একাত্তরে যে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক চেতনার বিরুদ্ধে পুরো জাতি একাট্টা হয়ে একটি অসম যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অথচ পরিতাপের বিষয় নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সেই চেতনাধারীদের পরাভূত করতে পারলেও তাদের অশুভ সাম্প্রদায়িক চেতনার কাছে জাতি শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরন করেছে। দিন যত যাচ্ছে সেই পরাজয়ের ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তির দ্বারপ্রান্তে এসে যাদেরকে দেখার কথা ছিল দেশের বৃহৎ সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অংশ হিসেবে তারা পাকিস্তান আমলের মতো আজও সেই সংখ্যালঘুই রয়ে গেলেন। আর জাতি শত্রু যে মুষ্টিমেয় শক্তি পুরো জাতির সাথে প্রতারণা করে বিদেশী আদর্শিক প্রভুদের সাথে আঁতাত করে ওদের স্বার্থ রক্ষায় বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, সমাজের যারা একটি অতি নগন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে গণ্য হওয়ার কথা ছিল, তারাই সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে বিশাল সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সাথে একাত্ন হয়ে গেছে। অথবা বলা যায় তারাই পুরো সমাজকে আত্নীকরণ করে ফেলেছে। কিন্তু যে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়টি তাদের অভিশপ্ত লঘুত্ব ঘোচানোর জন্য সংখ্যাগুরু মুসলমান ভাইদের সাথে সমান তালে যুদ্ধ করেছে, ধন সম্পদ সম্ভ্রম বিসর্জন দিয়েছে; তাদের অবস্থা পাকিস্তান আমলে যে তিমিরে ছিল এখনও সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। বলা যায় তিমির ক্রমাগত ঘনীভূত হচ্ছে। লগঘু হচ্ছে ক্রমাগত লঘুতর। বৃথা গেল তাদের লক্ষ প্রাণের বলিদান। তাদের রক্ত আর অশ্রু মিশে গেল নর্দমার নোংরা জলে।

রামু থেকে নাসিরনগর একই ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণ। এগুলি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, একটি চলমান প্রক্রিয়া মাত্র। কারা এইসব ঘটনার জন্মদাতা ? এর সরল উত্তর কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, সেখানকার প্রায় সকল মুসলমান। এখানে আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জামাত, জাতীয় পার্টি প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সবাই এক। এই এক জায়গাতেই মনে হয় ‘সব পথ শেষে মিলে যায়, মিশে যায় এসে অলৌকিক এক মোহনায়’। যারা ঘটনা ঘটায় তাদের চেয়ে শতগুণ বেশী মানুষ তা পরম থ্রীল হিসেবে উপভোগ করে। ব্যতিক্রম কিছু বাম ঘরানার মানুষ। এরা লাল পতাকা আর লাল ব্যানার নিয়ে রাস্তায় নামে, সাধ্যমতো প্রতিবাদ করে, কিন্তু সেই ভূমিকাটি যাত্রাপালার বিবেকের চেয়ে বেশী কিছু মনে হয়না। ক্ষমতাবান’রা, সংখ্যাগরিষ্ট মানুষেরা ‘দূর হ বনের পাগল’ বলেই এদের উড়িয়ে দেয়, তাড়িয়ে দেয়।

সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনাতেই দেখা যায় আওয়ামী লীগের কিছু স্থানীয় নেতা ইমামের দায়িত্ব পালন করে থাকে। জামাত, বিএনপি, হেফাজত, আহলে সুন্নত সবাই মিলে মনে হয় মূর্তিভাঙ্গা ইবাদতের ইমামতির দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছে আওয়ামী নেতাদের উপর। আর নেতা গুলিও অতি উৎসাহ অধ্যবসায়ে তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। এর পেছনে হিন্দু সম্পত্তি গ্রাসের একটা ব্যাকগ্রাউন্ড যেমন আছে তেমনি আওয়ামী লীগ ইসলামী করণের স্পিরিটটিও নিয়ামক হিসেবে আছে। সময়ের প্রয়োজনেই যেমন একদিন আওয়ামীলীগ থেকে মুসলিম শব্দটি উৎপাটিত হয়েছিল তেমনি ভাবেই সময়ের প্রয়োজনে আবার নামে না হলেও চরিত্রে মুসলিম চেতনাটি আওয়ামী শরীরে যুক্ত হতে শুরু করেছে। ধর্ম নিরপেক্ষতা আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার হালকা ফতোয়াটি এখন আর আওয়ামী শরীরটাকে ঢেকে রাখতে পারছেনা। মৃদু বাতাসেই লেবাস সরে যায় আর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে কাবা’র ছবি। কাবা’র ছবি মানেইতো মূর্তি ভাঙ্গার অনুপম অনুপ্রেরণার উৎস। এ ঘরের সাথেই যে মূর্তিভাঙ্গার বৃহত্তম যজ্ঞটির ইতিহাস জড়িত। একদিনে ভিন্ন বিশ্বাসীদের তিন’শ ষাট দেবতার ধ্বংস সাধন। নাসিরনগরে তো মাত্র গোটা সাতেক মন্দির আর গোটা তিরিশ বিগ্রহ ধ্বংস করা হয়েছে, একে এলাকার মাননীয় সাংসদ এবং মন্ত্রী খুব বড় একটি ঘটনা হিসেবে স্বীকৃতি নাও দিতে পারেন। আর এ নিয়ে এত বাদ প্রতিবাদ কান্নাকাটিতে বিরক্ত হয়ে মন্ত্রী ছায়েদুল হক রুপবান যাত্রাপালার ভিলেন ছায়েদ বাদশাহর মতো হুংকার ছেড়ে বলতেই পারেন ‘মালাউনের বাচ্চারা বেশী বাড়াবাড়ি করছে। মন্ত্রীর এই আচরনে অনেকেই ক্ষুব্ধ বিক্ষুব্ধ। দাবী উঠেছে তার পদত্যাগের। পদত্যাগের ব্যাপারটিতে আমি সবিনয়ে ভিন্নমত পোষণ করি। কেননা এক ছায়েদুলের পদত্যাগে যদি ক্ষত সেরে যেত আওয়ামী লীগ পূত পবিত্র হয়ে যেত। তাহলে এর যৌক্তিকতা ছিল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আওয়ামীলীগে এখন এই ছায়েদুলদেরই যে প্রাধান্য। ছিটেফোঁটা কিছু ব্যতিক্রম হিসেবে যারা আছেন মূল খুঁজলে দেখা যাবে তারাও বিভিন্ন প্রগতিশীল দল থেকে ছুটে আসা সেলফ গ্রাফটিং অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। এদের ক্ষয়িষ্ণু শরীরে নদীভাঙ্গা জনপদের শেষ ভূমির চিহ্ন হিসেবে সেক্যুলার ধারনাটি এখনও টিকে আছে কিন্তু তারাও লতিফ সিদ্দিকীর পরিনাম দেখে দ্রুত সেই চিহ্নটি মুঁছে ফেলতে চাইবেন। লতিফ সিদ্দিকী কতটুকু সেক্যুলার ধারণার মানুষ ছিলেন তা প্রশ্ন সাপেক্ষ কেননা একজন প্রকৃত সেক্যুলারের যেমন তূলণামুলক পরিশীলিত একটি ইমেজ থাকে লতিফ সিদ্দিকীর তা ছিলনা। অতীতে তিনি অনেক অপকর্ম করেছেন দরিদ্রের ভূমি গ্রাস করেছেন, সাকা চৌধুরীর মতো ঔদ্ধত্বপূর্ণ আচরন করেছেন, কেন্দ্র তাকে সামান্য ধমকও দিয়েছে এমন দৃষ্টান্ত কিন্তু নেই। চিরকাল আইনের উর্ধে থাকা সেই প্রবল পরাক্রমশালী লতিফ সিদ্দিকী যেই না মুসলমানদের হজ্বের বাণিজ্যকরণ প্রসঙ্গে একটি অপ্রিয় সত্য কথা বলে বসলেন তৎক্ষণাৎ তিনি ধরাশায়ী হলেন। মন্ত্রীত্ব গেল, সংসদ পদ গেল, এমনকি দলীয় সদস্য পদটিও হারালেন। আওয়ামীলীগ জানিয়ে দিল যতবড় সত্যই হোকনা কেন তা যদি ইসলামের বিপক্ষে যায় তবে সেই সত্য উচ্চারণকারীকে ঠাঁই দিতে ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামীলীগ এখন সম্পূর্ণ অপারগ। আওয়ামীলীগ ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে স্পষ্টতঃই সরে আসছে। তারা উপলব্ধি করতে পারছে বিএনপি কে ঠেকাতে হলে আওয়ামীলীগকে বিএনপি’র চেয়েও অধিক ইসলামপ্রিয় হতে হবে। তাদের আদর্শ হতে হবে ঘোর ইসলামী জাতীয়তাবাদ। এর পূর্বাভাস মিলে বিভিন্ন ইস্যুতে চরম ডানপন্থী মোল্লাদের সাথে তাদের আপোষ ও সংহতিতে। প্রায় প্রকাশ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সামনে মুক্তমনা লেখকদের হত্যা করলেও নিস্পৃহ ভূমিকা পালন ও সেইসব হত্যাকান্ডের বিচারের অস্বীকৃতি’তে। ইদানীং আরেকটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে একশ্রেণীর নেতাকর্মী ‘ইসলাম ও বঙ্গবন্ধু’, ‘ইসলামের সেবায় বঙ্গবন্ধু’, ‘মুসলিম উম্মার উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু’ ইত্যাদি শিরোনামযুক্ত ষ্ট্যাটাস দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে একজন মুসলিম লীডার হিসেবে পরিচিত করতে উঠেপড়ে লেগেছেন।

বেশ কয়েক বছর আগে আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ শুভাকাঙ্খী বলে পরিচিত প্রবীন সাংবাদিক শ্রদ্ধেয় আব্দুল গাফফার চৌধুরীর একটি লেখা পড়েছিলাম। তিনি যা লিখেছিলেন তার সার কথা হল এ রকম, একদিন তিনি ইংল্যান্ড আওয়ামী লীগের এক সভাপতির সাথে লং ড্রাইভে বেরিয়েছেন। গাড়ীর চালক দীর্ঘ পথের একঘেয়েমি দূর করার জন্য রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার একটি রবীন্দ্র সংগীতের ক্যাসেট বাজানোর সাথে সাথেই সেই আওয়ামী নেতা বিরক্ত হয়ে বললেন ‘এটা কি ক্যাসেট লাগিয়েছেন, সাঈদী সাবের ওয়াজ লাগান’। গাফফার চৌধুরী আক্ষেপ করে লিখেছিলেন এই মানসিকতার লোকগুলিই যদি আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে আসে তবে দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন। রামুর ঘটনা, নাসির নগরের ঘটনা, গাফফার চৌধুরীর আশঙ্কার সেই অন্ধকারের সংকেতবাহী টুকরো টুকরো মেঘ। সেই মেঘ ঘনীভূত হতে হতেই একদিন আসল অন্ধকারটি নেমে আসবে।

পরিশেষে আশাব্যাঞ্জক কথা শুনিয়েই লেখাটি শেষ করতে চাই। আধাঁরের পূর্বাভাসবাহী মেঘের মতো বিন্দু বিন্দু আলোর কণিকাও সমাজে এখনও উপস্থিত রয়েছে। নাসির নগরের ধ্বংসযজ্ঞ প্রতিরোধের জন্য কিছু সাহসী বিবেকবান মানুষও বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। এই সাহসী মানুষদের কথা যতটুকু জানতে পেরেছি তাদের একজন আওয়ামীলীগ কর্মী, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, হাসপাতালের একজন ষ্টোর কিপার, একজন প্রাক্তন মাদ্রাসা শিক্ষক এবং হয়তো আরও কেউ কেউ। সংখ্যায় অতি নগন্য হলেও এরাই আমাদের সেক্যুলারের পতাকাবাহী মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনাধারী। সংখ্যায় কম বলেই বালির বাঁধের মতো তাদের প্রতিরোধটি ভেঙ্গে গেছে। এদের সংখ্যা যত বাড়বে শঙ্কার অন্ধকার ততই দূরে সরে যাবে । এই বিন্দু বিন্দু আলোকে ধারণ করেই হয়তো একটি সম্ভাবনার সূর্য একদিন হেসে উঠবে। আসুন রাজনীতির জটিল কুটিল কুশীলবদের অপেক্ষায় না থেকে নিজ নিজ বিবেকের তাড়নায় এই সংখ্যাটিকে বাড়ান।