লেখকঃ চন্দন সরকার

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বই খাতায় আছে বটে কিন্তু রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হারিয়ে যায় এসব অনেক কথাই। আদৌ কি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ কখনো ছিলো! যদি সাম্প্রতিক ইতিহাস দেখি তাহলেই আসলে বোঝা যায়। সাল ১৯৯০। অক্টোবরের শেষ দিকের কথা। হঠাত গুজব উঠলো যে অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা হয়েছে। তারই ফলশ্রুতিতে ৩০ অক্টোবর থেকে নভেম্বরের ২ তারিখ পর্যন্ত চলে তান্ডব।
১৯৯২, ৭ ডিসেম্বর। বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ক্রিকেট ম্যাচ হবার কথা। খেলাও শুরু হল। কিন্তু ৮.১ ওভার খেলা হবার পর বন্ধ করতে হয় খেলা। কারণ স্টেডিয়ামের আশেপাশে তখন প্রায় ৫০০০ মুসলিম তখন রাস্তায় নেমেছে ধর্ম রক্ষার জন্য। সকলের হাতেই লোহার রড ও বাঁশের লাঠি। তাদের আন্দোলনে নামাটা আসলেই অনেক যুক্তিসঙ্গত। কারন বাবরি মসজিদ এবার আসলেই ভাঙ্গা হয়েছে। সেইদিনই আক্রমনের স্বীকার হয় ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দির, ভোলানাথগিরি আশ্রম সহ অনেক জায়গায়। এইবারের এই তান্ডব চলে প্রায় মার্চ মাস পর্যন্ত। প্রায় ২৮০০০ হিন্দু ঘরবাড়ি, ২৭০০ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ৩৬০০ মন্দির ভাঙ্গা হয় সারা দেশে যার সম্মিলিত ক্ষতি হয়েছিল ২০ লক্ষ টাকা। পুরাণ ঢাকা, রায়রেবাজার, ভোলা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলো সবথেকে বেশি। এছাড়াও কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপজেলায় ১৪টি মন্দির সহ ৫১টি হিন্দু ঘরবাড়ি ভাঙ্গা হয়। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, মীরেশ্বরী গ্রাম পুরো পোড়ানো হয়। পঞ্চাণনধাম, তুলসীধাম সহ পাঁচটি মন্দির ভাংচুর করা হয়। এসবের প্রতিবাদ করে “লজ্জা” বই লেখার জন্যই তো তসলিমা নাসরিনকে তো দেশ ছাড়াই করা হলো। আর ১৯৪৬ এর নোয়াখালী রায়ট, ১৯৫০ এর বরিশাল রায়ট তো বাদই দিলাম।
এই সমস্ত পুরনো কাসুন্দি ঘাটার একমাত্র কারন হলো আমাদের মননটার ইতিহাস দেখানো। এবার আসি রামুর ঘটনায়। বিশদ বিবরণের কোনো প্রয়োজন নেই। সকলেই প্রায় জানি কি ঘটেছিলো সেদিন রামুর বৌদ্ধ বিহারে। একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে কাদের প্ররোচনায় বা কাদের মদদে এসব হচ্ছে? প্রশাসন কেন কিছু করতে পারছে না। রামুতে সে সময় যে ওসি ছিলেন ওনার বক্তব্যে উনি বলেছিলেন যে ওনার গায়ে যদি পুলিশের পোষাক না থাকতো তাহলে তিনিও ওই আক্রমনে যোগ দিতেন। যদিও সেই পুলিশ অফিসারকে ক্লোস করা হয়েছিলো। বান্দরবনে তাকে আবার ওসি হিসেবে পাঠানো হলো। ২০১৪ সালে দেখলাম সেই লোক আবার একই ধরনের সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় উস্কানি দিয়েছে। এই যে পুলিশ বলুন, প্রশাসন বলুন সবকিছুর মধ্যে জামাত তাদের লোক ঢুকিয়ে দিয়েছে এইটাও একটা বড় কারন এইসব প্রতিরোধ করতে না পারার জন্যে। এখন আমাদের উপমহাদেশের মানুষদের একটা বড় সমস্যা হল ধর্মান্ধতা। এটাকে আমি সমস্যাই বলবো। কারণ এই ধর্মান্ধতাই এই সবের মূল কারণ। আর এতে ইন্ধন জোগায় সমাজের স্বার্থলোভী কিছু মানুষ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে ঘটনাটি ঘটল তাও একটা ফেসবুক ষ্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে। এই ফেসবুক স্ট্যাটাসের বিরুদ্ধে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছিলো সেখানকার ইউএনও। একজন সরকারী কর্মকর্তা হয়ে তিনি কিভাবে কোনো তদন্ত ছাড়াই এরকম একটি সমাবেশের অনুমতি দিলেন সেটাই এক বিস্ময়ের ব্যাপার। এসব বিষয়ে আসলে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা দরকার এবং শাস্তি দেয়া দরকার। প্রশাসনের ঠিক কে কে এগুলোর জন্য দায়ি তা বের করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি দরকার। কারন শর্ষের মধ্যেই যদি ভূত থাকে তবে এসব কখনোই থামবে না।
মওদুদীবাদ নামে একটা টার্ম আছে। কোনো সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, কোনো জঙ্গীবাদী সন্ত্রাস এদের যে রাজনীতি আছে বা ভাবধারা আছে যেটাই বলি না কেনো আমরা সেটাই মওদুদীবাদ। মওদুদিবাদের ভিতর অন্য কোনো ধর্মের কোনো জায়গা নেই। এমনকি যে মুসলমান মউদুদীবাদের সাথে একমত হবে না তাকেও হত্যা করার কথা মউদুদী বলেছে।
বাংলাদেশে এসব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থাকতো না যদি না বাহাত্তরের সংবিধান পরিবির্তন করা হত। এই জন্য জেনারেল জিয়াকেই দায়ী করা উচিত। কেননা তিনিই সকল দুষ্কর্মগুলো করে রেখে গেছেন। বাহাত্তরের সংবধানে তো ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা ছিলো। ধর্মের নামে রাজনীতি করা নিষিদ্ধ ছিলো, তিনিই তা চালু করলেন। জামাত শিবিরকে রাজনীতিতে পূনর্বাসন করলেন। এটার খেসারত এখন আমাদের দিতে হচ্ছে। বাংলাদেশে যদি ধর্মের নামে রাজনীতি না চালু হতো তবে আজ এই দিন আমাদের দেখতে হতো না। ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় এই ৩০০ লোকজনের বাড়ি ভাংতো না। এই ধর্মের রাজনীতির ফলেই মানুষের মনন পরিবর্তন হয়ে মৌলবাদী হয়ে গিয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান এই অবস্থা ভবিষ্যতে যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা বলা আসলেই খুব মুশকিল হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। তবুও আশা রাখি বাংলাদেশ একময় সত্যিকারের অহিংস, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে পরিণত হবে।