অনেকেই বলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ব্যাপারটা বুঝতে ঝামেলা হচ্ছে। আবার অনেকে বলছেন, এটা কোন ব্যাপার নাকি, ১০০ জনের মধ্যে ৫১ জন যদি বলে হিলারি ক্লিনটন বা ডোনাল্ড ট্রাম্প আমার প্রেসিডেন্ট তা’হলেই তো হয়ে গেলো। মানে, এটা নিয়ে এতো মাথাব্যাথার আবার কি আছে? কথা কিন্তু ঠিক। বেশিরভাগ মানুষ যা চায় তা’ই তো হওয়া দরকার; না’কি? কিন্তু না; ব্যাপার এখানে তেমনটা নয়। বেশ জটিল এবং মজারও বটে। বলতে পারেন বেশির ভাগ মানুষ যা বলবে তা হবে না? প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে, উত্তরটা হচ্ছে নাহ ; এটি নাগরিকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ বা পপুলার ভোটের পদ নয়। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় ইলেক্টরাল কলেজ নামের একটি পদ্ধতির মাধ্যমে। হুমমমম, যুক্তরাষ্ট্রে এমনটা হবে না অথচ গণতন্ত্রের প্রতি সম্মান রেখে; একটা কার্যকর রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্য দিয়ে দেশটা চলে; এবং; অবশ্যই নির্বাচনের মাধ্যমে এবং সেগুলো এদেশের নাগরিকরা সংবিধানের খাতিরে মেনেও চলে।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ২০১৬ ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ২০১৬
ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে।

বেশ জটিল আর ইন্টারেস্টিং এখানকার নির্বাচন ব্যবস্থা। যেহেতু এদেশের প্রেসিডেন্ট, মানে দেশের প্রধান নির্বাহী ২০১৬ নির্বাচন নিয়ে কথা হচ্ছে তা’ই আলোচনাটা এখানেই সহজ করে সীমাবদ্ধ রাখবার চেষ্টা করছি। লেখাটি নিতান্তই সাধারণ তথ্য হিসেবে বিবেচনা করলে ভালো হবে, একাডেমিক রেফারেন্স হিসেবে নয়।

আমেরিকা ৫০ টি রাজ্য নিয়ে গঠিত একটা দেশ। এই সব রাজ্যের নিজের আইন কানুন থাকলেও সব ক’টি রাজ্য নিয়েই সমিতির মত কিন্তু একটি যুক্ত রাষ্ট্র গঠন হয়েছে, তাই এটি যুক্তরাষ্ট্র বা ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা। রাজ্যগুলোর আইন আবার যুক্তরাষ্ট্রের মানে কেন্দ্র অর্থাৎ ফেডারেল আইনকেও মেনে চলে। এই দেশটা চালায় দেশের তিনটি শাখা; নির্বাহী (এক্সিকিউটিভ), আইন প্রনয়ন (লেজিসলেটিভ) আর বিচার (জুডিশিয়ারি) বিভাগ। এই নিয়েই এদের জনপ্রতিনিধি ও সরকার এবং সব কটি বিভাগই স্বতন্ত্র ভাবে নিজেদের কাজ করতে পারে নিজেদের মতে করে অথচ এদের আবার পারস্পরিক নির্ভরতাও আছে। নাগরিক নিরুপায় হয়ে পড়লে বিচার চাইতে পারে এদেশের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে যে কারো বা প্রতিষ্ঠানেরও। আগেই বলেছি রাজ্যগুলোরও আবার নিজস্ব সরকার এবং আইন আছে এবং রাজ্য মানে স্টেট্ কাঠামোও কিন্তু অনেকটা কেন্দ্রের মত, একই রকমের। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর পদ হচ্ছে প্রেসিডেন্ট আর রাজ্যগুলোর নির্বাহী প্রধান হচ্ছেন গভর্নর।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রক্রিয়াটি কেমন তা কিছুটা বুঝে উঠবার জন্য এদেশের আরো কিছু পদ্ধতি নিয়ে কথা বলতে হবে। ধরা যাক বাংলাদেশের সংসদে ৩৫০ খানি আসন। এক একটি আসন মানে এক একজন এম.পি। এরাই সরকার গঠন করে এবং দেশ চালায়। আমেরিকায়ও অনেকটা তাই। নিচু পর্যায়ের সংসদের নাম হাউজ অফ রিপ্রেজেনটেটিভ আর ওপরের অংশটির নাম সিনেট। ৫০ (+ ১) রাজ্য থেকে থেকে নির্বাচিত হয়ে আসে। এদের মধ্য প্রত্যেক রাজ্য থেকে ২ জন করে সিনেটর হিসেবে মানে ১০০ জন, (+১) ডিসি থেকে ৩ জন হাউজ রিপ্রেজেন্টেটিভ, আর সবগুলো রাজ্য থেকে আরো ৪৩৫ জন হাউজ রিপ্রেজেন্টেটিভ; মোটমাট ৫৩৮ জন। জেনে রাখুন ভারমন্ট বা ডেলওয়ারের মত ছোট রাজ্য থেকে মাত্র ১ জন করে প্রতিনিধি এলেও ক্যালিফোর্নিয়ার মত বড় রাজ্য থেকে প্রতিনিধি আসে ৫৫ জন। তো? এই হলো নাটকের শুরু।

সিনেট প্রতিটি রাজ্য থেকে সরাসরি নির্বাচিত দুজনে করে প্রতিনিধি দিয়ে মোট ১০০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত। অন্যদিকে হাউজ অফ রিপ্রেজেনটেটিভ প্রতিটি রাজ্যের জনাসংখ্যার আনুপাতিক মানে সরাসারি ভোটে নির্বাচিত ৪৩৫ জন প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত। প্রতিটি প্রতিনিধি গড়ে প্রায় ৭ লাখ নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব করে। নাগরিক কল্যানে কোনো বিল মানে প্রস্তাব পাস হতে হলে সেটাকে প্রথমে হাউজ অফ রিপ্রেজেনটেটিভে, তারপর সিনেটে পাশ হতে হবে। সিনেটে পাশ হবার পরে প্রেসিডেন্ট সই করবেন যদিও প্রেসিডেন্টের ভেটো ক্ষমতা আছে, তবে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পেয়ে পাশ করা বিল’এ প্রেসিডেন্ট ভেটো দিতে পারেন না।

আগেই ইঙ্গিত করেছি যে আমেরিকান প্রেসিডেন্টের নির্বাচন কিন্তু সংসদের ওপর নির্ভরশীল নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সংগঠিত করে ইলেকটোরাল কলেজ নামের একটা পদ্ধতি। কলেজ আসলে মোটেও কলেজ নয়, এটা হচ্ছে ৫০’টা রাজ্য থেকে নেওয়া প্রতিনিধিদের একটা দলীয় রাজনৈতিক ছায়া পরিষদ। আর একটি রাজ্যের একাংশ, যা কিনা ডিস্ট্রিক্ট অফ কলাম্বিয়া বা ডি.সি নামে পরিচিত, সেখান থেকে। ডি.সি’র আইন কানুন একটু বিশেষ এবং অন্যরকম। তবু এখানে সাধারণ মানুষ থাকে বিধায় নাগরিক অধিকার রক্ষায় এখান থেকেও জন প্রতিনিধি থাকে।

এতক্ষনে নিশ্চই বুঝতে পারছেন যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন কিন্তু নাগরিকরা সরাসরি ভাবে করছে না; করছে ইলেকটোরাল কলেজের ইলেক্টররা। এই ইলেক্টরদেরকে রাজনৈতিক দলগুলো আগে থেকে নির্বাচিত করে। তাদের একটি মাত্র কাজ, নির্বাচনের পরে ওয়াশিংটনে গিয়ে ভাল মানুষের মত নিজের প্রার্থীকে ভোটটা দেবার। মার্কিন দেশে মোট ৫৩৮টি ইলেকটোরাল কলেজ আছে। এই সংখ্যাটি নির্ধারিত হয় জনসংখ্যার অনুপাতে। যেমন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ৫৫ জন, নিউ ইয়র্ক থেকে ২৯ জন, আবার মনটানা থেকে ৩ জন। ৫৩৮এর অর্ধেক হলো ২৬৯ জন, কাজেই যেই প্রেসিডেন্ট পদপ্রাথী ২৬৯ এর বেশি অর্থাৎ ২৭০টা ইলেক্টরেটের ভোট পেয়ে যাবে সে’ই হয়ে যাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এই পর্যন্ত সহজ, তাই না? নটেগাছটি মুড়োলো ! না’কি? একটু নাটকীয়তা বাকি আছে। ছোট্ট করে বলবার চেষ্টা করছি।

ক্যালিফোর্নিয়াতে যদি ৫৫ আসনের ২৮’টা আসন হিলারীর ডেমোক্র্যাটদের দখলে চলে যায়, আর অন্য একমাত্র প্রার্থী হিসেবে ট্রাম্প বাকি ২৭’টার অধিকারী হবার কথা। অন্য দুজনকে আলোচনার সুবিধার জন্য বাদ দিচ্ছি কেমন? তো সারা দেশের হিলারীর ডেমোক্র্যাট মোট বনাম ট্রাম্পের রিপাবলিকান মোট এই নিয়ে হিসেবে হবার কথা, তাই না? নাহ। কিন্তু তা হবে না। ক্যালিফোর্ণিয়ার পুরো ৫৫’টা ই হিলারীর দখলে গোনা হবে। উইনার টেকস ইট অল। বিরাট ঝামেলা। যুক্তরাষ্ট্রের রাজ্যগুলোর ৪৮’টা রাজ্যেই এই ঘটনা ঘটবে। বাকিগুলো সাধারণতঃ খুব বেশি ঝামেলা না পাকালেও যন্ত্রনা বাধায়। ‘ঠিক জানিনা’ বা আনডিসাইডেড রাজ্যগুলির ভোট, এদেরকেই সুইং স্টেট্ বলে। এই কারণেই এতো অনিশ্চয়তা। পাগলামি। যদিও এখানকার সংবাদ মাধ্যমগুলো বিভিন্ন সমীক্ষাভিত্তিক ধারণা বা পোল বেশ ভালো ভাবেই করতে পারে; তবু অনিশ্চয়তা থেকেই যায়। সবচেয়ে যেটা বিভ্রান্তিকর সেটা হল বেশীরভাগ লোকের ভোট পেয়েও ইলেকটরাল কলেজের মারপ্যাঁচে একজন হেরে যেতে পারে, যেমন আল গোর জর্জ বুশের কাছে ২০০০ সনে হেরে গিয়েছিল।

৫০ টি রাজ্যের মধ্যে অনেকগুলো রাজ্য কট্টর ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকান সমর্থক। অর্থাৎ গোঁড়ামো ভিত্তিক সেইসব রাজ্য প্রায় সব সময়ই একই ফলাফল প্রসব করে। আগে থেকেই বুঝতে পারা যায় কি হবে। গত ৮ টি নির্বাচনে, অর্থাৎ ৩২ বছর ধরেই এমন হচ্ছে। অল্প কয়েকটি ষ্টেট দোদূল্যমান থাকে, এই ধরুন গোটা ছয়। ফ্লোরিডা , ওহাইয়ো, নর্থ ক্যারোলিনা, ভার্জিনিয়া, কলোরাডো এবং নেভাডা। ৫৩৮ আসনের ৯০’টাই এই রাজ্য গুলোর মোট আসন সংখ্যা। এই সুইং ষ্টেট গুলোতেই চলে কঠিন ভোটাভোটির লড়াই। এগুলোর ফলাফলই, বলা চলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন চূড়ান্ত করে দেয়।

প্রেসিডেন্ট ভোট হয় প্রতি ৪ বছরে একবার, হাউস অফ রিপ্রেজেনটেটিভ প্রতি ২ বছরে একবার আর সিনেটরদের ভোট হয় প্রতি ৬ বছর অন্তর। সবার একসাথে ভোট হয় না; তবে প্রায় ১/৩ ভাগ প্রতিনিধি এই চার বছরের ভোটাভুটিতে পড়েই যায়। প্রেসিডেন্ট, হাউস অফ রিপ্রেজেনটেটিভ আর সিনেটরদের ভোট ছাড়াও গভর্নরদের নির্বাচন এবং বিভিন্ন প্রস্তাবনার ওপরও ভোটাভুটি হয় এই সময়ে। এবারের ভোট হচ্ছে নভেম্বরের ৮ তারিখে। দি দি এন্ড 🙂

কংগ্রেস, হাউস অফ রিপ্রেজেনটেটিভ, সিনেট ইত্যাদির কাজ এবং মার্কিনিদের অন্যান্য বিষয় নিয়ে পরে হয়তো কোন পর্বে লেখা যাবে। আপাততঃ এইটুকুই। ধন্যবাদ।