tagore-collins

মুলঃ মাইকেল কলিন্স
অনুবাদঃ নৃপেন্দ্রনাথ সরকার ও মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন

প্রথম অংশঃ ধর্ম এবং পূনর্গঠন, উনিশ শতকে রবিঠাকুরের উত্তরাধিকার

উপনিষদে বর্ণিত ভারতীয় মুনি-ঋষিদের মুখনিঃসৃত বাণী থেকে সৃষ্ট ধর্মের ভিত্তিতে দেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথিকৃত পরিবারে আমার জন্ম। কিন্তু আমার স্বভাব, মেজাজ, এবং চিন্তা-চেতনা একান্ত আমার। ফলে আমার চারপাশের লোকেদের ধর্ম বিশ্বাসকে সত্য হিসেবে মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমি কল্পনা করার চেষ্টাও করতে পারিনি যে কাউকে বিশ্বাস বা শ্রদ্ধা করলে তাঁর ধর্মীয় মূল্যবোধকেও গ্রহণ করতে হবে১।
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, একজন শিল্পীসত্ত্বার কাছে ধর্ম।

এই বইটির আলোকপাত মূলত ১৯১২ থেকে ১৯৪১ সালঃ ইংরেজী ভাষায়ও একজন লেখক হিসেবে রবিঠাকুরের প্রথমবার পাশ্চাত্য ভ্রমণ থেকে তাঁর মৃত্যুর বছর পর্যন্ত। বেশীর ভাগ আলোচনাই সাম্রাজ্যবাদ এবং জাতীয়তাবাদের উপর রবিঠাকুরের লেখা এবং পাশ্চাত্যের শিল্পী সমাজের সাথে তাঁর ভাব-বিনিময় নিয়ে হলেও উনবিংশ শতাব্দীর বংগদেশ পটভূমিতে তাঁর অবস্থান নির্ণয় করাও প্রয়োজন। সারা জীবন তাঁর কর্ম এবং লেখনীর মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে যুক্তিসংগতভাবে একজন প্রান্তিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেই তুলে ধরেছেন। তারপরেও যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং চিন্তাশীল পরিবেশের মধ্য থেকে তিনি বেরিয়ে এসেছেন এবং কলকাতার বনেদী সমাজের যে অংশটা আন্তঃদেশীয় আন্দোলনের উন্মেষ ঘটিয়েছিল তা জানা না থাকলে রবিঠাকুরকে উপলব্ধি করা কঠিন।

শুধুমাত্র কলকাতার আধুনিক উপনিবেশিকতার কারণে বাংলার চিন্তাচেতনা, সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় ইতিহাসকে মূল্যায়ন করা যাবে না। উনবিংশ শতাব্দীর চিন্তাচেতনা, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের প্রানকেন্দ্র কলিকাতা ছিল উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির প্রধান ঘাটি। শুধুমাত্র শহরের বুদ্ধিজীবি শ্রেণীই নয়, এখানে সব কিছু মিলেই একটি ঔপনিবেশিক বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়; এক আলাদা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত বংগ সংস্কৃতি এবং বুদ্ধিজীবি সম্প্রদায় গড়ে উঠে। সংক্ষেপে ডেভিড কফের ভাষায়, “জাতীয়তাবাদী দ্বৈত সত্ত্বাকে” উৎখাত করার জন্য “হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদ” এবং “বিশ্ব মানবতাবোধ”২ আদর্শের আলোকে গঠিত হয় “নব্য সংস্কারকের”। এ অধ্যায়টির মূল বিষয়বস্তু হলো ইতিহাসের নানাবিধ উপাদান খতিয়ে দেখা। খতিয়ে দেখা হবে কেশব চন্দ্রের বিশ্বমানবতা ও বৈষ্ণববাদের সাথে উপনিশদের আধুনিক মানবতাবাদের মিশ্রণ৩। মূলতঃ এই পটভূমিই রবিঠাকুরকে পাশ্চাত্য “চেতনায়” উদ্বুদ্ধ করে।

ধর্মীয় আবরণের মাঝ থেকে রবিঠাকুর মনুষ্য প্রকৃতি উপলব্ধি করেছেন। তাঁর চেতনাবোধ উপলব্ধির মাধ্যমেই কেবল আমরা তাঁর প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে পারি। মানুষের স্বভাব বা প্রকৃতিবোধের উপর নানা দার্শনিক তত্ত্ব বিদ্যমান। তন্মধ্যে রবিঠাকুরের দর্শন ছিল অনুধাবনমূলক। তিনি মমত্ববোধ দিয়ে মানুষকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। কল্যাণ সেনগুপ্তের মতে, রবিঠাকুরের দৃষ্টিতে মানুষ জড়বস্তু নয়, ‘মানুষের প্রতি মানুষের যথার্থ মমত্বই ভালবাসা, সবাই একই উপকরণ দিয়েই তৈরী’। ‘মানুষ একে অন্যের সাথে কঠিন বন্ধনে আবদ্ধ। এটা মমত্ববোধের অনুভূতি এবং এটাকে সহমর্মিতার অভিজ্ঞতা দিয়ে অনুধাবন করা যায়’৪। মানুষ ভালবাসা, আনন্দ, এবং শিল্প সৃষ্টি দিয়ে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে পারে। রবিঠাকুরের ‘জীবন ছিল আনন্দময়’। ‘উপনিষদ এবং গীতার ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতাকে তিনি অনুসরণ করেছেন’৫।

মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসাও একধরণের উপাসনা এবং মুক্তির পথ। আর এই ভালবাসা থেকেই সীমার মধ্যে অসীমের অনুভূতি সৃষ্টি হতে পারে। মানুষের মধ্যে একাত্মতাবোধ গড়ে তোলা এক চলমান প্রক্রিয়া। এই উপলব্ধি থেকে রবিঠাকুর জাতীয়তাবোধ আন্দোলনের অন্ধ সমর্থন ছেড়ে সংস্কৃতির বেড়া ডিঙ্গিয়ে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের মধ্যে ‘মনের বন্ধন’ এর প্রতি নিবিষ্ট হন। এটা ছিল তাঁর একান্তই নিজস্ব পথ। এবং এভাবেই তিনি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সহাবস্থানের সম্ভাবনা দেখেছেন। রবিঠাকুর এবং অন্যান্য সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্ব দ্বারা প্রভাবান্বিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক জনগোষ্ঠীর একাত্মতা বোধকে কেউ কেউ সমস্যার একটা চূড়ান্ত নিস্পত্তির পথ হিসেবেই দেখতেন। দত্তের যুক্তি হল, ‘রবিঠাকুর বিবর্তনের মধ্যেই পরিপূর্ণতার স্বপ্ন দেখতেন, মানবতাই চূড়ান্ত সত্য’। ‘মহাজাগতিক বিবর্তনই রবিঠাকুরের জীবন দর্শনের মূল নিয়ামক’৬। তিনি অনুভব করতেন সাম্রাজ্যবাদ বিভিন্ন কৃষ্টি এবং জাতির মানুষকে আন্তরিকতার সংস্পর্শে এনেছে বটে, কিন্তু তেমন কল্যাণ হয়নি। মানুষের লক্ষ্যপথ হল বৃহত্তর মিলন। এই মহা মিলন ঘটানোর দায় বর্তায় রবিঠাকুরের মত চিন্তাশীল এবং সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিদের উপর। এই আলোকেই রবিঠাকুর ব্রাহ্মবাদের শিক্ষা এবং জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের ধারণা থেকে ১৯১২ সালে পাশ্চাত্যের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন।

এ বিষয়গুলোর একটা ভূমিকা দেওয়ার জন্য, এই অধ্যায়ে উনবিংশ শতাব্দীর বংগদেশের চিন্তাশীলদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস থাকবে। মুখ্য বিষয় থাকবে চিন্তাশীল ব্যক্তি হিসেবে রবিঠাকুরের বেড়ে উঠা। এই লেখায় আরও থাকবে তাঁর উপর মুখ্য প্রভাবসমূহ, তাঁর কিছু স্ববিরোধিতা এবং কিছু অস্পষ্টতা। একটি বিশেষ অংশ জুড়ে থাকবে এমন কিছু ব্যক্তিত্ব যাঁরা নিজস্ব সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অবস্থান থেকে বাইরে থাকতে চেয়েছেন। শুরুতে থাকবে রামমোহন রায়। তিনিই সর্ব প্রথম পাশ্চাত্যের সাথে সহাবস্থানের সূচনা করেন। এর পর দেখা হবে উনবিংশ শতাব্দীতে বংগদেশে প্রথম সারির চিন্তাশীল এবং আধ্যাত্মিক আন্দোলন – ব্রাহ্ম সমাজ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। তারও পরে আসবে রবিঠাকু্র।

রামমোহন রায়ঃ ‘আধুনিক ভারতবর্ষের জনক’

স্বামী বিবেকানন্দের মতে, রামমোহন রায় (১৭৭২ – ১৮৩৩) ছিলেন ‘নতুন উদ্দীপনায় ভারত গঠনের প্রথম ব্যক্তিত্ব’৭। ইউরোপের প্রেক্ষিতে ম্যাক্স মুলারের মূল্যায়ন, ‘তিনিই প্রথম পূর্ব থেকে পশ্চিমে বিশ্বব্যাপী মিলনের হাত বাড়িয়ে দেন, শুরু হয় বিদ্যুৎ সঞ্চালনের মত নব উদ্যম, এবং এখন থেকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে চিন্তাধারার পারস্পরিক আদান প্রদান হবে’৮। উনবিংশ শতাব্দীতে তাঁর গভীর চিন্তাশক্তি এবং বিস্তৃত অবদানের জন্য বংগ সংস্কৃতিতে তাঁর অবস্থান ছিল বিশাল। রামমোহন রায়ের কর্মতৎপরতা শিক্ষা, সাহিত্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, সামাজিক সংস্কার এবং আইন শাস্ত্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সেই অর্থে তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত “রেনেসাঁ ব্যক্তিত্ব।” তাঁর অনেক জীবনীকারই তাঁকে এই ভারমূর্তিতেই দেখতে চেয়েছেন। সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল অতিক্রম করে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের ‘আধুনিক সংশ্লেষণকে’ গতিময় করার ক্ষেত্রে একজন কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবেও রামমোহন রায়কে দেখা হয়৯। “আধুনিক হিন্দু আত্মোপলব্ধি প্রসংগে রামমোহন অনেক সময়ই একজন অতিমানবীয় ব্যক্তিত্বের ন্যায় কাজ করে গেছেন” বলে ওয়েলহেম হ্যাবফাস মনে করেন।

অতীতের হারানো গৌরব এবং আধুনিক হিন্দুধর্মের গুরুত্বপূর্ণ অনেক আশা-আকাংখাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অনেকটাই কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব, বিশেষ করে এর পরিপূর্ণতা এবং উন্মুক্ততা ও বিশ্বজনীনতার সমন্বয় করণে। তাঁর উদার মনের যে বিশাল সম্ভাবনা ছিল তা তিনি যথার্থভাবে বাস্তবায়ন করে আধুনিক বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছেন১০।

এই ধারণাটি কতটা ঠিক, সেটি বড় কথা নয়। উনবিংশ শতাব্দী এবং বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে বংগদেশে এক সাংস্কৃতিক বিকাশ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষ সাধনের যুগ ছিল। ভারতবর্ষব্যাপী সামাজিক বিবর্তনের এই উষ্ণ স্রোতের কেন্দ্র ছিল বংগদেশ। রবিঠাকুরকে নিয়ে কিছু বলতে গেলে এই মূল্যবান প্রেক্ষিতটাকেই আগে দেখতে হবে। উনবিংশ শতাব্দী প্রায় শেষ। স্বাধীন রাষ্টের আকাঙ্ক্ষা উন্মেষের প্রায় কয়েক দশক আগেই হিন্দু পুনর্জাগরণ একটি সংস্কৃতিতে উন্নীত হয়েছে। হিন্দুধর্ম তখন একধরণের জাতীয়তাবোধ সৃষ্টিতে মূখ্য ভূমিকা পালন করছে। এই প্রেক্ষাপটে, ঐতিহাসিক দিক নির্দেশকের মত উদার, একত্রীকরণযোগ্য এবং সহনশীল হিন্দু দর্শনের দরকার ছিল। সেই জন্যই, ভারতবর্ষের অনেক উদারনৈতিক ব্যক্তিগন ‘আধুনিক ভারতের পিতা বা স্থপতি’ হওয়ার মত গুনাবলী রামমোহন রায়ের মধ্যেই লক্ষ্য করেন১১। ঐতিহাসিক বিবেচনায় রবিঠাকুর রামমোহন রায়কে ‘আধুনিক ভারতের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি’ হিসেবে গন্য করার ক্ষেত্রে যথার্থ ভূমিকা পালন করেছেন১২। প্রকৃত পক্ষেই রামমোহন

একজন প্রকান্ড মেধা সম্পন্ন বিশাল হৃদয়ের মানুষ ছিলেন… (তিনি) আধ্যাত্মিকতার নতুন দ্বার উন্মোচন করতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মেধাহীন, স্থবির বস্তুবাদী, এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানবিবর্জিত সাধারণ লোকেরা বারংবার তা বাধাগ্রস্থ করেছে১২।

রবিঠাকুর বুঝলেন তাঁর নিজ জীবনের কর্ম এবং আদর্শ হবে রামমোহন রায়ের আধ্যাত্মিক সত্ত্বাকে বাঁচিয়ে রাখা। অনেকের মত রবিঠাকুরও শুধু ভারতের ইতিহাসে নব যুগের জন্মই নয়, বরং উন্মুক্ত মন মানসিকতা এবং ভারতীয়বোধের অগ্রদূতের ভূমিকায় রামমোহন রায়কে একজন মূল ব্যক্তিত্ব হিসেবে মনে করতেন১৩।

রামমোহন রায় পাশ্চাত্য ধারায় কতটা প্রভাবিত হয়েছিলেন তা খতিয়ে দেখাটাই সম্ভবত একটা বড় ঐতিহাসিক বিষয়। প্রাচ্য ধারা মতে পুনর্জন্ম কিম্বা রেনেসাঁর ধারণার গুরুত্ব কতটা? অনেকের মতে (শুধু এডওয়ার্ড সাইডের পরের লেখা থেকেই নয়) বিষয়টির সাথে শক্তিসাধনা ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। কতিপয় পন্ডিত ব্যক্তি রামমোহন রায়ের অবদান জটিল করার প্রয়াসী ছিলেন। প্রকৃত হিন্দু্ত্বকে উপস্থাপন করতে তারা রামমোহন রায়ের কথিত অক্ষমতার কথা বলেছেন৩৪। ব্রাহ্মসমাজের ধারণাই ছিল তাঁর ধর্মসংস্কারের মূলমন্ত্র। তাদের মতে রামমোহন ব্রাহ্মসমাজকেই বড় করে দেখতেন। ফলে তিনি বৃহত্তর হিন্দু সমাজের আশা-আকাংখার প্রতিফলন ঘটাতে পারেননি১৫। সমালোচনার প্রধান বিষয় ছিল, রামমোহন রায়ের ‘বংগ পুনর্জাগরণের’ ধারণা পাশ্চাত্য দর্শন দ্বারা প্রভাবিত। মার্ক্সবাদী দৃষ্টিকোন থেকে সুমিত সরকার তাঁর, ‘রামমোহন রায় এবং অতীতের সাথে ছিন্নতা’ রচনায় বলেছেন, ‘বংগ পুনর্জাগরণ’ পাশ্চাত্য আদর্শের প্রভাব বিদ্যমান। রামমোহন রায়ের মত ব্যক্তিত্বের দ্বারা এই পুনর্জাগরণের কাজটি হয়েছে অনেকটা আধুনিকতা বিবর্জিত। ‘এটা পুর্নাংগ ভাবে বিকশিত আধুনিক বুর্জোয়া সমাজ হয়ে উঠেনি … হয়েছে একটা দুর্বল, ভারসাম্যহীন অদ্ভূতুরে জিনিষ। এগুলো হল যা সাম্রাজ্যবাদীরা সচরাচর অনুমোদন করে থাকে’১৬। ডেভিড কফ অন্য এক দৃষ্টিকোন থেকে লিখেছেন – উনবিংশ শতাব্দীতে রামমোহন রায় প্রাচ্য অনুরাগী হয়েও ভারতের অস্বস্তিকর অবস্থা নিয়ে পাশ্চাত্যের কিছু প্রচলিত ধারণার কাছাকাছি ছিলেন। কফের মতে, ‘আদি হিন্দু ঐতিহ্য বা স্বর্ণযুগে আবিষ্ট রামমোহন হিন্দু ধর্মের কালো অধ্যায় এবং ঐ সময়ের সামাজিক অবিচারের অবলুপ্তি ত্বরাণ্বিত করেন। সেই জন্য তাঁকে প্রাচ্যে আধুনিকারক হিসেবে গণ্য করা হয়’১৭।

ঔপনিবেশিক চাপের ফলে কতখানি ‘প্রগতিশীল’ বা ‘রংক্ষণশীল’ সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা চিন্তাশীল সংস্কারবোধ সঞ্চারিত হয়েছিল? এই প্রশ্নটা জাতীয়তাবাদী এবং মার্ক্সবাদীদের কাছে ভাল লাগলেও উপনিবেশ পরবর্তী চিন্তাবিদরা অবশ্যই নাকচ করে দেবে। উপনিবেশ-পরবর্তী কোন অগ্রগতিকে ইতিহাসের আলোকে মূল্যায়ন করা প্রকৃত পক্ষে অবমূল্যায়নেরই নামান্তর১৮। যা হোক, হাবফাসের মত আমার কাছে অতিকতর প্রাসংগিক বিষয় হল মৌলিকত্ব বা রামমোহনের অন্যরকম চিন্তাধারাই শুধু কেন্দ্রীয় বিষয় নয়, ‘তাঁর চিন্তাধারা এবং স্ব-উপাস্থাপনা আন্তঃকৃষ্টীয় অবস্থানে এতই উদাহরণতূল্য’ যে এসব ‘পরবর্তী উন্নয়নে সুত্র হিসেবে কাজ করে’১৯।

এই কথাটি মনে রেখে তিনটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। প্রথমতঃ অনেক চিন্তাবিদ এবং মাঠকর্মীরা উনবিংশ শতাব্দীর শেষে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে উদীয়মান ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েন। এদের মধ্যে রামমোহন ছিলেন একজন গুরুত্বপূর্ণ, প্রভাবশালী, এবং নানা ভাবেই প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তিত্ব। দ্বিতীয়তঃ তাঁর গুরুত্ব, বিশেষতঃ তাঁর প্রভাবের প্রকৃতি প্রশ্ন সাপেক্ষ ছিল। তৃতীয়তঃ যুক্তিসংগত কারণেই, রামমোহনের কীর্তি এবং গতিশীল আদর্শের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে রবিঠাকুর এবং অন্যান্যদেরকে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হত। এক্ষনে, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এবং মাঝামাঝি সময়ে রবিঠাকুর থেকে জওয়াহারলাল নেহেরু পর্যন্ত অনেক ভারতীয় রামমোহনকে “বিশ্ব মানব” হিসেবে আখ্যায়তি করে থাকেন। তিনি ছিলেন ভারতবর্ষের এক ‘অদ্বিতীয় প্রতিভা’, এক নিবেদিত প্রান ও নব্য ভারত দর্শনের এক কেন্দ্রীয় চরিত্র২০।

রামমোহন রায়ের দর্শনের প্রধান সঞ্চালক শক্তি ছিল একটি একেশ্বরবাদ এবং সমাজ সংস্কারমূলক প্রতিষ্ঠান যা ব্রাহ্মসভা নামে পরিচিত। ১৮২৮ সালে তিনি এ সভা প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যৎ কর্ম পরিকল্পনা প্রদানের একটি বলিষ্ঠ রূপরেখা দেওয়ার প্রয়োজনীয় সময় তিনি পাননি। এবং এই প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে তাঁর ভাবনার প্রকৃত ধারণাও দিয়ে যেতে পারেন নি। কারণ প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৮৩৩ সালে তিনি ব্রিস্টলে দেহত্যাগ করেন২১। এ সভা এর পর ১৮৪৩ সাল পর্যন্ত বুদ্ধিবৃত্তিক নিষ্ক্রিয় সময় অতিবাহিত করে। তখনই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মসভাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে ব্রাহ্মসমাজে রূপান্তর করেন। একই সময় তিনি ‘সত্যান্বেষীদের’ জন্য তত্ত্ববোধিনী নামে একটি পত্রিকা বের করেন। এর উদ্দেশ্য ছিল কলকাতার শিক্ষিত সমাজে ব্রাহ্মধর্ম প্রচার। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি যে সুসংগঠিত উপাসনা, নিয়ম-নীতি সংকলন এবং প্রকাশনা শিল্পের বিকাশের উপর গুরুত্ব আরোপের মাধ্যমে যে ধর্মোৎসাহ শুরু হয় তা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবীকালের জাতীয়তাবোধ সমন্ধে তাঁর চিন্তাচেতনার সামঞ্জস্যতার উচু স্তরকেই তুলে ধরে।

দেবেন্দ্রনাথ এবং রামমোহনের ধর্ম বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য ছিল। রামমোহন যদিও ভারতীয় ঐতিহ্যের আদলে ‘আদি জাতীয়তাবোধকেই’২২ বুঝাতেন, ডেভিড কফের ধারণা – রামমোহনই ছিলেন সর্ব প্রথম ‘আধুনিকীকারক’, তিনি প্রথম ‘পুণর্জাগরক ছিলেন না’। ‘তুলনামূলক ধর্মীয়’ বিবেচনায় এটা গ্রহনযোগ্য২৩। এটা সত্য যে রামমোহনের লেখায় সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় প্রভাব বিদ্যমান ছিল। তিনি ভারতীয় ‘মৌলিক বিবেচনা-বুদ্ধির’ মধ্যেই মানুষ এবং ঈশ্বরের বিশ্বজনীন বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করেছেন। ভারতীয় সভ্যতার এক বিশেষ প্রতিভাকে শুধু বিচার-বিবেচনাহীন প্রশংসা নয়, তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে সর্বজন শ্রদ্ধেয় এবং বিশেষ গুণী ব্যক্তিত্বকে যাচাই করাই সঠিক কর্তব্য। ভিন্ন সাংস্কৃতিক ব্যাপ্তিতে একজন প্রতিভার যথাযথ মূল্যায়ন করার একটা সমস্যা আছে। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও বিষয়টি প্রযোজ্য। ওইলহেম হালফাজের মতে

রামমোহন খুবই আলোচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁকে নিয়ে আলাদা তাত্ত্বিক চিন্তা ভাবনা বা পুস্তক ভিত্তিক ভিন্ন ব্যাখ্যা দানের অবকাশ তেমনটা নেই। ভিন্ন দৃষ্টিকোন, আগ্রহ এবং গ্রহনযোগ্যতার প্রেক্ষিতে তিনি তাঁর চিন্তাচেতনা সঙ্ঘবদ্ধ করে ‘তাদের মাঝেই’ পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি তাঁর নিজ ঐতিহ্যের সাথে ইউরোপীয় ধর্ম, আদর্শ এবং আশা-আকাংক্ষার সমন্বয় দেখতে চেয়েছেন। নিজ এবং নিজের ঐতিহ্যকে বিদেশীদের কাছে পরিবেশন করতে গিয়ে তিনি যেন বিদেশীদের চোখে নিজেকে দেখতে পেয়েছেন।২৪

ইউরোপীয় এবং স্বজাতি ভারতীয়রা রামমোহনের অবস্থান নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করার একটা বিপদ ছিল। রামমোহন খ্রীস্টীয় ভ্রাতৃত্ববোধ দ্বারা প্রভাবান্বিত ছিলেন। অনেকেই মনে করতেন তিনি একটু বেশীমাত্রায় প্রভাবান্বিত ছিলেন।

একেশ্বর এবং দ্বৈত স্বত্ত্বা
‘উত্তরপুরুষের আচার-আচরণ বর্জন’ পূর্বক ‘ধর্মীয় এবং দার্শনিক সচেতনার আদর্শে এক নব স্তরে পৌঁছানোর’ উপাদান প্রাচ্য দর্শণে অন্তর্নিহিত আছে বলেই মনে করা হয়। এই উক্তির সমর্থন রামমোহনের এক ব্যাখ্যায় পাওয়া যায়। ব্যাখ্যাটা এরকম, ‘শেষাবধি ভারতের উত্তরণ খ্রিস্টীয় ধর্মের দিকেই’ এবং ‘অন্য একটি ধারণা মতে পশ্চিমের দীর্ঘ দিনের একটি প্রত্যাশা পূর্ণ হয়েছে’২৫। এম মনিয়ার-উইলিয়াম হয়তো রামমোহনকে, ‘তুলনামূলক ধর্ম বিজ্ঞান অনুসারে পৃথিবীর সর্বপ্রথম দৃঢ়-মনের গবেষক’২৬ হিসেবে আখ্যায়িত করতেন। কিন্তু মনিয়ার-উইলিয়ামস এবং ম্যাক্স মুলারের মত বিজ্ঞজনেরা রামমোহনের ‘খ্রিস্টীয় মূল্যবোধের আলোকে বিশ্বজনীনতা’কে দেখতেন এবং তাঁরা আশাবাদী ছিলেন, ভারতবর্ষ হিন্দুধর্ম সংস্কারের পথ ধরেই একদিন খ্রিস্টীয় ভারতে রূপান্তরিত হবে২৭। পাশ্চাত্য প্রভাব এবং হিন্দু ধর্ম সংস্কার নিয়ে গভীর সমস্যার সাথে রামমোহন এবং দেবেন্দ্রনাথের মধ্যে প্রচুর মতভেদ ছিল। কিন্তু দুজনের মধ্যে সময়ের ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও দেবেন্দ্রনাথ তাঁর অনেক রীতিনীতিই অনুসরণ করতেন। রামমোহনের মৃত্যুর পর দেবেন্দ্রনাথ নব্য প্রতিষ্ঠিত ‘ব্রাহ্মসমাজের’ নেতৃত্ব গ্রহন করেন। হিন্দু ধর্ম এবং সামাজিক পুণর্গঠন প্রকল্পে ব্রাহ্মসমাজ অতন্দ্রপ্রহরীর দ্বায়িত্ব পালন করে।

সমাজ সংস্কারে রামমোহনের উদ্যোগ তাঁর একেশ্বরবাদ বিশ্বাসের সাথে জড়িত। হিন্দুদের সামাজিক রীতিনীতি এবং ধর্মীয় আচার-ব্যবস্থা রামমোহনের পছন্দ ছিল না। তিনি চাইলেন, ‘আদিকালের মূর্তি পূজার পরিবর্তে বেদান্ত মতে সর্বশক্তিমান নিরাকার ঈশ্বরের স্থলাভিসিক্তি’২৮। পরিস্কার ভাবে, ‘শংকরের বেদান্তের আলোকে’ ‘বেদান্ত-দর্শন’ নামে ‘ভিক্ষুদের আদর্শের ন্যায় একটি প্রকৃত এবং চূড়ান্ত সত্য একেশ্বরবাদ’ ধর্ম প্রতিষ্ঠা২৯। মুখ্যতঃ রামমোহনের একেশ্বরবাদ এবং তাঁর ব্রাহ্মণবিরোধী ভূমিকা সমাজ সংস্কারের জন্য যুক্তিযুক্ত ছিল। তাঁর মতে সংস্কৃত ভাষার দুর্বোধ্যতার সুযোগে ব্রাহ্মণরা বেদ এবং উপনিষদের প্রকৃত ব্যাখ্যাকে কলুষিত করে। অন্য পক্ষে, দেবেন্দ্রনাথের মধ্যে দ্বৈততা ছিল। তিনি শংকরাচার্য এবং রামমোহনের ‘ঈশ্বর এবং মানুষ এক এবং অদ্বিতীয়’ তত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করেন। দেবেন্দ্রনাথ বলেন, ‘উপনিষদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ব্রহ্ম এক এবং অদ্বিতীয় তত্ত্বই প্রকৃত বেদান্ত’৩০।

শংকরাচার্যের বেদান্ত প্রমাণ করতে চায় ব্রহ্ম এবং সমস্ত প্রাণী এক এবং অদ্বিতীয় … আমরা তা বিশ্বাস করিনা। আমরা ঈশ্বরের উপাসনা করতে চাই। উপাসক এবং উপাস্য যদি এক হয়, তাহলে উপাসনা হবে কীভাবে? … শংকরাচার্য যেভাবে উপনিষদের ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা আমরা অনুধাবন করতে পারিনা’৩১।

দেবেন্দ্রনাথের অভিপ্রায় অনুযায়ী উপাসনার ধারণাটি হল হিন্দু ধর্মকে নতুন আংগিকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া। একই আদর্শে সুসংহত একটি সংগঠন যা দেশব্যাপী উন্নয়নের একটি চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করবে। দেবেন্দ্রনাথ দৃষ্টিপাত করেন সার্বজনীন দৃষ্টিভংগি থেকে ঐতিহাসিক এবং সামাজিক কাঠামোতে একটি আদর্শের আরোপ এবং তার ব্যবহার। এটা মনে রেখেই তিনি পবিত্র হিন্দু পুরাণ থেকে নির্দিষ্ট কিছু উপাদান নিয়ে ‘ব্রাহ্মধর্মে’র ভিত্তি সূচিত করতে চাইলেন যা একটি নির্ভরযোগ্য এবং সমন্বিত সংগঠন হিসেবে দেশের অংশবিশেষে আন্দোলন শুরু করবে। ১৮৪৩ সালে ‘ব্রাহ্মসমাজ’ গঠনের পরে, তিনি ‘উপনিষদ’ থেকে তাঁর নিজস্ব বাণী তৈরী করতে শুরু করলেন। ১৮৫০ সালে তিনি ‘ব্রাহ্মধর্ম’ প্রকাশ করলেন যার মধ্যে আছে ‘ব্রাহ্ম’ বিশ্বাস অনু্যায়ী সুনির্দিষ্ট ‘নীতিমালা’। দেবেন্দ্রনাথ মনে করলেন, নতুন ধর্ম এবং সামাজিক জীবনধারা প্রতিষ্ঠিত করতে দ্বৈত সত্ত্বাই কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করতে পারে। সেই জন্যই তিনি তাঁর ‘উপনিষদ’ থেকে তৈরী নীতিমালার উন্নয়ন করতে থাকলেন।

কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে আমরা রামমোহন রায়ের যথাযথ মূল্যায়ন নাও করে থাকতে পারি। । তিনি হয়তো বৃটিশদেরকে ‘ঐশ্বরিক সত্ত্বার’ ন্যায় আবাহন করেছেন (ব্যাপারটি উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুতে রবিঠাকুরসহ অনেক বুদ্ধিজীবি এবং চিন্তাশীল ব্যক্তিদের লেখায় বার বার এসেছে)। তিনি মনে করেছেন, ‘ভারতবর্ষে ইংরেজ রাজত্ব এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থা দুটোই উপযোগী এবং দরকারী’৩২। কিন্তু একই সময়, তাঁর কর্ম পদ্ধতিতে বিশেষতঃ তাঁর জীবনের শেষের দিকে, রামমোহনের অবদান ছিল ‘সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় আত্ম-সচেতনা গড়ে তোলা, যার ফলশ্রুতিতে পরে, আধুনিক ভারতীয় জাতীয়তাবাদ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়’ এবং ‘সনাতন হিন্দু আদর্শের ছত্রছায়ায় ইউরোপীয় উপাদান সহযোগে রাজনীতি, মানবিক মূল্যবোধ, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির বিকাশ ঘটে’৩১।

সম্ভবত, দেবেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজ ‘সার্বজনীন সংস্কৃতির’ সাথে সংগতি রেখে ভারতীয় মূল্যবোধ এবং কৃষ্টিগত পরিবর্তন সাধিত করে। এতে কারও দ্বিমত দেখা যায়নি। দেবেন্দ্রনাথ এবং রামমোহনের মধ্যে অনেক মিলও ছিল। দ্বৈত সত্ত্বা যুক্তিতে কখনই তা ঢাকা পড়েনি। উদারহণ স্বরূপ, দেবেন্দ্রনাথ মনে করতেন, শুধু ধর্মীয় পুস্তকের বাণী নয়, মেধা এবং অভিজ্ঞতা সহযোগে আধ্যাত্মিক সত্যতা গ্রহন করতে হবে। মেধার একটা অংশ, ‘সাধারণ জ্ঞানের’ সাথে উনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় রোমান্টিসিজমের সাথে মিল পাওয়া যায়। কিন্তু এটা রামমোহনের সকল প্রশংসিত বিশ্বাস, যেমন, প্রেম, মহত্ব এবং সার্বজনীন মূল্যবোধের সাথেও যোগ আছে। পরিষ্কার করে বলা যায় যে, ইতিহাস এবং সংস্কৃতির ভিন্নতা সত্ত্বেও সারাবিশ্বের ধর্মীয় ভাল দিকগুলোর মধ্যে মিলের বন্ধন আছে। দেবেন্দ্রনাথের যুক্তি হল এসব ভাল উপাদান গুলো হিন্দু সংস্কৃতিতেও বিদ্যমান। এই যুক্তি, চিরায়ত ঐতিহ্যকে মজবুত করে, নতুন উদ্যম সৃষ্টি হয়, পুনরুদ্ধারিত হিন্দু সংস্কৃতি সারা বিশ্বে সমমর্যাদা লাভ করে৩৪।


‘উদারপন্থা’ এবং ‘জাতীয়তাবাদ’

ধর্মীয় রীতিনীতি বিষয়ে দেবেন্দ্রনাথ এবং রামমোহনের মধ্যে মতভেদ থাকলেও তাঁদের মধ্যে যে অনেক মিল ছিল তা কোন ক্রমেই খাটো করে দেখা যায়না। কিন্তু, ডেভিড কফের মতে, ‘দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রাহ্ম জাতীয়তাবাদ’ এবং তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের ‘ব্রাহ্ম ধারণাচ্যুত, যেমন, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় এবং অরবিন্দ ঘোষের হিন্দু জাতীয়তাবোধের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ ছিল’। কফের মতে, ‘দুই প্রজন্মের মধ্যে সবচেয়ে বেশী যে তফাৎ ছিল তা মূলতঃ সময়ের ব্যবধানের জন্য’৩৫। সময়টা মোটামুটি ১৮৭০ থেকে ১৮৯০। সুমিত সরকারের ব্যাখ্যা মতে, এই সময়টা ছিল ‘রেনেসাঁজাত উন্নয়ন এবং জাতীয়তাবাদের অবদানের মধ্যে ধারাবাহিকতায় ছেদ জনিত অস্পষ্টতা’৩৬। ১৮৭০ দশকের শুরুতে, সার্বজনীনতা এবং জাতীয় ধর্মের চাপের মধ্যে সুক্ষ্ম ব্যবধান বংগদেশের সব প্রজন্মের চিন্তাশীল এবং সংস্কারবাদীদের জন্য একটি বিশেষ অধ্যায়ের সূত্রপাত হয়। ‘পাশ্চাত্য করণ’ এবং ‘হিন্দু পুনর্জাগরণের’ মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। ‘স্বকীয়তাবোধের আন্ত-সাংস্কৃতিক বিস্তার এবং আবেদন’ এবং ‘আগ্রহ এবং আত্মবিশ্বাসে’র মধ্যে টানাপোড়েন দেখা দেয়। এসব ধারাগুলো একত্রে ‘আধুনিক হিন্দু চেতনাবোধ এবং স্বকীয়-বোধের এক ভিত্তি’ রচিত হয়৩৭। যাহোক, আমরা দেখেছি রামমোহন এবং দেবেন্দ্রনাথের চিন্তাধারার ভিন্নতা সব সময়ই প্রখর ছিল না। রশিংঙ্কা চৌধুরী বলেছেন, এই সময় বঙ্গীয় চিন্তাশীল সমাজে যথেষ্ট ‘বিপরীত মুখী নতুন ধ্যান-ধারণা’৩৮ বিদ্যমান ছিল। ‘বিপরীত মুখী চিন্তাধারা… নিয়ে একটা গবেষণা থেকে দেখা যাবে যে উনবিংশ শতাব্দীতে হিন্দু অধিকার এবং উদারপন্থী অবস্থানের উপর একটা প্রশ্নহীন পরিষ্কার চিত্র তৈরী করা দুরূহ ব্যাপার’।

যে প্রধান ব্যবধানটি তরুণ রবীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করে থাকতে পারে তা ছিল ১৮৬৬ সালে ‘কেশববাদ’ এবং ‘আদি ব্রাহ্মসমাজ’। দেবেন্দ্রনাথ তখনও ব্রাহ্মসমাজের দায়িত্বে ছিলেন। পরে একই বছর রাজনারায়ণ দায়িত্ব গ্রহন করেন। কেশবচন্দ্র যে পরিবারে জন্মেছিলেন তাঁরা সবাই তৎকালে কেরানীগিরির চাকুরী করতেন কিন্তু এদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল এবং উচ্চ পর্যায়ে ভাল যোগাযোগও ছিল। কেশবের ঠাকুরদা দ্বারকানাথ ঠাকুরের চাকুরী করতেন এবং তাঁর বাবা পিয়ারী মোহন সেন ১৮৩১ সাল থেকে এশিয়াটিক সোসাইটির সচিব ছিলেন। কেশব এই পদটি পান ১৮৫৪ সালে। ১৮৫৭ সালে তিনি দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (রবীন্দ্রনাথের বড় ভাই) ব্যক্তিগত সচিব হন। তিনি ব্রাহ্মসমাজের সদস্য হন এবং ১৮৫৭ থেকে ১৮৬৬ সাল পর্যন্ত এই ধর্ম এবং এর সামাজিক শিক্ষা বিস্তারে আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু ১৮৬৬ সালের মে মাসে কেশব কলকাতায় ‘জিসাস ক্রাইস্ট, ইউরোপ এবং এশিয়ার’ উপর একটি বক্তৃতা দেন। কেশবচন্দ্রের উপর খ্রিস্টান ধর্মের প্রভাব নিয়ে জল্পনা-কল্পনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এই বক্তৃতা থেকে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়৪০। বস্তুতঃ, খ্রিস্টান ধর্মটাই মুখ্য নয়। একেশ্বরবাদের সত্যতা থেকে পৃথিবী ব্যাপী সর্বধর্মের একত্রীকরণের জোয়ার থেকেই কেশবের এই চিন্তার সূচনা হয়। হিন্দুধর্মের বাইরে এসে কেশব দেবেন্দ্রনাথের চেয়ে জিসাস, বুদ্ধ, চৈতন্য, মুসা এবং কবীরের আদর্শেই বেশী উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। ‘বিভিন্ন ধর্মীয় বিধিব্যবস্থা সমন্বয়ে এক বিশ্ব ভ্রাতিত্ত্ববোধকেই তিনি খুঁজেছিলেন’৪১। বাইরের প্রভাব সমন্ধে যুক্তি দেখানো হয়েছে

সত্য এবং গ্রহনযোগ্য বিচারবোধ এবং হৃদয় থেকে উৎসারিত বাণী … খুঁজতে গিয়ে কেশব অষ্টবিংশ এবং উনবিংশ শতাব্দীর পাশ্চাত্য আদর্শ, ‘অন্তর থেকে উৎসারিত বিশ্বাস’, ‘সাধারণ ধারণা’, ‘বাস্তবতা’, ‘মানবিক বোধ’, ‘চিন্তাশীলতা’, এবং বিচার-বুদ্ধি দিয়ে গ্রহনযোগ্য আদর্শের প্রতি অনুরক্ত হন৪২।

এটা সত্য হতে পারে। কিন্তু এই তাগিদের মূলে পাশ্চাত্যের আদর্শ আছে মনে করে তেমন একটা লাভ সম্ভবত নেই। হিন্দু ঐতিহ্যের গভীরে মুনি-ঋষিদের নিগূঢ় চিন্তা এবং তাদের বাণীর যে প্রভাব আছে, আসলে বিষয়টা নিশ্চয় তাই।

এই অনুভূতি থেকেই কেশব ১৮৬৬ সালে ভারতীয় ব্রাহ্মসমাজ নামে ব্রাহ্মসমাজের এক ‘প্রগতিশীল’ শাখা গঠন করলেন। কিন্তু কেশবের নেতৃত্বে রামমোহনের আদর্শেরই পুণরোজ্জীবন মনে হলেও কিছুটা উলটো স্রোতের উপস্থিতি ছিল। কেশব ২৪ শে জানুয়ারী ১৮৬৮, কলকাতায় “The Tabernacle of New Dispensation” নামে এক নতুন চার্চের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন। আধ্যাতিক বিশ্বায়নের এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ হিসেবে চ্যাপেলটির উৎসর্গ করা হল ২২ আগষ্ট ১৮৬৯ তারিখে। কিন্তু ১৮৭৮ এর মধ্যে কেশববাদের মধ্যে চরম দ্বিধাবিভক্তি দেখা দেয় যখন তিনি নিজ আদর্শ বহির্ভূত গোঁড়া ধর্মীয় পদ্ধতিতে তাঁর ছোট মেয়ের বিয়ে দেন। ব্রাহ্মবাদের প্রগতিশীল শাখাকে নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ’ প্রতিষ্ঠিত হল। ফলে ব্রাহ্মবাদের বিশ্বজনীন আদর্শ এবং জাতীয়তাবাদ আদর্শের মধ্যে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। চিন্তাশীলদের মতানৈক্যের এই চরম মুহুর্তে তরুণ রবিঠাকুরের আবির্ভাব হয়। জীবনের শুরুতে তিনি এদের সাথে উঠাবসা করেন। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকটা ছিল জটিল সময়। এই সময় নতুন উদ্দীপনায় ‘হিন্দু পুণর্জাগরনে’র মধ্য দিয়ে কঠোর রক্ষণশীল ‘আর্য সমাজ’ এবং অপর পক্ষে বিপিন চন্দ্র পাল, অরবিন্দ ঘোষ ও বালগঙ্গাধর তিলকের মত উগ্র জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হয়।

রবিঠাকুর যখন বয়সে ছোট, কেশব তখন একটা আকর্ষণীয় এবং গতিশীল ব্যক্তিত্ব। ডেভিড কফ বলেন, ‘রক্ষনশীল-পশ্চিমীকারকদের’ ভাংগন আর রবিঠাকুরের ছেলেবেলার ইতিহাসের একই সময়ের ঘটনা (কেশবচন্দ্র এই সময় ঠাকুর পরিবারেই থাকতেন)। ১৮৬৬ সালের কয়েক বছর পর, রবিঠাকুরের বড় ভাইয়েরা কেশববাদীদের ভাংগন রোধে কঠোরতার সাথে রুখে দাঁড়ান। আগেই যেমন বলা হয়েছে, দেবেন্দ্রনাথের একটা উদ্দেশ্য ছিল ব্রাহ্মসমাজের সাংগঠনিক এবং ভাষাগত ভিত্তি মজবুত করা – আশা ছিল দেশ একদিন ফুলেল শুভেচ্ছা দিয়েই ব্রাহ্মধর্মীয় শিক্ষাকে আবাহন করবে। এ ক্ষেত্রে, কেশববাদীরা আদি ব্রাহ্মদের ‘হিন্দু সংস্কারের শুধু মুখ্য উদ্দেশ্য এবং দিক নির্দেশনাকেই লংঘন করেনি, হিন্দু ধর্মীয় খোদ বন্ধনের প্রতিও হুমকি হয়ে দাঁড়ায়’৪৩। আদি ব্রাহ্মদের মতে কেশববাদীদের আদর্শ ছিল, ‘আপন সংস্কৃতি এবং সভ্যতার প্রতি বর্বরতা’। কফ কেশববাদকে ‘জাতীয়তাবাদ’৪৪ হিসেবেই চিহ্নিত করেন। তপন রায় চৌধুরী মন্তব্য করেন, ‘পুত-পবিত্র দেবেন্দ্রনাথ’ খ্রিস্টানবিরোধী আন্দোলনে প্রধান সারির একজন। ব্রাহ্ম পত্রিকা তত্ত্ববোধিনী ছিল ‘অল্প সময়ের জন্য খ্রিস্টানবিরোধী মানসিকতার মুখপত্র’৪৫।

এ অবস্থায় রাজনারায়ণ বোস, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর সহযোগে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সংস্কারে তৎপর হলেন। এ সংস্কারের ধারা ছিল ক্রমান্বয়ে দেশমুক্তির পথে অগ্রসর হওয়া। দ্বিজেন্দ্রনাথ স্ব-শিক্ষিত দার্শনিক ছিলেন। তিনি কুটির শিল্প প্রসারে উৎসাহী হলেন। মূলতঃ ঠাকুর পরিবারের আর্থিক সহায়তায় তিনি হিন্দু মেলার ব্যবস্থা করলেন। এ ব্যবস্থাকে ‘১৯০০ দশকের শুরুতে স্বদেশী আন্দোলন গড়ে উঠার’৪৬ পূর্বসূত্র হিসেবে ধরা হয়। দ্বিজেন্দ্রনাথের ‘নিজে করো’ ধারণা সহযোগে উন্নয়নকে, অন্তত ‘হিন্দু পু্নর্জাগরণকারীদের’ বিপরীতে ‘আধুনিকীকরণের মডেল’ হিসেবে গন্য করা যেতে পারে। এই ‘আধুনিকীকরণ’ ছিল পাশ্চাত্য অভিজ্ঞতার আলোকে ভারতীয় সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা – পাশ্চাত্য অভিজ্ঞতা হুবহু অনুকরণ নয়। গডফ্রে মুরহাউসের মতে, রবিঠাকুরের পিতা ‘খ্রিস্টান মিসনারীদের উদ্যোগকে প্রতিহত করার জন্য যথেষ্ঠ শক্তি ব্যয় করেছিলেন। শ্রীরামপুরকে খ্রিস্টান প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য মধ্যবয়সী হিন্দু ছেলেদের বিনা বেতনে শিক্ষা-দীক্ষার জন্য হিন্দু সহায়ক প্রতিষ্ঠান গঠন করেছিলেন’। মুর বলেছেন, ঠাকুর পরিবার ‘হিন্দু ধর্মের সংস্কার দেখতে চেয়েছিলেন, বাইরের হস্তক্ষেপ চাননি’৪৭। প্রকৃতপক্ষে, ‘দেবেন্দ্রনাথের নজরদারী এমন কড়া ছিল যে একবার তিনি তাঁর ভাই জ্ঞানেন্দ্র মোহনকে ব্রাহ্মসমাজে ইংরেজী ভাষায় বক্তৃতা দিতে বারণ করেছিলেন। তিনি তাঁর এক জামাতার কাছ থেকে একই ভাষায় লেখা চিঠি গ্রহন করেননি’৪৮। মিশনারী কর্তৃক যে কোন ধরণের অপমানজনক আগ্রাসনের প্রচেষ্টাকে দমন করতে দেবেন্দ্রনাথ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। কাজেই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভূমিকায় হিন্দুধর্মকে বর্ম হিসেবে ব্যবহারকারীদের মধ্যে তিনিও ছিলেন একজন। স্থানীয় এবং পুরো দেশের কৃষ্টি তথা বিশ্বজনীনতাবোধ বিষয়ে দেবেন্দ্রনাথ এবং রামমোহনের মধ্যে মতভেদ অনেক সময় ম্লান হয়ে যেত। যাহোক, উনবিংশ শতাব্দীর শেষ পঁচিশ বছরে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সাথে ভারতীয় চিন্তাবিদদের দ্বন্দ্ব কঠোর রক্ষণশীলতার রূপ নেয়৪৯। উনবিংশ শতাব্দীর শেষে, জীবনের শুরুতে আদি ব্রাহ্ম ঐতিহ্য রবীন্দ্রনাথের চিন্তাচেতনাকে বেশী প্রভাবিত করে। তিনি উপলব্ধি করেন – ‘বিশ্বজনীনতার আগে থাকতে হবে দেশাত্মবোধ’৫০।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্দ্ধে, বংগদেশের চিন্তাবিদদের বিভিন্ন চিন্তাধারা সম্পর্কে ডেভিড কফ আপাতঃ ‘রক্ষণশীল-পশ্চিমীকরণে’ দ্বিধা-বিভক্তি এবং ‘বিপরীত মেরুকরণে’র কথা উল্লেখ করেছেন। রবিঠাকুর ‘সময় বিশেষে এই দুটোর প্রতিই আকৃষ্ট হয়েছিলেন’৫১। এ ধরণের যুক্তি খানিকটা দুর্বল মনে হয় কারণ তিনি মানবিক, সামাজিক এবং ঐতিহাসিক ব্যাখ্যাকেই প্রাধান্য দিতেন। কফ তাঁর ‘ব্রাহ্মসমাজ’ বইয়ের সর্বত্র একটা ধারণা সৃষ্টি করেছেন যে, বংগদেশের চিন্তাশীল সমাজ ‘আত্মপরিচয়ে দ্বিধাগ্রস্থতার’ ভিতর দিয়ে গেছে ব্যাপারটা মানসিক বিভ্রান্তি (psychological flaw) বলেই মনে হয়; সম্ভবত এটা ব্যক্তিগত মানসিক চেতনা। সমাজ, কৃষ্টি এবং চিন্তাধারা সময়ের সাথে পরিবর্তনশীল, এটাকেই হয়ত এ জাতীয় একটা ‘সমস্যা’ হিসেবে ধরা যেতে পারে। অনেকেই ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সাথে এটাকে গুলিয়ে কোন রকমে একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চায়। ‘আত্মপরিচয়ে দ্বিধাগ্রস্থতাকে’ মানসিক আওতায় এনে দেখলে, মনে হয় না কোন একক ব্যক্তির কারণে সামাজিক, চিন্তাশীলতা এবং কৃষ্টিগত পরিবর্তন হতে পারে। অপর পক্ষে, এটা ভুলক্রমে মনের শূন্যতা বোধকেই বুঝায়— অর্থাৎ মনটা যেন দুই চরম প্রান্তের মাঝে এক সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে।

কফের ধারণা, ‘উদারপন্থীদের যুক্তি – তাদের অধিকার আছে পশ্চিমা অভিজ্ঞতায় নিজ সমাজের সংস্কার করা। অপর পক্ষে জাতীয়তাবাদীদের যুক্তি – তাদের অধিকার আছে পশ্চিমা একরোখাদের হাত থেকে নিজেদের কৃষ্টীয় সংহতি নিশ্চিত রাখা’। এ থেকে আমার মনে হয়, জাতীয়তাবোধের বৈশিষ্ট্য সমন্ধে নিজেদের ধারণা ঠিক না করেই তাঁরা আরও আগ বাড়িয়ে বলেছেন, জাতীয়তাবাদ হল ‘মানসিকতার একটি ভিন্ন পূর্বনির্দ্ধারিত অবস্থা যার ফলে আত্মপরিচয়ে দ্বিধাগ্রস্থ বিঘ্নতা সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায়, উদারপন্থীদের মত রক্ষণশীলতা এবং আধুনিকতার তফাতই শুধু নয়, সামান্য ‘তারা এবং আমরা’ এর মধ্যে যে ফারাক সেটুকু পর্যন্ত বুঝতে পারেনা’৫২। আমি তৃতীয় অধ্যায়ে পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করব, রবিঠাকুরের অবস্থান পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করতে এই সমস্ত তর্কাতর্কির কোন অবদান নেই। এই বিশেষ ক্ষেত্রে, কফ মনে হয় বলতে চান, ‘জাতীয়তাবাদী’ একটি প্রয়োজনীয় সংস্করণঃ এটি আধুনিকতাবাদের প্রতি এক শিশুসূলভ আস্ফালন ৫৩। এই রকম ব্যাখ্যা শুধুই সরলীকরণ।

দেশাত্মবোধের বিপরীতে রবীন্দ্রনাথ

তৎকালীন ভারতের কেন্দ্রীয় চিন্তাবিদদের মধ্যে রক্ষণশীলতা এবং আধুনিকীকরণ নিয়ে বিরাজমান বিতর্কের সাথে রবীন্দ্রনাথ একজন বিতর্কিত ব্যক্তি হয়ে পড়েন। তিনি পক্ষে এবং বিপক্ষে ধারালো জবাব দিতে থাকেন। এখানে আমরা নিশ্চয়ই একটা মৌলিক বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দিতে পারি। রামমোহনের ব্রাহ্ম আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের পিতামহ সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তাঁর পিতা আন্দোলনকে বেগবান করেন এবং তাঁর ভাইয়েরা আদি ব্রাহ্ম সমাজের সক্রিয় এবং নিবেদিতপ্রান সদস্য ছিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই এই ব্যাপারটা থেকে অনুমেয় হয়, রবীন্দ্রনাথের জীবন এবং চিন্তাধারা সমসাময়িক ঐতিহাসিক ক্রিয়া-কলাপ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। কিন্তু নির্দিষ্ট করে বলা যায়, রবিঠাকুর নিজে তাঁর স্বকীয় চিন্তাভাবনার উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতেন। রবিঠাকুরের দৃঢ়তা এবং প্রজ্ঞাকে সমর্থন করার যথেষ্ঠ কারণ আছে।

ব্রাহ্ম সমাজ বা আদি ব্রাহ্ম সমাজ নিয়ে তাঁর পিতা এবং ভ্রাতাদের পরিস্কার অবস্থান ছিল। কিন্তু ১৮৮০ দশকে রবিঠাকুরের অবস্থান এঁদের চেয়ে দিনদিনই ভিন্ন হতে থাকে। তিনি স্বচ্ছন্দে নিজেকে এভাবেই গড়ে তোলেন। বড় ভাইদের মত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেওয়া থেকে তিনি বিরত থাকেন। ১৮৮২ সালে, ২১ বছর বয়সে তাঁর নিজের ‘কোন বৈষয়িক দায়িত্ব ছিলনা। পারিবারিক সম্পত্তি থেকে যে পরিমান আয় হত, তাতে তাঁর জীবিকা ছিল নিশ্চিত’৫৪। ১৮৯০ দশকের বেশীর ভাগ সময়টাই তিনি কলকাতার নাগরিক সভ্যতা এবং চিন্তাশীল পরিবেশ থেকে দূরে পূর্ব বংগে কাটান। ঠিক এই সময়টাতেই তিনি তথাকথিত ‘ভদ্রলোক’দের থেকে দূরে সরে থাকার মনোবৃত্তি গড়ে তুলেন এবং ফলে পল্লীর দুস্থদের প্রকৃত অবস্থাটা অনু্ধাবন করতে সক্ষম হন৫৫। ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত ‘একজন শিল্পীর কাছে ধর্ম’ নামে এক লেখায়, রবিঠাকুর (সেই সময়ে) তাঁর স্বকীয়বোধ নিয়ে লেখেন, ‘আমার নিজস্ব ধর্মবোধ নিয়ে উদাসীনতার কারণ কোন এক ঘটনাচক্রে একটি পরিবারে আমার জন্ম হয়েছে বিধায় স্বাভাবিক নিয়মে সেই পারিবারিক ধর্মটিই আমার ধর্ম হয়ে উঠেনি’ ৫৬।

রবিঠাকুর নিজে যা বলেছেন সেটাকেই মুখ্য হিসেবে ধরে নেয়ার দরকার নেই। এমন করাটা কোন বিশাল ব্যক্তিত্বের প্রতি অবমাননা স্বরূপ। রবিঠাকুরের মত একজন চিন্তাশীল ব্যক্তিকে বুঝতে হলে তিনি যে চিন্তাশীলতা এবং সাংকৃতিক পরিমন্ডলে জন্মেছেন সেটিকে আগে বুঝতে হবে। কফ অনেক সময় ‘উদারনৈতিক জাতীয়তাবাদী’ ‘দ্বিমুখী’ শব্দটা ব্যবহার করলেও, প্রকারান্তরে স্বীকার করেছেন যে, ‘ব্রাহ্ম সামাজিক ইতিহাসের অসমাধিত সমস্যার প্রতি রবিঠাকুরের মতবাদ এবং তীক্ষ্ণ জবাবকে অনেক সময় অনেক প্রচলিত প্রাচ্য-প্রতীচ্য বিরোধী মডেলের পরিপন্থী হিসেবে ধরা হয়’৫৭।
এ প্রেক্ষিত থেকে আমাদের একটা ভাল ধারণা হল, বিভিন্ন ধাপে চিন্তাবিদ রবিঠাকুরের বেড়ে উঠা, চিন্তাশীলতার উত্তরাধিকার এবং সর্বোপরি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে এবং আদর্শে নিজেকে গড়ে তোলা। রবিঠাকুরের জীবনকে সময়ের আলোকে ভাগ করে দেখা দরকার – সর্বপ্রথম তিনি স্বদেশী চেতনাবোধকে সাদরে গ্রহন করেন। কিন্তু তার পরেই নাটকীয়ভাবে এর রাজনৈতিক জাতীয়তাবোধের সাথে দূরত্বে চলে আসেন।

বংগভংগ

মোটামুটি ১৯০১ থেকে ১৯০৬ সময়টা রবিঠাকুরের জীবন গড়ে উঠার এক ক্রান্তি লগ্ন। এই সময়টাতেই তাঁর ভবিষ্যত মতাদর্শের পথ রচিত হয়। তিনি স্বদেশী আন্দোলনের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। এই আন্দোলন ছিল লর্ড কার্জনের বংগদেশকে ভাগ করার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে। এই সময় রবীন্দ্রনাথ গতিশীল ব্যক্তিত্ব ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় দ্বারা প্রভাবিত হন।
১৮৯১ থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত রবিঠাকুর পূর্ববংগে পারিবারিক জমিদারী দেখাশুনা করেছেন। সেখানে শিলাইদহের বিস্তীর্ণ গ্রামীন আবন্ধনে তিনি প্রচুর কবিতা রচনা করেছেন। ভারতবর্ষের কৃষকদের হতদরিদ্র অবস্থার সাথে তাঁর পূর্ব ধারণা ছিল না। এখানে মূলত কৃষক সম্প্রদায়ের দৈনন্দিন কষ্টকর অবস্থা অতি নিকট থেকে দেখতে পেয়েছেন। শুধু তাই নয়, দরিদ্র কৃষকের প্রতি রাজদন্ডের নির্মূহ অত্যাচার এবং নির্যাতনও তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। দত্ত এবং রবিন্সনের মতে, প্রজাদের সমন্ধে কোন ধারণাহীন দুর্নীতি পরায়ন রাজকর্মচারীদের দ্বারা অত্যাচারিত কৃষকদের অসহায় অবস্থা রবীন্দ্রনাথকে ‘দুটি দৃঢ় ব্রতে’র প্রতি আত্মনিমগ্ন হতে বাধ্য করে৫৮। এগুলো হল, ‘সরকারী সাহায্যের জন্য অপেক্ষা না করে ভারতীয়দেরকে নিজ পায়ে দাঁড়াতে হবে এবং গ্রাম পুনর্গঠন ছাড়া ভারতের জাগরণ সম্ভব নয়’৫৯। তিনি আরো অনুধাবন করেন যে, কলিকাতার ভদ্রলোক সমাজের সাথে সাধারণ মানুষের ব্যবধান যে কোন ধরণের সমষ্টিগত বা জাতীয়ভিত্তিক উন্নয়নে ক্রমবর্ধমান সমস্যা সৃষ্টিকারক। ‘দেশের স্বার্থে বংগদেশের প্রায় সব রাজনীতিবিদদের ভনিতা উন্মোচন’ করে তিনি একটি রম্য রচনা লিখেন। ১৮৯০ সাল পর্যন্ত ‘দেশের নিম্নমুখিতা নিয়ে অনেক জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখেন’৬০। ১৯০১ সাল নাগাদ রবিঠাকুর দেশের জন্য কর্মতৎপর হয়ে উঠেন।

পুনর্জাগরণের জন্য এক মহতী উদ্যোগ হিসেবে ১৯০১ সালের ২১শে ডিসেম্বর তারিখে শান্তিনিকেতনে রবিঠাকুরের বিদ্যালয় উদ্বোধন করা হয়। রবিঠাকুরের আন্তরিকতা, উৎসাহ এবং উদ্দীপনা বোঝা যায় তাঁর এই প্রকল্পকে সাহায্য করার জন্য ত্রিপুরার যুবরাজকে লেখা চিঠি থেকে। ‘আমি আমার ছাত্রদেরকে ইউরোপীয় বিলাসবহুল জীবনযাপনের প্রতি নির্বোধ অনুরাগ থেকে মুক্ত রাখতে চাই’। তিনি আরও লেখেন, ‘এবং এভাবেই ভারতের দারিদ্রের মধ্য থেকে পূত-পবিত্র সুনাগরিক সৃষ্টি হবে’৬১। লক্ষ্যনীয় যে, বিদ্যালয়টি অনেকটা প্রাচীনকালে সন্যাসগৃহে শিষ্যদের শিক্ষাদান পদ্ধতির মত। শুরুতে বিদ্যালয়টির ছাত্রসংখ্যা ছিল পাঁচ এবং পাঁচ জন শিক্ষকের তিনজন ছিলেন খ্রীস্টান। তার মধ্যে একজন ছিলেন বিশেষ জ্ঞানী ব্যক্তি। রবিঠাকুর তাঁকে খুব খাতির করতেন।

ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় রবিঠাকুরের সমসাময়িক ছিলেন (১৮৬১ – ১৯০৭)। তিনি কলিকাতা থেকে ৩৫ মাইল উত্তরে একটি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহন করেছিলেন। তাঁর পিতৃব্যের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহন করেন। ১৮৯১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তিনি প্রটেস্ট্যান্ট চার্চে যোগ দেন। এর ছয় মাস পরে তিনি ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহন করেন। যুবক ব্রহ্মবান্ধবের বেপরোয়া কাজের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ ছিল। দত্ত এবং রবিনসন তাঁকে ‘অনুপ্রেরণাকারী পেশীসমৃদ্ধ বাঙ্গালী’৬৭ নামে অভিহিত করেন। আশীষ নন্দী বলেন, তিনি তাঁর পিতামহীর মোদ্ধা কথা, ‘বক্তৃতাই দেশটাকে ডুবালো’ জাতীয় ধারলো বক্তব্য দ্বারা অনুপ্রানিত ছিলেন। বক্তৃতা নয়, কাজে উদ্বুদ্ধ করার জন্য যুবা বয়সে তিনি ধারাবাহিক জ্বালাময়ী এবং উদ্দীপনামূলক কর্মসূচী গ্রহন করেন। তিনি মিলিটারী ট্রেনিংএও উদ্বুদ্ধ হন।

বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ প্রকাশের পর, সক্রিয় যুদ্ধ ভদ্রলোকদের কাছে একটা আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ব্রহ্মবান্ধব, ঠিক এই সময়, সম্ভবত গীতায় অনুপ্রানিত হয়ে এ পথকেই কার্যকরী পদক্ষেপ হিসেবে চিন্তাভাবনা করেন৬৩।

কাজেই ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষিত হওয়া সত্বেও যুদ্ধাংদেহী মিলিটারী মনোভাব ব্রহ্মবান্ধবের হিন্দুজীবন ধারায় বড় হয়ে উঠার সাথে আত্মিক সংগতিপূর্ণ। জুলিয়াস লিপনার বলেছেন, তাঁর পারিবারিক বিগ্রহ ছিল কালী। পরবর্তীকালে সাধু রামকৃষ্ণ ‘কালীর এক দয়াময়ী দেবী রূপ বংগদেশে জনপ্রিয় করে তুলেন। অন্য পক্ষে, ব্রহ্মবান্ধবের কালী শত্রুর কাছে ছিল রুদ্রমূর্তিধারিণী, সংহারকারী, এবং ভীতিসঞ্চারক, কিন্তু পূজারীদের কাছে কল্যাণময়ী’৬৪।

১৮৯০ দশকে ব্রহ্মবান্ধবের ক্যাথলিক বিশ্বাসে ক্রমশঃ ভাটা পড়ে – একসময় বেদান্তিক হিন্দুধর্মের কাছাকাছি চলে আসেন। ফলে কলিকাতার ক্যাথলিক নেতাদের সাথে তাঁর সমস্যা সৃষ্টি হয়। ১৮৯৪ সালে ব্রহ্মবান্ধব একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেছিলেন। এই সময় এই পত্রিকা রবিঠাকুরের কবিতা ছাপতে শুরু করে। রবিঠাকুরের কবি জীবন নিয়ে ব্রহ্মবান্ধবের তেমন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু তাঁদের মধ্যে ভাল বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। সমসাময়িক কালে ১৯০১ সালে রবিঠাকুরের নতুন বিদ্যালয় (শান্তি নিকেতনে) স্থাপিত হয়। রবিঠাকুর ব্রহ্মবান্ধবকে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিতে বলেন। ব্রহ্মবান্ধব এটা চেয়েছিলেন। কিন্তু শান্তি নিকেতনে তাঁর থাকার মেয়াদটা খুবই সংক্ষিপ্ত হয়, কারণটা একেবারে তুচ্ছ নয় যে, রবিঠাকুর তাঁর কঠিন নিয়মানুবর্তিতা পছন্দ করেননি (রবিঠাকুরের ছেলে, রথীন্দ্রনাথের মতে তিনি ক্রিকেট খেলার মত নিয়মানুবর্তী ছিলেন)৬৫।

দেশপ্রেমের চূড়ান্ত পর্যায়ে রবিঠাকুর ব্রহ্মবান্ধবের কর্ম পদ্ধতির প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। ব্রহ্মবান্ধব একজন খুবই জ্ঞানী ব্যক্তি এবং আধ্যাত্মিক পুরুষ ছিলেন। তিনি ধর্ম এবং রাজনীতি নিয়ে চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত যাওয়ার লোক ছিলেন। ১৯০০ সালের দিকে খ্রিস্ট ধর্ম ত্যাগ করে তিনি পুনরায় হিন্দুধর্মে ফিরে আসেন। কার্জন কর্তৃক বংগভংগকে তিনি প্রচন্ড রকম অপমান মনে করলেন। বৃটিশ বিরোধী একটি বাংলা পত্রিকা বের করলেন। ১৯০৭ সালে তাঁকে রাষ্ট্রদোহিতার অভিযোগ করা হয়। নন্দীর মতে ব্রহ্মবান্ধব কোর্টে যেতে অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি এই মামলায় অংশ গ্রহন করব না। কারণ ‘স্বরাজ’ (স্বাধীকার) আমাদের ঈশ্বর প্রদত্ত অধিকার। আমি বিনীত ভাবে এই অধিকারের জন্য কাজ করছি। ঘটনাচক্রে যে বিদেশীরা আমাদের শাসক হয়েছে, আমি বিশ্বাস করি না, তাদের কাছে আমার কোন জবাবদিহি করতে হবে’৬৬।

বৃটিশরা ব্রহ্মবান্ধবের বিরুদ্ধে মামলা করার সময়টাতে, তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত ১৯০৭ সালের অক্টোবর মাসে টিটেনাস সংক্রমণ থেকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অনেক ভারতীয়রা মনে করেন, বৃটিশদের হেনস্থা এড়ানোর জন্যই তিনি একজন বীরের ন্যায় আত্মহনন করেন৬৭।
%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b6%e0%a7%80-%e0%a6%b0%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%a0%e0%a6%be%e0%a6%95%e0%a7%81%e0%a6%b0প্লেট ১। ১৯০৫ সালে স্বদেশী রবিঠাকুর। এই সময়টাতে স্বদেশীদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের জন্য তিনি জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক রাজনৈতিক আদর্শ থেকে বেরিয়ে আসেন। (ছবি সৌজন্যঃ রবীন্দ্র ভবন, শান্তিনিকেতন।)

১৯০১ থেকে ১৯০৮ সাল সময়ে, চতুর্দিকে যুগপৎ নানাবিধ পরিবর্তন ঘটতে থাকে। রবিঠাকুরের চিন্তাশীলতায় দ্বিধা-দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করা যায়। রসিঙ্ক চৌধুরী লিখেন, ‘এই সময়ের সবচেয়ে কৃতিত্বপূর্ণ এবং চিন্তাশীল লেখক রবিঠাকুর বংগদেশে হিন্দু জীবনধারা নিয়ে বিস্তর লেখালেখি করেন। তিনি তখন পুনর্জাগরণের এক উচ্চ স্থানীয় ব্যক্তিত্ব’৬৮। তিনি স্বদেশী সমাজকে প্রশ্ন করেন, ‘হিন্দু ধর্ম কি আমাদের সবাইকে একাত্মতার বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারবে না? দেশ মাতার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করতে পারবে না? এ দেশ ঈশ্বরের দেশ, এ দেশ মুনি-ঋষিদের দেশ, আমাদের পূর্ব পুরুষের দেশ’৬৯। ‘হিন্দু পূনর্জাগরণে’র এ স্রোত ক্ষণস্থায়ী ছিল। দেশপ্রেমিক স্বদেশী আন্দোলন-জাত ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ দেখে রবিঠাকুর খুবই মর্মাহত হন। একই ভাবে, ব্রহ্মবান্ধবের মর্মান্তিক বিয়োগ রবিঠাকুরকে দারুণভাবে বিমর্ষ করে ফেলে। এমন কি আশীষ নন্দী বলতে চাইছেন, ব্রহ্মবান্ধব ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অন্তরেরই একটি বাড়তি সত্ত্বা। সেই জন্যই তাঁর প্রতি রবিঠাকুরের এত একাত্মবোধ৭০। ‘উদার’ ক্যাথলিক ধর্ম ছেড়ে ব্রহ্মবান্ধব ‘যুদ্ধংদেহী আদর্শে উজ্জীবিত’ হিন্দু ধর্মে চলে আসেন। তিনি মনে করেন ‘পশ্চিমা আগ্রাসন যে কোন মূল্যে প্রতিহত করতে হবে’৭১। ব্রহ্মবান্ধবের এই রূপান্তর ছিল যুক্তিসংগত। বিপিন চন্দ্র পাল, অরবিন্দ ঘোষ এবং বাল গংগাধর তিলক প্রমুখ এরকমই জাতীয়তাবাদী ছিলেন।

১৯৩৬ সালে প্রকাশিত রবিঠাকুরের চার অধ্যায় উপন্যাসের উপাদান ছিল – দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ এবং স্বাধীকার। এই উপন্যাসে রবিঠাকুর তাঁর স্মৃতিতে ব্রহ্মবান্ধব এবং উপন্যাসের বিষয়বস্তুর যোগসূত্র পরিষ্কার করে উপস্থাপন করেন। বংগভংগের সময়টা লিখতে গিয়ে রবিঠাকুর ব্রহ্মবান্ধবের একটা মূল্যায়ন তুলে ধরেন। এর পুরোটাই তুলে ধরা আবশ্যকঃ

আবেগে উদ্বেলিত সন্যাসীকে (ব্রহ্মবান্ধব) আমি একদিন দেখলাম সারাদেশ নিয়ে তিনি তোলপাড় খাচ্ছেন। দেশ জেগে উঠল। তিনি সন্ধ্যার সূচনা করলেন। দৈনিক পত্রিকায় জ্বালাময়ী ভাষায় যে যাদুমন্ত্র তিনি ঢালতে শুরু করলেন তা দেশবাসীর শিরায় শিরায় শিহরণের সৃষ্টি করল। এই পত্রিকাতেই প্রথম সন্ত্রাসের ধারণা দেওয়া হল … আকারে ইঙ্গিতে সারা বংগদেশে এই পদ্ধতি বেরুতে থাকল। বেদান্ত সন্যাসীর এরকম চাঞ্চল্যকর রূপান্তর আমি কোনদিন ভাবতেও পারিনি। এই সময়টাতে অনেকদিন তাঁর সাথে আমার দেখা হয়নি। আমার মনে হয় আমাদের ভিন্ন মতাদর্শের কারণে হয়তো বা তিনি আমার কাছ থেকে দূরেই থেকেছেন… চারদিকে নানাবিধ ঘটনার ছড়াছড়ি এবং অমানুষিক অত্যাচার আমাদেরকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখত। জোড়াসাকো বাড়ীর তৃতীয় তলায় একদিন আমি একাকী ছিলাম, হঠাৎ দেখি ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় প্রবেশ করলেন। আমাদের আলোচনায় পূর্বের কিছু বিষয় যুক্ত হল। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর চলে যাওয়ার জন্য তিনি উঠে দাঁড়ালেন। সেই ক্ষণে তিনি পেছন ফিরে আমার দিকে তাকালেন। বললেন, ‘রবি বাবু, আমি একেবারে শেষ হয়ে গেছি’ … এটা বলার পরে তিনি তৎক্ষণাৎ চলে গেলেন। স্পষ্টতই এটা ছিল তাঁর হৃদয় বিদারক অভিব্যক্তি। এ বাক্যটি থেকে বোঝাই যাচ্ছে যে তিনি শুধুমাত্র আমার সাথে দেখা করতেই এসেছিলেন। তিনি খুবই যন্ত্রনাদায়ক অবস্থায় জড়িয়ে পড়েছিলেন – বেরিয়ে আসার কোন পথ ছিল না। আমার কাছে এটাই ছিল তাঁর শেষ কথা, এবং আমাদের শেষ দেখা৭২।

কিছু তথ্য থেকে দেখা যায়, ১৯০৮ সালে রবিঠাকুরের মনে লক্ষ্যনীয় ভাবান্তর ঘটে। স্বদেশী আন্দোলনের অব্যবহিত পরে, সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজে এক ভাষণ দেন। তিনি আলোকপাত করেন, কলিকাতা বা বংগদেশের চিন্তাশীলদের বাইরে, সারা ভারতবর্ষের চিন্তাশীলদের কাছে কীভাবে তিনি তাঁর বক্তব্য তুলে ধরবেন। তিনি আন্তর্জাতিক, বিশেষত বৃটিশ শ্রোতাদের কাছেও তাঁর বক্তব্য পৌঁছে দেওয়ার কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘এক জায়গায় সহাবস্থানের মাধ্যমে মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে হবে। আমাদের পরস্পরের কাছাকাছি আসতে হবে, একজন ইংরেজের ভাল লাগার জিনিষটিও আমাদেরকে বুঝতে হবে – হোক সে একজন সৈনিক, ব্যবসায়ী, বা একজন রাজ কর্মচারী। একজন ভারতীয়ের সাথে একজন ইংরেজের মধ্যে যখনই দূরত্ব থাকবে, তখনই দুএর মাঝে চরম বিভেদ এবং উত্তেজনা সৃষ্টি হবে’৭৩।

১৯১০ সাল। স্বদেশী আন্দোলনের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ এবং ব্রহ্মবান্ধবের তেজোদীপ্ত নেতৃত্ব তখন আর নাই। রবিঠাকুর কেশববাদদের সাথে একটা সমঝোতা করেন। নিজের চিন্তাশীলতা এবং পরিবার ও সমাজের ঐতিয্য সমন্বয়ে তিনি একটি নতুন পদক্ষেপের চিন্তা করলেন। এই বছর, কেশব সেন বার্ষিকী বক্তৃতায়, রবিঠাকুর দাবী করলেন, ‘প্রতিটা ধর্ম থেকে সত্যের সন্ধান করতে হবে – সত্যকে প্রকাশ করতে হবে তারপর তা অন্তর দিয়ে গ্রহন করতে হবে। এটাই ছিল কেশব চন্দ্রের মৌলিক ইচ্ছা।

[তুলনামূলক ধর্মগ্রন্থ থেকে] এ সত্যকেই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন এবং এই উপলব্ধিকে প্রশ্নাতীত নতুনবাণী হিসেবে সব কিছুর উপরে তিনি স্থান দিয়েছিলেন। আমি যখন এই বাণীর মর্ম বুঝতে পারলাম, তাঁর সাথে আমার অতীতের সব বিরোধ তিরোহিত হল। আজ আমি তাঁর প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি’৭৪। ডেভিড কফ বলেন, ‘কেশব চন্দ্রের আদর্শ ছিল, ধর্মীয় বিভিন্নতার মধ্যেই নিহিত আছে ঐক্য । এ বক্তৃতা থেকে এটা পরিষ্কার হল যে, রবিঠাকুর সত্যের জন্য মূল্যবান ও সাহসিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে কেশব চন্দ্রের এই আদর্শকে গ্রহন করলেন’৭৫। এবং এটা ছিল স্বদেশী আন্দোলন পরবর্তী রবিঠাকুরের চিন্তা বিকাশের এক পরম মুহুর্ত। রবিঠাকুরের আত্ম-উপলব্ধি হল। তিনি কেশব চন্দ্রের বিশ্বজনীন আদর্শকে গ্রহন করলেন। আদি, কেশববাদ, এবং সাধারণ ব্রাহ্মধর্মের তিন শাখাকে একত্রীকরণের নিমিত্তে, ১৯১১ সালে রবিঠাকুর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার পুনপ্রতিষ্ঠা করলেন। রবিঠাকুরের বয়স তখন পঞ্চাশ পার হয়ে গেছে। তিনি পাশ্চাত্য ভ্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এটা নিশ্চয় কোন আকস্মিক ঘটনা নয় যে, ঠিক এই সময়টাতেই তিনি বুঝতে পারলেন, ‘তৎকালীন অসুস্থ বংগ সমাজ ও রাজনীতির প্রতিশেধক হিসেবে’ ব্রাহ্ম ঐতিহ্যকে লালন এবং পালন করতে হবে৭৬। ‘তিনি তাঁর নিজ হিন্দু ধর্ম এবং সামাজিক-রাজনৈতিক বিশ্বজনীনতার প্রেক্ষিতে কোন অসামঞ্জস্যতা দেখতে পেলেন না’৭৭।

আবির্ভাব, সত্যতা এবং ক্রিয়া

স্বদেশী আন্দোলনোত্তর ‘পূর্ণবিকশিত’ রবিঠাকুরের চিন্তাধারণাটি কী রকম এবং ১৯১২ সাল থেকে রবিঠাকুরের চিন্তাভাবনার সাথে পাশ্চাত্যের মিল বন্ধনের যোগসূত্রটি কী? উপনিষদের প্রধান বাণী একেশ্বরবাদই হল ব্রাহ্মণ। তিনি সেখান থেকেই শুরু করলেন। শঙ্করের কার্যপদ্ধতির ভিত্তি ছিল একেশ্বরবাদ। রামমোহন গ্রহন করেছিলেন, কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ বাতিল করেছিলেন। কিন্তু, কল্যান সেনগুপ্তের মতে, উপনিশদীয় একেশ্বরবাদের কেন্দ্রীয় বিষয় হল, উপনিষদ আমাদের মেটাফিজিক্যাল সত্যের একটা ধারণা দিতে চেষ্টা করে … আমাদের প্রত্যেকের মাঝে স্রষ্টার ইচ্ছার প্রতিফলন হয়, অন্যভাবে দেখলে – আমরা সবাই মিলে একই আত্মা৭৮। এই মেটাফিজিক্যাল ধারণার সাথে জীবনের মূল্যবোধের সম্পর্ক পরিষ্কার। রবিঠাকুর এই বিষয়টাই তুলে ধরেছেন।

উপনিষদ নিয়ে রবিঠাকুরের ব্যাখ্যা একেশ্বরবাদেরই নামান্তর। মানবীয় গুনাবলী ব্রাহ্মণ থেকেই আসে৭৯। রবীন্দ্রনাথের জন্য অস্তিত্বের নানা মাত্রা একই সত্যে বিলীন। এই অর্থে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর পিতার দ্বৈতবাদে ঋণী না হয়ে রামমোহনের কাছে ঋণী। ‘পূনর্জীবিত বংগদেশ’ বইতে ভবতোষ দত্ত বলেছেন, ‘উপনিষদ থেকে রবীন্দ্রনাথ পরম সত্যকে বুঝতে পেরেছেন যা সমস্ত, জাত-ফাত, ধর্ম এবং জাতীয়তাবাদের উর্দ্ধে … এটা কোন বৈজ্ঞানিক ভাবধারা নয়, এমনকি আধুনিক রাজনৈতিক সমাজবাদীদের ধারণাও নয়’৮০। দত্ত ঠিকই বলেছেন – রবিঠাকুর বিজ্ঞান এবং সমাজবিদ্যার কোনটা থেকেই কিছু নেননি। রবিঠাকুরের অবস্থান উপনিষদ দিয়েই বুঝতে হবে, দত্তের এই ধারণা বিভ্রান্তিকর। রবিঠাকুর উপনিষদ তথ্যনির্দেশ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এই সব থেকে তাঁর সমন্ধে কোন পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যায় না৮১। আসলে আমার মতে, গোঁড়া অদ্বৈত বেদান্ত উপনিশদে, মায়া এবং সত্যের পৃথিবীর মধ্যে স্পষ্ট দ্বৈততা আছে৮২। এই জন্যই সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ পাশ্চাত্যের পাঠকদের কাছে বেদান্তের একজন বিজ্ঞব্যক্তি হিসেবে রবিঠাকুরকে উপস্থাপন করতে যেয়ে ভুল করে ফেলেছেন৮৩। রবিঠাকুরের পৃথিবীতে মায়া এবং সত্য ‘অংগাংগিভাবে জড়িত’। রবিঠাকুর কোন জিনিষকে হুবহু গ্রহন করেননি। তাঁর চিন্তাচেতনায় তাঁর স্বকীয়তা বিদ্যমান৮৪। রবিঠাকুরের কাছে মায়ার সত্ত্বা কী তা বুঝতে হলে তিনি ‘নিজস্ব ঈশ্বর’ বলতে কী মনে করেন তা বুঝতে হবে।

‘নিজস্ব মানুষ এবং নিজস্ব ঈশ্বর’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরবোধের উপর আর. ডি. ভট্টাচার্য পছন্দসই একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে রবিঠাকুর দুটি ভিন্ন স্তরে ভাবতেন, ‘প্রয়োজনীয় এবং বিদ্যমানীয়’। ঈশ্বর হলেন পরিপূর্ণ সত্ত্বা। কিন্তু খ্রিস্টীয় মতে ঈশ্বর হলে পরিপূর্ণ শক্তিসম্পন্য এবং পরিপূর্ণ দয়ার আধারঃ অর্থাৎ ঈশ্বর এক ‘বিশাল অভিভাবকের আসনে আসীন’ ৮৫। আসলে, ঈশ্বর অস্তিত্বমান। বেশী ভাবলে বলতে হয়, একটি শক্তি থেকেই মানুষের এই পৃথিবী তৈরী হয়েছে। আমাদের বুঝতে হবে ঈশ্বরের সৃষ্টি এখনও শেষ হয়নি; অর্থাৎ এটা কোন দিকে যাচ্ছে। এই ধারণা থেকেই ভট্টাচার্য বলেছেন, রবিঠাকুরের ‘নিজস্ব ঈশ্বর’- মানুষ নিয়ে তাঁর চিন্তারই ফসল। তাহলে দেখা যাচ্ছে সবার দৃষ্টিই সৃষ্টির মাহাত্মের মধ্যেই নিহিত৮৬। ‘অতিরিক্ত’ সৃষ্টি তত্ত্ব, আমাদের অস্তিত্বের অভিজ্ঞতা, সবাই মিলে মিশে বেঁচে থাকার তীব্র তাগিদ ইত্যাদি উপকরণ মানুষের সার্বিক বৈশিষ্ট বুঝার জন্য খুবই উপযোগী। রবিঠাকুর ঈশ্বরের মাঝে এক ‘শিল্পী-সত্ত্বা’ দেখেছেন। ভট্টাচার্যের মতে, রবিঠাকুর বিশ্বাস করতেন শিল্প-ক্রিয়া হল ‘অন্ধকারে হাতড়ানো’ এবং ‘হঠাৎ আলোর সন্ধান’ পাওয়ার মিশ্রণ। ‘হাতড়ানো’ ব্যাপারটি ‘মায়ার এক রূপক অবস্থা’। এই প্রেক্ষিতে, একটা পরিষ্কার ‘চৈতন্যহীনতা’র (ভট্টাচার্য পরে, ‘অবচেতন’ শব্দ ব্যবহার করেছেন) উপকরণ আছে৮৭। এ বিশ্বটি যদি ‘নিজস্ব ঈশ্বরের’ সৃষ্টি হয়, তবে, মায়াকে ঈশ্বরের সৃষ্টিশীলতার প্রতীক হিসেবেই ধরা যায়, কিন্তু এটা অসমাপ্ত।

ভট্টাচার্য যা বুঝাতে চাইছেন তার সাথে রবিঠাকুরের সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিষয়ে লেখায় প্রতিফলিত হয়। রবিঠাকুর যেভাবে দেখেন আমরা আসলে সেই বিশ্বেই বাস করি। ‘আমরা যা জানি এবং অনুভব করি তার বাইরে যেতে পারিনা’৮৮, রবিঠাকুরের এই মেটাফিজিক্যাল ধারণা পরিষ্কার। এই মেটাফিজিক্যাল ধারণার বাইরে কোন কারণ নাই। আসলে রবিঠাকুরের মানসে এই ধারণাটাই সত্য। আবেগপ্রবনতা পদ্ধতির অভিজ্ঞতায় দৃঢ় প্রত্যয় তৈরী হয় যে মানুষ এবং ঈশ্বর, মানুষ এবং মানুষ, এমনকি মানুষের সাথে প্রকৃতির মধ্যে কোন বৈরীতা নেই। অথচ, সেনগুপ্ত বলেন, স্বকীয়তা ‘কেন্দ্রবিহীন’। একজন মানুষ নিজ সত্ত্বা ছাড়া, অন্য জন থেকে আলাদা, এরকম সত্ত্বাকে শুধু বলা যাবে, ‘আছে ওখানে’, কোথাও এই বিশ্বে। অনেকটা এরকমই বলেছেন হাইডগার, ‘রয়েছে এই পৃথিবীতে’ এবং ‘মানুষের একটা অস্পষ্ট দিক’। এটা ‘নিজ স্বাধীন অভিব্যক্তির পরিপন্থী’৮৯। রাধাকৃষ্ণণের মতে, ‘আমি আর আমি-নই এই দ্বৈত আবেশবোধের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। কিন্তু এটা একই অন্তিম শক্তির প্রকাশ’৯০।

সৃষ্টির প্রতি চৈতন্যহীন ইম্পালসের ধারণা থেকে রবিঠাকুরের উপর ভট্টাচার্যের ব্যাখা ঈশ্বর এবং মানুষের মধ্যে এক আন্তরিক বন্ধন সৃষ্টি করে। এই ব্যাখ্যা আদি ব্যাখ্যা অর্থাৎ মানুষের এই পৃথিবী বা স্রষ্টার বিশ্ব সৃষ্টি তত্ত্বকে ব্যাহত করেনা – সৃষ্টি ক্রমাগত চলছে এবং যাচ্ছে কোন এক বড় সৃষ্টির দিকে। ভট্টাচার্য বলেন, এই অগ্রসরতা ‘সর্বশক্তিমানের আদল ঠিক রেখে শূন্য আদিপুরুষের ধারণাকে বাতিল করে দেয়’। ‘সর্বশক্তিমান এবং সর্বজ্ঞ – ঈশ্বরের দ্বৈতসত্ত্বার ভ্রান্ত ধারণাকেও নস্যাৎ করে দেয় (মায়াবাদ মতে তিনি নতুনতর। এবং তিনি যেহেতু সর্বজ্ঞ নন, তাঁর ক্ষমতা কার্যতঃ সীমিত)’৯১। সৃষ্টি করার ক্ষমতাহীন ঈশ্বর অপূর্ণ। সর্বময় ঈশ্বরের দুইটি প্রকৃতি আছে। ‘ঈশ্বরের ‘চেতনা’ প্রকৃতির মধ্যে আমরা তাঁর সর্বজ্ঞের গুনাবলী দেখি, যেমন – প্রেম, আনন্দ, এবং সহযোগিতা, এবং এর পরেও তাঁর মায়া-প্রকৃতি আমাদের বুদ্ধির বাইরে থাকে, এবং অনেকের কাছে তা ভয়ানক৯২। এটা, আমাদের কাছে বোধগম্য যে, আমার মতে, ঈশ্বরের মানুষ এবং পৃথিবী দরকার, এর উল্টাটাও হতে পারে। ‘ঈশ্বর হলেন একজন পূর্ণাংগ সত্ত্বা। ভাল এবং ভয়াভহতার এক শিল্পী-সত্ত্বা … আমাদের জন্য তাঁর প্রেম আছে, তাঁকে বুঝা যায়’৯৩। সব শিল্পীদের মত, ‘তিনি ভাব-বিনিময় করতে চান’ এবং ‘একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্ত্বা ভাব-বিনিময়ের গ্রহনকারী’৯৪। ঈশ্বর মানুষের অন্তরেই অবস্থান করেন – রবিঠাকুরের এই ধারণা এবং ‘চেতনাহীন’ মায়ার কিছু উপাদান থেকে আমরা আনন্দ ও বেদনা, জীবন ও মৃত্যু, প্রেম ও ভীতির উপস্থিতি বুঝতে পারি। রবিঠাকুরের মত, সর্বশক্তিমানের এইসব প্রকৃতি এবং এইসবগুলোকে বিশ্বাসের মধ্যদিয়েই আমরা ঈশ্বরের পথে অগ্রসর হতে পারি। যেরকম ঈশ্বরের সৃষ্টির সব প্রকৃতিগুলোকে স্বীকার করি, সেরকম করেই আমরা স্বীকার করি আমাদের সৃষ্টির তাগিদ। রবীন্দ্রনাথের জন্য এটা ছিল ফল্গুধারার মত প্রতিদিন যা উপনিষদের দৃষ্টিভঙ্গিকেই প্রমান করে। রবিঠাকুরের প্রিয় উদাহরণ ছিল সুফীবাদ – শান্তিনিকেতনের কাছাকাছি বসবাসরত সাওতাল উপজাতি এবং বংগদেশের বাউল সাধনা৯৫। রবিঠাকুরের চোখে এই মানুষগুলো মূল্যবান যে, ঈশ্বরের সৃষ্টি হয়েও সাধারণ মানুষের বাইরে অনাদরে প্রকৃতির সাথে মিশে থাকে। কাজেই রবিঠাকুরের আদর্শের কোন কিছু বুঝার কেন্দ্রে আছে সৃষ্টির ধারণা এবং নিত্যদিনের পৃথিবী।

রবিঠাকুরের আদর্শে সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রক্ষিত

গীতাঞ্জলী প্রকাশের পর অনেক বৃটিশ রবিঠাকুরের আধ্যাত্মবাদ নিয়ে মন্তব্য করেছেন, যেমন, তাঁর একেশ্বরবাদ অনুভূতিকে বড় কর দেখা প্রয়োজনীয় যদিও তাঁর এই অনুভূতি অনুযায়ী বিশ্বটা অপূর্নাংগ থেকে পূর্নাংগতার দিকে অগ্রসরমান। কলিকাতার অনেক বস্তুবাদী জাতিয়তাবাদীরা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে রবিঠাকুরের বিরোধিতা করেছে। রবিঠাকুর স্বকীয় সৃষ্টিশীলতা এবং তার কার্যকারিতা জীবন-দেবতায় নিবন্ধন করেছেন। রবিঠাকুর নিজে এই সৃষ্টিশীলতাকে ‘আদিভৌতিক দন্দ্ব’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন এবং নিজের মধ্যেই (‘আদিভৌতিক দন্দ্ব’) সমাধান করেছেন। তাঁর মতে, ‘মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরকে খুজতে হবে। মানুষ অনাদিকাল থেকেই তাঁকে খুজে চলছে’৯৬। অন্য কথায়, জীবন-দেবতা মর্মকথা হল, মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের বাণী সঞ্চালন এবং মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর দর্শন।
…(চলবে)

দ্রষ্টব্যঃ মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন ঢাকা বিভাগের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এবং হবিগঞ্জ মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ছাড়াও বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকর্তা ছিলেন। তিনি খুবই রসিক মহাজন এবং সদাহাস্যময় ও গানপ্রেমী মানুষ। বর্তমানে তিনি হিউস্টনের অধিবাসী।