্যা করেন। তিনি তাঁর “On the similarity of effect of electrical stimulus on inorganic and living substance” প্রবন্ধে ম্যাগনেটিক আয়রন অক্সাইডের ওপর বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ ফেললে সময়ের সঙ্গে তার পরিবাহিতার পরিবর্তনের গ্রাফ দেখিয়ে জীবদেহের মাংসপেশীর সাড়া দেয়ার গ্রাফের সাথে তার সাদৃশ্য ব্যাখ্যা করেন।

প্যারিসের এই সম্মেলন ছিল আন্তর্জাতিক পদার্থবিজ্ঞানীদের প্রথম কংগ্রেস। সারা পৃথিবীর বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে ভারতবর্ষ থেকে শুধুমাত্র জগদীশচন্দ্রই আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন।

কিন্তু প্যারিসে এসে প্রায় এক বছর দুই মাস পর জগদীশচন্দ্রের সাথে নিবেদিতার আবার দেখা হলো এক অদ্ভুত যোগাযোগের মাধ্যমে। প্যারিসে অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী ও সম্মেলনের সংগঠক প্যাট্রিক গ্যাডিস নিবেদিতাকে অনুরোধ করেছিলেন সম্মেলনের সেক্রেটারি হবার জন্য। সম্মেলনের ‘ধর্ম ইতিহাস’ শাখায় আমন্ত্রিত হয়েছেন স্বামী বিবেকানন্দ। নিবেদিতা তাতেও উৎসাহী হননি আমেরিকা থেকে প্যারিসে যেতে। তিনি ঠিক করে রেখেছিলেন স্বামীজি প্যারিসে চলে গেলে তিনি আমেরিকা থেকে সরাসরি কলকাতায় চলে যাবেন। কিন্তু যখন শুনলেন যে সম্মেলনের আরেকটি অংশ হলো ‘ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অব ফিজিসিস্ট’ এবং সেখানে জগদীশচন্দ্র বসুকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে- নিবেদিতা খুশি মনে রাজি হয়ে গেলেন সম্মেলনের সেক্রেটারি হতে।

প্যারিসের আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী চলছিলো এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এবং বিজ্ঞান ধর্ম শিল্প সাহিত্য দর্শন ইতিহাস সব বিষয়েরই প্রদর্শনী ও সম্মেলন চলছিলো বিভিন্ন সময়ে। ইতিহাস ও ধর্ম বিষয়ে বক্তৃতা দেয়ার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি বক্তৃতা দিতে পারেননি, তবে তাঁর উপস্থিতিই ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আমেরিকা থেকে নিবেদিতাকে সাথে নিয়ে প্যারিসে গিয়েছিলেন। জগদীশচন্দ্রের বক্তৃতায় উপস্থিত ছিলেন বিবেকানন্দ এবং জগদীশচন্দ্রের বক্তৃতা ও প্রশংসা শুনে ভীষণ আনন্দিত হন। জগদীশচন্দ্র ও অবলা বসুর সাথে দেখা করে অভিনন্দন জানান বিবেকানন্দ। জীব ও জড়ের সাড়ার অভিন্নতার মধ্যে তিনি সনাতন ধর্মের উপনিষদের মিল খুঁজে পেলেন। শুধু তাই নয়, একজন ভারতীয় বিজ্ঞানী ইওরোপের বিশ্বসভায় বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা দিয়েছেন এটাও তাঁকে খুব উদ্বেলিত করলো। এ প্রসঙ্গে তিনি তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন:

“আজ ২৩ শে অক্টোবর; কাল সন্ধ্যার সময় প্যারিস হতে বিদায়। এ বৎসর এ প্যারিস সভ্যজগতে এক কেন্দ্র, এ বৎসর মহাপ্রদর্শনী। নানা দিগদেশ-সমাগত অর্জুনসঙ্গম। দেশ-দেশান্তরের মনীষিগণ নিজ নিজ প্রতিভা প্রকাশে স্বদেশের মহিমা বিস্তার করছেন আজ এ প্যারিসে। এ মহাকেন্দ্রের ভেরীধ্বনি আজ যাঁর নাম উচ্চারণ করবে, সে নাদ-তরঙ্গ সঙ্গে সঙ্গে তাঁর স্বদেশকে সর্বজন সমক্ষে গৌরবান্বিত করবে। আর আমার জন্মভূমি- এ জার্মান ফরাসী ইংরেজ ইতালী প্রভৃতি বুধ-মন্ডলী-মন্ডিত মহা রাজধানীতে তুমি কোথায়, বাসভূমি? কে তোমার নাম নেয়? কে তোমার অস্তিত্ব ঘোষণা করে? সে বহু গৌরবর্ণ প্রতিভামন্ডলীর মধ্য হতে এক যুগ যশস্বী বীর বঙ্গভূমির আমাদের মাতৃভূমির নাম ঘোষণা করলেন, সে বীর জগৎপ্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক ডক্টর জে সি বোস। এক যুবা বাঙালী বৈজ্ঞানিক আজ বিদ্যুৎবেগে পাশ্চাত্য-মন্ডলীকে নিজের প্রতিভা মহিমায় মুগ্ধ করলেন- সে বিদ্যুৎসম্ভার মাতৃভূমির মৃতপ্রায় শরীরে নবজীবন-তরঙ্গ সঞ্চার করলে! সমগ্র বৈদ্যুতিকমন্ডলীর শীর্ষস্থানীয় আজ জগদীশ বসু- ভারতীয় বঙ্গবাসী, ধন্যবীর। বসুজ ও তাঁর সতী সাধ্বী সর্বগুণাসম্পন্না গেহিনী যে দেশে যান, সেথায়ই ভারতের মুখ উজ্জ্বল করেন, বাঙালীর গৌরব বর্ধন করেন! ধন্য দম্পতি।”

প্যারিসের সম্মেলনে বক্তৃতার পর সরবোঁ বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং প্যারিসের পদার্থবিজ্ঞান ও প্রাণিবিজ্ঞান সমিতিতেও বক্তৃতা দেন জগদীশচন্দ্র। তাঁর ‘জীব ও জড়ের সাড়া দেয়ার প্রকৃতি অভিন্ন’ এই মতবাদের পক্ষে-বিপক্ষে মতামত গড়ে উঠতে শুরু করে আন্তর্জাতিক মহলে। প্যারিস থেকে লন্ডনে এলেন জগদীশ ও অবলা। নিবেদিতা তখনও প্যারিসে বিবেকানন্দের সাথে। ২৪ অক্টোবর বিবেকানন্দ প্যারিস থেকে ভারতে চলে গেলে নিবেদিতা চলে আসেন লন্ডনে।

ফরাসী ও ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের মধ্যে জগদীশচন্দ্রের নতুন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে কী কী প্রতিক্রিয়া হলো সে বিষয়ে নিয়মিত চিঠি লেখালেখি চলছে জগদীশচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে।

৩১ আগস্ট ১৯০০, জগদীশচন্দ্র লিখলেন রবীন্দ্রনাথকে:

“একদিন congress-এর president আমাকে বলিবার জন্য অনুরোধ করিলেন। আমি কিছু কিছু বলিয়াছিলাম। তাহাতে অনেকে অতিশয় আশ্চর্য হইলেন। তারপর congress-এর secretary আমার সহিত দেখা করিতে আইসেন, এবং আমার কাজ লইয়া discussion করেন। এক ঘন্টা পর হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন – But, monsieur, this is very beautiful (but-এর অর্থ আমি প্রথমে বিশ্বাস করি নাই)। তারপর আরও তিন দিন এ-সম্বন্ধে আলোচনা হয়, প্রত্যহই more and more excited- শেষ দিন আর নিজেকে সম্বরণ করিতে পারিলেন না। Congress-এর অন্যান্য secretary এবং president-এর নিকট অনর্গল ফরাসী ভাষায় আমার কার্য সম্বন্ধে বলিতে লাগিলেন।
এই গেল প্যারিসের পালা। তাহার পর লন্ডনে আসিয়াছি। এখানে একজন physiologist আমার কার্যের জনরব শুনিয়াই বলিলেন যে, সে কখনও হইতে পারে না, there is nothing common between the living and non-living। আর একজন বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে ৪ ঘন্টা কথা হইয়াছিল। প্রথম ঘন্টায় ভয়ানক বাদানুবাদ, তারপর কথা না বলিয়া কেবল শুনিতেছিলেন, এবং ক্রমাগত বলিতেছিলেন, this is magic! this is magic! তারপর বলিলেন, এখন তাঁহার নিকট সমস্তই নুতন, সমস্তই আলোক। আরও বলিলেন, এইসব সময়ে accepted হইবে; এখন অনেক বাধা আছে। আমার theory পূর্ব সংস্কারের সম্পূর্ণ বিরোধী, সুতরাং কোন-কোন physicists, কোন কোন chemists এবং অধিকাংশ physiologists আমার মতের বিরুদ্ধে দন্ডায়মান হইবেন। কোন-কোন মহামান্য বৈজ্ঞানিকের theroy আমার মত গ্রাহ্য হইলে মিথ্যা হইবে; সুতরাং তাঁহারা বিশেষ প্রতিবাদ করিবেন। এবার সপ্তরথীর হস্তে অভিমন্যু বধ হইবে; আপনারা আমোদে দেখিবেন। কিন্তু আপনাদের প্রতিনিধি রণে পৃষ্ঠভঙ্গ দিবে না। সে মনশ্চক্ষুতে দেখিবে যে, তাহার উপর অনেক স্নেহদৃষ্টি আপতিত রহিয়াছে।”

উত্তরে শিলাইদহ থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯০০, রবীন্দ্রনাথ লিখলেন:

“যুদ্ধ ঘোষণা করে দিন। কাউকে রেয়াৎ করবেন না – যে হতভাগ্য surrender না করবে, লর্ড রবার্টসের মত নির্মম চিত্তে তাদের পুরাতন ঘর-দুয়ার তর্কানলে জ্বালিয়ে দেবেন। তারপরে আপনি জয় করে এলে আপনার সেই বিজয় গৌরব আমরা বাঙ্গালীরা ভাগ করে নেব।”

সেপ্টেম্বরে (১৯০০) ব্রাডফোর্ডে ব্রিটিশ আস্যোসিয়েশনে জগদীশচন্দ্র প্যারিসের মতো আরেকটি বক্তৃতা দেন। বৈদ্যুতিক তরঙ্গের গ্রাহক যন্ত্র কীভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে জগদীশচন্দ্র ও অলিভার লজের মধ্যে মতভেদ দেখা দিয়েছিল। অলিভার লজ কোহেরার যন্ত্রের আবিষ্কারক এবং প্যাটেন্টও পেয়েছেন। কোহেরারের ধাতুচূর্ণের মধ্যে বিদ্যুৎ-স্ফুলিঙ্গ ঘটালে রেজিস্ট্যান্স যে হঠাৎ কমে যায়, অলিভার লজ তার কারণ হিসেবে ধারণা করেছিলেন যে ধাতু-চূর্ণ গলে গিয়ে সেরকম হয়। কিন্তু জগদীশচন্দ্র ধারণা দিয়েছিলেন যে স্পর্শ-রোধ বা কনট্যান্ট রেজিস্ট্যান্সের কারণে এটা হয়। মানে হলো ধাতুচূর্ণগুলো খুব কাছাকাছি এলে বা স্পর্শ করে থাকলে বিদ্যুৎ প্রবাহ বেড়ে যায় এবং রোধ কমে যায়। কিন্তু যখন তাদের ঝাঁকানি দিয়ে আলাদা করে দেয়া হয়, তারা আলাদা হয়ে যায় এবং বিদ্যুৎ-প্রবাহ কমে যায়, রোধ বেড়ে যায়। যদি অলিভার লজের যুক্তিমতো ধাতু গলে যেতো, তাহলে ঝাঁকুনি দিলেও তারা আলাদা হতো না।

ব্র্যাডফোর্ড সম্মেলনে জগদীশচন্দ্রের বক্তৃতার পর প্রফেসর লজের ধারণা পাল্টে যায় এবং জগদীশচন্দ্রকে অভিনন্দন জানান তিনি। ১০ই সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশানের রিসেপশান রুমে বসে রবীন্দ্রনাথকে লিখলেন জগদীশচন্দ্র:

“আমার পূর্ব research সম্বন্ধে কোন বৈজ্ঞানিক পত্রে অতি প্রশংসাবাদ ছিল এবং সেই সঙ্গে Prof. Lodge-এর theory সম্বন্ধে অপ্রশংসা ছিল। ইহাতে Prof. Lodge অতিশয় মনঃক্ষুণ্ণ ছিলেন এবং আমার theroryর প্রতিবাদ করিবার জন্য বদ্ধপরিকর হইয়া আসিয়াছিলেন। আমার প্রবন্ধের মুখবন্ধেই দুই theory লইয়া বাদানুবাদ, আর আমার সম্মুখেই Lodge! সকলেই Lodge-এর মুখের দিকে তাকাইতেছিল, আমিও এক একবার দেখিতেছিলাম। জন বুলের মনের ভাব প্রকাশ পায় না। তবে যখন শেষ হইল, বহু প্রশংসাধ্বনি শুনিলাম। Lodge উঠিয়াও প্রশংসা করিলেন এবং বসু-জায়ার নিকট যাইয়া বলিলেন, “Let me heartily congratulate you on your husband’s splendid work.” আমাকে বলিলেন, “You have a very fine research in hand, go on with it.” হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিলেন, “Are you a man with plenty of means? All these are very expensive and you have many years before you, your work will give rise to many others – all very important.”

ক’দিন আগে অধ্যাপক ব্যারেটের কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়েছেন জগদীশচন্দ্র। ব্যারেট লিখেছেন:

“কাল রাতে আমাদের মধ্যে আলোচনা হলো। অধ্যাপক লজও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। আমরা ভেবে দেখলাম, ভারতবর্ষে আপনার সময়ের অনেক অপচয় হচ্ছে। আপনার কি স্থায়ীভাবে ইংল্যান্ডে থাকতে কোন আপত্তি আছে? উপযুক্ত অধ্যাপকের পদ কদাচিৎ শূন্য হয়, তার প্রার্থীও থাকে অসংখ্য। বর্তমানে একটি ভাল পদ শূন্য আছে। প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন অধ্যাপকের পদ। এই চাকরি আপনার জন্য সুনিশ্চিত, কেবল আপনার সম্মতির অপেক্ষা।”

ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটিতে পড়ানোর সুযোগ মানে গবেষণার ব্যাপক সুযোগ হাতে পাওয়া। কিন্তু স্বদেশের সাথে, প্রেসিডেন্সি কলেজের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে বিদেশের মাটিতে পড়ে থাকা জগদীশ বসুর পক্ষে সম্ভব হলো না। তিনি তাঁর দেশকে হয়তো তাঁর বিজ্ঞান গবেষণার চেয়েও বেশি ভালবাসতেন। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন:

“জড়বস্তুর সংবেদনশীলতার যে আভাস আমি পেয়েছি তাকে তথ্যের উপর স্থায়ী ভাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিজ্ঞানের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের অন্বেষণ দরকার। ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানী-মহলের ধারণা ছিল, বহু বছরের অনুসন্ধানে আমার কাছে এই নতুন সত্য ধরা পড়েছে। আমি নিঃসঙ্কোচে বলেছিলাম, বিদ্যুৎ-তরঙ্গের আঘাতে পদার্থের আণবিক পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করবার সময় কীভাবে মুহূর্তের মধ্যে আমি জড়দেহে প্রাণস্পন্দন লক্ষ্য করেছি। ক্ষণকালের উপলব্ধি থেকে আমার গবেষণাধারায় যে বিরাট সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তাকে রূপায়িত করবার পক্ষে ইংল্যান্ড প্রবাসই শ্রেয়। কিন্তু প্রেসিডেন্সি কলেজের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করা আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। ব্যারেটের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে হলো। অক্ষয় হয়ে রইলো তাঁদের স্মৃতি, যাঁদের অকৃত্রিম বন্ধুত্ব আমাকে কৃতার্থ করেছে।”

কিন্তু মনের দোলাচল সহজে যায় না। বন্ধু রবীন্দ্রনাথকে জানান নিজের মানসিক দ্বন্দ্বের কথা:

“এখন বলুন কী করি? একদিকে আমি যে কাজ আরম্ভ করিয়াছি – যাহার কেবল outskirts লইয়া এখন ব্যাপৃত আছি এবং যাহার পরিণাম অদ্ভুত মনে করি, সেই কাজ amateurish রকমে চলিবে না। তাহার জন্য অসীম পরিশ্রম ও বহু অনুকূল অবস্থার প্রয়োজন। অন্যদিকে আমার সমস্ত মনপ্রাণ দুঃখিনী মাতৃভূমির আকর্ষণ ছেদন করিতে পারে না। আমি কী করিব, কিছুই স্থির করিতে পারিতেছি না। আমার সমস্ত inspiration এর মূলে আমার স্বদেশীয় লোকের স্নেহ। সেই স্নেহবন্ধন ছিন্ন হইলে আমার আর কী রহিল?”

আরেকটি চিঠিতে লিখেছেন:

“আমাদের হৃদয়ের মূল ভারতবর্ষে। যদি সেখানে থাকিয়া কিছু করিতে পারি, তাহা হইলেই জীবন ধন্য হইবে। দেশে ফিরিয়া আসিলে যেসব বাধা পড়িবে তাহা বুঝিতে পারিতেছি না। যদি আমার অভীষ্ট অপূর্ণ থাকিয়া যায়, তাহাও সহ্য করিব।”

ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশানে জগদীশচন্দ্র জীব ও জড়ের সংবেদনশীলতার যে তথ্য দিয়েছেন তা পদার্থবিজ্ঞানীরা যতটা সহজে মেনে নিয়েছেন, জীববিজ্ঞানীরা তত সহজে মেনে নিতে চাইলেন না। সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণের জন্য তাঁরা জগদীশচন্দ্রের পরীক্ষাগুলো আবার করে দেখার পক্ষপাতি। জগদীশচন্দ্রকে নানারকম তর্ক ও বিতর্কে জড়িয়ে পড়তে হচ্ছে প্রতিদিন। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে লেখা এক চিঠিতে উল্লেখ করেছেন জগদীশচন্দ্র:

“Chemist and physicist-এর মধ্যে ঘোরতর সংগ্রাম, Physiologist-রাও সেইরূপ। সেদিন আমাদের physical section-এ chemist-দিগকে অতি সমাদরে অভ্যর্থনা করা হইয়াছিল। আমাদের president তাহাদিগের মন আকর্ষণ করিবার জন্য তাহাদিগের বিশেষ স্তুতিগান করিলেন। তাহার উত্তরে এক chemistপ্রবর উঠিয়া বলিলেন, আমাদের ঝগড়া করিবার ইচ্ছা নাই; কিন্তু আপনাদের J. J. Thompson সেদিন বলিয়াছেন যে, atom অবিভাজ্য নহে। যাহারা আমাদের atom-এর উপর হাত তোলে, তাহাদিগের সহিত আমাদের চিরসংগ্রাম।
… তারপর একজন Physiologist-এর সহিত দেখা হয়। তিনি আমার কার্যের বিশেষ প্রশংসা করিলেন এবং বলিলেন, ‘আশা করি আপনি অন্যান্য physicist-এর ন্যায় আমাদের সুবৃহৎ Physiology-কে Physics-এর শাখা বলিয়া উড়াইয়া দিতে চাহেন না। একটা formula দিয়া সব explain করা, একি চালাকি?’
… আমার দু’একজন Physicist বন্ধু বলেন যে, Psychology Science নহে, সুতরাং ও বিষয়টা বাদ দিবেন। অর্থাৎ মনে হয়ত সন্দেহ হইয়াছে যে, এ লোকটা Oriental, যদি ওদিকে একবার বেঁকে যায়, তাহা হইলে Physics ছাড়িয়া ওদিকে চলিয়া যাইবে।”

জীববিজ্ঞানীদের সাথে বিরোধের টেনশান এবং অধিক পরিশ্রমের কারণে হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন জগদীশচন্দ্র। অসুস্থ জগদীশকে নিয়ে কী করবেন, কোথায় চিকিৎসা করাবেন – প্রায় দিশেহারা হয়ে পড়লেন অবলা। কিন্তু নিয়মিত খবর রাখেন নিবেদিতা। জগদীশচন্দ্রের অসুখের খবর পেয়ে ছুটে এলেন তিনি। সারা বুলও সেই সময় ইওরোপে ছিলেন। তাঁরা দু’জনে জগদীশ ও অবলাকে আগলে রাখলেন। লন্ডনের ভালো ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করানো হলো। ডাক্তার বললেন জগদীশের পেটে অপারেশান করতে হবে। অপারেশানের আগে ও পরে মিলিয়ে দু’মাসের বেশি সময় পূর্ণ-বিশ্রামে থাকতে হবে জগদীশকে। নিরিবিলিতে বিশ্রামের জন্য নিবেদিতা জগদীশচন্দ্র ও অবলাকে নিয়ে যান উইম্বলডনে তাঁর মায়ের বাড়িতে। নিবেদিতার মা তখন ছিলেন না সেখানে। নিবেদিতা ও অবলা পালা করে রাত জেগে সেবা করেন অসুস্থ জগদীশকে।

জগদীশচন্দ্রের অসুখের খবর যায় রবীন্দ্রনাথের কাছেও। তিনি লিখলেন:

“সীজার যে নৌকায় চড়েন সে নৌকা কি কখনও ডুবিতে পারে? মহৎ কর্ম আপনাকে আশ্রয় করিয়া আছে। আপনাকে অতি শীঘ্র সারিয়া উঠিতে হইবে।”

শরীর পুরোপুরি সেরে ওঠার আগে জগদীশকে নতুন কোন গবেষণায় হাত দিতে দিচ্ছেন না নিবেদিতা। মানসিক বিশ্রামের জন্য জগদীশ তখন তাঁর বন্ধু রবীন্দ্রনাথের গল্প পড়েন। তিনি আসার সময় রবীন্দ্রনাথের প্রকাশিত গল্প ও কবিতা নিয়ে এসেছিলেন কিছু। সে বছর ১৭ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছের প্রথম খন্ড। রবীন্দ্রনাথ গল্পগুচ্ছের এক কপি জগদীশকে পাঠিয়েছেন। পড়তে পড়তে জগদীশ ভাবলেন রবীন্দ্রনাথের এত চমৎকার সব গল্প বাংলা ভাষাভাষী ছাড়া আর কেউ পড়বে না- তা তো হয় না। তিনি ভাবলেন গল্পগুলোর ইংরেজি অনুবাদ করলে কেমন হয়?

১৯০০ সালের ২ নভেম্বর তিনি রবীন্দ্রনাথকে লিখলেন:

“তুমি পল্লীগ্রামে লুক্কায়িত থাকিবে, আমি তাহা হইতে দিব না। তোমার গল্পগুলি আমি এদেশে প্রকাশ করিব। লোকে তাহা হইলে কত বুঝিতে পারিবে। আর ভাবিয়া দেখিও, তুমি সার্বভৌমিক। এদেশের অনেকের সহিত তোমার লেখা লইয়া কথা হইয়াছিল। একজনের সহিত কথা আছে (শীঘ্রই তিনি চলিয়া যাইবেন) যদি তোমার গল্প ইতিমধ্যে আসে তাহা প্রকাশ করিব। Mrs. Knight-কে অন্য একটি দিব। প্রথমোক্ত বন্ধুর দ্বারা লিখাইতে পারিলে অতি সুন্দর হইবে।”

শুধু জগদীশের সেবা করাই নয়- জগদীশের লেখার কাজও হাতে তুলে নিয়েছেন নিবেদিতা। জগদীশচন্দ্র ‘প্রথমোক্ত বন্ধু’ বলতে নিবেদিতাকে বুঝিয়েছেন। কিন্তু নিবেদিতার নাম সরাসরি লিখলেন না কেন? নিবেদিতাকে তো রবীন্দ্রনাথ ভালো করেই চেনেন। তবে কি নিবেদিতার সাথে ঘনিষ্ঠতার কথা রবীন্দ্রনাথকে জানাতে চাননি জগদীশ?

নিবেদিতাকে দিয়ে জগদীশচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের গল্প ইংরেজিতে অনুবাদ করিয়ে নিতে শুরু করেছেন এর আগে থেকেই। নিবেদিতার কাজের অন্ত নেই। জগদীশচন্দ্রের পেপার লেখা, চিকিৎসা-সেবা, নিজের ইন্ডিয়া ফিরে আসার তাড়া। কিন্তু সবকিছুকে তুচ্ছ করে তিনি জগদীশের কথামতো রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের অনুবাদ করতেও শুরু করলেন।

নিবেদিতার ব্যস্ততার কিছু বিবরণ ধরা আছে মিস ম্যাকলাউডকে লেখা তাঁর চিঠিতে। ২২/১১/১৯০০ তারিখে লিখলেন:

“চিঠি লেখার সময়ও পাই না। গোটা দিন কেটে যায় বিজ্ঞান লেখা আর অনুবাদের কাজে, আর ভারতবর্ষ সম্পর্কে কথাবার্তায়। আজ বেশি কিছু লিখতে পারবো না। কারণ ‘কাবুলিওয়ালা’ শেষ করেছি। আজ রাতের মধ্যে তার ভূমিকা লিখতে হবে।”

নিবেদিতা রবীন্দ্রনাথের গল্প অনুবাদ খুব দ্রুত করছিলেন। ১৯০০ সালে নভেম্বরের মধ্যে তিনটি গল্প কাবুলিওয়ালা (The Cabuliwalah), ছুটি (Leave of Absence) আর দেনাপাওনা (Giving and Giving in Return) শেষ করে ফেললেন। জগদীশ মহাউৎসাহে তাঁর ইওরোপীয় বন্ধুদের শোনাতে লাগলেন তাঁর বাঙালী বন্ধুর লেখা গল্প।

২৩ নভেম্বর ১৯০০ সালে রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখে জানাচ্ছেন জগদীশ:

“তোমার লেখা তরজমা করিয়া এদেশীয় বন্ধুদিগকে শুনাইয়া থাকি। তাঁহারা অশ্রু সংবরণ করিতে পারেন না। তবে কী করিয়া publish করিতে হইবে এখনো জানি না। এবার যদি তোমার নাম প্রতিষ্ঠিত করিতে পারি, তাহা হইলে যথেষ্ট মনে করিব। ৬টি গল্প বাহির করিতে চাই। শীঘ্র তোমার অন্যান্য গল্প পাঠাইবে। Mrs. Knight কে দিই নাই।”

জগদীশ এবারও নিবেদিতার নাম উল্লেখ করলেন না। শুধু তাই নয়, এত শ্রম দিয়ে যে গল্পগুলো অনুবাদ করেছিলেন নিবেদিতা জগদীশচন্দ্র তা প্রকাশ তো দূরের কথা রবীন্দ্রনাথকেও পাঠাননি অনুবাদগুলো।

এর নয় বছর পর ১৯০৯ সালে Modern Review পত্রিকা রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করতে শুরু করে। তখন নিবেদিতার করা অনুবাদগুলোর খোঁজ পড়ে। ১৯১১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্রনাথ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লেখেন- “ডাক্তার বসু বলিতেছিলেন সিস্টার নিবেদিতা আমার দুইটি ছোটগল্প ইংরেজি অনুবাদ করিয়াছেন- তাহা বিশেষ উপাদেয় হইয়াছে।”

এত বছর ধরে জগদীশ রবীন্দ্রনাথকে জানাননি কেন নিবেদিতার অনুবাদের কথা? শুধু তাই নয়- জগদীশ গল্প তিনটি খুঁজেও পাচ্ছিলেন না। শেষে নিবেদিতার মৃত্যুর পর একটা মাত্র গল্প ‘কাবুলিওয়ালা’ খুঁজে পান। এই ব্যাপারটা কি খামখেয়ালের বশে ঘটেছে নাকি নিবেদিতার প্রতি কোন অভিমানবশত ঘটেছে? জগদীশচন্দ্র নিবেদিতার উপর অভিমানটা একটু বেশিই করেছেন মাঝে মাঝে।

সে যাই হোক। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ডাক্তার ক্রমবির (৩১, নিউ ক্যাভেন্ডিস স্ট্রিট)-এর হাসপাতালে জগদীশচন্দ্রের পেটের অপারেশন হয় ১১ ডিসেম্বর ১৯০০ তারিখে। নিবেদিতা ও অবলা পালা করে জগদীশের সেবা করেছেন তখন দিনের পর দিন, রাতের পর রাত।

অসুস্থ জগদীশের সেবা করার সময় নিবেদিতা তাঁর সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনা করেছেন ধর্ম ও দর্শন বিষয়ে। ব্রাহ্মধর্ম সম্পর্কে বিশদ জানার একটা কৌতূহল তাঁর অনেক আগে থেকেই ছিল। জগদীশ শুরুতে খুব একটা উৎসাহী ছিলেন না নিবেদিতার সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা করতে। কারণ তিনি এর আগে শুনেছেন এ বিষয়ে মতের মিল না হলে কেমন রেগে যান নিবেদিতা। কিন্তু আস্তে আস্তে দেখা গেলো নিবেদিতা ব্রাহ্মসমাজের ব্যাপারে বেশ নরম হয়ে উঠছেন। ব্রাহ্মধর্ম সম্পর্কে জগদীশের ব্যাখ্যা বেশ ভালো লাগে নিবেদিতার।

১৯০১ সালের ৪ জানুয়ারি মিস ম্যাকলাউডকে চিঠিতে জানান:

“আমি আমার মনের দরজা খুলে দিয়েছি। বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে আমার ভগবানকে পাবার জন্য শ্রী রামকৃষ্ণদেবও যেন আমাকে এই পথেই চালাতে চাচ্ছেন। তোমার হয়তো মনে আছে শুরুতে আমরা শিব বা কালীকেও মেনে নিতে পারিনি।”

নিবেদিতা ক্রমে মনের দোলাচল কাটিয়ে উঠেছেন। মনকে সান্ত্বনা দিয়েছেন এই বলে যে মূর্তিপূজা আর নিরাকার ব্রাহ্মধর্মের মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। নিবেদিতার এই মানসিক পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি যেটা কাজ করেছে সেটা হলো জগদীশের প্রতি তাঁর অন্যরকম টান। জগদীশের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার নিজের কলমে বিশ্বের কাছে উপস্থাপিত হচ্ছে দেখে নিজেকে জগদীশেরই কর্মসঙ্গী হিসেবে দেখার যে টান সেটাই নিবেদিতাকে বদলে দিয়েছে অনেকখানি।

তবে শুধু ধর্ম দর্শন ও বিজ্ঞান আলোচনা নিয়েই দিন কাটতো না তাদের। খেলাধূলা, বেড়ানো সবই চলছিলো। প্রতি রবিবার বাড়ির কাছে বনের ভেতর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যেতেন নিবেদিতা ও জগদীশ। সারা বুলও সাইকেল চালানো শিখে নেন সেসময়।

জগদীশচন্দ্র যখন ধীরে ধীরে সেরে উঠছেন তখন স্যার উইলিয়াম ক্রুক্‌সের কাছ থেকে আমন্ত্রণ পেলেন রয়্যাল ইন্সটিটিউটে বক্তৃতা দেয়ার। চিঠিতে স্যার ক্রুক্‌স লিখেছেন:

“I have read the most interesting account of your researches with extreme interest. I wonder whether I could induce you to deliver a lecture on these or kindred subjects of research before the Royal Institution. If you could do so, I shall be very glad to put your name down for a Friday Evening Discourse after Easter of 1901. I have a vivid recollection of the great pleasure you gave us all on the occasion when you lectured a few years ago.”

রয়্যাল সোসাইটি অব আর্টস থেকেও আমন্ত্রণ পেলেন জগদীশচন্দ্র। ‘ভারতবর্ষে বিজ্ঞানচর্চা’ সম্পর্কিত বক্তৃতা দেন তিনি সেখানে কয়েক মাস পর।

রয়্যাল ইন্সটিটিউটের বক্তৃতার জন্য প্রস্তুতি দরকার। কিছু পরীক্ষারও দরকার আছে। নিবেদিতা উইম্বলডনে মায়ের বাড়ির খাবার ঘরটি জগদীশকে ছেড়ে দেন গবেষণাগার হিসেবে ব্যবহারের জন্য। জগদীশ সেটাকে ল্যাবরেটরি বানিয়ে ফেলেন। রয়েল ইন্সটিটিউশনে বক্তৃতার দিন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই দ্রুত নিজেকে তৈরি করছেন জগদীশ।