লিখেছেনঃ সাত্যকি দত্ত

ঝরা পালকের পাঠপ্রতিক্রিয়ায় রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দকে একটি চিঠি লিখেছিলেন , জীবনানন্দ তখন বরিশালে , চিঠির বক্তব্য –

” তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাতে সন্দেহমাত্র নেই । – কিন্তু ভাষা প্রভৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন বুঝিতে পারিনে । কাব্যের মুদ্রাদোষটা ওস্তাদিকে পরিহাসিত করে ।
বড় জাতের রচনার মধ্যে একটা শান্তি আছে , যেখানে তার ব্যাঘাত দেখি সেখানে তার স্থায়িত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ জন্মে । জোর দেখানো যে জোরের প্রমাণ তা নয় বরঞ্চ উল্টো । ”

জবাবে জীবনানন্দ যে দীর্ঘপত্রটি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে , অনুমান , শেষতক তিনি তা পাঠাননি – কারণ বিশ্বভারতীর সংগ্রহে মূলচিঠিটি খুঁজে পাই নি । জীবনানন্দের মৃত্যুর পর তার সংরক্ষিত কাগজ – পত্র থেকে ভূমেন্দ্র গুহ মহাশয় সেটি উদ্ধার করেন । সে যাই হোক , রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য জীবনানন্দকে ধাক্কা দিয়েছিল । জীবনানন্দের চিঠিটির অংশ বিশেষ তুলে ধরবার আগে কিছু কথা বলার প্রয়োজন ।

সেসময় কালের যে মঞ্চটি নির্মাণের জন্য জীবনানন্দ প্রস্তুত হচ্ছিলেন তলে তলে , তা ছিল রবীন্দ্রভাবনা বলয়ের ঠিক বিপরীত এবং অনেক বেশি শক্তিশালী । জীবনের অন্ধকার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখা এক রৈখিক আধুনিকতা থেকে মুক্তির পথ খুঁজছিল যে বিশশতকীয় বিশ্বকবিতা , বাংলা ভাষায় জীবনানন্দই তা সর্বাধিক আঁচ করেছিলেন তাঁর সময়ে – আধুনিক বাংলা কবিতায় প্রান্তিকতার ধারণাও তিনিই দিলেন প্রথম । যখন রবীন্দ্রনাথে একরৈখিক কাব্যভাবনা তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ছে , সে সময় কুলীনদের সভায় প্রবেশ করলেন ব্রাত্য পরিচয়ে জীবনানন্দ – সেই পথ চলা শুরু , একদিন হয়ে উঠলেন আধুনিক কালের সর্বাপেক্ষা জটিল এবং মহাকবি ।

আসলে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বুঝে ওঠার সময় পাননি । সময় পেলেও দুজনের চেতনারাজ্যের দূরত্ব এত বেশি এবং জীবনানন্দের কবিতায় মানুষ আর প্রকৃতিকে এক সাথে চেনা এত জটিল আর আধুনিক ছিল যে তিনি জীবনানন্দকে সে সময় দাঁড়িয়ে বুঝে উঠতে পারতেন কিনা সন্দেহ – আর নিজের সেই না বুঝতে পারার অক্ষমটাকে ঢাকতেই জীবনানন্দের প্রতি রবীন্দ্রনাথের এহেন বাক্যবাণ । রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে এতখানি উপেক্ষা কি আদেও প্রাপ্য ছিল জীবনানন্দের ?

13174107_1033051323409422_161859282472425898_n

গবেষকরা রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির সময়টাকে বিভাজন রেখা হিসাবে বিবেচনা করেছেন এবং কারো কারো মতে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির আগের রবীন্দ্রনাথের কাঁচা লেখা প্রাজ্ঞ হয়ে উঠেছে নোবেল প্রাপ্তির পরের সময়ে। “নোবেল পুরস্কারের মান রক্ষার খাতিরেই রবীন্দ্রনাথকে বৈশ্বিক ও বিশ্বমানবিক চিন্তা-চেতনার অনুশীলন করতে হয়েছে। তাঁর দীর্ঘায়ু তাঁকে এ সুযোগ-সৌভাগ্য দিয়েছে। পুরস্কার প্রাপ্তির পরে তিনি সুদীর্ঘ আটাশ বছর বেঁচে ছিলেন, তার আগে বাল্য-কৈশোরের যৌবনের মধ্যবয়সের জীবনদেবতা চালিত কাঁচা-পাকা লেখায় ঊনিশ শতক ও এ শতকের এক দশক কেটেছে বটে, প্রায় সমসংখ্যক বছরব্যাপী, কিন্তু পরিচ্ছন্ন ও পরিপক্ক জ্ঞান-প্রজ্ঞা, মন-মনন এবং মনীষা ও নৈপুণ্য নিয়ে বিশ্ববোধ অন্তরে জাগ্রত রেখে লিখেছেন জীবনের স্বর্ণযুগে আটাশ বছর ধরে। বলতে গেলে পুরস্কার পূর্বকালের রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ঊনিশ শতকী কবি আর পুরস্কার উত্তরকালের রবীন্দ্রনাথ হলেন বিশ শতকের মনীষা মানুষ। ” সেখানে নিকটঅগ্রজদের ঋণভূমে দাঁড়িয়ে জীবনানন্দই এক নতুন সময়চেতনার ইঙ্গিত দিতে পেরেছিলেন তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকেই , সেই সময়চেতনার ইঙ্গিত রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যে হল – ” ভাষা প্রভৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি । ”

ঝরা পালকের ছন্দে ও প্রকাশ প্রকরণে জীবনানন্দ অনেকের দ্বারা প্রভাবিত হলেও , বিষয় প্রকরণে কিন্তু নতুন বাঁকের ইশারা রাখতে পেরেছিলেন । নাবিক , অস্তচাঁদে , আলেয়া , কবি , পিরামিড ইত্যাদি কবিতায় সে ইশারা খুবই স্পষ্ট । আসলে প্রত্যন্ত বরিশালের এক অখ্যাত কবি তাঁর কাব্য ভাবনাকে নস্যাৎ করে আধুনিক কবিতার জগত তৈরি করবে , বাংলা কবিতার রথচক্রে যথার্থ গতিদান করবে পরিণতির দিকে – এটা রবীন্দ্রনাথ প্রথমে মেনে নিতে পারেননি ।

এই প্রসঙ্গে ফরহাদ মজহার লিখেছেন –

” জীবনানন্দ দাশ কেরানি যুগের শ্রেষ্ঠ কবি । তাঁর আগে রবীন্দ্রনাথের তিরোধানের মধ্য দিয়ে পুরনো মনিব বা জমিদারদের যুগ শেষ হয়ে গিয়েছে । জমিদারের যুগেও অন্তত কবিকে আমরা প্রতিষ্ঠান গড়ার কাজে দেখেছি , সমাজ সংস্কার ও নানান সামাজিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে দেখেছি , কৃষিকাজে সরাসরি নিয়োজিত হতে দেখেছি , বিজ্ঞনে উৎসাহী দেখেছি , ইত্যাদি । কারণ , সাহিত্যের পুরানো ভূস্বামীরা তাদের জমিদারি হারাবার ভয়ে আতংকিত ছিলেন । তাঁরা আর মনিব নন , নতুন মনিব ইতিহাসে এসে হাজির হয়েছে , এই বোধটুকু তাদের ছিল । ফলে ক্ষয়িষ্ণু জমিদারের মতো একটা লড়াই তাঁরা দিয়েছিলেন । কিন্তু কেরানিদের কিছু হারাবার ভয় ছিল না… ”

রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠির বৈশিষ্ঠ্যই হল , তাতে কিছু আশীর্বাদসূচক শব্দ বা বাক্য থাকবে । জীবনানন্দের প্রতি বিরক্তি আর বিদ্বেষ কতখানি ছিল তার সহজ প্রমাণ মেলে চিঠিতে রবীন্দ্রস্বভাবী আশীর্বাদসূচক কোন শব্দ বা বাক্যের অনুপস্থিতি থেকে ।

কিন্তু জীবনানন্দ হতে চলেছেন আধুনিক কালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি – রবীন্দ্রনাথ তাঁকে আর্শীবাদ করলো না অভিশাপ দিল তাতে কিছু এসে যায় না , অতীতের ধ্বংসস্তূপের উপরেই যে তাঁর আসন পাততে হবে । আর ঘটলও তাই , জীবনানন্দের ” মৃত্যুর আগে ” কবিতা পাঠ করে রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধদেব বসুর কাছে স্বীকার করতে বাধ্য হলেন – ” জীবনানন্দ দাশের চিত্ররূপময় কবিতাটি আমাকে আনন্দ দিয়েছে । ” এরপর ধূসর পাণ্ডুলিপির পাঠ প্রতিক্রিয়ায় জীবনানন্দকেই লিখে ফেললেন – ” তোমার লেখায় রস আছে , স্বকীয়তা আছে এবং তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে । ”
jibanananda_das_old

জীবনানন্দ চিত্রকল্পেরই কবি । তাঁর বিরাট কৃতিত্বের একটি প্রধান নির্ভর কাব্যপ্রচলনকে বর্জন এবং নতুন কাব্যভাষা সৃষ্টি । তাঁর কবিতায় প্রেম ও প্রকৃতি , তাঁর কবিতায় ইতিহাস চেতনা , ও সমাজ রাজনীতি চেতনা , তাঁর কবিতায় ব্যক্তি ও স্বদেশ , তাঁর জীবন ও মৃত্যু চিন্তা – সব মিলিয়ে এমন একটি একক পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে – যেটি রবীন্দ্রনাথের মতো রহস্যীকরণের জালে মোড়া কল্যাণময়ী নয় – সে পৃথিবী একান্ত আমাদেরই ,স্বতঃ , রজঃ , তমঃ – সাংখ্যের এই তিনের মতোই সেই পৃথিবীর জল , আলো , আকাশ , মাটি সবকিছু সময় , সংবেদ ও নিসর্গ দিয়ে তৈরি ! যেখানে আশা ও নিরাশা হাত ধরাধরি করে চলে – সে পৃথিবীর আবহমান বাণী সমাহৃত হয় এরকম একটি বাক্যে –

“অসম্ভব বেদনার সাথে মিশে রয়ে গেছে অমোঘ আমোদ ”

প্রসঙ্গত বলি , রবীন্দ্রনাথ আমাদের জন্য একটা বিশ্বাসের জামা তৈরি করে রেখেছে – রবীন্দ্রনাথকে বুঝতে হলে সেই জামাটা আগে পরতে হবে ! জীবনানন্দ অবশ্য এমন জামাটামা কিছু রেখে যাইনি ।

” পথের শেষ কোথায় , শেষ কোথায় , কী আছে শেষে !

এত কামনা , এত সাধনা কোথায় মেশে ? ”

– রবীন্দ্রনাথের অনেক গানের মতোই এই গানটিতেও অব্যক্ত কাতরতা আমাদের মুগ্ধ করে , সুরের আলোড়নে আমরা ভাসি ডুবি । কিন্তু আমি এই সুরের আড়ালে এক মোহগ্রস্ত মানুষকে দেখে শিহরিত হই – এক অচেনা রবীন্দ্রনাথ সে । যতদূর জানা যায় জীবন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মোহ সম্পূর্ণ চলে গিয়েছিল যখন তিনি মাঝ বয়সি , যদিও চলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক , তিনি যতবার যাকেই ধরে রাখতে চেয়েছিলেন , তাঁরাই রবীন্দ্র হৃদয়ে এক গভীর শূন্যতা রেখে চলে গেছেন । রবীন্দ্রনাথের পাশে যতই ঠাকুর বাড়ি আর শান্তিনিকেতন দেখি না কেন , রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ ব্রাত্য ভাবে জীবনের এক বৃহত্তর সময় যাপন করেছিলেন , সে যাপন হৃদয় লোকে । তবুও আমি হতবাক্ হই , কেন তিনি জীবনের নিরর্থকতাকে স্বীকার করে নেন নি ! রবীন্দ্রনাথ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত খালি দুঃখই পেয়ে গেছেন – কারণ তিনি জীবনের নিরর্থকতার মতো চিরন্তন জিনিসকে মেনে নিতে পারেনি । সেই না মেনে নিতে পারার ক্ষতকে ঢেকেছেন বিশ্বজগতের রহস্যীকরণের কাজ করে । রবীন্দ্রনাথের একটা ভীষণ প্রিয় শব্দ – সত্য । যখনই তিনি তাঁর বুঝতে না পারা কোন পরম উপলব্ধি বা বিশ্বাসের কথা বলতে চেয়েছেন , যা সম্পর্কে নিজেরই ধারণা অস্বচ্ছ , তখনই তিনি এই শব্দ ব্যবহার করেছেন এবং অনুরাগীরাও এক সুখকর বিভ্রান্তির ভীতর বাস করার স্বাধ পেয়েছেন ।

” সত্য যে কঠিন ,
কঠিনেরে ভালোবাসিলাম
সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে ” – ইত্যাদি উক্তি গুলোতে কবিতা কম , বিভ্রান্তি বিপুল ।

রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের গানগুলো দাঁড়িয়েআছে অনেকটা বিশ্বাসের উপর , গানগুলোকে উপলব্ধি করতে হলে খানিকটা বিশ্বাসের দরকার – অনেকক্ষেত্রে পরমসত্তায় বিশ্বাস । আমি পরমসত্তায় বিশ্বাসী নই – রবীন্দ্রনাথের মতো আমি অন্তত সব কিছুকে পরমসত্তায় অস্তিত্ব দিয়ে পরিবৃত দেখতে রাজি নই । আমি কখনই মোহগ্রস্থ রবীন্দ্রনাথের মতো বলবো না –

” সারা জীবন দিল আলো সূর্য গ্রহ চাঁদ
তোমার আর্শীবাদ , হে প্রভু , তোমার আর্শীবাদ । ”

কারণ আমি জানি , সূর্য গ্রহ চাঁদ কারো আর্শীবাদ নয় , এগুলো এক বিশাল মহাজাগতিক দুর্ঘটনার ফল । রবীন্দ্রনাথ কি জানতেন না ? নিশ্চয়ই জানতেন , তবুও তিনি কেন রহস্যীকরণের জাল বুনে গেলেন – কেন তাঁর পরমসত্তায় দরকার পরলো ? উত্তর একটাই তিনি জীবনের নিরর্থকতাকে মেনে নিতে পারেননি , মোহের কাছে সমর্পণ করেছেন নিজেকে , আঘাত পেয়েছেন বারবার তবুও করেছেন ।

যাই হোক – আসুন আমরা কেউই রবীন্দ্রনাথেরমতো হাহাকার করবো না , আমরা কেউই মোহগ্রস্ত মানুষের মতো বলবো না – এত কামনা , এত সাধনা কোথায় মেশে ? আমরা সৎ থেকে রাজা সিসিফাসের মতো জীবনের মহা নিরর্থকতাকে মেনে নেবো – কোন কিছুতেই আমরা বিভ্রান্ত হবো না – আমরা জানি পথের শেষ মৃত্যুতে , সব কামনা ও সাধনার শেষে আছে নির্বিকার মাটি ও ক্ষুধার্ত আগুন , কিন্তু আমরা ভয় পাবো না !

আমাদের সঠিক পথ দেখিয়েছেন জীবনানন্দ , তিনি রূপময় জীবনের শেষে এই পরিণতিকে কবিতায় রূপান্তরিত করতে পেরেছিলেন । তিনি মেনে নিলেন সুন্দর নিরর্থকতাকে – এর জন্য তাকে অলীক কোনো পরমসত্তার সৃষ্টি করতে হলো না , শুধু তিনি লিখলেন ” মৃত্যুর আগে ” কবিতাটি –

মৃত্যুর আগে

আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষ সন্ধ্যায়,
দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল
কুয়াশার; কবেকার পাড়াগার মেয়েদের মতো যেন হায়
তারা সব; আমরা দেখেছি যারা অন্ধকারে আকন্দ ধুন্দুল
জোনাকিতে ভ’রে, গেছে; যে মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে
চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ — কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে;
আমরা বেসেছি যারা অন্ধকারে দীর্ঘ শীত-রাত্রিটিরে ভালো,
খড়ের চালের পরে শুনিয়াছি মুগ্ধ রাতে ডানার সঞ্চার;
পুরোনা পেঁচার ঘ্রাণ — অন্ধকারে আবার সে কোথায় হারালো!
বুঝেছি শীতের রাত অপরূপ — মাঠে মাঠে ডানা ভাসাবার
গভীর আহ্লাদে ভরা; অশত্থের ডালে ডালে ডাকিয়াছে বক;
আমরা বুঝেছি যারা জীবনের এই সব নিভৃত কুহক;
আমরা দেখেছি যারা বুনো হাঁস শিকারীর গুলির আঘাত
এড়ায়ে উড়িয়া যায় দিগন্তের নম্র নীল জোছনার ভিতরে,
আমরা রেখেছি যারা ভালোবেসে ধানের গুচ্ছের পরে হাত,
সন্ধ্যার কাকের মতো আকাঙক্ষায় আমরা ফিরেছি যারা ঘরে;
শিশুর মুখের গন্ধ, ঘাস, রোদ, মাছরাঙা, নক্ষত্র, আকাশ
আমরা পেয়েছি যারা ঘুরে — ফিরে ইহাদের চিহ্ন বারো-মাস;
দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হয়েছে হলুদ
হিজলের জানালায় আলো আর বুলবুলি করিয়াছে খেলা,
ইঁদুর শীতের রাতে রেশমের মতো রোমে মাখিয়াছে খুদ,
চালের ধূসর গন্ধে তরঙ্গেরা রূপ হয়ে ঝরেছে দু ‘বেলা
নির্জন মাছের চোখে — পুকুরের পাড়ে হাঁস সন্ধ্যার আঁধারে
পেয়েছে ঘুমের ঘ্রাণ — মেয়েলি হাতের স্পর্শ লয়ে গেছে তারে;
মিনারের মতো মেঘ সোনালি চিলেরে তার জানালায় ডাকে,
বেতের লতার নিচে চড়ুয়ের ডিম যেন শক্ত হয়ে আছে,
নমর জলের গন্ধ দিয়ে নদী বার-বার তীরটিরে মাখে,
খড়ের চালের ছায়া গাঢ় রাতে জোছনার উঠানে পড়িয়াছে;
বাতাসে ঝিঁঝির গন্ধ — বৈশাখের প্রান্তরের সবুজ বাতাসে;
নীলাভ নোনার বুকে ঘন রস গাঢ় আকাঙক্ষায় নেমে আসে;
আমরা দেখেছি যারা নিবিড় বটের নিচে লাল লাল ফল
পড়ে আছে; নির্জন মাঠের ভিড় মুখ দেখে নদীর ভিতরে;
যত নীল আকাশেরা রয়ে গেছে খুঁজে ফেরে আরো নীল আকাশের তল;
পথে পথে দেখিয়াছি মৃদু চোখ ছায়া ফেলে পৃথিবীর পরে
আমরা দেখেছি যারা শুপুরির সারি বেয়ে সন্ধ্যা আসে রোজ,
প্রতিদিন ভোর আসে ধানের গুচ্ছের মতো সবুজ সহজ;
আমরা বুঝেছি যারা বহু দিন মাস ঋতু শেষ হলে পর
পৃথিবীর সেই কন্যা কাছে এসে অন্ধকারে নদীদের কথা
কয়ে গেছে;- আমরা বুঝেছি যারা পথ ঘাট মাঠের ভিতর
আরো এক আলো আছে: দেহে তার বিকাল বেলার ধুসরতা:
চোখের — দেখার হাত ছেড়ে দিয়ে সেই আলো হয়ে আছে স্থির;
পৃথিবীর কঙ্কাবতী ভেসে গিয়ে সেইখানে পায় ম্লান ধূপের শরীর;
আমরা মৃত্যুর আগে কী বুঝিতে চাই আর? জানি না কি আহা,
সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে
ধূসর মৃত্যুর মুখ — একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিল — সোনা ছিল যাহা
নিরুত্তর শান্তি পায় — যেন কোন্‌ মায়াবীর প্রয়োজনে লাগে।
কী বুঝিতে চাই আর? রৌদ্র নিভে গেলে পাখি-পাখালির ডাক
শুনি নি কি? প্রান্তরের কুয়াশায় দেখি নি কি উড়ে গেছে কাক!

রবীন্দ্রনাথের কামনার হাহাকার , জীবনানন্দের কাছে হল আরো রূপময় – সব রাঙা কামনা কিন্তু হাহাকার নেই , এর শেষে জেগে আছে নিরর্থক দোয়েলের মতো ধূসর মুখ ।

মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আমরা বহু রূপ রসের ভীতর দিয়ে চলবো – কখনও পৌষের সন্ধ্যা আমাদের স্পর্শ করবে , কখনও বৈশাখী রৌদ্র আমাদের রক্তে ঢুকবে , কখনও বা ভরা শ্রাবণ আমাদের বিগলিত করবে – জীবনে এত কিছু প্রাপ্তির পরেও আমরা কেন রবীন্দ্রনাথের মতো বুঝতে চাইবো কি আছে শেষে ? কেন জীবনানন্দের মতো বোঝার কিছু নেই বলে বলবো না –

” যে দুটি শুধু ঢেউ তুলে চলে স্থির জলে –
রৌদ্র নিভে গেলে পাখ-পাখালীর ডাক
শুনি নি কি ?
প্রান্তের কুয়াশায় দেখি নি কি উড়ে গেছে কাক ? ”

জীবননানন্দের চিত্রকল্প আমাকে অন্তত ভাবিয়েছে – জীবনানন্দের আমাকে শিখিয়েছে সে পথ – জীবনকে চিত্ররূপময় করবার কৌশল – জীবনের শেষে মৃত্যুর মতো মহানিরর্থকতাকে অতিক্রম করবার কৌশল এবং তাকে মেনে নেবার মতো মানসিকতা ।

এত মৃত্যু দেখেও কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুভয় যাইনি শেষ পর্যন্ত – তাই তো তাকে এত করে লিখতে হয় , মৃত্যুকে ভয় পাইনে , ভয় পাইনে ! এই প্রশ্ন রবীন্দ্রনাথকেই করেছিলেন কেউ , তার উত্তরে জুটেছে সেই বিভ্রান্তিকর কিছু একটা । তাই তো শান্তিনিকেতন থেকে শেষ যাত্রায় তাঁর চোখে আমরা জল দেখতে পাই । কিন্তু আমরা কখনই রবীন্দ্রনাথের মতো কাঁদবো না – আমরা বারবার বলবো না , মৃত্যুকে ভয় পাইনে ভয় পাইনে ।

বরং আমরা এই তাৎপর্যহীন জীবনকে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি দিয়ে কিছু কাল তাৎপর্যপূর্ণ করে যেতে চাইবো – একশ বছর বাঁচতে না চাইলেও এখনি যেতে চাইবো না , যদিও যে কোন মুহূর্তেই প্রস্তুত থাকবো । আরো কিছু কাল বেঁচে থেকে আমরা কোজাগরী জ্যোৎস্নায় ভিজতে চাইবো , অমাবস্যার নক্ষত্রে ভরা আকাশ দেখতে চাইবো , নারী দেখতে চাইবো , শিশির রদ্দুর ছুঁতে চাইবো , ছড়ানো কুয়াশার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে ঘাসের গন্ধ পেতে চাইবো , কবিতা পড়তে চাইবো – লিখতে চাইবো , আর পৃথিবীর কোণায় কোণায় ছুটে যেতে চাইবো …

তারপর একদিন মৃত্যু আসুক হঠাৎ করে – আমরা যেকোন জায়গাতেই পড়ে থাকতে পারি – জলে , জলাভূমিতে , পাহাড়ের চুড়োয় , নদীতে , মরুভূমিতে , তুষারস্তূপে । কিছুই অপবিত্র নয় যেমন কিছুই পবিত্র নয় ; সবই সুন্দর – আর সব থেকে সুন্দর এই তাৎপর্যহীন জীবনকে নিজের ইন্দ্রিয় গুলো দিয়ে তাৎপর্যময় করে বেঁচে থাকা ।

রবীন্দ্রনাথকে লেখা অভিমানী জীবনানন্দের জবাবি পত্রের অংশ বিশেষ –

” পত্রে আপনি যে কথা উল্লেখ করেছেন সেই সম্পর্কে দু – একটা প্রশ্ন মনে আসছে । অনেক উঁচু জাতের রচনার ভেতর দুঃখ বা আনন্দের একটা তুমুল তাড়না দেখতে পাই । কবি কখনও আকাশের সপ্তর্ষিকে আলিঙ্গন করবার জন্য উৎসাহে উন্মুখ হয়ে অথেন, – পাতালের অন্ধকারে বিষজর্জর হয়ে কখনও তিনি ঘুরতে থাকেন । কিন্তু এই বিষ বা অন্ধকারের মধ্যে কিম্বা জ্যোতিলোকের উৎসের ভেতরেও প্রশান্তি যে খুব পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে তা তো মনে হয় না । প্রাচীন গ্রীকরা serenity জিনিসটার খুব পক্ষপাতী ছিলেন । তাঁদের কাব্যের মধ্যেও এই সুর অনেক জায়গায় বেশ ফুটে উঠেছে । কিন্তু যে জায়গায় অন্য ধরনের সুর আছে সেখানে কাব্য ক্ষুণ্ণ হয়েছে বলে মনে হয় না । দান্তের Divine Comedy -র ভেতর কিম্বা শেলির ভেতর serenity বিশেষ নেই । কিন্তু স্থায়ী কাব্যের অভাব এঁদের রচনার ভেতর আছে বলে মনে হয় না । ”

কৃতজ্ঞতা স্বীকার – হুমায়ূন আজাদ , আবদুল মান্নান সৈয়দ , হুমায়ূন কবির , শৈলেশ্বর ঘোষ , অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত , সৈয়দ মনজরুল ইসলাম