মূল: জে এম রবার্টস, ও এম ওয়েস্টাড
(দ্য হিস্টরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড)

৫৫০ খ্রিস্টাব্দের গুপ্ত সাম্রাজ্য থেকে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন অবধি ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রায় হাজার বছরের ঘটনাপ্রবাহে আবহমান চৈনিক ইতিহাসের মতো কোনও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য কিংবা ঐক্য নেই। মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় সভ্যতার মতো কোনও আকস্মিক উম্ফলনের নজিরও অনুপস্থিত। বরং এতে রয়েছে বহুধারার ঐতিহ্যের নমনীয় এক মেলবন্ধন। জ্ঞান ও ঐশ্বর্য ভাণ্ডারকে ভিত্তি করে অর্জিত গৌরবময় সব সাংস্কৃতিক কীর্তি, পরিশুদ্ধি ও আত্মবিকাশের প্রতি সুগভীর একাগ্রতা। সেযুগের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে আপাতদৃষ্টিতে নৈরাজ্যকর বলে প্রতীয়মান হয়- একদিকে যেমন বিবদমান রাজবংশের মধ্যকার ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, অন্যদিকে বিভিন্ন বহিঃসাম্রাজ্যের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় আগ্রাসী আচরণ। এর মাঝেও ব্যতিক্রমী অথচ গুরুত্বপূর্ণ একটি দৃষ্টান্তও রয়েছে। সাম্রাজ্য বিস্তার কিংবা বহিঃশক্তির আক্রমণ নয়, ভারতবর্ষের ইতিহাসের এই বিশেষ সময়কালটি বরং সংজ্ঞায়িত হবে যুক্তিতর্কের কাল হিসেবে। পৃথিবী অন্য যেকোনো অঞ্চল থেকে উর্বর ও ধনসম্পদ পূর্ণ অঞ্চলে বসবাসকারী ভারতীয়রা শান্তিপূর্ণ কিংবা আক্রমণাত্মক- উভয় ধরণের যুক্তিতর্কে মেতে ছিল।

সেসময়কার সবচেয়ে বড় পরিবর্তনের সূচনা ঘটে ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে। আফগানিস্তানের মুসলিম শক্তি প্রথমবারের মতো উত্তর ভারতের সমতলভূমিতে নিজেদের কর্তৃত্ব বিস্তার করতে সমর্থ হল, অধিষ্ঠিত হল দিল্লি সলতনৎ। খেয়াল রাখতে হবে যে, ভারতবর্ষের ইতিহাসের পরবর্তী যুগে রাজনৈতিক বিভক্তি সূচনার পেছনে তরবারির জোরে ইসলাম প্রতিষ্ঠাই একমাত্র কারণ নয়। বরং হিন্দু-মুসলিম আন্তঃসম্পর্কের মতো উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারত, উপকূলবর্তী অঞ্চল ও মধ্যভাগ, বিভিন্ন গোত্র ও সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যকার আন্তঃসম্পর্কও একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ভারতবর্ষের ইতিহাসে ‘ধর্ম’ গুরুত্বপূর্ণ, ঐশ্বর্যমণ্ডিত, বৈচিত্র্যপূর্ণ ও জটিল একটি নির্দেশক; যদিও পরবর্তী যুগের জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকরা একে শুধু হিন্দু-মুসলিম বিভেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছেন।

৫০০ খ্রিস্টাব্দ অবধি ভারতীয় ইতিহাসের অধিকাংশই উত্তর ভারত নির্ভর, দক্ষিণ ভারত সেখানে কেবল ছায়ার ভূমিকা পালন করেছে। উত্তর ভারতের বিশাল মৌর্য এবং গুপ্ত সাম্রাজ্য এবং তাদের সৃষ্ট সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয় ছিল মনোযোগের কেন্দ্রে। কিন্তু প্রথম সহস্রাব্দের মধ্যভাগ অতিক্রমের পরেই চিত্র পালটে গেল। এমন নয় যে, উত্তর ভারতের কর্তৃত্বের বাঁধন আলগা হয়ে পড়েছিল। দক্ষিণ ভারতেও বিভিন্ন রাষ্ট্রকাঠামোর গোড়াপত্তন হল এবং এদের নিজেদের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক জোরালো হল। ‘চোলা’ দক্ষিণ ভারতের উল্লেখযোগ্য প্রথম গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। চোলা রাজবংশ দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে প্রায় এক হাজার বছর ধরে টিকে ছিল।

null

চোলা সাম্রাজ্য

প্রভাবশালী সব আঞ্চলিক রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবার পূর্বে একদা গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীন সকল অঞ্চল নিয়ে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার সর্বশেষ একটি প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। ৬০৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৬৪৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্বকালে সম্রাট হর্ষবর্ধন এমন একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা হিমালয় থেকে উড়িষ্যা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এর কেন্দ্রভাগে ছিল রাজধানী কনৌজ যেখানে হর্ষবর্ধনের আমন্ত্রিত পণ্ডিতগণ হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় দর্শন চর্চায় সংস্কৃতভাষার বিকাশ ঘটান। হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর সাথে সাথে তাঁর সাম্রাজ্যেরও পতন হয়, একই সাথে উত্তর ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী কনৌজেরও অবলুপ্তি ঘটে।

null

হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্য

এমনকি হর্ষবর্ধনও দক্ষিণ-মধ্য ভারত তথা দাক্ষিণাত্যকে নিজ সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত করতে পারেননি। হর্ষবর্ধনের রাজসভায় সময় কাটানো চৈনিক বৌদ্ধ ভিক্ষু জুয়ান জাং এর ভাষ্যেও দাক্ষিণাত্য নিয়ে হর্ষবর্ধনের আক্ষেপের কথা লিপিবদ্ধ আছে। হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর ভারতীয় রাজনীতি ক্রমে বিভিন্ন রাজবংশের মধ্যকার আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের দ্বন্দ্বে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এ ধারা বার শতক পর্যন্ত টিকে ছিল। নবম শতকে, দাক্ষিণাত্যের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজ্য ‘রাষ্ট্রকূট’ সমগ্র ভারতবর্ষ দখলের একটি বিফল প্রচেষ্টা চালায়। এই ধারার অন্য মেরুতে ছিল উত্তর পশ্চিমের গুজরাট রাষ্ট্র এবং পূর্বের বাংলা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে রাজত্বকারী বৌদ্ধ-ধর্মাবলম্বী ‘পাল বংশ’। দীর্ঘ সময় ধরে তো নয়ই, ইচ্ছা এবং প্রচেষ্টা সত্ত্বেও একে অন্যকে পরাভূত করার সামর্থ্য কোনও রাজবংশেরই ছিলনা।

এই রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অথচ অব্যক্ত দিকটি হল, উত্তর ভারতে জন্ম নেওয়া একটি সাংস্কৃতিক পরি-কাঠামো সে যুগে সমগ্র ভারতে বলবত ছিল। আঞ্চলিক রাজ্যগুলোর একাধারে জন্ম ও বিলীন ঘটলেও, প্রতিটি রাজ্য কাঠামোতে প্রতিনিয়ত সংস্কৃত শিক্ষা থেকে প্রাপ্ত দর্শন, রাষ্ট্রপরিচালনার দিকনির্দেশনা এবং বিজ্ঞান ব্যাপকহারে গৃহীত ও চর্চিত হচ্ছিল। দক্ষিণের চিদাম্বরম কিংবা উত্তরের বানারসির মতো বিখ্যাত সব মন্দিরের শহর নির্মাণের পেছনে ধর্মের প্রতি গভীর অনুরক্তি কাজ করেছে। যদিও এতে আঞ্চলিকতার প্রভাব চোখে পড়ে। হিন্দু ও বৌদ্ধ মতাদর্শের বিভেদের চেয়েও প্রার্থনার ধরণ এবং ঈশ্বর ও ধর্মীয় গুরুর সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিন্নতাই তৎকালীন সমাজজীবনের মূল বিভেদ রেখা বলে প্রতীয়মান হয়।

খুব সম্ভব হিন্দু ধর্মের আভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সাংঘর্ষিক মতাদর্শের মধ্যে একটি আপোষ-মীমাংসার প্রচেষ্টার মাধ্যমে গুপ্ত সাম্রাজ্যের শেষদিকে এসে ভারতীয় বৌদ্ধ দর্শনের প্রভাব ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়ে। অনেক গবেষকের যুক্তি মতে, গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা ভারতবর্ষের সীমানার বাইরে কিংবা ভিতরে উদ্ভূত অন্যসকল দর্শন ও ধর্মের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বলীয়ান হিন্দুদের ধর্মীয় শাস্ত্রীয় উপচারের অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে, যেখানে বুদ্ধ আর সব হিন্দু দেবতার মতো একইভাবে পূজিত হন। যদি তা সত্যিও হয়ে থাকে, তবে এটাও মানতে হবে যে হিন্দুধর্মের স্বীয় -পরিচয় উদ্ভাবনী ক্ষমতাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, আবহমানকালের আদি ও অকৃত্রিম প্রথাগুলোরও একই ভূমিকা ছিল । অষ্টম শতাব্দী থেকে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের উত্থাপিত বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে হিন্দু পণ্ডিতগণ প্রত্যুত্তর দেওয়া শুরু করলেন। কেরালায় জন্মগ্রহণকারী মহান হিন্দু দার্শনিক শঙ্করাচার্য(৭৮৮-৮২০ খ্রিস্টাব্দ) ব্রাহ্মণ্য-বাদী বিভিন্ন ধারার একত্রীকরণ ঘটিয়ে দাবি করলেন যে, একমাত্র সঠিক জ্ঞানই জন্ম-মৃত্যুর চক্রের হাত থেকে আত্মাকে রক্ষা করতে পারে। দশম শতাব্দীতে এসে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, হিন্দু বহুত্ববাদ বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ক্ষুণ্ণ করতে সক্ষম হয়েছে। বার শতকে এসে ভারতবর্ষের মূল ভূখণ্ডে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে।

null

শিল্পীর তুলিতে শিষ্যদের দ্বারা পরিবেষ্টিত শঙ্করাচার্য

সামাজিক নানা পরিবর্তন এই যুগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, বিশেষত দক্ষিণ ভারতে। সপ্তম দশক থেকে দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন শহরে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। দুই শতাব্দী পরে, ব্যবসায়ী পরিষদগুলোই মূলত এই শহরগুলো পরিচালনা করতো। এই সংগঠনগুলোর সাথে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও নগর কর্তৃপক্ষের সমান্তরাল এক দ্বৈত শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলে। তাদের নিজেদের সেনাবাহিনী ও অস্ত্রসজ্জিত নৌ জাহাজ ছিল। উত্তর ও দক্ষিণ ভারত ছাড়াও তারা পারস্য, আরব ও আফ্রিকান বন্দরগুলোর সাথে বাণিজ্যিক লেনদেন শুরু করে। তবে তাদের মূল বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। সম্ভবত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই বাণিজ্যিক লেনদেন পূর্ব থেকেই বিরাজমান সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ককে আরও জোরালো করে তোলে, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভারতীয় যুগ নামে পরিচিত।

নবম শতাব্দীতে এসে বার্মা থেকে ফিলিপাইন অবধি বিস্তৃত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ক্রমে মানবসভ্যতার নতুন কেন্দ্র হয়ে ওঠে। খেমর এবং ইন্দোনেশিয়ার শ্রী বিজয় সাম্রাজ্য সেযুগে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় রাজত্ব করতো। নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তখন চৈনিক এবং এবং ভারতীয় সাম্রাজ্যগুলোর ব্যাপক প্রভাব ছিল। বিশেষত ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ভারতীয় সভ্যতার প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। বাণিজ্যের মাধ্যমে এই সম্পর্কের সূত্রপাত হলেও শীঘ্রই বৌদ্ধ দার্শনিক ও ভিক্ষুরা সেখানে পাড়ি জমান এবং নিজেদের মতবাদ প্রচার করতে শুরু করলেন। সেখানকার আদালতের বিচার প্রক্রিয়ায় তারা উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তী যুগের খ্রিস্টান মিশনারিদের মতো ভারতীয় বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও দক্ষিণ-পূর্ব ভারতে বিশেষ আধ্যাত্মিক ও বাস্তবিক জ্ঞান বিতরণ করেন এবং এর একটি সুদূরপ্রসারী ফল রয়েছে। পরবর্তীতে যখন বিভিন্ন দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে, সেগুলো সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় দিক থেকে ভারতীয় লোকাচারে দীক্ষিত এবং বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্ম হয়ে ওঠে প্রধান দুটি ধর্ম।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশাল অংশে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাব ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে ভারতবর্ষেও নতুন এক সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। প্রথমবারের মতো গড়ে উঠল সামন্তপ্রথা। একক কোনও রাজার অনুগত জমিদাররা রাজা ও একে অন্যের প্রতি স্বীয় দায়িত্ব পালনে ব্রতী ছিলেন। এই দায়িত্বগুলোর মধ্যে রয়েছে যুদ্ধকালীন সময়ে সহযোগিতা, এবং একই সাথে বিভিন্ন রাজকীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ যেগুলো রাজতন্ত্রকে আরও গ্রহণযোগ্যতা প্রদান করে। সামন্তপ্রথার অবস্থান ছিল বর্ণাশ্রমের বাইরে এবং প্রভুর আনুকূল্যের সাপেক্ষে সামন্ত খেতাব প্রাপ্তদের বর্ণগত পরিচয়েও পরিবর্তন ঘটতো।

প্রথম সহস্রাব্দের শেষ দিকে এসে নতুন সামাজিক ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি প্রদানে যোদ্ধা গোত্র ক্ষত্রিয়দের কিছু সদস্য নিজেদেরকে রাজপুত বলে ঘোষণা করল। অনেক ইতিহাস গবেষকের মতে, সামাজিক পরিবর্তন রোধে রাজপুত গোত্রের আবির্ভাব ঘটে। নবম ও দশম শতাব্দীতে ভারতের বিভিন্ন সাম্রাজ্যের মধ্যে দ্বন্দ্ব যখন তুঙ্গে, উত্তর ভারতের রাজপুতরা তখন এক বা দুটি প্রতিযোগী সাম্রাজ্যের মধ্যেই নিজেদের জন্য পৃথক অঞ্চল গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। নবম শতকের শেষে এসে রাজপুতদের করায়ত্ত অঞ্চলগুলো আংশিকভাবে সার্বভৌমত্ব অর্জন করে যাদের রাজধানীগুলো সংস্কৃতির নতুন কেন্দ্রে পরিণত হয়। রাজপুতদের ভট্টি গোত্র বার শতকে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত রাজস্থানের জয়সলমীর শহরটিতে প্রায় ৮০০ বছর ধরে রাজত্ব করেছে, যেটি আজকের যুগে এসেও জৌলুশ হারায়নি।

ইতোমধ্যে ভারতবর্ষে ইসলামের আগমন ঘটল। পশ্চিম তীরের আরব বণিকদের হাত ধরে এর আগমন। পরবর্তীতে ৭১২ খ্রিস্টাব্দে, আরবদের একটি সৈন্যবাহিনী সিন্ধু দখল করল। অগ্রসর না হয়ে তারা সেখানেই বসতি স্থাপন করল এবং ভারতীয়দের জন্য নতুন কোনও উপদ্রব তৈরি করল না। পরিস্থিতি কিছুকাল শান্ত থাকলেও গজনীর সুলতান মাহমুদ ভারতের মূল ভূখণ্ডে ধ্বংসাত্মক আক্রমণ চালালেন। কিন্তু এতে সমাজে কোনও আমূল পরিবর্তন ঘটেনি। দুই শতাব্দী পরেও ভারতীয় ধর্মীয় সংস্কৃতি একই গতিতে অগ্রসর হচ্ছিল। শুধুমাত্র বৌদ্ধ ধর্ম তার প্রতিপত্তি হারায়, অন্যদিকে জাদুবিদ্যা ও অলৌকিকতা নির্ভর তান্ত্রিক সাধনার বিকাশ ঘটে যা আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দৈবত্ব অর্জনের প্রতিশ্রুতি দেয়। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পরবর্তী যুগে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষের অনুপস্থিতিতে বিভিন্ন ধর্মীয় তীর্থস্থানে ধর্মীয় আচার-প্রথা পালনের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এর কিছুদিন পরেই মধ্য-এশীয়রা আক্রমণ চালাল।

আক্রমণকারী ছিল তুর্কী মুসলিম যারা লুণ্ঠনের চেয়ে বসতি স্থাপনেই বেশি মনোযোগী ছিল। এগার শতাব্দীতে এসে তারা পাঞ্জাবে বসতি স্থাপন করে এবং বার শতাব্দীতে এসে আরও এক দফা আক্রমণ শুরু করে। ফলশ্রুতিতে কিছুকাল পরেই দিল্লীতে তুর্কি সলতনৎ অধিষ্ঠিত হয় এবং গাঙ্গেয় উপত্যকা এর করায়ত্তে আসে। এই শাসনব্যবস্থা একত্ববাদী ছিল না। মধ্য এশিয়ার মঙ্গলদের বশ্যতা স্বীকারকারী খ্রিস্টান রাষ্ট্রগুলো মতো হিন্দু রাজ্যগুলোও এই সলতনতের অধীনে টিকে ছিল। হিন্দুদের মন্দির ধ্বংসের ঘটনাকে বিবেচনায় নিলে দেখা যায় যে, মুসলিম শাসকরা নিজেদের বস্তুগত স্বার্থের প্রতি মনোযোগী ছিলেন বিধায়, ওলামা গোষ্ঠীর জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ প্রক্রিয়া চালু করার দাবিকে সবসময় প্রশ্রয় দেননি।

গাঙ্গেয় উপত্যকা ছিল ভারতবর্ষের তৎকালীন মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র। মুসলিম সৈন্যরা দ্রুততার সাথে বঙ্গভূমি দখল করে নেয় এবং পরবর্তীতে ভারতবর্ষের পশ্চিম উপকূল এবং দাক্ষিণাত্যে আধিপত্য বিস্তার করে। তারা আরও দক্ষিণে অগ্রসর হওয়া থেকে বিরত থাকে। ফলে, দক্ষিণ ভারতের মুক্ত অঞ্চলগুলোর হিন্দু সমাজ তেমন কোনও পরিবর্তন ছাড়াই টিকে থাকতে সক্ষম হয়। তের শতকের পর এটা স্পষ্ট হয়ে গেল, উত্তর ভারতে মুসলিম আগ্রাসনের বিপরীতে দক্ষিণ ভারত, বিশেষত ভারতীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের নবীনতম সদস্য তামিল জনগোষ্ঠী নিজেদেরকে আবহমান হিন্দু সংস্কৃতির আত্ম-সচেতন ধ্বজাধারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

১২০৬ সালে দিল্লি সলতনৎ অধিষ্ঠিত হয় এবং চৌদ্দ শতকের শেষ অবধি ব্যাপক প্রভাবশালী ছিল। এর মাধ্যমে ভারতবর্ষের প্রাণকেন্দ্রে মুসলিম শাসনের একটি ধারা শুরু হয় যা ৭০০ বছর ধরে টিকে ছিল। তুর্কী বংশোদ্ভূত আফগানদের হাত ধরে মুসলিম সাম্রাজ্যের সূচনা, যার অধিভুক্ত ছিল সমগ্র পাকিস্তান, উত্তর ভারত এবং আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। সলতনতের মাধ্যমেই ভারতবর্ষে পশ্চিমা প্রভাবের সূচনা হয়। এর ফলে ভারতবর্ষের সাথে প্রথমবারের মতো পারস্য, মধ্যপ্রাচ্য এবং মধ্য ইউরেশিয়ার জোরালো সম্পর্ক তৈরি হয়।

null

সময়রেখায় দিল্লী সলতনৎ

তের শতকের শেষভাগ থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর প্রারম্ভ-কাল পর্যন্ত খলযি রাজবংশের তিন সুলতানের শাসনামলে দিল্লি সলতনৎ উৎকর্ষের শীর্ষে আরোহণ করে। ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে রাজত্ব করা সুলতান আলাউদ্দিন একজন জাঁদরেল শাসক ছিলেন যিনি দুবার উত্তরের মঙ্গল সৈন্যবাহিনীকে পরাজিত করেন। তার শাসনামলে মুসলিম সাম্রাজ্য দাক্ষিণাত্যের সীমানা অবধি প্রসারিত হয়, যা দক্ষিণ ভারতে ইসলামি সংস্কৃতির প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উত্তর ভারতীয়দের ন্যায় দক্ষিণ ভারতীয়দের সবাই জোরপূর্বক ভাবে ধর্মান্তরিত হয়নি। বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের অধিবাসীদের মতোই কিছু ভারতীয় ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এর বৈপ্লবিক বৈশিষ্ট্যাবলীর জন্য। একটি আবদ্ধ সমাজের কাছে ইসলামে মানুষের সমানাধিকার ও ঈশ্বরের সাথে সরাসরি ব্যক্তিগত সম্পর্কের ধারণা যথেষ্ট প্রণোদনা সৃষ্টি করতে সক্ষম।

দক্ষিণ ভারতে ইসলামি রাজনৈতিক শক্তির আবির্ভাব ঘটে সলতনতের এক তাজিক সেনাপ্রধানের হাত ধরে, যিনি দিল্লির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বর্তমান মহারাষ্ট্র অঞ্চলে স্বীয় স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। তবে এর ব্যাপ্তি ছিল দক্ষিণের কর্ণাটক এবং অন্ধ্র প্রদেশ পর্যন্ত। বহমানি সলতনৎ নামে পরবর্তীকালে পরিচিত পাওয়া এই রাজ্যে ফার্সি ভাষা ভিত্তিক বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। রাজ্যের শাসকবর্গ ফারসি ভাষা চর্চা করতেন এবং পারস্যের শিরাজ, ইস্পাহান এবং কুমের মতো সমৃদ্ধ শহরগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতেন। তাদের ফার্সি উপদেষ্টাদের আনুকূল্য ও উৎসাহে বহমানিরা শিয়া ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ফলশ্রুতিতে ভারতবর্ষের বুকে সর্বপ্রথম শিয়া ধর্মাবলম্বী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

মুসলিম সাম্রাজ্যের এই বিভেদের ফলে উত্তরের হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে গেল। ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে তৈমুর লঙের সেনাবাহিনী গাঙেয় উপত্যকায় ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ঐ আক্রমণে অংশগ্রহণকারী এক অভিযাত্রীর ভাষ্য অনু্যায়ী, লাশের স্তূপের উৎকট গন্ধের হাত থেকে বাঁচতে তৈমুর লঙের বাহিনী দ্রুতই প্রস্থান করে। এই বিপর্যয়ের পরে মুসলিম সেনাপতি ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর অধীনে মুসলিম সাম্রাজ্য আরও বেশি খণ্ডিত হয়ে পড়ে। যাইহোক, উপমহাদেশে ততদিনে ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে। ভারতবর্ষের সামগ্রিকতার ঐতিহ্যের বিপরীতে ইসলামের সক্রিয়, ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত চিন্তাধারা হিন্দু ও বৌদ্ধ দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত। আবার একই সঙ্গে ইসলাম নিজেও হিন্দু ও বৌদ্ধ দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়।

null

দক্ষিণ ভারতের স্বাধীন বিজয়নগর সাম্রাজ্য

কিন্তু সমগ্র ভারতবর্ষ মুসলিম শাসনের আওতায় আসেনি। দক্ষিণ ভারতে একটি হিন্দু সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে যেটি দাক্ষিণাত্যের দক্ষিণাঞ্চল এবং আরও দক্ষিণের কিছু অংশে চৌদ্দ শতকের মধ্যভাগ থেকে রাজত্ব করছিল। আভিজাত্যপূর্ণ রাজধানী ‘বিজয়নগর’ এর নামে নামাঙ্কিত রাজ্যটির অবস্থান ছিল বর্তমান কর্ণাটক প্রদেশের উচ্চভূমিতে যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে ব্যাপক সমৃদ্ধি অর্জন করেছিল। সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী বিজয়নগর ভারতবর্ষের প্রথম রাষ্ট্র যা মধ্য-এশিয়ার রুট ব্যবহার করে ইউরোপ এবং দক্ষিণ-এশিয়ার রুট ব্যবহার করে চীন থেকে অস্ত্র আমদানি করেছিল। বিজয়নগর সুখ্যাতি অর্জন করেছিল এর দক্ষ শাসনব্যবস্থা এবং পূর্বতন শতাব্দীসমূহের বিভিন্ন হিন্দু সংস্কৃতির সারগ্রহণ করে গড়ে ওঠা ধর্মীয় সংস্কৃতির জন্য। ভারতবর্ষের চিরায়ত বহুমুখী সংস্কৃতির ধার-বাহক হিসেবে বিজয়নগর এমন একটি ভবিষ্যতের দিকে দিকনির্দেশ করে যেখানে হিন্দু কিংবা মুসলিম কোনও গোষ্ঠীই সম্পূর্ণভাবে প্রাধান্য বিস্তার করতে সক্ষম হবে না।