banner
লেখকঃ রিয়াজ ওসমানী ও শেখ মোঃ মমিনুল ইসলাম

বৈচিত্র্যই সৌন্দর্য্য। পৃথিবীর সবকিছুতেই বৈচিত্র্য আছে। ঠিক তেমনি এই পৃথিবীর মানুষগুলোর মধ্যেও আছে অনেক বৈচিত্র্য। সেটা হতে পারে একেকজন মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি, জাতীয়তা, চিন্তা-ভাবনা, মতাদর্শ, জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস, অর্থ-সম্পদ, শিক্ষা, পেশা, দেহের আকার-আকৃতি, চোখ-চুল-ত্বকের রং, চেহারা, যৌনতা, লিঙ্গ ইত্যাদি ভিত্তিক। এসবের মধ্যে যৌনতা এবং লিঙ্গ-বৈচিত্র্যের বিষয়টি প্রায়শই উপেক্ষা করা হয় এবং নানা জানা-অজানা কারনে এটা নিয়ে খুব বেশি একটা আলোচনা করা হয় না। হয়তো অনেকে এসব বিষয়ে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করেন, নতুবা এসব বিষয় সম্পর্কে তাঁদের ধারণা খুবই কম। কারণ যাইহোক, পরিসংখ্যান অনুযায়ী পৃথিবীর ৫ থেকে ১০ শতাংশ মানুষ “যৌন সংখ্যালঘু” হিসেবে বিবেচিত। এদেরকে ইংরেজিতে একত্রে এলজিবিটিকিউআইএ+ (LGBTQIA+) জনগোষ্ঠী বলা হয়। এর পূর্ণরূপ হচ্ছে যথাক্রমে: L = সমকামী নারী (লেসবিয়ান/Lesbian), G = সমকামী পুরুষ (গে/Gay), B = উভকামী নারী ও পুরুষ (বাইসেক্সুয়াল/Bisexual), T = রূপান্তরকামী (ট্রান্সজেন্ডার/Transgender), Q = যৌন-প্রকৃতি অনির্ধারিত যাঁদের তাঁরা (কুইয়ার/Queer), I = দৈহিক/জৈবিক/শারীরিক লিঙ্গ অনির্ধারিত যাঁদের তাঁরা (ইন্টারসেক্স/Intersex), A = অযৌন ব্যক্তি (অ্যাসেক্সুয়াল/Asexual), + দিয়ে Pan-sexual (প্যান-সেক্সুয়াল), Gender-fluid (জেন্ডার-ফ্লুয়িড বা তরললিঙ্গ), Genderqueer (জেন্ডারকুইয়ার) ও বিবিধ ব্যক্তিদের বোঝানো হয়েছে।

এদের মধ্যে প্রথম দু’টি গোত্র যৌন ও মানসিকভাবে সমলিঙ্গের মানুষদের প্রতি আকর্ষন বোধ করে, সমাজের রীতি অনুযায়ী বিপরীত লিঙ্গের কারো প্রতি নয়। বাংলাদেশেও এর কোন ব্যতিক্রম নেই এবং অনেকেই আছে যারা পরিবার, বন্ধু-বান্ধব এবং সমাজের আঁড়ালে গোপন যৌন-জীবন যাপন করে। অনেকেই পরিবার ও সমাজের কাছে মুখ রাখার জন্য বিপরীত লিঙ্গের কারোর সাথে লোক দেখানো বিয়েতে আবদ্ধ হয়ে দ্বৈত জীবন যাপন করে। এই দাম্পত্য জীবনগুলো দুই পক্ষের উভয়কেই চরমভাবে ক্ষতি করে; যেহেতু সেগুলো ভালবাসা এবং আন্তরিকতার ভিত্তিতে কাটানো হয় না।

এই বছর ২৫ শে এপ্রিল ইসলামী জঙ্গীদের হাতে সমকামী অধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান এবং সমকামী সাংষ্কৃতিককর্মী মাহবুব রাব্বি তনয় হত্যা হবার পর বাংলাদেশের সমকামীরা নিজেদের জীবনের ভয়ে এখন আত্মগোপনে রয়েছে। যারা পারছে প্রাণ বাঁচাতে তারা হচ্ছে দেশান্তরিত। এটা একটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে সমাজ এবং রাষ্ট্র তাদেরকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে; যার এখনই পরিবর্তন প্রয়োজন। এই পরিবর্তন আনার জন্য প্রথমেই দরকার একটু শিক্ষা, সচেতনতা, আন্তরিকতা এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।

মানুষ কখনই তার লিঙ্গ (সামাজিক এবং দৈহিক লিঙ্গ) এবং যৌনতা বেছে নেয় না। বিষমকামীদের (বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষন বোধ করা সংখ্যাগরিষ্ঠদের) মত সমকামীরাও তাদের যৌনতা নিয়ে জন্মগ্রহন করে যা তারা প্রাপ্তবয়সে উপলব্ধি করে। কেউ এই যৌনতা বেছে নেয় না। এখানে বাছাইয়ের কিছু নেই। উপরন্তু কেউ নিজের যৌনতা বদল করতে পারে না। এর অর্থ হল একজন সমকামী কখনো নানা প্রক্রিয়ায় “বিষমকামী” হয়ে যেতে পারে না এবং ছোট ছেলে মেয়েদেরকে কখনও সমকামীরা প্রভাবিত করে “সমকামী” বানিয়ে দিতে পারে না। বড় হয়ে কেউ হঠাৎ সমকামী হয়ে যায় না। তাদের যৌনতা আরো অনেক আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে প্রাকৃতিকভাবেই।

মার্কিন সাইকোলজিকাল এসোসিয়েশন, ভারত ও পশ্চিমা দুনিয়ার অন্যান্য সংঘটন এবং জাতিসঙ্ঘের মত আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো অনেক আগেই নির্ধারন করেছে” এবং ঘোষণা দিয়েছে যে সমকামিতা কোন মানসিক ব্যাধি বা রোগ নয়। পৃথিবীর জনসংখ্যার একটি ছোট অংশের জন্য এটা হচ্ছে একটি স্বাভাবিক যৌন-প্রকৃতি (sexual orientation) বা বিকাশ।

কোন প্রকার চিকিৎসা, ধর্মীয় অনুশাসন, ঝাড়ফুঁক, কিংবা যে কোন প্রকার শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে এটা পরিবর্তন করা যায় না। গত কয়েক দশক ধরে বিশ্বের অনেক দেশে সমকামী ব্যক্তিদের উপরে নানা প্রকার শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে এটা পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু যারা তা করতে চেয়েছিল তারা ব্যর্থ হয়েছে। অনেক অসাধু চিকিৎসক ও মনোবিজ্ঞানী, বিশেষত কিছু মার্কিন উগ্র ধর্মীয় চিন্তাধারার চিকিৎসকবৃন্দ অনেক সমকামী ব্যক্তিদের উপর নানা প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তাদের যৌনতা পরিবর্তনের চেষ্টা করেও সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে; কিন্তু ভুক্তভোগীদের মাঝে বিষন্নতা ও আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি করেছে দিয়েছে। পশ্চিমা দুনিয়া অনেক আগেই এই সত্যতা মেনে নিয়েছে যে সমকামিতা এবং অন্যান্য যৌন-প্রকৃতি ও লিঙ্গ-পরিচয় গুলো সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক। সে কারণে পশ্চিমা বিশ্ব বৈষম্যমূলক আইনসমূহ (যেমনঃ সমকামীদেরকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে, তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য সৃষ্টি করে, তাদের প্রতি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন হয় এমন আইন এবং তাদেরকে তাদের ভালবাসার মানুষকে বিয়ে করতে বাধা দেয়) এ সকল আইন-কানুন ও প্রথা বাতিল করে দিয়েছে। আর কিভাবে তাদের মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকারসমূহ রক্ষা করা যায় সে ব্যাপারে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে।

বাংলাদেশেও সমকামীদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে এবং মানুষ হিসাবে ও রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে তাদের মৌলিক অধিকারসমূহের প্রতি বৈষম্য হয় এমন সকল আইন বাতিল করে দেয়া এখন অপরিহার্য। আলোচ্য বিষয় হচ্ছে যে, বাংলাদেশের দন্ডবিধিতে যেই ব্যাপারটি সমকামিতাকে অপরাধ হিসেবে তুলে ধরেছে সেই ধারাটি ঐ কারনে সেখানে প্রতিষ্ঠিত করা হয়নি। এই বিষয় বা আইনটি হচ্ছে “রানী ভিক্টোরিয়ার আমলের ৩৭৭ ধারা” যা স্বাধীন দেশ হিসেবে ভারত, পাকিস্তান, এবং অন্যান্য প্রাক্তন বৃটিশ উপনিবেশের দেশগুলোসহ বাংলাদেশও উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে গেছে। এই আইনী ধারায় বলা আছে (বাংলা সারমর্ম) – “যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত ভাবে কোন পুরুষ, নারী বা প্রাণীর সাথে প্রকৃতি বিরূদ্ধ কোন যৌনাচারে লিপ্ত হবে তাকে দশ বছরের কারাদন্ড এবং/অথবা জরিমানা করা হবে”। (এটা শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে – কিছু কিছু দেশে যাবজ্জীবন কারাদন্ড এমন কি মৃত্যুদন্ডের বিধানও রয়েছে)।

যৌনতার ব্যাপারে ব্রিটিশ রাণী ভিক্টোরিয়ার আমলের মানুষদের কিছু আজগুবি চিন্তা ভাবনা ছিল এবং তারা তাদের সাম্রাজ্যে এই আইন পাশ করে দেয়। এই আইনের ফলে সেখানে দুটো মানুষ অথবা একজন মানুষ এবং একটি প্রাণীর মধ্যে “মানব সন্তান গর্ভধারণ হয় না” এমন জাতীয় যৌনাচারকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়। এর অর্থ হল একজন পুরুষ ও একজন নারী যদি এমন কোন যৌনাচারে লিপ্ত হয় (যেমনঃ পায়ুকাম, হস্তমৈথুন, মুখমেহন ইত্যাদি) যাতে গর্ভধারণ সম্ভব নয় (জন্ম নিয়ন্ত্রন পদ্ধতির কথা বলছি না এখানে), তাহলে তারা এই আইনের ফলে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাবে। এর অর্থ এটাও হয়ে যায় যে দু’জন সমকামীর মধ্যে যে কোন যৌনাচার “অপরাধ” হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু এই দ্বিতীয় ব্যাপারটি ছিল একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি। এখানে মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল সকল যৌনাচার যেন শুধু মানব সন্তান গর্ভধারণ করার মধ্যে সীমিত থাকে। আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি যে, যে সকল বিষমকামী দম্পতি সন্তান জন্মদানে অপারগ তারা কি তাদের সন্তান জন্মদানের অপারগতার জন্য “অপরাধী” হিসাবে গণ্য হবেন? তাদের এই আপারগতা কি “প্রকৃতি বিরুদ্ধ”? যদি তাদের এই আপারগতা “প্রকৃতি বিরুদ্ধ” হয়, তাহলে প্রকৃতি কেন তাদেরকে এভাবে সৃষ্টি করলো?

আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে এই নগ্ন আইনী হস্তক্ষেপের জন্য ব্রিটিশদের দোষারোপ করা এখন বৃথা। অনেকগুলো বছর পার হয়েছে আমরা স্বাধীন হয়েছি এবং বিলেতীরা তাদের দেশে তাদের নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য দূর করতে তাদের নিজেদের আইনী খাতা থেকে ৩৭৭ ধারার মত তাদের যে নিজস্ব ধারাগুলি ছিল সেসব বাতিল করে দিয়েছে এবং সকল নাগরিকদের সমান অধিকার ও মর্যাদা দিয়েছে।

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ীঃ “সকল নাগরিকগন আইনের চোখে সমান এবং সকল প্রকার আইনী নিরাপত্তার অধিকারী… ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, লিঙ্গ অথবা জন্মস্থানের ভিত্তিতে রাষ্ট্র কোন নাগরিকের বিরূদ্ধে বৈষম্য করবে না”।

ভারতে ৩৭৭ ধারার বিরূদ্ধে আইনী অভিযোগে যেমনটি করা হয়েছে, বাংলাদেশেও উল্লেখিত অনুচ্ছেদে যৌন-প্রকৃতি এবং লিঙ্গ-পরিচয়কে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আমি দেশের ৩৭৭ ধারার বিরূদ্ধে এমন একটি আইনী চ্যালেঞ্জ আনার আহ্বান জানাচ্ছি যেহেতু এই ধারাটি আমাদের সংবিধানের মূলমন্ত্রের পরিপন্থি। কোন অবস্থাতেই ৩৭৭ ধারার ফলে বাংলাদেশের সমকামীদেরকে “অপরাধী” হিসেবে গন্য করা যাবে না।

বর্তমান পরিস্থিতিতে যেখানে ইসলামী জঙ্গীরা প্রকাশ্যে সমকামীদের হত্যা করছে এবং সামাজিক মাধ্যম ব্যাবহার করে এরকম আরও হত্যার হুমকি দিয়েছে, সেখানে মৃত্যুর ভয়ে একজন সমকামীকে বাংলাদেশের পুলিশের কাছে নিরাপত্তা চাওয়া সম্ভব নয়। সেই ব্যক্তি পরিণতিতে উল্টো গ্রেফতার বা ধর্ষনের শিকার হতে পারে। এই বর্বর দন্ডবিধিটি উঠিয়ে দিলে অন্ততঃপক্ষে তারা আইনের আশ্রয় নেয়ার সুযোগ পাবে।

প্রসঙ্গক্রমে এবার চলে আসছি বাংলাদেশে সার্বজনীন জীবনে ধর্মের ভূমিকা বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের ভূমিকাকে নিয়ে। দেশে সমকামীদের সামাজিক আন্দোলন একটি স্থির পর্যায়ে এসে যাবে (যদি ইতোমধ্যে না এসে থাকে) যতক্ষন পর্যন্ত রাজনীতিবীদ, সুশীল সমাজ, এবং বিশেষ করে ধর্মভিত্তিক গোষ্টীগুলো ৩৭৭ ধারা উঠিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিরোধক বা প্রতিবন্ধক হিসেবে “ধর্ম” বিশেষকরে ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করবে, এবং সমকামীদের সমান নাগরিক হওয়া থেকে বঞ্চিত করার জন্য তাকে চিহ্নিত করবে। যদিও অধিকাংশ মুসলমান এবং অন্যান্য ধর্মালম্বীরা এক বাক্যে বলে যে তাদের ধর্ম সমকামীদের বিরূদ্ধে এবং সমকামীরা শাস্তির যোগ্য, তাদের কাছে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে কোন্ ধর্মীয় অনুশাসন তাদেরকে এই ধারণা দিয়েছে; তখন তারা শুণ্যের দিকে তাকিয়ে থাকে কিংবা বলে যে অমুক হুজুর বা অমুক ঠাকুর বলেছে কিংবা আমার বাপ-দাদা বলেছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

কোন কোন সময়ে আমরা লুতের কাহিনীর কথা শুনে থাকি যা কোর’আন শরীফ, বাইবেলের “ওল্ড টেস্টামেন্ট” এবং “তাওরাত শরীফ” (যা ইহুদী ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ) নামক জায়গায় উল্লেখ করা আছে। এই গল্পে আছে যে সমকামিতার কারনে সৃষ্টিকর্তা নাকি “সদোম” বা “গমোরা” নামের একটি শহরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। সমকামীদের প্রতি প্রচন্ড বিরূপ মনোভাবের উৎস শুধু মাত্র এই গল্পটিই।

অথচ এই গল্পের আসল অর্থ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। পশ্চিমা দুনিয়াতে ইসলাম নিয়ে অনেক গবেষকরা বলছেন যে এই গল্পে প্রাপ্তবয়স্ক সমকামীদের মধ্যে সম্মতিসূচক যৌনাচার নিয়ে কোন কথা বলা হয়নি, বলা হয়েছে পুরুষ ধর্ষনের বিরূদ্ধে যা ছিল সেই শহরে প্রবল। আমি এই বিষয়ে কোন গভীর আলোচনায় যেতে চাই না; যেহেতু এই বিষয়টি ধর্মীয় গবেষকদের চিন্তার বিষয় এবং তাদের বেলায় বেশি প্রাসঙ্গিক। যে দেশের আইন-কানুন জনগনের সাধারন আইন (Common Law) দিয়ে গঠিত এবং যা ধর্মনিরপেক্ষ এবং সার্বজনীন, সে দেশে এমন ধর্মভিত্তিক আইন, তার ব্যখ্যা বা নীতি প্রয়োগ প্রযোজ্য নয়। যেহেতু বাংলাদেশ একটি (নামে মাত্র হলেও) ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ, যেখানে বিভিন্ন ধর্মের অবলম্বনকারীরা সমান মর্যাদা ভোগ করে (ইসলাম রাষ্ট্র ধর্ম হওয়ার মত অসংগতিপূর্ণ ব্যাপার হওয়া সত্ত্বেও), সেখানে যারা কোন ধর্ম পালন করে না বা সমকামীদের মধ্যে যারা কোন ধর্ম পালন করে বা করে না, তাদেরও সমান জায়গা থাকতে হবে (উল্লেখ্য; সব সমাজেই সমকামীরা আছে; তা সে মুসলমান সমাজেই হোক, হিন্দু সমাজেই হোক কিংবা খ্রিস্টান বা বৌদ্ধ সমাজেই হোক। সমকামীরা আস্তিক এবং নাস্তিক উভয়ই হতে পারেন। সমকামীদেরকে পূর্ন নাগরিক অধিকার দিতে হবে, অপরাধী হিসেবে গন্য করা যাবে না এবং তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রকার বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না) ।

ব্রিটিশরা আসার পূর্বে ভারতবর্ষ কয়েকশত বছর মুসলমানদের দ্বারা শাসিত হলেও, কোন মুসলমান শাসক কখনই সমকামিতার বিরুদ্ধে কোন আইন তৈরি বা প্রয়োগ করেননি। ভারতবর্ষের হিন্দু শাসকগণও কখনই সমকামিতার বিরুদ্ধে কোন আইন তৈরি বা প্রয়োগ করেননি। ব্রিটিশ রাণী ভিক্টোরিয়াই প্রথম সমকামিতার বিরুদ্ধে আইন তৈরি করে প্রয়োগ করেছিলেন সমগ্র ব্রিটিশ উপনিবেশে। এটাই ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত সত্য।

এই ব্যাপারে সামাজিক নমনীয়তা অনেক পরে আসলেও দেশের রাজনীতিবীদ এবং আইনজীবিদের দূরদর্শিতা দেখাতে আমি আহ্বান জানাচ্ছি। আহবান জানাচ্ছি আইন বদলানোর উদ্যোগ নিতে। পশ্চিমা দুনিয়াতে সমকামিতার বিরুদ্ধে আইনগুলো সমাজ বদলানোর অনেক আগেই বিলুপ্ত করা হয়। এখানে বলে রাখা উচিৎ যে, যদি কখনো বাংলাদেশ সমকামিতার বিরুদ্ধে আইনগুলো উঠিয়ে দেয়, তাহলে মুসলমান সংখাগরিষ্ঠ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম হবে না। অন্যান্য মুসলমান সংখাগরিষ্ঠ দেশ যেগুলো সমকামিতাকে অবৈধ বলে না বা সমকামিদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করে না, এমন দেশের মধ্যে আছে তুরষ্ক, মালী, আলবেনীয়া, বাহরাইন, জর্দান, ইরাক, প্যালেষ্টাইন (শুধু পশ্চিম তীর) আর ইন্দোনেশিয়া (আচেহ প্রদেশ বাদ দিয়ে)। এই দেশগুলোর কোনটাই কখনো ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল না বা ব্রিটিশদের দখলে আসেনি এবং রানী ভিক্টোরিয়ার এই ৩৭৭ দন্ডবিধি উত্তরাধিকার সূত্রে পায়নি।

কিন্তু আগেই বলেছি যে আমাদের দেশগুলো এখন আমাদেরই গড়তে হবে এবং দেশের এলজিবিটিকিউআইএ+ জনগোষ্ঠীর এই অমানবিক পরিস্থিতি আমাদেরকেই বদলাতে হবে। এর অর্থ এও যে বাংলাদেশকে কোন দিন একটি “ইসলামী প্রজাতন্ত্রে” কিংবা একটি “সাম্প্রদায়িক” ও “অগণতান্ত্রিক” রাষ্ট্রে পরিণত হতে দেয়া যাবে না। দেশের সুশীল সমাজকে এই ব্যাপারে আরও সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। যেহেতু বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং সমকামী জনগোষ্ঠীও আর দশজনের মত বাংলাদেশের বৈধ নাগরিক, সেহেতু দেশের কল্যাণের স্বার্থেই সকল বৈষম্য দূর করা একান্ত অপরিহার্য। বৈচিত্র্য, ধর্মনিরপেক্ষতা, বৈষম্যহীনতা এবং পরমতসহিষ্ণুতা বাংলাদেশ ও বাঙ্গালী সংস্কৃতির চিরায়ত ঐতিহ্যের অঙ্গ।