৮ নভেম্বর রাতে যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা হচ্ছে তখন আমি প্লেনে; স্থানীয় সময় রাত ৯টায় আটলান্টা ছেড়েছি। তখনও সবে আমেরিকার পূর্বদিকের স্টেটগুলো থেকে ফল আসতে শুরু করেছে। ফ্লোরিডা এবং নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট দুটো ট্রাম্পের পক্ষে যাওয়ার পরপরই ভয় দানা বাঁধতে শুরু করল প্লেনের সবার মধ্যে। প্রযুক্তির গুণে আজ আটলান্টিক মহাসাগরের উপরেও আমার কম্পিউটারে ওয়াইফাই আছে– এ কারণে আমার সিটের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন আশেপাশের কয়েকজন সহযাত্রী। এরা সবাই আমেরিকার পূর্ব বা পশ্চিম প্রান্তের শহুরে সাদা উচ্চশিক্ষিত চাকরি বা ব্যবসা করা আমেরিকান নারী বা পুরুষ। সবার মুখ ক্রমে কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে উঠতে শুরু করেছে।

আমার মেয়ে ওদিকে থেকে বারবার ‘টেক্সট’ করে জানাচ্ছে যে, তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও মনক্ষুণ্ন এবং ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে শুরু করেছেন। প্লেনের একজন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার বললেন, তার ক্লায়েন্টরা ইতোমধ্যেই পরের দিন স্টক মার্কেট ক্রাশের আশঙ্কা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ইমেইল করতে শুরু করেছেন। একজন তো বলেই বসলেন, “আমরা (আমেরিকানরা) ক্রমে সারা বিশ্বের কাছে হাসির পাত্র হয়ে উঠছি।”

আমি মাথা নেড়ে, মৃদু হেসে সায় দিলাম।

সবাই অস্বস্তিতে মাথা নাড়ছেন। দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে ‘অসম্ভব’, ‘অচিন্ত্যনীয়’, ‘এখন কী হবে’ টাইপের কথাগুলো গুঞ্জরিত হচ্ছে আমার চারপাশে বারবার। মজার ব্যাপার হচ্ছে, একটা ব্যাপার ঘটে যাওয়ার পর এই আপাত অসম্ভবই সম্ভব বলে প্রমাণিত হয়, অচিন্ত্যনীয় ব্যাপারটা চিন্তনীয় হয়ে ওঠে। রাত তিনটার মধ্যে নাটকের অবসান হল। লন্ডনে নামার আগে কিছুক্ষণ ঘুমাব ভেবেছিলাম। তা আর হল না।

এই মানুষগুলোর আমেরিকা জেতেনি সেদিন রাতে। মেইনস্ট্রিম মিডিয়া যাদের সঙ্গে কথা বলে পোলিং করেছে এত মাস ধরে, তারাও জেতেননি। তাহলে জিতলেন কারা? কারা ট্রাম্পকে ভোট দিলেন? কেন দিলেন?

সেই বর্ণবাদী, নারীবিদ্বেষী, যৌননিপীড়ক, পপুলিস্ট জাতীয়তাবাদী, ল্যাটিনো-কালো-মুসলিমবিরোধী, অভিবাসনবিদ্বেষী, পরিবেশ-অবান্ধব, বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী এবং সস্তা এন্টারটেইনমেন্ট জগতের প্রতাপশালী ব্যক্তি ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।

সব জেনেও সংখ্যাগরিষ্ঠ আমেরিকান ভোটার ট্রাম্পকেই কেন ভোট দিলেন? আর ভোটদাতাদের আরেক অর্ধাংশ (পপুলার ভোটের হিসাবে হিলারি ক্লিনটন ট্রাম্পের চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন। ইলেক্টোরাল কলেজের হিসাব বাদ দিয়ে সারা দেশের মোট ভোটসংখ্যা হিসাব করলে যা দাঁড়ায় তাই পপুলার ভোট। তবে আমেরিকায় পপুলার ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন না, স্টেটভিত্তিক নির্ধারিত ইলেক্টোরাল ভোটে হন) যে হিলারিকে ভোট দিলেন তারাই-বা কারা?

এই ‘গণতন্ত্র’ বেশ মজার একটা ধারণা (concept)। সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে অর্থাৎ সামান্য ‘গণতন্ত্র’ দিয়ে দিব্যি স্বৈরতন্ত্রের বৈধতা দিয়ে দেওয়া যায়। আমেরিকায় তো আবার সার্বিক সংখ্যাগরিষ্ঠতাও ব্যাপার নয়, ষ্টেটভিত্তিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এর নমুনা আমরা অনেক দেখেছি, এখনও দেখছি দেশে দেশে। হিটলারও তো ‘গণতান্ত্রিকভাবে’ নির্বাচিত হয়েই ক্ষমতায় এসেছিলেন। সেই প্রাচীন গ্রীকের দার্শনিকেরা এ নিয়ে আলোচনা করে গেছেন।

তবে আপাতত এটুকু ভেবে হয়তো এখনও স্বস্তি পাওয়া যেতে পারে যে, আজকের উন্নত পশ্চিমা বিশ্বে এবং আমেরিকায় পুঁজিবাদ কাঠামোগতভাবে আগের চেয়ে অনেক পক্ব ও দৃঢ়ভিত্তি অবস্থা ধারণ করেছে– দেশের ভিতরে হিটলারি কায়দায় ধ্বংসযজ্ঞ ঘটানো হয়তো এখন সম্ভব হবে না। তবে, বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের কথা আলাদা। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি অনুযায়ী, দেশের বাইরে বিদেশের ভূমিতে, যে কোনো অজুহাতে যে কোনো ধ্বংসযজ্ঞ হালাল বলে পরিগণিত হতে পারে, সেটা ওবামা বা ট্রাম্প যে-ই গদিতে বসুন না কেন।

আমি নিশ্চিত যে, এই নির্বাচন নিয়ে হাজার হাজার একাডেমিক পেপার লেখা হবে আগামীতে। কারা, কোন স্টেট, জনসংখ্যার কোন অংশ কাকে ভোট দিয়েছেন, কেন দিয়েছেন সেটা নিয়ে বিস্তারিত সব বড় বড় গবেষণা হবে। অভিবাসনের ফলে ডেমোগ্রাফি বদলাতে শুরু করলেও এখনও আমেরিকার মোট জনসংখ্যায় সাদা ৬০ শতাংশের কিছু বেশি (হিসপ্যানিক সাদাদের বাদ দিয়ে), আফ্রিকান আমেরিকান ১৩ শতাংশ, হিসপ্যানিক/ল্যাটিনো প্রায় ১৭ শতাংশ এবং এশিয়ান ৫ শতাংশের মতো।

প্রাথমিক হিসাবে দেখা যাচ্ছে যে, দেশের মোট সাদা জনগোষ্ঠীর ৫৮ শতাংশ ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। আফ্রিকান আমেরিকানদের মধ্যে ৮ শতাংশ, হিসপ্যানিক/ল্যাটিনোদের ২৯ শতাংশ ও এশিয়ানদের ২৯ শতাংশও ভোট দিয়েছেন ট্রাম্পকে। তাহলে দেখা যাচ্ছে এই নির্বাচন মূলত সাদাদের ভোটেই নির্ধারিত হয়েছে। তাহলে আরেকটু খতিয়ে দেখতে হলে প্রশ্ন করতে হয়, সাদাদের মধ্যে কারা ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন? সরাসরি না হলেও আরেকটা তথ্য এখানে প্রাসঙ্গিক। পাশ্চাত্যের অন্যান্য উন্নত দেশগুলোর মধ্যে আমেরিকায় ভোটদাতার সংখ্যা অপেক্ষাকৃতভাবে কম, সাধারণত ৫০ শতাংশের কিছু বেশি মানুষ ভোটে অংশ নেন।

তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এরা সব জেনেশুনে ট্রাম্পকে নির্বাচিত করলেন কেন? ট্রাম্পের কথাগুলো আমেরিকার জনগোষ্ঠীর ঠিক কোন অংশের মনে ধরেছে? এত উল্টোপাল্টা কথা বলার পরেও তাঁর জনপ্রিয়তার কারণ কী?

বিডিনিউজে কয়েক সপ্তাহ আগে ‘যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অসাম্য ও ‘ট্রাম্প-রোগ’ লেখাটা প্রকাশিত হওয়ার পরে আমার একজন বন্ধু ফেসবুকে মন্তব্য করেছিলেন:

“মধ্য ও নিম্ন আমেরিকার (ভৌগলিক ও অর্থনৈতিক উভয় অর্থেই) মন্দা বহুদিন হল চলেছে এবং ট্রাম্প এই অবস্থার সুযোগ নিচ্ছেন। তবে এই আমেরিকা গত ৩০ বছর রিপাবলিকানদের ভোট দিয়ে এসেছেন, ট্রাম্প আর বার্নি এক কথা বললেও তারা কখনও বার্নিকে ভোট দেবেন না। মৌলবাদ ও রক্ষণশীলতা শুধুমাত্র অর্থনীতি ও সামাজিক অসাম্য দিয়ে ব্যাখা করা যায় না। সেটা যেমন মধ্যপ্রাচ্যের জন্য সত্য, মধ্য আমেরিকার জন্যও। ট্রাম্প যদি হিসপানিক-মুসলিম ও গর্ভপাতবিরোধী বক্তব্য না দিতেন তবে তিনি এই অংশে গৃহীত হতেন না। কিন্তু মার্কিন দেশের জনসংখ্যার গঠন ক্রমাগতই পাল্টাচ্ছে-– মূলত অভিবাসনের জন্য।… চিরায়ত অর্থনীতিচর্চায় অভিবাসী জনবৈচিত্র্যের ডাইনামিক্সের ভূমিকা সেরকমভাবে উল্লিখিত হয়নি– মার্কিন দেশে সেই বৈচিত্র্যের যে এক্সপেরিমেন্ট চলছে সেটা পৃথিবীর ইতিহাসে অভূতপূর্ব। এই অভিবাসন মার্কিন দেশে innovationএর একটি মূল উৎস।”

কথাটা এক দিক থেকে সঠিক– আমেরিকার রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট সমর্থকদের মধ্যে তুলনা করলে। গত কয়েক দশকে রিপাবলিকান পার্টি নিজেকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে রক্ষণশীলতার (Conservatism) ধারক এবং বাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। তারা গর্ভপাত, নারী এবং সমকামীদের অধিকারবিরোধী, অভিবাসনবিরোধী, পরিবেশ এবং সরকারি স্বাস্থ্য বা শিক্ষাব্যবস্থাবিরোধী, কর্পোরেশন এবং বড়লোকদের উপর ট্যাক্স কমানোর পক্ষে।

অন্যদিকে, সাধারণভাবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক এই ইস্যুগুলোতে ডেমোক্র্যাটদের অপেক্ষাকৃতভাবে লিবারেল উদারনৈতিক বা ‘প্রগতিশীল’ হিসেবে গণ্য করা হয়।

আমি আগের লেখাটায় রিপাবলিকান প্রাইমারি নিয়ে কথা বলছিলাম, তখনও জাতীয় নির্বাচন সংঘটিত হয়নি। ট্রাম্প যদি এই মৌলবাদী ও রক্ষণশীল নীতিগুলো এভাবে সামনে তুলে না আনতেন তাহলে রিপাবলিকানরা তাদের পার্টির অভ্যন্তরীন প্রাইমারি নির্বাচনে ট্রাম্পকে সমর্থন করতেন না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ট্রাম্পও সেটা জানেন এবং সে কারণেই তিনি ব্যাপারগুলো সামনে এনেছেন। তিনি নিজে কিন্তু আগে গর্ভপাত বা অভিবাসন নিয়ে মোটেও রক্ষণশীল ছিলেন না, রিপাবলিকানদের ভোট পাওয়ার জন্যই এটা করেছেন। তিনি এমনকি অনেক বছর রেজিস্টার্ড ডেমোক্র্যাট ছিলেন।

আমি আসলে প্রথম পর্বে যেটা দেখাতে চেয়েছিলাম সেটা হচ্ছে, রিপাবলিকানদের মধ্যেই তাদের সমর্থকেরা পার্টির বহু বছরের প্রতিষ্ঠিত এবং ‘সম্মানিত’ নেতাদের মনোনীত না করে সম্পূর্ণভাবে পার্টির বাইরের মানুষ ট্রাম্পকে কেন মনোনীত করলেন! অন্যরাও তো তাঁর মতোই রক্ষণশীল মত ধারণ করেন। তাহলে সবাইকে উপেক্ষা করে রাজনীতিতে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ, নভিস একজন ধুরন্ধর ব্যবসায়ীকে তারা কেন পছন্দ করলেন?

আর যদি এখানে জাতীয় নির্বাচনের কথা বলেন, তাহলে আমেরিকার অধিকাংশ মানুষ রক্ষণশীল ও মৌলবাদী (বর্ণবাদের ব্যাপারটা বাদ দিলাম) হলে বারাক ওবামা দুদুবার ল্যান্ডস্লাইড ভোটে জিতেছিলেন কীভাবে? হিলারির চেয়ে ওবামাকে তো অনেক বেশি লিবারেল হিসেবে গণ্য করা হয়।

উল্টোভাবে আবার একই কথা খাটে বার্নি স্যান্ডার্সের ক্ষেত্রে। তিনি ডেমোক্র্যাটদের প্রাইমারিতে ১৩ মিলিয়নের বেশি ভোট পেয়েছিলেন। অল্পের জন্য হিলারি ক্লিনটন জিতেছিলেন সেই লড়াইয়ে। উইকিলিক্স থেকে শুরু করে অন্যান্য অনেক সূত্র থেকেই দেখা গেছে যে, ডেমোক্র্যাটিক পার্টির কর্ণধাররা চালাকি করে বার্নিকে দমিয়ে রেখে হিলারিকে জিতিয়েছিলেন। সেই চেষ্টা রিপাবলিকান পার্টির ভিতরে চললেও ওরা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ঠিক সুবিধা করে উঠতে পারেননি।

অনেকেই মনে করেন যে, বার্নিকে প্রাইমারিতে জিততে দিলে আজকে জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল অন্যরকম হতে পারত। আজকের পুঁজিবাদী কাঠামোর একটা রাজনৈতিক স্কেল তৈরি করলে ট্রাম্প পড়বেন নিও-লিবারেল রাজনীতি এবং সামাজিক মৌলবাদের এক্কেবারে ডান দিকের প্রান্তে– আর বার্নির অবস্থান স্কেলের উল্টোদিকে, উদারনৈতিক সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পুঁজিবাদের বাম দিকে।

এবারের নির্বাচনে ট্রাম্পের (এবং বার্নিরও) জনপ্রিয়তার কারণ বুঝতে হলে রাজনৈতিক এস্টাব্লিশমেন্ট এবং মিডিয়ার প্রতি জনগণের অবিশ্বাস ও ঘৃণার কারণ এবং সেই সঙ্গে আমেরিকার এই সাদা মানুষদের কিছু ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য ও মূল্যবোধও বুঝতে হবে। ব্যাপারটা যেভাবে শুধুমাত্র বর্ণবাদ বা অভিবাসন এবং নারীবিদ্বেষ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে তা ঠিক নয়। আপাতদৃষ্টিতে এরকম মনে হলেও আসলে এর চেয়ে অনেক বেশি জটিল। আমেরিকার রাজনৈতিক দলগুলো এখনকার প্রেক্ষাপটে সাদা মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর হতাশার মূল কারণগুলো বুঝতে পারেনি। হিলারিরাও ব্যর্থ হয়েছেন বুঝতে। কিন্তু ট্রাম্প ঠিকই বুঝেছিলেন, রাজনৈতিক অঙ্গনের বাইরে থেকেও। সেটা পুঁজি করে এবং নিপুণভাবে ব্যবহার করেই তিনি নির্বাচনে জিতেছেন।

এবার আসি ৮ নভেম্বরের জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে। এটা ঠিক যে, বাইবেল বেল্টসহ দক্ষিণ-পূর্ব এবং মধ্য আমেরিকার রক্ষণশীল সাদা অংশের বেশিরভাগই ঐতিহাসিক কারণে রিপাবলিকানদের ভোট দেন। রাজনৈতিক এবং সামাজিক রক্ষণশীলতার কারণে তারা সব সময় রিপাবলিকানদের সঙ্গে বেশি একাত্মতা বোধ করেন।

আবার আমেরিকার পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলের স্টেট এবং বড় বড় শহরগুলোতে বেশিরভাগ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ও অভিবাসীরা বসবাস করেন। এখানকার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তরা একদিকে যেমন অপেক্ষাকৃতভাবে বেশি উদারনৈতিক– অন্যদিকে এরাই কিন্তু কয়েক দশক ধরে চাকরি, ব্যবসায়সহ সবকিছুতে বিশ্বায়নের সুফল ভোগ করছেন। এদের একটা বড় অংশ ডেমোক্র্যাট।

পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলের এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে কিছু শিক্ষিত ভালো চাকরিজীবী অভিবাসী থাকলেও তাদের একটা বিশাল অংশ কিন্তু নিম্নতম মজুরির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন, শ্বেতাঙ্গরা যেমনটা তেমন করেন না। ডেমোক্র্যাটরা সাধারণভাবে যেহেতু অভিবাসী ও নিচের তলার মানুষের পক্ষে কাজ করেন, তাই এই অংশটাও প্রধানত ডেমোক্র্যাটদেরই ভোট দেন। আগেই উল্লেখ করেছি যে, আমেরিকার দক্ষিণ ও মধ্যভাগের মূলত সাদা রক্ষণশীল অংশ ভোট দেন রিপাবলিকানদের।

তাই নির্বাচনের ম্যাপে আমেরিকার পূর্ব ও পশ্চিম উপকূলীয় স্টেটগুলো নীল (ডেমোক্র্যাট) আর মাঝখানের বেশিরভাগ অংশ লাল (রিপাবলিকান) হয়ে থাকতে দেখা যায়।

কিন্তু এই দুই বিপরীত মনোভঙ্গির দুই অংশের কারও ভোটেই সাধারণত নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারিত হয় না। কারণ এরা কেউ এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেন না। মোটা দাগে হিসাব করলে আমেরিকায় আরেকটি অংশ আছে, যারা ‘রাস্ট বেল্ট’ নামে খ্যাত গত কয়েক দশকে। আমেরিকার ম্যাপের উপরের দিকে উত্তর-পুর্বাঞ্চলের কতগুলো স্টেট-– যেমন, পেনসিলভ্যানিয়া, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, ওহাইয়ো, মিশিগান, ইলিনয়, ইন্ডিয়ানা, আইওয়া এবং উইসকন্সিনের মতো স্টেটের বিভিন্ন অংশ মিলে এই বেল্ট। এবারের নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটন এই স্টেটগুলোর বেশিরভাগে হেরেছেন, যদিও ঐতিহাসিকভাবে আমেরিকান শ্রমিকদের বেশিরভাগ ডেমোক্র্যাটদের ভোট দেন।

আগের লেখায় উল্লেখ করেছিলাম যে, এরা ঐতিহাসিকভাবে আমেরিকার মধ্য আয়ের সাদা ফ্যাক্টরি শ্রমিক, যাদেরকে ‘ব্লু কলার ওয়ার্কার’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এরা মূলত সাদা আমেরিকান পুরুষ যাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নেই। এরা এতদিন আমেরিকার ছোট শহরগুলোতে কলকারখানায় চাকরি করে মোটামুটি একটা মধ্যবিত্ত জীবন যাপন করতে সক্ষম ছিলেন। ওবামা এসব স্টেটের বেশিরভাগগুলোতেই জিতেছিলেন ২০০৮ এবং ২০১২ সালের নির্বাচনে।

এবারো ডেমোক্র্যাটরা মোটামুটি নিশ্চিত ছিলেন যে, এই অঞ্চলগুলোতে তারাই জিতবেন। ডেমোক্র্যাটদের নিশ্চিত ধরে নেওয়া ‘দুর্ভেদ্য’ রাস্ট-রাজ্যের দেওয়াল ভেদ করে ঢুকে যেতে সমর্থ হয়েছেন বলেই কিন্তু ট্রাম্প জিতেছেন। এই সাদা ভোটদাতাদের মধ্যে হিলারির চেয়ে মোট হিসেবে ৩৯ শতাংশ বেশি (হিলারি ২৮ শতাংশ এবং ট্রাম্প ৬৭ শতাংশ) ভোট পেয়েছেন ট্রাম্প। এখানকার সাদা পুরুষ ভোটাররাই যে শুধু ট্রাম্পকে ৫০ শতাংশ বেশি ভোট দিয়েছেন তা নয়, ট্রাম্পের এত নারীবিদ্বেষী কার্যকলাপের পরও ৩৯ শতাংশ সাদা নারী তাঁকে ভোট দিয়েছেন। সাধারণভাবে হিসেব করলে, আমেরিকার ছোট শহর এবং গ্রামাঞ্চলের ৩/৫ (তিন-পঞ্চমাংশ) ভোট ট্রাম্পের পক্ষে গেছে।

আমেরিকার মধ্যবিত্ত সাদা এই ব্লু কলার কর্মীরা অত্যন্ত হতাশ ও ক্ষুব্ধ। ওরা ক্রমশ যেন পিছিয়ে পড়ছেন পৃথিবীর ‘অগ্রগতি’ থেকে। বিশ্বায়নের ফলে এদের বেশিরভাগ শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এইসব ফ্যাক্টরি-শ্রমিকদের ভালো বেতনের চাকরি চীন, মেক্সিকো, ফিলিপিন্স, বাংলাদেশের মতো কম বেতনের দেশগুলোতে পাচার হয়ে গেছে।

২০০৮ সালে বিশাল অর্থনৈতিক সংকটের ধাক্কা এখনও পুরোপুরি সামলে উঠতে পারেনি পাশ্চাত্যের দেশগুলো।এসব দেশে প্রবৃদ্ধির হার খুব কম। ওদিকে বেকারত্বের হার কমে এলেও মধ্য আয়ের চাকরিগুলো যেন হারিয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে নিম্নবেতনের চাকরিগুলো ফেরত এসেছে। শুধু তা-ই নয়, বড় বড় কোম্পানি বা কর্পোরেশনের উচ্চ আয়ের শিক্ষিত চাকরিজীবী, ওয়াল স্ট্রিটের ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার এবং ব্যবসার মালিকরা বিশ্বায়নের সুযোগে ভীষণভাবে লাভবান হয়েছেন।

একই সময়ে আবার আমেরিকার নিচের দিকের ৫০ শতাংশ মানুষ তাদের জীবনধারণের মান ক্রমশ নিচে নামছে বলে মনে করেন। এরা কঠিন পরিশ্রম করেও আগের সেই স্বচ্ছন্দ মধ্যবিত্ত জীবন আর ধরে রাখতে পারছেন না।

এরাই শুরুতে, রিপাবলিকান প্রাইমারিতে, এস্টাব্লিশমেন্টের সব বড় বড় নেতার বিরোধিতা করে ট্রাম্পকে বিপুলভাবে সমর্থন দিয়েছিলেন। এখন দেখা যাচ্ছে, এদের ভোটেই (এবং সে সঙ্গে দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার সাদাদের ভোটে যারা সাধারণত রিপাব্লিকান পার্টিকেই ভোট দেন) নির্বাচনের ফলাফল ট্রাম্পের দিকে ঢলে পড়েছে।

আমি বলছি না এটাই একমাত্র কারণ, তবে এটা একটা বেশ বড় কারণ। এছাড়া, ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে অনেকেই এবার ভোট দেননি, ওবামার নির্বাচনের সময় তাদের যে উৎসাহ ছিল এবার তা আর সেভাবে দেখা যায়নি।

এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক, ভাষাতত্ত্ববিদ এবং বর্তমান পুঁজিবাদী সিস্টেমের বিশেষ সমালচনাকারী নোম চমস্কির, কয়েক বছর আগে (সম্ভবত ২০১০ সালে) দেওয়া একটা ইন্টারভিউএর কথা মনে পড়ে গেল। চমস্কি যেন দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছিলেন তাঁর দেশের ভবিষ্যৎ। তাঁর কথার ভাবানুবাদ অনেকটা এরকম দাঁড়ায়-–

“প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের রাগ, হতাশা, ঘৃণা কেমন যেন আত্মবিধ্বংসী একটা ফ্যান্টাসির রূপ ধারণ করছে, কোনো সংগঠিত উপায়ে সেগুলো বের হয়ে আসছে না। এখন যদি কেউ এসে বলে যে, আসল শত্রু খুঁজে পাওয়া গেছে, তাহলেই মানুষজন ঝাঁপিয়ে পড়বে। জার্মানিতে যেমন ইহুদিদের শত্রুতে পরিণত করা হয়েছিল ঠিক তেমনি এখানে হয়তো কালো এবং বেআইনি অভিবাসীদের শত্রু বানানো হবে। বলা হবে, সাদা পুরুষেরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে, আমাদের এখন নিজেদেরকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসতে হবে, দেশের সম্মান রক্ষা করতে হবে। সারা পৃথিবীর উপর তলোয়ার-ঘোরানো আমেরিকার ক্ষেত্রে সেটা জার্মানির চেয়েও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।”

চমস্কি কট্টর ডানপন্থী টক রেডিও অনুষ্ঠানের শ্রোতাদের কথা উল্লেখ করে বলেন যে, এরা যেন দিনদিন আত্মহুতি দিতে যাওয়া সেসব পাইলটদের মতো হয়ে উঠেছেন। তাদের একটাই প্রশ্ন: আমরা তো সব কিছু নিয়মমতো করেছি, কঠোর পরিশ্রম করি, বন্দুক রাখি সঙ্গে, ভালো খ্রিস্টান হিসেবে গডকে ভয় করে চলি, দেশের সব নৈতিকতা মেনে চলি, তারপরও আমাদের জীবন এভাবে ধসে পড়ছে কেন? আমাদের জীবন এরকম হয়ে যাচ্ছে কেন?

চমস্কির ভবিষ্যৎবাণী যে এই কয়েক বছরের মধ্যেই এভাবে সত্যি হবে সেটা আসলে কেউ আশা করেনি।

তবে অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে আরও কিছু ‘বিশেষ আমেরিকান বৈশিষ্ট্য’ও অন্তর্ভুক্ত না করলে বোধহয় বিশ্লেষণটা সম্পূর্ণ হবে না। ঐতিহাসিকভাবেই আমরা জানি যে, রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময় কাঠামোগতভাবে মূল সমস্যাটা অর্থনৈতিক হলেও এর সঙ্গে অন্যান্য কারণগুলোর যথেষ্ট সংশ্লিষ্টতা থাকে। আর এখানেই আমেরিকার সাদা জনগণের মধ্যে বর্ণবাদী, অভিবাসনবিরোধী রক্ষণশীল ব্যাপারগুলো এসে পড়ে।

অনেক সমাজতত্ত্ববিদ মনে করেন, সাদাদের মধ্যে এক ধরনের পরিচয়গত বা আইডেন্টিটির সংকট এবং অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এত শতক ধরে– তাদের বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের সময় থেকে শুরু করে– তারা যে বিশ্বব্যবস্থা দেখে এসেছে তাতে যেন ফাটল ধরতে শুরু করেছে। তাদের জাতিগত কর্তৃত্ব যেন ফুরিয়ে যেতে শুরু করেছে। ওরা সেই পুরনো বিশ্বব্যবস্থা যেন আঁকড়ে ধরতে চাইছেন যে কোনো মূল্যে।

পশ্চিমা উন্নত বিশ্বের মধ্যে আমেরিকা সবচেয়ে বেশি রক্ষণশীল। এদেশের কিছু কিছু ক্রিশ্চান মৌলবাদী আমাদের দেশের ইসলামিক মৌলবাদীদেরও হার মানিয়ে দিতে পারেন। তারা এখনও সেই মধ্যযুগীয় খ্রিস্টান নৈতিকতা মনেপ্রাণে ধারণ করেন। পশ্চিমা বিশ্বে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বড় বড় অর্জনগুলো-– যেমন, যৌনস্বাধীনতা, নারীঅধিকার, সমকামীদের অধিকার, বিশেষ করে গর্ভপাত-– তাদের কাছে বিশাল অপরাধ বলে পরিগণিত। তারা কোনোভাবেই এসব বিষয়ে উদারনৈতিক লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের এজেন্ডা মেনে নিতে পারেন না। আবার ওদিকে এসবের প্রতিকারে এস্টাব্লিসমেন্টের রিপাবলিকানদের উপরও কোনোভাবে ভরসা করতে পারেন না। এসব ব্যাপারে আমেরিকায় যত বিশাল আকারে মৌলবাদী রক্ষণশীলতা দেখা যায় সেটা কিন্তু অন্যান্য উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে ততটা নয়।

এছাড়া আমার কাছে আমেরিকার সমাজে আরেকটা জিনিসের প্রভাব খুব প্রকট বলে মনে হয়। এরা পুঁজিবাদ ধারণ করেন যেন ধর্মের মতো। কোল্ড ওয়ারের সময় সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে প্রোপাগাণ্ডা তৈরি করা হয়েছিল, তারই ফলশ্রুতি হয়তো এটা। আগের লেখাতে যে আমেরিকান ড্রিমের কথা উল্লেখ করেছিলাম, ট্রাম্পকে দেখে এই মধ্যবিত্ত সাদাদের মধ্যে তা যেন আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তাদের কাছে মনে হচ্ছে এই ধরনের ব্যবসায়ী মানসিকতাই এখন তাদের সব সমস্যার সমাধান করতে পারে।

ট্রাম্প এখন আমেরিকার সিইও হয়ে বড় কর্পোরেশনের মতো দেশের স্বার্থ রক্ষা করে আমেরিকার সেই হারানো ‘গৌরব’ ফিরিয়ে আনবে। পরিহাস এই যে, বড় বড় কর্পোরেশনের কারণে এবং তাদের সঙ্গে এস্টাব্লিশমেন্ট রাজনীতিবিদদের খাতিরের কারণে আজকে তাদের এই অবস্থা, অথচ তাদেরই একজন কর্ণধারের হাতে আজকে নিজেদের ভবিষ্যৎ সঁপে দিয়েছেন তারা। ‘ভক্ষক’ কীভাবে ‘রক্ষকে’ পরিণত হবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।

তারা ভীত যে আধুনিক বিশ্বায়নের এই যুগে তারা আর তাল মিলিয়ে চলতে পারছেন না, কোনো সরকারই তাদের সেই অধিকার এবং ক্ষমতা আর সংরক্ষণ করছে না। আমেরিকা আর তাদের সম্পত্তি থাকছে না। আজকের প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদেরা (ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান) এখন পুরোপুরি ওয়াল স্ট্রিট এবং বড় বড় কর্পোরেশনের হাতের মুঠোয়। তারা আজকে শুধু ওদের স্বার্থই দেখতে ব্যস্ত। সে কারণে তারা অভিবাসন বাড়ানো, নিম্ন মজুরির দেশে কলকারখানার কাজগুলো পাঠিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে দেশের মধ্যবিত্ত বা নিম মধ্যবিত্ত জন্যগণের জন্য ক্ষতিকর মুক্তবাজার নীতি গ্রহণ করা পর্যন্ত কোনো কিছু করতে দ্বিধা বোধ করবে না। দুই রাজনৈতিক দলই বড় বড় ব্যবসায়ী এবং কর্পোরেশনের কাছ থেকে এত টাকা চাঁদা পায় যে, তাতে অবাক না হয়ে পারা যায় না। আমেরিকায় মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করে সরকারের কাছে লবি না করলে কোনো আইনই নাকি আর পাশ করানো যায় না।

একই সঙ্গে তারা এখন লিবারেল মিডিয়াকেও মনেপ্রাণে ঘৃণা করেন। কারণ তাদের কাছে এরা সম্পূর্ণভাবে এস্টাব্লিশমেন্টের পা-চাটা শক্তিতে পরিণত হয়েছে। আসলে এরাও তো এখন বিশ্ববিস্তৃত বড় বড় ব্যবসাতেই পরিণত হয়েছে। তাই আমরা এবারের নির্বাচনে দেখেছি, মিডিয়া যতই ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তাঁর নারীবিদ্বেষ, যৌন-উৎপীড়ন, জেনোফোবিয়া, অভিবাসন-বিরোধিতা বা তার উল্টোপাল্টা কথা নিয়ে রিপোর্ট করেছে ততই তাঁর জনপ্রিয়তা বেড়েছে এই অংশের জনগণের মধ্যে।

আমরা সম্প্রতি দেখলাম যে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ব্রিটিশ জনগণ ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট দিয়েছে। সেটাও কিন্তু একই কারণে এবং একই মানসিকতার ফলে ঘটেছে। ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনকে ব্রেক্সিট ১০.০ বলেও অভিহিত করেছিলেন নির্বাচনী প্রচারণার সময়। গতকাল দেখলাম ট্রাম্পের সঙ্গে প্রথম বিদেশি নেতা হিসেবে দেখা করতে এসেছেন ব্রিটিশ ব্রেক্সিট নেতা নাইজেল ফারাজে। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আটলান্টিকের দুই পাশে অ্যাংলো-স্যাক্সনদের প্রতিনিধিত্বকারী দুই দেশের সাদা মধ্যবিত্তরা যেন বর্তমান বিশ্বের ধীর-প্রবৃদ্ধির শেয়ার নিয়ে অভিবাসীদের বিরুদ্ধে লাঠিসোটা নিয়ে যুদ্ধে নেমেছেন।

তাই ট্রাম্প যখন বলেন যে, তাদের এই অবস্থার জন্য দায়ী দুই দলের নেতারা-– যারা গত ২৫-৩০ বছর ধরে বিশ্বব্যাপী ফ্রি ট্রেডের নীতিগুলো প্রণয়ন করেছেন, যার ফলে তাদের চাকরি হাওয়া হয়ে গেছে, অভিবাসীরা এসে দেশ ছেয়ে ফেলছেন-– তখন তারা আশান্বিত হয়ে ওঠেন। তারা ২০০৮ সালে ওবামাকেও নির্বাচন করেছিলেন এই পরিবর্তনের আশা নিয়েই। কিন্তু বিভিন্ন কারণে গত ৮ বছরে হতাশ জনগণের জীবনে তিনি তেমন পরিবর্তন আনতে সক্ষম হননি। ওবামাও তো আসলে এই প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির অংশ। তাই তারা এবার পেশাদার রাজনীতির বাইরে একজন বিতর্কিত ডান রক্ষণশীলকেও ভোট দিতে পিছপা হননি।

আরেকটা বিষয় সামনে আসছে বারবার। অনেকে বলছেন যে, হিলারি ক্লিনটন নারী বলে হেরেছেন। আমার কাছে এই যুক্তিও গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না। এখানে বর্ণবাদ, নারীবৈষম্য নেই তা বলছি না, তবে আমার মতে, এই কারণে তিনি কিছু ভোট যদি হারিয়েও থাকেন, নারী হওয়ার কারণেই আবার অনেক ভোট পেয়েছেনও। হিলারি এতটাই শক্তিশালী এবং প্রতিষ্ঠিত সব ক্ষমতাবানদের প্রতিনিধিত্ব করেন যে, তাঁকে আলাদা করে নারী হিসেবে দেখা বেশ কঠিন। যখন দেশের অধিকাংশ মানুষ আর এস্টাব্লিশমেন্টকে বিশ্বাস করতে পারছেন না, ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন এর বিপক্ষে, তখন হিলারির মতো এস্টাব্লিশমেন্টের শিখরে বসা একজন প্রার্থীকে যে কোনো মূল্যেই হারতে হত। সেটা হিলারি না হয়ে অন্য যে কেউ হলেই একই ঘটনা ঘটত। তবে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি প্রাইমারি নির্বাচনে যদি বার্নিকে প্রার্থী করত, তাহলে আমেরিকায় উদারনৈতিক পুঁজিবাদী রাজনীতির জনপ্রিয়তা কতটা সেটা বোঝার সুযোগ তৈরি যেত।

আমি মনে করি, এবারের যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের চমকগুলো (বা ব্রিটেনে ব্রেক্সিট ভোটের চমক) পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আরেক সংকটের প্রতিফলন। এরকম কাঠামোগত বড় সংকট আমরা কয়েকবারই দেখেছি গত দেড়-দুই শতকে। ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রচারের সময় বলেছিলেন যে, এটা নির্বাচন নয়, আন্দোলন। আমেরিকার রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত দুধারার সমর্থকেরা-– রক্ষণশীল ডানপন্থী এবং গণতান্ত্রিক প্রগতিশীলেরা (সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট)-– সিস্টেমের কাঠামোগত চরম সংকটের সময় প্রার্থী নির্বাচন করে মূলত অর্থনৈতিক কারণের উপর নির্ভর করে। এর সঙ্গে তাদের রাগ, ক্ষোভ, দুঃখ, জাত্যভিমান, নির্দিষ্ট কিছু জাতিগত বৈশিষ্ট্য মিলেমিশে একাকার হয়ে একটা জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। একই ধরনের শিফট আমরা ইউরোপজুড়েও দেখতে পাচ্ছি সাম্প্রতিককালে।

আসলে এবারই প্রথম নয়, এই জনগোষ্ঠীর একটা অংশ রিপাবলিকানদের আগেও ভোট দিয়েছেন। ১৯৮০ সালের নির্বাচনে। জিমি কার্টারকে হারিয়ে রোনাল্ড রিগ্যানের ক্ষমতায় আসার পিছনে এই অংশের বিশাল ভূমিকা ছিল। এদেরকে তখন ‘রিগ্যান ডেমোক্র্যাট’ বলে আখ্যায়িত করা হত। কিন্তু রিগান ডানপন্থী হলেও ট্রাম্পের মতো বর্ণবাদী ও জেনোফবিক বলে পরিচিত ছিলেন না। আগের লেখায় আলোচনা করেছিলাম যে, রিগ্যান এবং থ্যাচারকে সে সময়ের নিও-লিবারেল পুঁজিবাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করা হয়। যদিও অনেকে মনে করেন আদর্শগতভাবে এর শুরু আরও প্রায় এক দশক আগে। এর পরের পর্বে এই নিও-লিবারেলজম নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা করার ইচ্ছা রইল।

আজকে আমেরিকার সাদা মধ্যবিত্তদের এই অংশ পেছনের ‘গৌরবময় সুসময়ে’ ফিরে যেতে চান-– যখন তাদের স্থিতি ছিল, স্বচ্ছলতা ও স্বপ্ন ছিল, পৃথিবীজুড়ে তাদের জাতির কর্তৃত্বও ছিল অক্ষুণ্ণ। কিন্তু সে সময়েও এদেশেই লক্ষ লক্ষ কালো, আদিবাসী এবং নারীদের কোনো অধিকারই ছিল না। তারা তাদের ‘ফাউন্ডিং ফাদার’দের বানানো যে সংবিধান নিয়ে এত গর্বিত সেখানেও শুধু সম্পত্তিবান সাদা পুরুষের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছিল। তাই আমেরিকার এই মধ্যবিত্ত সাদা অংশটি ক্রমাগতভাবে পিছিয়ে পড়ার হতাশা থেকে যখন বলেন যে, তারা সেই আগের আমেরিকা ফিরে পেতে চান, বা তারা আমেরিকাকে আবার গ্রেট বানাতে চান (ট্রাম্পের শ্লোগান), তখন আমার আমেরিকান কালো কবি ল্যাংস্টন হিউজের (১৯০২-১৯৬৭) সেই বিখ্যাত কবিতা মনে পড়ে যায়:

Let America Be America Again

Let America be America again.

Let it be the dream it used to be.

Let it be the pioneer on the plain

Seeking a home where he himself is free.

(America never was America to me.)

Let America be the dream the dreamers dreamed—

Let it be that great strong land of love

Where never kings connive nor tyrants scheme

That any man be crushed by one above.

(It never was America to me.)

O, let my land be a land where Liberty

Is crowned with no false patriotic wreath,

But opportunity is real, and life is free,

Equality is in the air we breathe.

(There’s never been equality for me,

Nor freedom in this “homeland of the free.”)

সম্প্রতি নর্থ ডেকোটার স্ট্যান্ডিং রকে সু ট্রাইবের রিজার্ভেশনের কাছ দিয়ে যে তেলের পাইপলাইন বসানো হচ্ছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়েছেন হাজার হাজার আদিবাসী। তাদের একজন নেতা এক সাক্ষাৎকারে এই কথাটাই তুলে ধরেছেন-– “দুই পার্টির কোনো নেতাকে নিয়েই আমার কোনো আগ্রহ নেই, কারণ এরা কখনও আমাদের জন্য কিছু করেননি এবং করবেনও না।”

আরও মজার কথা হচ্ছে, এই পাইপলাইনের কোম্পানির শেয়ারেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের কোটি কোটি টাকা ইনভেস্ট করা আছে।

আজকে আমেরিকার একটা জনগোষ্ঠী যে আশায় বুক বেঁধে ট্রাম্পের মতো লোককে ভোট দিয়েছেন তাতে তারা কতটুকু সফল হবেন সেটা শুধু ভবিষ্যতই বলতে পারবে। ইউরোপ এবং আমেরিকায় পুঁজিবাদের ডান রক্ষণশীল অংশের উত্থান এখনকার সময়ের বাস্তবতা-– ট্রাম্পিজম বা ব্রেক্সিটিজম এখনকার সময়ের পপুলিজমের ফলাফল। বর্তমানে দাঁড়িয়ে সেই মুহূর্তের সার্বিক ব্যাখ্যা দেওয়া বেশ কঠিন। কারণ বর্তমানের ছোট্ট বিন্দুতে দাঁড়িয়ে চারপাশের বিস্তৃত ৩৬০ ডিগ্রি পটভূমি বিচার করে তার সঠিক বিশ্লেষণ দিতে পারা খুব সহজ কাজ নয়। সাধারণ মানুষের জন্য তো সেটা আরও অসম্ভব। তাই এই পুঁজিবাদী সিস্টেমের সংকট শুধুমাত্র একটি দেশের সরকারের সংকট হিসেবে চিহ্নিত করা নতুন কিছু নয়।

পৃথিবীজুড়ে আজকে ট্রাম্পকে নিয়ে হাহুতাশ শুরু হয়ে গেছে (যদিও পুতিন বা ব্রেক্সিট নেতা ফারাজে খুব খুশি,। কিন্তু ট্রাম্প কী আসলেই এতখানি জাতীয়তাবাদী, জাতিবিদ্বষী বর্ণবাদী আইন কার্যকরী করবেন? ওবামা যখন ক্ষমতায় এসেছিলেন তখনও উল্টো দিকের লিবারেলদের উপচে-পড়া উৎসাহ দেখে আমি সন্দিহান হয়ে উঠতাম। এত হই-হুল্লোড়ের পরে ওবামা কী-ই-বা পরিবর্তন এনেছেন বা আনতে পেরেছেন দেশের ভিতরে এবং বাইরে? আমেরিকার এই পুঁজিবাদী সিস্টেমে যে ‘চেকস এন্ড ব্যালেন্স’ আছে তাতে শুধুমাত্র একজন প্রেসিডেন্টের পক্ষে খুব বেশি ডানে বা বামে সরে আসা সম্ভব নয়। তবে কাঠামোগত সংকটের কারণে এখনকার এই পুঁজিবাদী সিস্টেম যদি আবার নতুন দিকে মোড় নেওয়া শুরু করে তাহলে হয়তো বড় কিছু পরিবর্তন দেখাও যেতে পারে।

ট্রাম্প যদি এখন সত্যি সত্যি তাঁর নির্বাচনী প্রতিজ্ঞাগুলো রাখতে চান-– যেমন ধরুন, বেআইনি ১১ মিলিয়ন অভিবাসীকে দেশ থেকে বিতাড়িত করা, মেয়েদের গর্ভপাতের অধিকার খর্ব করা বা পরিবেশ দূষণবিরোধী আইনগুলো থেকে সরে আসা বা শ্রমিকদের ইউনিয়নের বিপক্ষে আইন প্রণয়ন বা আমেরিকার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বজুড়ে আরও বেশি আগ্রাসী ভূমিকা গ্রহণ-– তাহলে আমরা অল্প হলেও যতটুকু এগিয়েছিলাম তা থেকে আবার পিছাব। এখন পর্যন্ত ট্রাম্পকে যেমন বেশ কিছু প্রতিক্রিয়াশীল নির্বাচনী প্রতিজ্ঞা থেকে সরে আসতে দেখা যাচ্ছে ঠিক তেমনি তাঁর চারপাশে খুবই প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চাদপদ মানুষজনের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। তাই সামনে কী আছে তা বলা বেশ কঠিন। ট্রাম্প নিজেও তা জানেন কি না সেটা নিয়েই অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেন।

আবার শোনা যাচ্ছে, আমেরিকার গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল অংশ ক্ষুব্ধ এবং ভীত হয়ে উঠেছেন। তাদের মধ্যে বেশ নড়াচড়া দেখা যাচ্ছে। তারা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছেন। ট্রাম্পের বিজয় হয়তো তাদের নতুন করে ক্ষমতায় আসার প্রেরণা জোগাবে। এমনও হতে পারে যে, আশির দশকে আমরা পুঁজিবাদের যেরকম একটা শিফট দেখেছিলাম এখন আবার নতুন কোনো পরিবর্তন আসবে– সাম্প্রতিককালের কাঠামোগত সংকট মোকাবেলা করা জন্য নতুন আরেক ব্যান্ডেজ হিসেবে। অথবা হয়তো পুঁজিবাদী কাঠামো থেকে বেরিয়ে পৃথিবীতে নতুন কোনো পথের সূচনা হবে। কে জানে!

মানুষের ‘সভ্যতা’ কখনও সরলরেখায় চলে না। কখনও সে দুপা আগায় তো এক পা পিছায়। কখনও-বা আটকে থাকে একই জায়গায় শত শত বছর। এক পা এগিয়ে দুপা পিছানোর উদাহরণেরও অভাব নেই ইতিহাসজুড়ে। তাই এই মুহূর্তে যে বদলের হাওয়া দেখা যাচ্ছে তার ফলাফল কী হবে তা জানতে হয়তো আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।