লিখেছেন: সাত্যকি দত্ত

( প্রথম পর্ব )

১৩২৪ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসের দুপুরে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠি খুলে দেখলেন তাতে লেখা আছে –

“প্রিয় রবিবাবু ,

আমি আপনার গল্পগুচ্ছের সব গল্পগুলি পড়েছি , আর বুঝতে পেরেছি কেবল ক্ষুধিত পাষাণটা বুঝতে পারিনি । আচ্ছা , সেই বুড়োটা যে ইরানী বাঁদির কথা বলছিল , সেই বাঁদির গল্পটা বলল না কেন ? শুনতে ভারি ইচ্ছা করে । আপনি লিখে দেবেন । হ্যা ?
আচ্ছা জয়-পরাজয় গল্পের শেষে রাজকন্যার বিয়ে হল । না ? কিন্তু আমার দিদিরা বলে শেখর মরে গেল । আপনি লিখে দেবেন যে , শেখর বেঁচে গেল আর রাজকন্যার সঙ্গে তার বিয়ে হল । কেমন ? সত্যিই যদি শেখর মরে গিয়ে থাকে , তবে আমার বড়ো দুঃখ হবে । আমার সব গল্প গুলোর মধ্যে মাষ্টারমশাই গল্পটা ভালো লাগে । আমি আপনার গোরা , নৌকাডুবি , জীবনস্মৃতি , ছিন্নপত্র , রাজর্ষি , বউ-ঠাকুরানীর হাট , গল্প সপ্তক পড়েছি । কোন কোন জায়গা বুঝতে পারিনি কিন্তু খুব ভালো লাগে । আপনার কথা ও ছুটির পড়া থেকে আমি আর আমার ছোটবোন কবিতা মুখস্ত করি । চতুরঙ্গ , ফাল্গুনী ও শান্তিনিকেতন শুরু করেছিলাম কিন্তু বুঝতে পারলাম না । ডাকঘর , অচলায়তন , রাজা , শারদোৎসব এসবো পড়েছি । আমার আপনাকে দেখতে খু- উ -উ – উ – উ – উব ইচ্ছে করে । একবার নিশ্চয় আমাদের বাড়িতে আসবেন কিন্তু । না এলে আড়ি । আপনি যদি আসেন তবে আপনাকে আমাদের শোবার ঘরে শুতে দেব । আমাদের পুতুল দেখাব । ও পিঠএ আমাদের ঠিকানা লিখে দিয়েচি ।

রাণু
235 Agast – kund
Benares City
আমার চিঠির উত্তর শিগগির দেবেন ।
নিশ্চয় । ”

চিঠিটি পড়তে পড়তে বেশ অবাক হলেন রবীন্দ্রনাথ – সারাদিন কতই চিঠি না চিঠি আসে – তাদের ভীতর কেউ গুণমুগ্ধ পাঠক , কেউ উন্নাসিক সমালোচকের দল , কেউ বা অন্ধ ভক্ত – খালি ভারী ভারী শব্দের জাল বুনে স্তুতি করাই যাদের কাজ , কেউ বা পাঠান নিখাদ প্রশংসা আর অবশ্যই চিঠি আসে তাদের কাছ থেকে যারা রবীন্দ্র – কাব্যের ত্রুটি -বিচ্যুতি খুঁজে তাই নিয়ে হৈ চৈ করে বৈষ্ণব সুলভ আনন্দ পান । কিন্তু এমন চিঠি যে প্রথমবার , আর বিশেষ করে ওই যে লাইনটি – ” আমার আপনাকে দেখতে খু- উ -উ – উ – উ – উব ইচ্ছে করে ” – হৃদয়য়ের এতখানি গভীরতা খামে ভরে আগে তো কেউ পাঠায়নি কবিকে। আমাদের রবীন্দ্রনাথ – যিনি জীবনের ক্ষুদ্রতম ভালোবাসা টুকুকেও সযত্নে সঞ্চিত করে চলেছেন হৃদয়য়ের মণিকোঠায় – তাঁর হৃদয়কে আচ্ছন্ন করার জন্য ওইটুকু লাইনই ছিল যথেষ্ট । যদিও রুল টানা কাগজে মাত্রা দিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা চিঠিটি দেখেই পত্র লেখিকার বয়স অনুমান করা শক্ত নয় কিন্তু কে সেই ক্ষুদ্র পাঠিকা যে , শুধু প্রশংসামুখর নন , ক্ষুধিত পাষাণ গল্পে ইরানী বাঁদীর কাহিনীকে অসম্পূর্ণ রাখা বা জয়পয়াজয় গল্পে রাজকন্যার সাথে শেখরের বিয়ে দিয়ে তাকে মেরে ফেলা যে রবীন্দ্রনাথের পক্ষে ঠিক কাজ হয়নি ও তার সংশোধন আবশ্যক , অনুরোধের ছদ্মবেশে এই পরোক্ষ সমালোচনাও তাঁর প্রথম পত্রেই অসঙ্কোচে জানিয়েছে । কাজেই এমন একটা ও পরে আরও অনেক চিঠি পড়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বহুবিধ ব্যস্ততা সত্ত্বেও এই বালিকা বন্ধুর সঙ্গে এক দীর্ঘকালস্থায়ী পত্রালাপে প্রবৃত্ত হবেন , তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই ।

ইতিমধ্যে রবীন্দ্রনাথ ” ডাকঘর ” অভিনয়ে ঠাকুরদা সেজে অভিনয় করে ফেলেছেন – একে একে প্রকাশ করছেন ” কর্তার ইচ্ছায় কর্ম ” , ” অনুবাদ চর্চা ” , ” My Reminiscences ” , ” Nationalism ” , ” Personality ” , ” Sacrifice and Other Plays ” । আর বিশ্ব সাহিত্যে তখন প্রকাশ পাচ্ছে পাস্তেরনাকের “লাইফ মাই সিস্টার” , হামসুনের ” গ্রোথ অফ দি সয়েল” , ভ্যালেরির “দি ইয়ং ফেথ”, ইয়ুং এর “সাইকোলজি অফ দি আনকন্সাস” কিংবা হিমেনেথের “প্ল্যাটেরো অ্যান্ড আই” । নব নব সৃষ্টির নেশায় ব্যক্তিগত নিজের জীবন সম্পর্কে উদাসীন রবীন্দ্রনাথ ইতিমধ্যে হারিয়ে ফেললেন চিঠিটি , কোথায় যে যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন সেটি আর মনে করতেই পারলেন না । মাঝে মধ্যে যদিও সেই ক্ষুদ্র পাঠিকার পত্রের উত্তর দেওয়া হল না বলে কষ্ট পান , তাঁকে যেমন করেই হোক চিঠিটা পেতেই হবে – তারপর একদিন ওর বাড়িতেও যেতে হবে নইলে যে জন্মগত আড়ি দেবে সেই মেয়ে ।

শ্রাবণ শেষে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন –

ব্যাকুল বকুল ফুলে ভ্রমর মরে পথ ভুলে ।।
আকাশে কী গোপন বাণী বাতাস করে কানাকানি ,
বনের অঞ্চলখানি পুলকে উঠে দুলে দুলে ।।
বেদনা সুমধুর হয়ে ভুবনে আজি গেল বয়ে ।।
বাঁশিতে মায়া টান পূরি কে আজি মন করে চুরি ,
নিখিল তাই মরে ঘুরি বিরহসাগরের কুলে ।।

সে দিন ভাদ্র মাসের তিন তারিখ , না খুঁজতেই হটাত ডেস্কের ভেতরে পেয়ে গেলেন সে চিঠি । পাওয়া মাত্রই আর দেরি করলেন না , লিখতে বসলেন রাণুকে , যদিও এটা তাঁর পোশাকি নাম , আসল নাম তিনি তখনও জানেন না , জানেন না তাঁর কোন পরিচয় , চিঠিতে না ছিল পদবী না ছিল প্রযত্নে তাঁর বাবার নাম ।

১৯ অগাস্ট ১৯১৭
শান্তিনিকেতন
বোলপুর

কল্যাণীয়াসু ,

তোমার চিঠির জবাব দেব বলে চিঠিখানি যত্ন করে রেখেছিলুম কিন্তু কোথায় রেখেছিলুম সে কথা ভুলে যাওয়াতে এত দিন দেরি হয়ে গেল। আজ হঠাৎ না খুঁজতেই ডেস্কের ভিতর হতে আপনিই বেরিয়ে পড়ল ।
তোমার রাণু নামটি খুব মিষ্টি— আমার একটি মেয়ে ছিল, তাকে রাণু বলে ডাকতুম, কিন্তু সে এখন নেই। যাই হোক ওটুকু নাম নিয়ে তোমার ঘরের লোকের বেশ কাজ চলে যায় কিন্তু বাইরের লোকের পক্ষে চিঠিপত্রের ঠিকানা লিখতে মুস্কিল ঘটে। অতএব লেফাফার উপরে তোমাকে কেবলমাত্র রাণু বলে অভিহিত করাতে যদি অসম্মান ঘটে থাকে তবে আমাকে দোষ দিতে পারবেনা। বাড়ীর ডাক নামে এবং ডাকঘরের ডাক নামে তফাৎ আছে যদি ভবিষ্যতে চিঠি লেখো তবে সে কথাটা মনে রেখো ।
শেখরের কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করেচ। রাজকন্যার সঙ্গে নিশ্চয়ই তার বিয়ে হত কিন্তু তার পূৰ্ব্বেই সে মরে গিয়েছিল। মরাটা তার ভুল হয়েছিল কিন্তু সে আর তার শোধরাবার উপায় নেই। যে খরচে রাজা তার বিয়ে দিত সেই খরচে খুব ধুম করে তার অন্ত্যেষ্টি সৎকার হয়েছিল।
ক্ষুধিত পাযাণে ইরাণী বাদির কথা জানবার জন্যে আমারও খুব ইচ্ছে আছে কিন্তু যে লোকটা বলতে পারত আজ পর্যন্ত তার ঠিকানা পাওয়া গেলনা ।
তোমার নিমন্ত্রণ আমি ভুলবনা— হয়ত তোমাদের বাড়িতে একদিন যাব— কিন্তু তার আগে তুমি যদি আর-কোনো বাড়িতে চলে যাও? সংসারে এই রকম করেই গল্প ঠিক জায়গায় সম্পূর্ণ হয় না।
এই দেখ না কেন, খুব শীঘ্রই তোমার চিঠির জবাব দেব বলে ইচ্ছা করেছিলুম কিন্তু এমন হতে পারত তোমার চিঠি আমার ডেস্কের কোণেই লুকিয়ে থাকত এবং কোনোদিনই তোমার ঠিকানা খুঁজে পেতুম না।
যেদিন বড় হয়ে তুমি আমার সব বই পড়ে বুঝতে পারবে তার আগেই তোমার নিমন্ত্রণ সেরে আসতে চাই। কেননা যখন সব বুঝবে তখন হয় তো সব ভাল লাগবে না— তখন যে-ঘরে তোমার ভাঙা পুতুল থাকে সেই ঘরে রবিবাবুকে শুতে দেবে।
ঈশ্বর তোমার কল্যাণ করুন।
ইতি ৩রা ভাদ্র ১৩২৪

শুভাকাঙ্ক্ষী
শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

প্রথম পত্রের শেষে লেখা শুভাকাঙ্খী, শ্রী শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “, পরের চিঠিতে তা পাল্টে হয়েছে কখনো হয়েছে ‘শুভানুধ্যায়ী শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , কখনো বা শুধু ‘ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘৷

রবীন্দ্রনাথের চিঠির উত্তরে সে তাঁর ‘ রবিবাবুর ‘ সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আরো অনেকটাই বাড়িয়ে লিখলেন –

“প্রিয় রবিবাবু,

আপনি এতদিন আমাকে চিঠি দেননি বলে খুব রাগ হয়েছিল কিন্তু আপনার চিঠি পেয়ে খুব খুসী হয়েছি। আমার ভাল নাম কি জানেন ? প্রীতি। বেশ সুন্দর নাম না। ইস্কুলে সবাই আমাকে প্রীতি বলে ডাকে। কিন্তু আপনি আমাকে রাণু রাণু বলেই ডাকবেন। আপনার ও নামটা সুন্দর লাগে কিনা তাই বলচি। আমার আরো নাম আছে শুনবেন। রাণী রাজা বাবা। সব নাম গুলোই বেশ না ? আপনি যে কৰ্ত্তার ইচ্ছায় কৰ্ম্ম বলে একটা সুন্দর লেকচার দিয়েছিলেন না, সেটা ভারতী আর প্রবাসী তে বেরিয়ে ছিল। মা বাবজা বাবু আশারা সেটা পড়ে বলেন যে খুব সুন্দর হয়েছে। আমিও তাই পড়তে গেলাম কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না। বোধহয় সেটা খুব শক্ত। কিছুদিন আগে আমার খুব অসুখ করেছিল। এখন ভাল আছি। আপনি নিশ্চয় একদিন আমাদের বাড়ী আসবেন আমরা এ বাড়ী ছেড়ে যাবনা। এ বাড়ী আমাদের নিজের বাড়ী। ভাড়ার বাড়ী নয়। আপনি আসবার সময় আমাদের জানাবেন। আমি ইস্কুলের ছুটি নিয়ে আপনাকে ইষ্টিসানে আনতে যাব। এ চিঠির উত্তর শিগগির দেবেন যেন, হারিয়ে ফেলবেন না যেন। আমি কেমন সুন্দর ফুল আঁকা কাগজে চিঠি লিখচি। (ভাদ্র ১৩২৪)

রাণু।
আমাদের বাড়ির ঠিকানা আবার লিখে দিচ্ছি ।
235 Agast Kundo
Benaras City
আপনি আর গল্প লেখেন না কেন। ”

এর পর শুরু হবে পত্র-আলাপন , ” প্রিয় রবিবাবু ” হবে ” আমার প্রিয় রবিদাদা ” , আমার প্রিয় রবিদাদা সম্বোধনের পিছনে রাণু যুক্তি দেখিয়ে লিখবে – ” আমার কেন লিখছি জানেন ? আপনি আমায় যে চিঠিটা দিয়েছিলেন সেইটতে তোমার রবিদাদা লিখেছেন । ” কখনো আবার রবীন্দ্রনাথের উপর রাগ করে বিনা সম্বোধনেই বা খালি রবিবাবু লিখেই চিঠি দিয়েছেন – ” আপনার চিঠি পেয়েছি। খুব রাগ হয়েছে। আপনি কেন আমার চিঠির উত্তর সব চাইতে আগে লেখেন নি। মাঝে কেন লিখেছেন আর কেন আমার দুটো চিঠির উত্তর অত ছোট্ট লিখেছেন। ওরকম কাগজে আপনি আর লিখতে পাবেন না। আর আপনি কেন আমার দুটো চিঠি পাননি তার আগেই আশাদের চিঠি লিখেচেন। আপনার সঙ্গে আড়ি। কেমন বিচ্ছিরি কাগচে চিঠি লিখছি। আর রবিবাবু লিখেছি। আমারও না প্রিয়ও না রবিদাদাও না। বেশ হয়েছে। দেখবেন এবার আপনার কি হবে। আপনাকে আর কেউ চিঠি লিখবেনা। আপনি আজকাল নিশ্চয় এণ্ডজকে বেশী ভালবাসেন। ” অভিমানের শেষ এখানেই নয় , চিঠির শেষে লিখেছে – ” আপনি ভারী দুষ্টু। সবচাইতে। যদি এবার একটা খুব বড় চিঠি না দেন তো আড়ি করে দেব একেবারে। ”

কিন্তু কে এই প্রীতি ? যে রবীন্দ্রনাথকে অকপটে দুষ্টু বলতে পারেন , যার সব অভিমান অভিযোগ রবীন্দ্রনাথ মেনে নিয়েছেন প্রতিবারই , কখনো আবার মাপও চেয়েছেন !

রবীন্দ্রনাথ যখন পঁয়তাল্লিশ এ পড়েছেন – সেই ১৯০৬ সালের ১৮ ই অক্টোবর বারাণসীতে হিন্দু ইউনিভার্সিটির দর্শনের অধ্যাপক ফণীভূষণ অধিকারীর ঘরে জন্ম নেয় প্রীতি – যাকে রবীন্দ্র অনুরাগী পাঠক মাত্রই রাণু নামে চেনে । ফণীভূষণ অধিকারী ছিলেন নদীয়া জেলার টুঙ্গী গ্রামের বেণীমাধব অধিকারীর তৃতীয় পুত্র । বেণীমাধব অধিকারী ছিলেন সংস্কৃত পণ্ডিত , স্ত্রী মারা গেলে তিনি সন্ন্যাস নেন এবং তাঁর নাম হয় পরমহংস স্বামী যোগানন্দ ।

খুব অল্প বয়স থেকেই রাণু রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়ে তাঁর ভক্ত । সেই ভক্ত হয়ে ওঠার পিছনে কিন্তু কাজ করেছে একটা পারিবারিক প্রেক্ষাপট । সরযূবালা অর্থাৎ রাণুর মায়ের অগ্রজ কালীপ্রসন্ন ছিলেন সাংবাদিক এবং রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার অনুরাগী । সেই অনুরাগ থেকেই তিনি তাঁর পুত্র বিশ্বনাথকে ব্রহ্মচর্যাশ্রমে ভর্তি করে দেন এবং রবীন্দ্রনাথের সংসর্গ লাভের আশায় কিছুকাল শান্তিনিকেতনে এসে বসবাস করেন । এই সময়ে কালীপ্রসন্নের চরিত্রমাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বিদ্যালয় পরিচালনার কাজে নিযুক্ত করতে চেয়েছিলেন কিন্তু কাশী হিন্দু বালিকা ও বালক বিদ্যালয়ের পরিচালার দায়িত্ব ত্যাগ করে ওনার পক্ষে চিরকাল শান্তিনিকেতনে থাকা সম্ভব হয়নি । কালীপ্রসন্নের মৃত্যু সংবাদে ব্যথিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ সরযূবালাকে ১৭ ই অগ্রহায়ণ ১৩২৬ যে পত্রখানি লেখেন সেটি ” শোকাতুরের প্রতি ” নামে পৌষ সংখ্যা শান্তিনিকেতন পত্রিকায় প্রকাশ হয় । সরযূবালার জীবনে তাঁর এই অগ্রজের প্রভাব অপরিসীম , রবীন্দ্র – সাহিত্যপ্রীতির দীক্ষা তিনি তাঁর কাছ থেকেই লাভ করেছিলেন । শৈশব থেকে সরযূবালা রবীন্দ্রনাথের যে কোনো কবিতা অনর্গল মুখস্থ বলতে পারতেন । শুধু তাই নয় , রবীন্দ্র – সংগীতে ছিল তাঁর অসামান্য দক্ষতা । ফণীভূষণও রবীন্দ্র অনুরাগী ছিলেন । আর এই অনুরাগের বশবর্তী হয়ে ১৯১০ সালে গ্রীষ্মাবকাশের সময় তিনি কলকাতায় থেকে কর্মস্থলে ফেরার পথে কয়েক ঘণ্টা্র জন্য শান্তিনিকেতনে আসেন এবং তাঁর অভিজ্ঞতার ইতিবাচক বিবরণ ” বোলপুর ব্রহ্মবিদ্যালয় ” নামে অগ্রহায়ণ ১৩১৭ – সংখ্যা প্রবাসীতে প্রকাশ করেন ।

ফণীভূষণের পরিবারে প্রথম থেকেই যে রবীন্দ্রচর্চার আবাহাওয়া বিদ্যমান ছিল তারই প্রভাব পড়েছে তাঁর সন্তানদের উপর । পরিবারে রবীন্দ্র সাহিত্য ও সংগীত চর্চার সজীবতার মধ্যে একটু একটু করে বেড়ে ওঠা রাণু খুব অল্প বয়স থেকেই যা রবীন্দ্রনাথের যে বই হাতে পেয়েছেন তার আদ্যপান্ত পড়ে ফেলেছেন বুঝে বা না বুঝে । তা ছাড়া তাঁদের বাড়িতে প্রবাসী , ভারতী , সবুজ পত্র পত্রিকা আসত , তাই নতুন নতুন লেখা পড়বার সুযোগ ছিল তাঁর । মা সরযূবালা পত্রিকা থেকে রবীন্দ্রনাথের ছবি কেটে বাঁধিয়ে শোয়ার ঘরের দেওয়ালে বাঁধিয়ে রেখেছিলেন , তাই চেহারার আদলও রাণুর অজানা ছিল না । এই ছবি প্রসঙ্গে একটা চিঠিতে রাণু লিখছে –

” আপনাকে দেখে আমার একটুও ভয় করবে না । আপনি তো খুব সুন্দর দেখতে । আপনি বুঝি ভাবেন আমি আপনার ফটো দেখিনি ।
তাতেও তো আপনাকে সুন্দর লাগে । আপনি খুব লম্বা আর সুন্দর । আমার কিন্তু লম্বা লোক বেশ লাগে । আজ হলি কিনা , তাই
আপনাকে একটু ফাগ পাঠাচ্ছি । আপনি মুখে মাখবেন । আপনি সুন্দর কিনা , তাই আপনাকে বেশ সুন্দর লাগবে ।
শুনুন , আপনি ভালো করে চুল-টুল আঁচড়াবেন । কাপড় বেছে বেছে পরবেন ।
আপনি পুজো পর্যন্ত চুল কাটবেন না । তখন বেশ বড় চুল সুন্দর দেখতে হবে । কিন্তু আপনি লক্ষ্মী ছেলে হয়ে থাকবেন । যাতে সুন্দর দেখায় ।
আমাদের শোয়ার ঘরে আপনার যে ফটো ছিল , সেটা বদলে আপনি নাম লিখে দিয়েছিলেন সেইটা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে । সেইটে
বেশি সুন্দর দেখতে তাই । …
… আপনি কি বিশ্ব – প্রকৃতিকে বেশি ভালোবাসেন ? বোধহয় বিশ্ব – প্রকৃতি আপনাকে আমার চাইতে কম ভালোবাসে ।
আমার আপনার জন্য মন কেমন করে । আমি আপনাকে চুমু দিচ্ছি … ”

এই চিঠিখানি পড়লে কেউ কি বিশ্বাস করবে এটি লিখেছে বারো বছরের এক বালিকা ? ওইটুকু বয়সে রাণুর মধ্যে কী রকম রবীন্দ্র অনুরাগ জন্মিয়েছিল তা সহজেই অনুমান করা যায় । বারো বছর বয়স থেকে পাকা হাতের লেখায় পাঠাচ্ছে চিঠি – যত দিন গড়িয়েছে নিজের সব মনের কথা নিঃসঙ্কোচে খুলে বলেছে কবিকে । ভাবতে অবাক ; আগে তখনও কিন্তু সেই বালিকা রবীন্দ্রনাথকে খালি ছবিতেই দেখেছেন । তা হলে সেই মানুষটির প্রতি এত ভালোবাসার উৎসার এল কি করে ? একেই কি বলে সত্যি কারের প্রেম ? না , মনোবিজ্ঞানীরা বলবেন , এ হল ক্ষণিকের মোহ ? এই সব নিয়ে তর্ক করবে চশমা আঁটা গবেষকের দল – পাতার পর পতা যুক্তি দেখাবেন – থাক সেই সব যুক্তি- তর্ক শুকনো পাতায় , আবেগ অভিমান কি কোন দিন যুক্তি তর্কের ধার ধারে ? তবে বয়সের পার্থক্যের জন্য রবীন্দ্রনাথ আর রাণুর আবেগের দৃষ্টিকোণের মধ্যে একটা মস্ত বড় পার্থক্য ছিল সে কথা কিন্তু মানতেই হবে । রবীন্দ্রনাথ তখন এমন একটা বয়সে , যে বয়স সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেন – ” যৌবনের শেষে শুভ্র শরৎকালের ন্যায় একটি গভীর প্রশান্ত প্রগাঢ় সুন্দর বয়স আসে যখন জীবনের ফল ফলিবার এবং শস্য পাকিবার সময়। তখন আর উদ্দাম যৌবনের বসন্তচঞ্চলতা শোভা পায় না। ততদিনে সংসারের মাঝখানে আমাদের ঘর বাঁধা একপ্রকার সাঙ্গ হইয়া গিয়াছে; অনেক ভালোমন্দ, অনেক সুখদুঃখ, জীবনের মধ্যে পরিপাক প্রাপ্ত হইয়া অন্তরের মানুষটিকে পরিণত করিয়া তুলিয়াছে । ” আর প্রথম পত্র লেখবার সময় রাণুর একটি বালিকা মেয়ে , জীবন তখনও তাঁর ভালো করে শুরুই হয়নি । তবুও দৃষ্টিকোণের এই বিশাল তারতম্য কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বলেই ভেঙে ফেলা সম্ভব হয়েছিল – রবীন্দ্রপ্রতিভার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য , তাঁর শৈশব ও তারুণ্যের সজীবতাকে সারা জীবন রক্ষা করে যাওয়া , সেই কারনেই সাহিত্য ও কর্মে নিজের পুনরাবৃত্তি না করে তিনি সর্বদাই নতুন পরীক্ষানিরীক্ষায় প্রবৃত্ত হতে পেরেছেন – তাই তো পরবর্তীকালে আমারা দেখবো রাণু যখন তাঁর বয়সকে অপরিবর্তনীয় সাতাশ বছরে বেঁধে দেওয়ার নির্দেশ জারি করেছেন , রবীন্দ্রনাথ সাগ্রহে তাকে শিরোধার্য করেন – শুধু রাণুকে লেখা চিঠিতে নয় , দেশ বিদেশের বহু সভায় ভাষণ দিতে গিয়ে তাঁর এই চিরন্তন সাতাশ বছরের কথা তিনি সগর্বে উল্লেখ করেছেন ।

রাণু তাঁর প্রতিটা চিঠিতেই কাশীতে আসার জন্য রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেছেন , শেষে গঙ্গার পরপারে ভ্রমণের একটি বিবরণ দিয়ে প্রলোভন দেখিয়েছেন , ” আপনি যখন আসবেন তখন আপনাকেও নিয়ে যাব । কিন্তু আপনি আসেন কই । ” ইতিমধ্যে সে এগারটি চিঠি দিয়ে ফেলেছেন আর উত্তরে কবির কাছ থেকে পেয়েছে সাতটি চিঠি । শেষ পর্যন্ত সে নিজেই এলো দেখা করতে । রবীন্দ্রনাথের সাথে প্রত্যক্ষ সাক্ষাতের আগের চিঠিতে রাণু লিখছেন – ” আপনার বেশ হয়েছে। যেমন আমার সঙ্গে না দেখা করে যাচ্ছিলেন তেমনি যাওয়া হল না। আপনি মঙ্গলবার দিন সন্ধ্যাবেলা নিশ্চয় আমাদের বাড়ী আসবেন। নয়ত জন্মের মতন আড়ি। আমাদের বাড়ীর ঠিকানাও লিখে দেব। আপনি হেরে গেলেন ছি, ছি। কেননা আপনি এলেন না। ”

অবশেষে এল সেই কাঙ্খিত প্রহর । দেখা হল দুজনায় । দিনটা কি রবীন্দ্রনাথ ভুলতে পেরেছিলেন ? না পারেননি , পারেননি তার অবশ্য আর একটি কারণ আছে ।

সাল ১৯১৮ – প্রকাশিত হচ্ছে “পলাতকা”, “গুরু” , Gitanjali and Fruit- Gathering ,Lover’s Gift and Crossing ,The Parrot’s Training , Mashi and Other Stories , Strories from Tagore …

দিনটা ছিল ১৫ ই মে – ইতিমধ্যে রাণু কলকাতায় এসেছে , উঠেছে সপরিবারে ল্যান্সডাউন রোডের একটা ভাড়া বাড়িতে , বাবা ফণীভূষণের দারুণ অসুখ । রাণুর যে আর তর সইছিল না । তাই তো সন্ধ্যায় সোজা চলে আসলে জোড়াসাঁকোতে । রবীন্দ্রনাথকে দেখে কি অবাক হল রাণু ? না একটুও হয়নি । সে যে তার মনের খাতায় এমনি ছবি এঁকেছে আনমনে । সেই “ছবির সাথে এই মানুষটির দারুণ মিল । ”

ছুটে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের হাতের উপর হাত রাখল রাণু । কী অনুভূতি হয়ে ছিল রবীন্দ্রনাথের ? তাঁর ভাষাতেই শোনা যাক –
” আমি যখন তোমাকে লিখেছিলুম যে , আমাকে তুমি নারদ মুনি মনে করে হয়ত ভয় করবে , তখন আমি কত বড় ভুলই করেছিলুম – আমি যে ছফুট লম্বা মানুষ , এত বড় গফ-দাড়িওয়ালা কিম্ভূতকিমাকার লোক , আমাকে দেখে তোমার মুখশ্রী একটুও বিবর্ণ হল না , এসে যখন আমার হাত ধরলে , তোমার হাত একটুও কাঁপল না , অনায়াসে কথাবার্তা আরম্ভ করে দিলে , কণ্ঠস্বরে একটুও জড়িমা প্রকাশ হল না – কী কাণ্ড বলো দেখি ?”
সেদিন কতক্ষণ ছিল রাণু ? সে খবর এখনও অবধি খুঁজে পাইনি । কিন্তু , রাণুকে প্রথম দেখেই রবীন্দ্র- হৃদয় উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল প্রচণ্ড ভাবে । কেন জানেন ?

প্রসঙ্গটি একটি মজার ঘটনার ভেতর দিয়ে শুরু করি –
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে এক দাসী হটাৎ একদিন অতি চিত্কার করে উঠে দাঁতে দাঁত লেগে অজ্ঞান হয়ে গেল ৷ নানান চেষ্টা করে জ্ঞান ফেরানোর পর সে বললে : সে নাকি কাদব্মরী দেবীকে দেখতে পেয়েছে ৷ আত্মঘাতীর আত্মা নাকি শান্তি পায় না, সে বার বার ফিরে আসতে চায় প্রিয়জনদের কাছে ৷ তার প্রিয় ঘরবাড়িতে৷ কাদম্বরী দেবীকে নিয়ে একটা আতঙ্ক ঠাকুরবাড়ির দাস দাসীদের মধ্যে ছিলই৷ কেউ সচারচর যেত চাইত না সেই ঘরের দিকে যে ঘরে কাদম্বরী আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন৷
যে দাসীটি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে শেষ পর্যন্ত রহস্যটি বোঝা গেল৷ কাদম্বরীর প্রেতমূর্ত্তি নয়, সে দেখেছে আসলে রাণুকে৷ অবশ্য দাসীর আতঙ্কিত হওয়াটা খুব অস্বাভাবিক ছিল না৷ যদি কাদম্বরী দেবী ও কিশোরি রাণুর ছবি পাশাপাশি রেখে দেওয়া যায় তবে দুজনের মুখের সাদৃশ্য দেখে বিস্মিত হতে হবেই৷ ফলে জোড়াসাঁকোর বাড়ির অলিন্দের আলোছায়া একটি নিরক্ষর সংস্কার প্রচ্ছন দাসীর ক্ষেত্রে রাণুকে হটাৎ দেখে কাদম্বরীর প্রেতমূর্ত্তি মনে হওয়াটা খুব অস্বাভাবিক নয়৷
শুধু এই নিরক্ষর দাসীর নয়, অনেক উচ্চশিক্ষিত সংস্কার মুক্ত মনের একাধিকবার বিভ্রান্ত হতে দেখা গেছে রাণুকে প্রথম দেখার পর৷
এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কৃষিবিজ্ঞানী এলমহার্স্ট বলেছিলেন:
“The girl(Rani) so vividly brought back to Tagore memory of his boyhood compandon that he begged the forther to leave her behind as a guest of the poet’s hoise. The relationship that developed was deep
and lasting.”

হ্যাঁ সেই প্রথম দেখার দিনেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর হারানো বৌঠানকে মুগ্ধ চোখে প্রত্যক্ষ করেছেন – আর রাণু যখন অষ্টাদশী ঠাকুর বাড়ির মেয়ে মহলে তো রাণুকে নিয়ে হই চই পড়ে গিয়েছিল , কাদম্বরী আবার ফিরে এসেছে বলে ।
পরের দিনটি অর্থাৎ ১৬-ই মে , রবীন্দ্র – জীবনে একটি দারুণ দুঃখের দিন – ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল রবীন্দ্র- হৃদয় আর সেই দিন থেকেই রবীন্দ্র-জীবনের পরিপূরক হয়ে ওঠে রাণু ।

এমন কি ঘটেছিল সেই দিন ? আর কিভাবেই বা রাণুর ভানুদাদাকে রাণু আবার জীবনের মূলস্রোতে ফিরিয়ে দিল ?কেনই বা ভানুদাদা 1918 সালের ২0-শে ফেব্রুয়ারী রেণুকাকে লিখেছেন, ” দোষ আসলে আমার৷ তুমি সেই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেইছ তখন না হয় আর ত্রিশ চল্লিশ বছর আগেই জন্মাতে৷ ” এই চিঠির শেষে লেখা- ” তোমর প্রাচীন বন্ধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “৷

1918 এর 12ই জুলাই রবীন্দ্রনাথকে প্রায় হুকুম করে কেন রাণু লিখেছে: ” হ্যাঁ শুনুনু কেউ বয়েস জিজ্ঞেস করলে বলবেন সাতাশ ৷” ?রবীন্দ্রনাথ যে বয়সের এই পরিবর্তন স্বীকার করে নিয়েছেন তার প্রমাণ 28শে আগষ্ট , 1918 সালে রাণুকে লেখা চিঠি – “….. কিন্তু যখন থেকে তোমার পঞ্জিকা অনুসার আমার ‘সাতাশ’ বছর বয়স হয়েছে তখন থেকেই বয়সের মানে আপনি ধরা দিয়ে কেটে বেড়াবার আর পথ পাইনি৷ ”

এই সব নিয়ে পরবর্তী অংশে আলোচনা করবো ।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার – চিঠিপত্র , পৃথ্বীরাজ সেন , প্রশান্ত কুমার পাল , এবং বরুণ চট্টোপাধ্যায়

(চলবে )