জানুয়ারি ২০, ২০১৭ তারিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫ তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিবেন ডোনাল্ড জুনিয়র ট্রাম্প। এ বছরের আটই নভেম্বর হয়ে যাওয়া নির্বাচনে প্রায় ত্রিশ লক্ষ ভোট কম পেয়েও ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটের কারণে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিতে যাচ্ছেন আবাসন ব্যবসায়ী ট্রাম্প। নোংরা আদর্শ দিয়ে মানুষের মাঝে বিভক্তির ডাক দেওয়া ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণা জুড়ে ছিলো মেক্সিকো সীমান্ত জুড়ে দেওয়াল তৈরির মাধ্যমে অবৈধ অভিবাসন বন্ধের অযৌক্তিক দাবী। নিজে অভিবাসী পরিবারের সন্তান এবং তার তৃতীয় স্ত্রী অভিবাসী হওয়া সত্ত্বেও ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণা পরিপূর্ন ছিলো অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্র ধ্বংস করে দিচ্ছে এমন অভিযোগ, কঠোর অভিবাসন আইন প্রয়োগ এবং প্রয়োজনে সমর্থকের দিয়ে সেই আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমেরিকাকে সাদা বা ‘গ্রেট’ বানানোর ইচ্ছা, ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে আমেরিকাকে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ থেকে রক্ষা, চীন, মেক্সিকো থেকে অল্পশিক্ষিত সাদাদের জন্য কারখানার চাকরি ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে আমেরিকার অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা, পৃথিবীকে ইচ্ছামতো উষ্ণ করার ক্ষমতা এবং হিলারিকে জেলে ঢোকানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া। প্রায় ষোলমাস ব্যাপি ঘৃণা উৎপাদনের নির্বাচনী প্রচারণার মাধ্যমে তিনি একত্রিত করেতে সক্ষম হয়েছেন মানবতার, পরিবেশের জন্য যা কিছু খারাপ এমন কিছু শক্তিকে। বন্যা আহমেদ তাঁর “দুই আমেরিকা” লেখায় বলেছেন ‘গণতন্ত্র’ বেশ মজার একটা ধারণা যার মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে স্বৈরতন্ত্রের বৈধতা দিয়ে দেওয়া যায়। তবে আমেরিকার অদ্ভূত ইলেকটরাল ভোটের কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠদেরও অগ্রাহ্য করা যায়। আমেরিকার সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনেও আমরা তাই দেখলাম, গণতন্ত্র দিয়ে সেখানে হালাল করা হলো প্রগতির পথে অন্তরায় অন্ধকার আদর্শগুলোকে। গণতন্ত্রের জামা পরিয়ে নিয়ে আসা হলো স্বৈরাচারি হবার স্বপ্নে বিভোর, স্বেচ্ছাচারী, মিথ্যাবাদী এক ভণ্ডকে।

হিটলারের আদর্শের অনুপ্রাণিত, পুতিন প্রেমে অন্ধ ট্রাম্পের হাতে বিধ্বংসী নিউক্লিয়ার মরনাস্ত্রগুলোর চাবি যদি তুলে দেওয়ার রায় দিয়েছে মার্কিন জনগণ যে হাতের গর্বিত ইচ্ছের একটি ছিলো বিনা অনুমতিতে নারীদের যৌনাঙ্গ স্পর্শ। ট্রাম্প ট্রেনের জয়ে বিব্রত বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা তাই নিজেকে এবং সবাইকে সান্ত্বনা দিতে বলেছেন- ‘যতো যাই কিছু হোক সূর্য ঠিকই উঠবে’। ট্রাম্পের হাতে পৃথিবীর অন্যতম ক্ষমতাবান রাষ্ট্রের ক্ষমতা তুলে দেবার সিদ্ধান্তের পরদিন শোকাতুর বিদায়ী রাষ্ট্রপতি নিজেকে এবং পৃথিবীকে সান্ত্বনা দেবার জন্য “সূর্য উঠবে” ছাড়া আর ভালো কিছু বলতে পারেন নি। পৃথিবী যখন ট্রাম্প সমস্যায় আক্রান্ত হবার জন্য রায় দিয়েছে তখন উদারপন্থী রাজনীতির এই কাণ্ডারি সমাধানের পথ দেখাবার বদলে দৃষ্টি ফেরাতে বলেন সূর্য ওঠার মতো ভিন্ন একটি বিষয়ে। তবু সেটা যদি সত্য হতো, কারণ সূর্য উদয় হয় বা অস্ত যায় না, আহ্নিক গতির কারণে পৃথিবীতে দিন ও রাত হয়। ডেমোক্রেটিক রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হিলারিও এমন ফাঁকা বুলির উপর ভর করেই ট্রাম্পকে হারিয়ে দিতে পারবেন ভেবেছিলেন, তার ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় ওবামা হিলারি প্রশাসনের নেওয়া নীতিগুলোর ব্যর্থতা, সমস্যার গভীরে ঢুকে, উপযুক্ত বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমাধানের পথ সন্ধানের বদলে বিভিন্ন সুবিধাভোগী মহলকে খুশি রাখার রাজনীতি করা, বাংলাদেশের গরীবের পাতের ভাত কেড়ে নেবার অর্থনীতির আবিষ্কারক ডক্টর ইউনুস থেকে শুরু করে সৌদি আরব, কাতার, কুয়েতের ধনকুবেরদের কাছ থেকে ক্লিনটন ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে অর্থ গ্রহণ করা, আবার একই সাথে এদের সুবিধার জন্য স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রভাব ব্যবহার করা, ধর্মীয় উগ্রপন্থার সাথে জড়িত বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে অস্ত্র চুক্তি করা, সর্বোপরি অর্থনীতি, স্বাস্থ্য সেবা, আবাসন, নিরাপত্তার ক্ষেত্রগুলোতে ক্রমশ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে ওঠা চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার জন্য ‘নতুন’, ‘যৌক্তিক’, ‘গ্রহণযোগ্য’ পথ দেখানোর ব্যর্থতায় ভারী ছিলো হিলারির নির্বাচনী প্রচারণা।

hr2

ছবি: হিলারীর ইমেইল স্ক্রিনশট। ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে গ্রামীনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দুই কোটি টাকার অনুদানকারী ডক্টর ইউনুসের পক্ষে লড়তে রাজি হিলরি, কি করা যায় তা জানতে লিখেছেন তার স্টেট ডিপার্টমেন্ট সহকারীকে অবশ্যই মুদ্রার অপর পিঠে কি আছে সেটা জানার আগেই।

একই সাথে ছিলো সংবেদনশীল ইমেইল নিয়ে স্বচ্ছতার অভাবের অভিযোগ। এত কিছুর পরেও হিলারির মুখে মধু ছিলো, সে মধুতে প্রগতির কথা ছিলো, যুদ্ধহীন পৃথিবীর কথা ছিলো, বৈশ্বিক উষ্ণায়ণের চ্যালেঞ্জ এবং পরিত্রাণের কথা ছিলো, ছিলো সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিতের কথা, ছিলো সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবার কথা। সে মধুর জোরে হিলারি সম্মিলিত ভোট গণায় জিতে গিয়েছিলেন বটে কিন্তু ইলেক্টোরাল কলেজ যা রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে, সেই ইলেক্টোরাল ভোটের হিসেবে ট্রাম্পের কাছে হেরেছেন হিলারি। যে কারণে ট্রাম্প হবেন যুক্তরাষ্ট্রের পঁয়তাল্লিশতম রাষ্ট্রপতি।

poty
ছবি: টাইম ম্যাগাজিনের ‘পারসন অফ দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হয়েছেন বিভক্ত আমেরিকার ভবিষ্যত রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প।

কি এই ইলেক্টোরাল ভোট?

গণতান্ত্রিক ধর্মে বিশ্বাসী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবে, বলে; পৃথিবীব্যাপী গণতন্ত্র বিস্তারে অনেক ভূমিকা রেখে চলছে তা আমরা সবাই জানি। গণতন্ত্র মানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যা ঠিক বলে রায় দিবে তাই সঠিক। কিন্তু আমেরিকার মতো প্রচণ্ড গণতন্ত্র বিশ্বাসীরাও খুব ভালো করেই জানেন সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত সবসময় সত্য বা সর্বোত্তম পন্থা নাও হতে পারে। একটা সময় সংখ্যাগরিষ্ঠ’রা মনে করতেন পৃথিবী নয় সূর্য ঘোরে, তা আমদের মননে এখনও এমনভাবে গেঁথে আছে যে আমরা সূর্য অস্ত যায়, উদয় হয় বলি বিনা দ্বিধায়। আর তাই আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা পিতা’রা এই সংখ্যাগরিষ্ঠরা যেনো কখনও ভোট দিয়ে ট্রাম্প কিংবা হিটলারের মতো কাউকে নির্বাচিত করে না বসে তা থামানোর জন্য তৈরি করেছেন ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটিং সিস্টেম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ইলেক্টোরাল কলেজ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি এবং সহ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের অপ্রত্যক্ষ পদ্ধতি। এ পদ্ধতি অনুযায়ী প্রতিটি রাজ্যে বসবাসকারী মানুষ নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি ও সহ রাষ্ট্রপতিকে ভোট দিলেও তারা মূলত ভোট দেন তার রাজ্যের ইলেক্টরদের। যারা জনগণের পক্ষে ভোট দিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করার দায়িত্ব পালন করেন। মূলত জনসংখ্যার উপর ভিত্তি করে প্রতিটি রাজ্যের ইলেক্টর সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। আমেরিকার সবচেয়ে ঘণবসতিপূর্ণ রাজ্য ক্যালিফোর্নিয়ার রয়েছে ৫৫ টি ইলেক্টোরাল ভোট। এখানে আবার একটা ছোট কিন্তু রয়েছে। ক্যালফোর্নিয়ায় প্রতি সাত লক্ষ ভোটারের বিপরীতে একজন ইলেক্টর কিন্তু ছোট এবং কম ঘনবসতিপূর্ণ রাজ্য ওয়াইওমিং এ প্রতি দুই লক্ষ ভোটারের জন্য একজন ইলেক্টর। এমনটা করা হয়েছে রাষ্ট্রপতি বাছাইয়ে ছোট রাজ্যগুলোর ভোটকে গুরুত্বপূর্ণ করার জন্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোমোট ৫৩৮ টি ইলেক্টোরাল ভোটের মধ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে এবার ট্রাম্প পেয়েছেন ৩০৬ টি, ভোট যদিও ২৭০টি’ই যথেষ্ট।

অর্থাৎ গণতন্ত্রের আস্থা নেই স্বয়ং গণের উপরেই! ডেমাগগদের রাষ্ট্রপতি হবার পথ কণ্টকাকীর্ণ করতে যে পদ্ধতি সে পদ্ধতি ২০১৬ এর নির্বাচনে নিয়ে আসলো ঘৃণা ও সঙ্কীর্ণতার চাষ করে জনপ্রিয়তা অর্জন করা এমন একজনকেই।

ভোটের আগে, পরে দুই সময়েই ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তৃতীয় রাষ্ট্রপতি প্রার্থীদের বিতর্কে উপস্থাপক ক্রিস ওয়ালেস ট্রাম্পের কাছে সরাসরি জানতে চেয়েছিলেন ফলাফল যাই হোক না কেনো, তিনি নির্বাচনের ফলাফল গ্রহণ করবেন কিনা। হেরে যাবেন বলে ভেবে রাখা ট্রাম্প সেরাতে প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেছেন, যে তিনি ফলাফল মানবেন কি মানবেন না জানার জন্য নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত সবাইকে সাসপেন্সে থাকতে হবে। পরের দিন নির্বাচনী র‍্যালিতে এর অর্থ পরিষ্কার করে ট্রাম্প বলেছিলেন, ফলাফল তিনি মানবেন, অবশ্যই মানবেন, যদি তিনি জয়ী হন।

নিজের জয়ের ব্যাপারে তখন সন্দেহে থাকলেও ট্রাম্প ঠিকই জিতে গেছেন এবং তার ‘প্রতিশ্রুতি’ মোতাবেক ফলাফলও মেনে নিয়েছেন। ডিসেম্বরের নয় তারিখে বারাক ওবামা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে রাশিয়া সাইবার আক্রমণের মাধ্যমে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জিততে সহায়তা করেছে কিনা তা তদন্ত করার আহবান জানিয়েছিলেন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে। সেই প্রতিবেদন পেয়ে রাষ্ট্রপতির নির্বাহী ক্ষমতা ব্যবহার করে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি। রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবি সহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করা রাশিয়ার ৩৫ জন কূটনীতিককে আমেরিকার নির্বাচনে সাইবার হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রে ত্যাগ সহ, রাষ্ট্রের সাথে সকল সম্পর্কের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা যার মধ্যে অন্যতম।

ট্রাম্প নিজেই নির্বাচনী প্রচারণার সময় রাশিয়াকে অনুরোধও করেছিলেন সাইবার আক্রমণ পরিচালনার জন্য। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দেওয়া রিপোর্ট সম্পর্কে পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ি এবারের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে পুতিনের হুকুমে রাশিয়ার গোয়েন্দারা ডেমোক্রেটিক এবং রিপাবলিক্যান দুই দলের ইমেইল ডাটাবেইজ হ্যাক করলেও শুধুমাত্র ডেমোক্রেটদের ইমেইল তুলে দিয়েছে উইকিলিকসের হাতে। যার মাধ্যমে লাভবান হয়েছেন ট্রাম্প।

ট্রাম্পকে সাহায্য করেছে পুতিন, যদিও ট্রাম্প এখন আর স্বীকার করতে চান না যে রাশিয়া আমেরিকায় সাইবার আক্রমণ করেছে। এতে পৃথিবীর সব রুশপন্থী বামরাজ্যবাদীরা বেকায়দায় পড়েছে। একদিকে ট্রাম্পকে অপছন্দ, অন্যদিকে পুতিনকে পছন্দ। কি বাছবে? একইসাথে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর আমেরিকার দর্শনকে প্রতিনিয়ত পালটে দিচ্ছেন ট্রাম্প। যে রোনালড রেগানকে রিপাবলিকানরা পুজা করে এইজন্য যে সে দীর্ঘ ঠাণ্ডা লড়াইয়ের পরে সোভিয়েত ইউনিয়নকে হারিয়ে দিয়েছে বা ভেঙে দিয়েছে, সেই রিপাবলিকানদেরই এখন রুশঢেঁকি গিলতে হচ্ছে কারণ এই মার্কিন নির্বাচনে রুশ দেশের হস্তক্ষেপ রয়েছে, কিন্তু তারা এই নিয়ে উচ্চবাক্য করতে চাইছে না। রেগান-রিপাবলিকানদের কি হাস্যকর দশা!

ভুয়া খবর

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের পর খবরের শিরোনাম হয়েছে ফেসবুকে ছড়ানো ভুয়া খবর মহামারী। যদিও আমাদের কাছে ভুয়া খবর নিত্যদিনের ব্যাপার। ভুয়া খবরের জোরে বাংলাদেশে প্রায়ই সাম্প্রদায়িক হামলা হচ্ছে, খুন হচ্ছে, ধর্ষককে, খুনীকে দেখা যাচ্ছে চাঁদে। ফেসবুকে ধর্ম অবমাননাকর (!) ভুয়া পোস্ট করে সেটা ছড়িয়ে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ২০ টি ঘর এবং পাঁচটি মন্দিরে হামলা করা হয়েছে। ভুয়া খবরের শক্তি এতোটাই যে এই বাংলাদেশে অনেকেই বিশ্বাস করেন ২০১৩ সালের পাঁচই মে হেফাজতে ইসলামের মতিঝিলের সমাবেশে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল আইনশৃংখলা বাহিনী। অসংখ্য ভিডিও, ছবি, প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা, প্রমাণ থাকার পরেও আমরা দেখেছি অনেকেই বাঁশেরকেল্লা নামক জামায়াত ইসলামের ফেসবুক মুখপত্র পেজের আশুলিয়া বেড়িবাঁধে হাজার হাজার লাশ পড়ে থাকার মিথ্যে কথার উপরেই বেশি আস্থা রেখেছেন।

এবারের আমেরিকার নির্বাচনেও ছিলো ভুয়া খবরের জয় জয়জয়কার। সবই মূলত ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হিলারির বিভিন্ন গোপন অপরাধ (ভিডিও সহ), যেগুলো মুহুর্মুহু ফেসবুকে শেয়ার হয়েছে, কোটি মানুষ পড়েছে, বিশ্বাস করেছে যা দিন শেষে গতি দিয়েছে ট্রাম্প ট্রেনকে আর পকেট ভারী করেছে ভুয়া খবর লেখকদের।

ভুয়া খবরের প্রতি মানুষের এতো আগ্রহের কারণ অজানা নয়। আমরা প্রমাণ, যুক্তি খুঁজে কোনো বিষয়ের উপর আস্থা রাখার বদলে হিলারীর ইউনুস সম্পর্কিত ইমেইলের মতো শুরুতে বিষয়টির উপর আস্থা না অনাস্থা রাখবো এটা ঠিক করে তারপর আমাদের অবস্থানের সার্থকতা সবার কাছে বা নিজের কাছেই উপস্থাপনের জন্য প্রমাণ ও যুক্তি খুঁজে বেড়াই। আর এখানেই আমাদের খাদ্য দিতে এগিয়ে আসে ভুয়া খবর লেখকরা। অনেক সময় এতটুকু কষ্টও আমাদের কাছে বড় কষ্ট হয়ে দেখা দেয়। তাই আমরা মানুষেরা সংগঠন করি। আমাদের সংগঠনগুলো আমাদের বিভিন্ন মৌলিক প্রশ্নের উত্তর বলে দিয়ে আমাদের চিন্তা করার কষ্ট থেকে বাঁচিয়ে রাখে, সংগঠনগুলো আমাদের নৈতিকতা শেখায়, শেখায় কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, মানুষ হিসেবে আমরা কোনটি গ্রহণ করব আর কোনটি বর্জন করব। এভাবে আমরা একত্রিত হয়ে নানা ধরনের দল তৈরি করি, এবং নিজের দলের সকল অবস্থান সত্য বলে মনে করি, তা আদৌ সত্য কিনা সেটা যাচাই করার তোয়াক্কা না করে।

ট্রাম্প ট্রেনেও আমাদের মতো মানুষেরাই আছেন। যারা মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে মেক্সিকো সীমান্ত জুড়ে দেওয়াল তৈরির মাধ্যমে, ঘাড় ধরে সকল অবৈধ অভিবাসীদের বের করে দেবার মাধ্যমে, ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ শেষ হবে সকল মুসলমানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাড়িয়ে দিয়ে। আমেরিকার মতো বাংলাদেশেও ট্রাম্প ট্রেনের যাত্রি সংখ্যাটা কম নয়, আদর্শ ভিন্ন হলেও কর্মপন্থা একই।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হবার পর ডোনান্ড ট্রাম্প প্রথমবারের মতো সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন বারাক ওবামার। নির্বাচনের আগে ওবামা বলেছিলেন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হবার কোনো যোগ্যতা ট্রাম্পের নেই। নভেম্বরের দশ তারিখে হোয়াইট হাউজে সাক্ষাৎকারের পর ওবামা সুর পালটে বলেছেন ট্রাম্প সফল হলে সফল হবে আমেরিকা। ট্রাম্প ইতিমধ্যেই তার ভয়ংকরতম নির্বাচনী ইশতিহারগুলো সফল করার জন্য নিয়োগ দেবার সূচনা করেছেন ট্রাম্প ট্রেনের চালকদের। নির্বাচনের আগে তিনি তার সমর্থকদের আশা দেখিয়েছিলেন সরকারের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি যোগ্যতম প্রার্থীদের নিয়োগ দিবেন। তবে যোগ্যতার অর্থটাই কেবল একটু ভিন্ন হবে।

ট্রাম্পের কাছে বৈশ্বিক উষ্ণয়ণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ধ্বংসের জন্য করা চীনা ফন্দি। ভুয়া খবরের দোহাই দিয়ে বাস্তবতাকে অস্বীকার করে ট্রাম্প ট্রেন তা তো আমরা জানি। আর তাই পরিবেশন সংরক্ষণ এজেন্সি (ইপিএ) এর দায়িত্ব ট্রাম্প দিচ্ছেন আরেক বৈশ্বিক উষ্ণতার বাস্তবতা বিরোধী স্কট প্রুয়িটকে। ওকলাহোমা রাজ্যের এই এটর্নি জেনারেল তেল কোম্পানির পক্ষে কাজ করেছেন, মামলা করেছেন ইপিএ এর পরিবেশ রক্ষার বিভিন্ন প্রজেক্টের বিরুদ্ধে। ট্রাম্প ট্রেনে তিনিই রক্ষা করবেন পরিবেশ। ডেইলি শো এর উপস্থাপক ট্রেভোর নোয়া তাই ভুল মন্তব্য করেন নি, স্বাগতম ট্রাম্প প্রশাসনে, যেখানে বৈশ্বিক উষ্ণতা মিথ্যা কিন্তু রেসলিং সত্য!

হ্যাঁ, ওয়ার্ল্ড ওয়াইড রেসলিং (WWE) এর সহ প্রতিষ্ঠাতা লিন্ডা ম্যাকমাহন পেয়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রশাসন। হিলারি ফাউন্ডেশনের দুর্নীতি নিয়ে মুখ ব্যথা করে ফেলা ট্রাম্প তার ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে লিন্ডার স্বামীর কাছ থেকে নিয়েছিলেন ২৫ মিলিয়ন ডলার অনুদান। লিন্ডা নিজেও ডোলান্ড ট্রাম্পের সমর্থক এবং প্রায় ছয় মিলিয়ন ডলার খরচ করেছেন ডোলান্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায়। অনেকটা তৃতীয় বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাজনীতি খেলার মতো তিনি তার বন্ধুত্বের এবং সর্বোপরি টাকার মূল্য পেয়েছেন।

ট্রাম্পের প্রধান স্ট্রাটেজিস্ট হবেন স্টিভ ব্যানোন, সাদা বর্ণবাদী, নারী বিদ্বেষী, সমকামী অধিকার বিরোধী স্টিভ পরিচালনা করতেন ব্রেইটব্র্যাট নামে সংবাদমাধ্যম। যাদের উল্লেখযোগ্য শিরোনাম হলো- “আপনি কী চান? আপনার সন্তান নারীবাদী হবে না তার ক্যান্সার হবে?”, “ জন্মনিয়ন্ত্রণ নারীকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে বিকৃত করে”, “কালো সংবাদকর্মীর হাতে খুন হলেন তার সাদা সহকর্মী (ভিডিও সহ)”! ট্রাম্প টেনের স্ট্রাটেজি ঠিক করার দায়িত্ব পাবার পর আমেরিকান বাঁশেরকেল্লা’র এই এডমিন বলেছেন- “Darkness is good, Dick Cheney. Darth Vader. Satan. That’s power.”

zgv29jxfzgc0ikisykte
ছবি: স্টিভ ব্যানোনের পত্রিকার উল্লেখযোগ্য কিছু শিরোনাম

আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট, ডিফেন্স ডিপার্টমেন্ট, এনএসএ, সিআইএ, এফবিআই সহ সকল গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট পর্যালোচনা করে তা রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপনের কাজ করেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। ট্রাম্প যে কাজের জন্য পছন্দ করেছেন জেনারেল মিশেল ফ্লিন কে যিনি সেনাবাহিনীর ইন্টেলিজেনস ডিপার্টমেন্টে থাকার সময় অবৈধ মিশন, তথ্য পাচারের ফলে কর্মক্ষেত্রে তদন্তের সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং তার সাথে কাজ করা একজন বরাত দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, অনেক সময়ই গোয়েন্দা রিপোর্টের উপর “দিস ইজ বুল শিট’ লিখে দিয়ে কাজ সেরে ফেলতে ওস্তাদ ছিলেন ফ্লিন। ফ্লিনের কাছে তবে কোন তথ্য বুল শিট নয়? তার জন্য যেতে হবে তার টুইটারে যেখানে তিনি ২০১২ এর নির্বাচনের পর বলেছেন, বারাক ওবামাকে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ভোট দিয়েছে কারণ তিনি কালো বলে, তার নীতির জন্য নয়। এছাড়াও রয়েছে, “হিলারি ইসলামী জঙ্গিদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে হিজাব পরেছেন”। শুধু জেনারেল ফ্লিন নন তার সুযোগ্য ব্যাটা মাইকেল ফ্লিন টুইটারে ওয়াশিংটন ডিসির পিজা এন্ড পিংপং পার্লারে হিলারি ক্লিনটন শিশু পর্ণগ্রাফির ব্যবসা করেন এমন খবর প্রচার করার পর নর্থ ক্যারোলিনার এক ব্যক্তি সেই পিজার দোকানে গিয়ে সশস্ত্র হামলা করেন গত সপ্তাহে। ট্রাম্প যিনি নিজেও এই ভুয়া খবর প্রচারে সময় দিয়েছিলেন নির্বাচনের আগে, যদিও এখন বিব্রত হবার ভান করে ফ্লিনের ছেলেকে তার ট্রাঞ্জিশন টিম থেকে বাদ দিতে বাধ্য হয়েছেন।

বারাক ওবামা তাই আমাদের যতোই সূর্য ওঠার আশা দেখান না কেনো ট্রাম্প ট্রেনের গন্তব্য স্বাধীনতা, প্রগতি নয়। ফ্যাসিবাদ আবার দানা বাধছে পৃথিবী জুড়ে, বাড়ছে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ, যুদ্ধ, হানাহানি, নিহত হচ্ছে নিরপরাধ মানুষ, ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ, প্রতিনিয়ত বাড়ছে তাপমাত্রা। তাই সূর্য উঠবে এই ভাবালুতা করে বসে থাকার সময় এটা নয়। আমাদের বসে থাকার সুযোগে, ভুয়া খবরে মানুষজনকে আলোড়িত করে যেতেই থাকবে হিটলার, ট্রাম্প, জামায়াত ইসলামীরা। এরপর সেইসব মানুষের ভোটে হালাল করা হবে বর্ণবাদ, ধর্মান্ধতা, মানবতা বিরোধী কর্মকাণ্ড। আমাদের তাই প্রত্যেকের অবস্থান থেকে ট্রাম্প ট্রেন বা অন্ধকারের সকল ট্রেন যাত্রীদের কাছে যেতে হবে বিজ্ঞান, যুক্তি, মানবতার কথা নিয়ে। তাদের সামনে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করতে হবে, যুক্তি দিয়ে দেখাতে হবে প্রগতির পথ। সূর্য উঠবেই বলে চ্যালেঞ্জ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাখার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে, প্রগতির পক্ষে দাঁড়াবার এখনই সময়। নতুবা আমেরিকার মতো করে পৃথিবীর আনাচে কানাচে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসতেই থাকবে ট্রাম্পরা। ট্রাম্পদের তৈরি করা ঘৃণার দেওয়াল, সীমাবদ্ধতার দেওয়ার ভাঙ্গতে হবে আমাদেরই।